সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

ভাষা সৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতি কথা : এস ডি সুব্রত


প্রকাশিত:
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২০:১৫

আপডেট:
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২৩:৫৭

ছবিঃ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত

 

ফেব্রুয়ারি এলেই পলাশ শিমুল রাঙা হয়ে উঠে। রক্তে শিহরণ জাগায়। শহীদ ভাইদের স্মরন করি। ভাষা আন্দোলনের মহানায়ক  যিনি, যিনি সর্ব প্রথম ভাষার দাবি জানান গণপরিষদে, যিনি ভাষা প্রীতির শেষ পরিনতিতে অনেক নির্যাতন এর শিকার হয়ে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে একাত্তরে মৃত্যু বরন করেন তার কথা আমরা কতটা মনে রেখেছি। ভাষা আন্দোলনের এই মহান সৈনিক প্রায়ই বলতেন -- " বাংলা আর বাঙালিকে ছেড়ে আমি কখনো যেতে পারব না। আমার হৃদয় জুড়ে বাংলা আর বাঙালিদের প্রতি অসীম ভালোবাসা।" এ বাংলা ছেড়ে তিনি যাননি। এ বাংলা র মাটিতে রয়েছে তার তাজা রক্ত। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হলেন সেই ব্যক্তি যিনি ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিলেন কিন্তু দেশ ছেড়ে যাননি পাকিস্তান সৃষ্টির পর। পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদ সদস্য যিনি সংসদ এ দাঁড়িয়ে ভাষার দাবি তুলে ধরেছেন এবং আজীবন সোনার বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রাম করে গেছেন।

তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার (বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া) রামরাইল গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়ার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে তার যাত্রা শুরু হয়। পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা ভাষার দাবি উত্থাপন করে তিনি পূর্ব বাংলায় পরিচিতি এবং মর্যাদার আসনে স্থান পান। দেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করে এই মানুষটি শেষ পর্যন্ত মৃত্যু বরন করেন পাকিস্তান বাহিনীর অমানুষিক নির্যাতন এর শিকার হয়ে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এ। তার উপর নির্যাতনের চিত্র পাওয়া যায় শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারক গ্রন্থে সাখাওয়াত আলী খান এর সাক্ষাৎকার থেকে। ধীরেন বাবু সম্পর্কে জানা যায় রমনী মোহন শীলের  বক্তব্য থেকে।

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কে নিয়ে এক নিবন্ধে কথা সাহিত্যিক রশিদ হায়দার লিখেছিলেন---"দূর্ভাগ্য হচ্ছে এই চরম আত্মত্যাগি সংগ্রামী মানুষটিকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিইনি, পক্ষান্তরে যে মানুষ টির দূঃসাহসিক ভূমিকার জন্য আজ আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলছি, সরকারি কাজে বাংলা ব্যবহার করছি তার নামটি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের কোথাও, কোন জায়গায় খুঁজে পাওয়া যায় না।"

ভাষা সৈনিক গাজিউল হক তার এক লেখায় বলেন ১৯৪৮ সালের ২৩ শেষ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন বসে। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে নয়, বাঙালি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ব্যক্তি হিসেবে গণপরিষদের অধিবেশনে প্রথম দিনেই প্রস্তাব করেন উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে  বাংলাকেও  গণপরিষদের ভাষা করা হোক। সেদিন পূর্ব বাংলার কোন মুসলমান গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এই প্রস্তাব কে সমর্থন তো করেননি বরং সরাসরি বিরোধিতা করেছিলেন। তীব্র কটাক্ষ ও বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য মন্তব্য করেছিলেন প্রভাবশালী মন্ত্রী রাজা গজনফর আলী  এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। পূর্ব বাংলার অন্যান্য মুসলমান সদস্য মুখে তালাচাবি এঁটে  দিয়ে অকুতোভয় ধীরেনদার এই হেনস্থা দেখেছিলেন। এটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা, যেটা ঘটেছিল সাম্প্রদায়িকতার তীব্র বিশ গায়ে মেখে পাকিস্তান জন্মের মাত্র ছয় মাস তের দিন পরে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পৈশাচিক দৃশ্যপট তখনো এদেশের মানুষের মন থেকে মুছে যায় নি। সাম্প্রদায়িক সংখ্যা গরিষ্ঠতার ভোটে গণপরিষদে বাংলা ভাষার অধিকারের প্রস্তাবটি নাকচ হয় কিন্তু পূর্ব বাংলার ছাত্র যুবক শিক্ষক প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী সবাই তাকে বীরের মর্যাদা দান করে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব বাতিল করায় ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলা ভাষার দাবিতে  ছাত্র ধর্মঘট হয়। সেই আন্দোলনে গ্রেফতার হন তখনকার ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ। ১৯৫২ সালের ২১ শেষ ফেব্রুয়ারি বাংলা কে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি তে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সালাম, জব্বার, রফিক, বরকত, সফিক সহ নাম না জানা অনেকেই।

