সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের প্রথম ব্যাংকনোটের কাহিনী : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
৬ মার্চ ২০২১ ১৯:০৮

আপডেট:
৬ মার্চ ২০২১ ২২:৪০

ছবিঃ ডঃ সুবীর মণ্ডল

 

এই বছর, অর্থাৎ, ২০২১ সাল, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দ্রুত উন্নয়নশীল রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষ। এই উপলক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের কাগজের মুদ্রার অর্ধ শতকের বর্ণময় যাত্রাপথের সূচনা লগ্নটিকে একবার ছুঁয়ে এলে কেমন হয়?

“তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা”

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বে বর্তমান বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ ছিল এবং এখানে পাকিস্তানের ব্যাংকনোট প্রচলিত ছিল। ২৬ মার্চ, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হবার পর বাংলাদেশে পাকিস্তানের ব্যাংকনোটের উপর রবার স্ট্যাম্প দিয়ে ইংরেজি ও বাংলায় ‘বাংলাদেশ’ ছাপ দিয়ে ব্যবহার করার কিছু ঘটনার নিদর্শন আজও বিদ্যমান। এরই প্রতিক্রিয়া হিসাবে ৮ জুন ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকার ‘জয় বাংলা’ বা ‘বাংলাদেশ’ ছাপযুক্ত রুপির ব্যাংকনোট বাতিল করে দেয় এবং ১০০ ও ৫০০ রুপির ব্যাংকনোটের বিমুদ্রিকরণ করে। সরকারি ভাবে পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশ অংশে তাদের বাকি ব্যাংকনোটের বৈধতা কখনও অস্বীকার করে নি। কিন্তু, পরাজয়ের অব্যবহিত পূর্বে পাকিস্তানি সেনারা ঢাকায় পাকিস্তানের স্টেট ব্যাংকের অফিসের সামনে বিপুল সংখ্যক ব্যাংকনোট জ্বালিয়ে দেয়।

বিজয়ের কয়েক দিনের মধ্যে, ২৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের ‘বাংলাদেশ ব্যাংক (সাময়িক) আদেশ’ অনুযায়ী পাকিস্তানের স্টেট ব্যাংকের ঢাকায় অবস্থিত ডেপুটি গভর্নরের অফিসকে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ থেকে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’-এ পরিবর্তিত করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংককে বাংলাদেশের ব্যাংকনোট প্রকাশের একক অধিকার প্রদান করা হয়। ১ টাকার নোট বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয় প্রকাশ করবে বলে স্থির হয়। ৩ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে পাকিস্তানের ১, ৫, ১০ ও ৫০ রুপির নোটকে সাময়িক ভাবে বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়। অবশ্য এর স্বল্পকাল পরেই, ১৯৭২ সালের মার্চ ও জুন মাসে পাকিস্তানি রুপির বিমুদ্রিকরণ করা হয়। ১৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে এ এন হামিদ উল্লাহ নবগঠিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম গভর্নর নিযুক্ত হন। ৩১ অক্টোবর ১৯৭২ সালে জারি করা ‘বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ’ বাংলাদেশ ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসাবে স্থায়ী স্বীকৃতি প্রদান করে।

প্রথম সিরিজ (বা ‘মানচিত্র’ সিরিজ)

৪ মার্চ ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের নিজস্ব মুদ্রার নাম ‘রুপি’র বদলে ‘টাকা’ হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই দিনই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ব্যাংকনোট প্রকাশিত হয়। এই দিন বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয় নীল-কালো রঙের ১ টাকার নোট ও বাংলাদেশ ব্যাংক সবুজাভ ১০০ টাকার নোট প্রকাশ করে। ১ টাকার নোটগুলি বাংলাদেশ সরকারের অর্থ সচিব কে এ জামান কর্তৃক স্বাক্ষরিত এবং ১০০ টাকার নোটগুলি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এ এন হামিদ উল্লাহ কর্তৃক স্বাক্ষরিত। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক ২ মে, ১৯৭২ সালে নীল রঙের ১০ টাকার নোট ও ২ জুন ১৯৭২ সালে বেগুনি রঙের ৫ টাকার নোট প্রকাশ করে। এই নোটগুলিও এ এন হামিদ উল্লাহ কর্তৃক স্বাক্ষরিত। প্রথম সিরিজের চারটি নোটের উপরই একটি বিন্দুর দ্বারা রাজধানী ঢাকার অবস্থান চিহ্নিত বাংলাদেশের মানচিত্র অঙ্কিত থাকার কারণে এই ব্যাংকনোটগুলি ‘মানচিত্র সিরিজ’ নামেও পরিচিত।

