সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

ভাষা আন্দোলন ও কিছু বাস্তবতা : এড‌ওয়ার্ড রিয়াজ মাহামুদ


প্রকাশিত:
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৯:৫৬

আপডেট:
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২০:৪৪

 

১৯৫২ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ২১শে ফেব্রুয়ারিতে চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে। গৌরবদীপ্ত এ ঘটনার আটচল্লিশ বছর পর ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর তারিখে আমাদের ২১শে ফেব্রুয়ারি অভিষিক্ত হয় নতুন মর্যাদায়। এই দিনে ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে আমাদের ভাষা আন্দোলনকে পৃথিবীর মানুষের গৌরবিত উত্তরাধিকারে রূপান্তরিত করেছে। ১লা মে যেমন আন্তর্জাতিক মে দিবস, যা পালিত হয় পৃথিবীর সব দেশে, ২০০০ সাল থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি তেমনি পালিত হচ্ছে, সমস্ত পৃথিবী জুড়ে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। বহুমাত্রিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একথা অবশ্য স্বীকার্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর বাঙালি জাতির জীবনে এমন গৌরবোজ্জ্বল অর্জন আর ঘটেনি। ভাষা আন্দোলনের শহীদ রফিক-সালাম-বরকতরা এখন বিশ্ব মানুষের গৌরবিত অহঙ্কার। পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন জাতিসত্তার মাতৃভাষা নিয়ে নতুন সম্ভাবনার উৎস হয়ে উঠতে পারে এই দিবসটি এমনি প্রত্যাশা ছিল আমাদের।

প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবের কখনো মিল থাকে, কখনো দেখা দেয় বৃহৎ ফারাক। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও কি শুভঙ্করের ফাঁকি হয়ে হাজির হলো আমাদের জীবনে, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবনে? এ সূত্রেই বায়ান্নর সঙ্গে নিরানব্বইয়ের একটা গোপন মিল খুঁজে পাই আমি। ১৯৮৭ থেকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নামে আরম্ভ হলেও ক্রমে আন্দোলনটি ভাষা আন্দোলন হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিতি পায়। সন্দেহ নেই, এই রূপান্তর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের চারিত্র, লক্ষ্য ও তাৎপর্যকে বহুলাংশে খর্ব করেছে। রাষ্ট্রভাষা বললে যে ব্যাপকতা আসে, রাষ্ট্রীয় চাকরি-প্রশাসন-আইন-আদালতে বাংলাভাষার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়, ভাষা আন্দোলন বললে তা কিছুতেই হয় না। ঔপনিবেশিক আমলের এই চেনাপথেই চলেছে পঁচাত্তর-উত্তর বাংলাদেশের ভাষা বিষয়ক যাবতীয় কর্মকাণ্ড। তাই বাংলা রাষ্ট্রভাষা হয়েও প্রকাশ্যেই নির্বাসনে যাচ্ছে সরকারি কর্মকা- থেকে, প্রশাসনিক দপ্তর থেকে, রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধান থেকে।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে ভাষা আন্দোলন বলে অভিহিত করলে এর তাৎপর্য ও গভীরতা যেমন খর্ব হয়, তেমন খর্বকরণের আরেক সাম্রাজ্যবাদী কৌশল ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা। আমরা খুশি হতে পারতাম, যদি ওই দিনটিকে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রভাষা দিবস ঘোষণা করা হতো। ‘রাষ্ট্রভাষা’ আর ‘মাতৃভাষা’ এক নয়। মাতৃভাষা মানুষ অর্জন করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে–কিন্তু রাষ্ট্রভাষা অর্জন করতে হয় সাধনা দিয়ে, পাণ্ডিত্য ও জ্ঞান দিয়ে, শিক্ষা দিয়ে।

মাতৃভাষাকে অবলম্বন করেই রাষ্ট্রভাষা গড়ে ওঠে, তবু মাতৃভাষার সঙ্গে রাষ্ট্রভাষার রয়েছে দুস্তর ব্যবধান। মাতৃভাষাকে আরোপিত গুরুত্ব দিতে গিয়ে রাষ্ট্রভাষাকে এদেশে আজ গৌণ করে তোলা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রভাষার অনুশীলন। ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা শ্বেতাঙ্গ প্রভুর এক ধরনের করুণাবর্ষণ ছাড়া আর কিছুই নয়। ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার ফলে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর আদি নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদের ভাষা নিয়ে আবেগসিক্ত কথা বলার বাৎসরিক একটা পার্বণ পাওয়া গেছে বটে, কিন্তু বাস্তবে ওইসব ভাষা উন্নয়ন ও সংরক্ষণে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।