লেখক কবির চৌধুরী এক প্রবন্ধে লিখছিলেন, “পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষার দাবি উত্থাপন করলে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ও ধর্মান্ধ মহল তাকে হিন্দু সম্প্রদাযকিতার ধারক, পাকিস্তান বিরোধী, রাষ্ট্রদ্রোহী, পাকিস্তানের সংহতি ধ্বংসের চক্রান্ত কারী আখ্যায়িত করেছিলেন।" ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং ওই রকম আরো কিছু মানুষের অবস্থানের মধ্যে দিয়েই দিয়েই যে সেদিন বাঙালি জাতিয়তাবাদী চেতনার বিকাশ সূচিত হয়েছিল আজ তা সর্বজন স্বীকৃত সত্য। আর সেই চেতনার বিকাশ ধারাতেই একটা রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম গ্রহন করেছিল বাংলাদেশ।

একবার এক পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী এ্যারোমা দত্ত বলেন, "আমাদের বাড়ি কুমিল্লায় ধরমসাগরের পশ্চিম পাড়ে। ৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে দেড়টায় ছয়টা ট্রাক আর একটা জীপে করে ওরা এসেছিল। এসে আমাদের থেকে দাদু শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং কাকু দিলীপ কুমার দত্তকে আলাদা করে। পরে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এ নিয়ে যায়। ক্যান্টনমেন্ট এ অনেক নির্যাতনের পর দাদু মারা যায় এবং ময়নামতি র কোন এক পাহাড়ে বধ্যভূমিতে তাকে ফেলে দেয়া হয়। এই কথা গুলো জানতে পেরেছি ক্যান্টনমেন্ট এ নিযুক্ত এক নাপিতের কাছ থেকে। আমার কাকার কি হয়েছিল তা আমরা কোনদিনই জানতে পারিনি।" 

এ্যারোমা দত্ত আরো বলেন, জনসংখ্যার মধ্যে বাংলা ভাষা ভাষীর বিচারে বাংলাই যে পাকিস্তানের লিঙ্গুয়া ফ্রান্কা হওয়া উচিত; সে বিষয়টি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে তুলে ধরার পর গাজীউল হক, শেখ মুজিবুর রহমানের মতো তখনকার ছাত্রনেতারা সমর্থন জানান।

লেখক মিনার মনসুর "ধীরেন্দ্রনাথ দত্তঃ জীবন ও কর্ম" বইয়ে বলেছেন, “মাতৃভাষার প্রথম দাবিদার হলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত”। এই বইয়ে লেখক মিনার মনসুর বলেন, "যা হয়, খুব ই  উপেক্ষিত ছিলেন নিভৃতচারী মানুষটি। তার নাতনি এ্যারোমা দত্তের সহযোগিতায় আমরা একটা স্মৃতি রক্ষা কমিটি গঠন করি নব্বইয়ের দশকে যার সভাপতি ছিলেন বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন এবং সম্পাদক আমি। বেশ কটি স্মরনসভা হয় ঢাকা, কুমিল্লা ও  ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি ছিল শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারক গ্রন্থ এবং  ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা প্রকাশ। তারপরও মানুষটি যথোচিত স্বীকৃতি পেয়েছেন এমনটা বোধ হয় জোর গলায় বলতে পারি না”।

১৯৫২ সালের ২১ শেষ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে যে রক্ত ঝড়েছিল তার প্রতিবাদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদের অধিবেশন বয়কট করেন এবং এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।

ভাষা সৈনিক এই মহান যুদ্ধার  জন্য আমরা তেমন কিছু ই করতে পারি নি। এমনকি তার স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি নিয়েও নেই কোন তেমন উদ্যোগ। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জরাজীর্ণ বাড়িটিতে রয়েছে মোট ৬টি কক্ষ যার মধ্যে ২টি কক্ষে একটা মুসলিম পরিবারে বাস করে বলে জানা যায় কেয়ার টেকার হিসেবে। বাড়িটির অবস্থা খুবই জরাজীর্ণ। সাধারণ মানুষের দাবী এটাকে স্মৃতি যাদুঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এতে পরিবারের কাছ থেকে অনিহা রয়েছে বলেও জানা যায়। 

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামে কুমিল্লায় সড়কের নামকরণ করা হয়েছে, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নামে একটি হলের নামকরণ করা হয়েছে, কুমিল্লা স্টেডিয়াম তার নামে নামকরণ করা হয়েছে। তবে এসব কিছুই পর্যাপ্ত বলা যায় না। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় তার নাম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সহ তার কুমিল্লার বাড়িটি সংস্কার করে  শহীদ  ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি যাদুঘর এ রুপান্তরিত করা এখন সময়ের দাবি।

 

এস ডি সুব্রত
কবি ও প্রাবন্ধিক
সুনামগঞ্জ, বাংলাদেশ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top