১৯৯৯ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার পর বিগত প্রায় এক যুগে এশিয়া -আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন দেশে বহু ভাষা মরে গেছে, বহু ভাষা চিরতরে লুপ্ত হয়ে গেছে। লন্ডনের স্কুল অব অরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের অধ্যাপক পিটার কে অস্টিনের মতে পৃথিবীজুড়ে বিদ্যমান সাত হাজার ভাষার মধ্যে প্রায় চার হাজার ভাষাই এখন বিপন্ন। বিগত দুই বছরে তিন শ’য়ের বেশি ভাষা চিরতরে হারিয়ে গেছে এবং এ ঘটনা ঘটেছে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার পরে। একুশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বিপন্ন হাজার তিনেক ভাষা চিরতরে হারিয়ে যাবে বলে ভাষাবিজ্ঞানীরা মনে করেন। ইংরেজি, স্প্যানিশ, হিন্দি বা সোয়াহিলির মতো রাজনৈতিক অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ভাষাগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়বে দুর্বল ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী। জেরু, খোমানি, ওরো উইন, কুসুন্ডা, আইনু, গুউগু যিমিধিইর, কেট, বো–এসব ভাষা খুব শিগগিরই হারিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করেছিলেন পিটার কে অস্টিন। ইতোমধ্যে ২০১০ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর প্রাচীন ভাষাগুলোর একটি বো ভাষায় কথাবলা বোয়া সিনিয়র নামের এক মাত্র মানুষটির মৃত্যু হয়েছে। আন্দামানের পোর্ট ব্লোয়ারে বোয়ার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে হারিয়ে গেল বো ভাষা। আগামী ৪০-৫০ বছরের মধ্যে এমনি হারিয়ে যাবে শত শত ভাষা।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এক্ষেত্রেই পালন করতে পারতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পৃথিবীর বিপন্ন ভাষাগুলো সংরক্ষণে ইউনেস্কো নিতে পারতো কার্যকর উদ্যোগ। কিন্তু বাস্তবে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কী, কী এর তাৎপর্য–এসব বিষয় বিশ্বজনসংখ্যার কয়জনই বা জানে, কতটা রাষ্ট্রে দিবসটি পালিত হয়, তা-ই বা কে বলতে পারে? এ ব্যাপারে বাংলাদেশ যে তেমন কোনো উদ্যোগ নিয়েছে, এমন সংবাদ আমাদের জানা নেই। এমনকি প্রায় এক যুগ অতিক্রান্ত হলেও এখন পর্যন্ত স্থায়ীভাবে গড়ে উঠলো না আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট।

বর্তমান সময়ে পৃথিবীর দেশে দেশে দেখা দিয়েছে নতুন এক প্রবণতা। রাজনৈতিক অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ভাষাগুলো উন্নত কোনো ভাষার বর্ণমালা দিয়ে লেখার প্রবণতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনও গড়ে উঠেছিল এ প্রবণতার প্রেক্ষাপটে। আরবি, উর্দু বা রোমান হরফে বাংলা লেখার সে ঔপনিবেশিক প্রয়াস সালাম-রফিক-বরকতরা বুকের রক্ত দিয়ে প্রতিহত করেছিল। কিন্তু সব দেশের পক্ষে, সব ভাষার ক্ষেত্রে এমনটা সব সময় আশা করা যায় না। ফলে আঞ্চলিক অনেক ভাষার বর্ণমালা ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে, মরে যাচ্ছে প্রাচীন ভাষাগুলো।

ভিন্ন কোনো ভাষার বর্ণমালা দিয়ে বিশেষ কোনো ভাষা লিখতে গেলে কী বিপর্যয় ঘটতে পারে, তার উদাহরণ পাওয়া যাবে বলিভিয়ার ভাষা থেকে। বলিভিয়ার মানুষ অতীতে কথা বলতো দু’টি ভাষায়–হয় ‘আয়মারা’, নয়তো ‘কুয়োছুয়া’। তেল ও সিসার আকর্ষণে যখন স্প্যানিশরা দলে দলে ঢুকে পড়লো বলিভিয়ায়, তখন দেখা দিল ভয়ঙ্কর ভাষা-বিপর্যয়। স্প্যানিশ ভাষায় লেখা শুরু হলো বলিভিয়ার মানুষদের মনের ভাব ব্যবহৃত হলো স্প্যানিশ বর্ণমালা। কয়েক বছরের মধ্যে স্প্যানিশ, আয়মারা ও কয়োছুয়া ভাষার মিশ্রণে সৃষ্টি হলো অদ্ভুত এক জগাখিচুড়ি ভাষা। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ব্যর্থ হলে ভাংলাভাষারও পরিণতি হয়তো হতো আয়মারা বা কুয়োছুয়া ভাষার মতো। বর্তমান বলিভিয়ার মানুষদের মতো হয়তো আমরা অদ্ভুত এক কৃত্রিম ভাষায় কথা বলতাম।

এ প্রেক্ষাপটেই তাৎপর্যময় হয়ে উঠতে পারে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ইউনেস্কো, জাতিসংঘ এমনকি তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ এ প্রবণতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। তাহলেই এই দিবস পালন হতে পারে অর্থবহ। পৃথিবীর শত শত ভাষার মতো বাংলা ভাষাও আজ আসন্ন এক বিপন্নতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।

মোবাইল ফোনে এসএমএস-এর মাধ্যমে বাংলাভাষাকে যেভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে, যেভাবে বেতারে বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে জগাখিচুড়ি ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার করা হচ্ছে, তাতে কোন দিন না আমরাও বলিভিয়ার ভাগ্য বরণ করবো, কে জানে? পঁচাত্তর-উত্তর নব্য এলিট শ্রেণী বাংলার পরিবর্তে ক্রমশ ঝুঁকে পড়ছে ইংরেজি ভাষার প্রতি। ঔপনিবেশিক মানস-প্রবণতা নব্য এই এলিটদের ভাষাবোধ নিয়ন্ত্রণে পালন করছে মূখ্য ভূমিকা। ঔপনিবেশিক মানস প্রবণতার কারণেই দোকানের বাংলা নাম ইংরেজিতে লেখা হয়, বিয়ে আর মিলাদের দাওয়াতপত্র লেখা হয় ইংরেজিতে, অধ্যাপক সাহেব ক্লাশে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভাষায় পঠন-পাঠনের সবক দেন, মন্ত্রী মহোদয় প্রচার মাধ্যমে বলেন এমন কথা–‘উই আর লুকিং ফর শত্রুশ।’ যারা বিধান রচনা করেন, যারা আইন প্রণয়ন করেন, যারা আগামী দিনের দক্ষ নাগরিক গড়ে তোলেন তাদের মধ্যে যদি সংগোপনে বাসা বেঁধে থাকে ঔপনিবেশিক মানসতা, তাহলে মাতৃভাষা টিকে থাকবে কীভাবে? ঔপনিবেশিক মানসিকতার ভূত ঘাড় থেকে না নামা পর্যন্ত রোগী ইংরেজি বকুক আর না বকুক ডাক্তার সাহেব ব্যবস্থাপত্র ইংরেজিতে লিখবেনই, গ্রাহকের ইংরেজি জ্ঞান থাকুক আর না থাকুক ব্যাংক-বীমার কাগজপত্র ইংরেজিতে লেখা হবেই, বিপনী বিতানের পরিবর্তে আমরা খুঁজবো শপিং মল, আদর্শ শহরের পরিবর্তে জায়গা খুঁজবো মডেল টাউন বা রিভার ভিউতে। আঁধারের মাঝে একটুখানি আলোর খবর আছে। তা হলো ইংরেজি সাইনবোর্ড লেখার বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে।

বর্তমান কাল পুঁজিবাদশাসিত কাল। পুঁজির মালিক যে, সে যে সবকিছুর মতো ভাষাকেও পণ্য বানাতে চাইবে সেকথা আমরা ভালো করেই বুঝি। চরিত্রগতভাবে পুঁজিবাদ নিম্নবর্গের শিল্প-সাহিত্যের মিত্র নয়, মিত্র নয় তৃতীয় বিশ্বের শত শত ভাষার। তাই পুঁজিবাদই কাল হয়ে দাঁড়ায় ভাষার তৃতীয় বিশ্বের ভাষার। ভাষা সাম্রাজ্যবাদের দাপটে পৃথিবীর অনেক ভাষার মতো বাংলা ভাষার অবস্থাও আজ ভালো নয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার মতো ভয়াবহ দুরবস্থার শিকার বাংলাদেশের আদি নৃগোষ্ঠীর ভাষাসমূহও। কেন্দ্রের দাপটে প্রান্তের মানুষদের মতো প্রান্তের ভাষারও আজ ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। কেন্দ্রলাঞ্ছিত প্রান্তের জনগোষ্ঠীর ভাষাসমূহের উন্নয়নের পরিবর্তে লক্ষ করা যায় কেবলি বিপন্নতা, কেবলি অবহেলা। প্রান্তিক মানুষদের মাতৃভাষা রক্ষাকল্পে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। চারদিকেই একটা গা-সওয়া ভাব দেখে মনে হয় এ বিষয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। এ অবস্থার আশু পরিবর্তন দরকার।

 

এড‌ওয়ার্ড রিয়াজ মাহামুদ
শিক্ষক, কলামিস্ট ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top