প্রথম সিরিজের ১ টাকার নোটের এক পিঠে বাংলায় ১ সংখ্যা ও অন্য পিঠে বাংলাদেশের মানচিত্র অঙ্কিত ছিল। এই নোটের দুই পিঠে বাংলায় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ ও এক পিঠে ইংরেজিতে ‘পিপলস রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ’ লেখা ছিল। ৫, ১০ ও ১০০ টাকার নোটের এক পিঠে বাংলা ও ইংরেজিতে সংখ্যায় টাকার মূল্য এবং অন্য পিঠে বাংলাদেশের মানচিত্র ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের প্রতিকৃতি অঙ্কিত ছিল। এই নোটগুলির দুই পিঠেই ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ লেখা ছিল। সব নোটের উপর বাংলা ও ইংরেজিতে নোটের মূল্যমান লেখা ছিল। এই ব্যাংকনোটগুলি ভারতের নাশিকের মুদ্রণালয়ে ছাপা হয়েছিল। সম্ভবত পর্যাপ্ত সুরক্ষাসূচক বৈশিষ্ট্যের অভাব ও প্রচুর নকল হবার কারণে এই প্রথম সিরিজ বেশি দিন প্রচলিত ছিল না। ১ এপ্রিল ১৯৭৩ সালে ৫, ১০ ও ১০০ টাকার নোট এবং ৩০ মার্চ ১৯৭৪ সালে ১ টাকার নোট প্রত্যাহৃত হয়।

দ্বিতীয় সিরিজ (টমাস দেলারু সংস্থায় মুদ্রিত)

২ জুন ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ইংল্যান্ডের টমাস দেলারু মুদ্রণ সংস্থায় ছাপা নতুন সবুজ রঙের ১০ টাকার নোট প্রকাশ করে। দ্বিতীয় সিরিজের এই নোটের এক পিঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের প্রতিকৃতি ও অন্য পিঠে নদীমাতৃক বাংলাদেশের গ্রামীণ দৃশ্য অঙ্কিত ছিল। ফসল ভরা ক্ষেত, কয়েকটি কুটির ও নদীতে বেয়ে চলা দুটি পাল তোলা নৌকার দৃশ্য এই নোটের উপর মুদ্রিত হয়েছে। এই নোটে প্রথম বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতীক অঙ্কিত হয়। এরপর ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ঐ একই সংস্থায় ছাপা নতুন ধূসর রঙের ১০০ টাকার নোট প্রকাশ করে। এই নোটের এক পিঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের প্রতিকৃতি ও অন্য পিঠে গ্রামীণ বাংলাদেশের একটি নদীর দৃশ্য অঙ্কিত ছিল। ২ মার্চ ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয় ইংল্যান্ডের ঐ সংস্থায়মুদ্রিত নতুন ১ টাকার নোট প্রকাশ করে। হালকা ও গাঢ় বেগুনি ও খাকি রঙের সমন্বয়ে ছাপা এই নোটের এক পিঠে ধানের মঞ্জরি ধৃত একটি হাতের চিত্র ও অন্য দিকে বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক অঙ্কিত ছিল। এই নোটের দুই পিঠেই বাংলায় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ লেখা রয়েছে। এরপর ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ইংল্যান্ডের ঐ সংস্থায়ই ছাপা নতুন লাল রঙের ৫ টাকার নোট প্রকাশ করে। এই নোটের এক পিঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের প্রতিকৃতি ও অন্য পিঠে বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলার চিত্র অঙ্কিত ছিল। দ্বিতীয় সিরিজের ১ টাকার নোটগুলি অর্থ সচিব মতিউল ইসলাম কর্তৃক স্বাক্ষরিত এবং ৫, ১০ ও ১০০ টাকার নোটগুলি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আ ন হামিদ উল্লাহ কর্তৃক স্বাক্ষরিত।

তৃতীয় সিরিজ (ব্র্যাডবেরি উইলকিনসন সংস্থায় মুদ্রিত)

বাংলাদেশের ব্যাংকনোট যখন ইংল্যান্ডের টমাস দেলারু সংস্থায় ছাপতে দেওয়া হয়, তখন প্রায় একই সময় ইংল্যান্ডেরই ব্র্যাডবেরি উইলকিনসন মুদ্রণ সংস্থাকেও ব্যাংকনোট ছাপতে দেওয়া হয়েছিল। এর নকশা টমাস দেলারু সংস্থায় ছাপা নোট থেকে পৃথক ছিল। ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ সালে প্রকাশিত এই তৃতীয় সিরিজের লাল রঙের ৫ টাকার নোটের এক পিঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের প্রতিকৃতি ও অন্য পিঠে একটি নদীর ধারে কারখানার চিত্র অঙ্কিত ছিল। এই নোটেই প্রথম ইংরেজির পরিবর্তে বাংলায় ক্রমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। ১৫ অক্টোবর ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত তৃতীয় সিরিজের সবুজ রঙের ১০ টাকার নোটের এক পিঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের প্রতিকৃতি ও অন্য পিঠে গ্রামীণ দৃশ্য অঙ্কিত ছিল। ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭৩ সালে হালকা ও গাঢ় বেগুনি ও খাকি রঙের সমন্বয়ে ছাপা তৃতীয় সিরিজের নতুন ১ টাকার নোট প্রকাশিত হয়। এই নোটের এক পিঠে এক নারীর খলে শস্য কোটার চিত্র ও অন্য দিকে ধানের মঞ্জরি ধৃত একটি হাতের চিত্র ও বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক অঙ্কিত। এই নোটেরও দুই পিঠে বাংলায় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ লেখা রয়েছে। তৃতীয় সিরিজের ১ টাকার নোটগুলিও অর্থ সচিব মতিউল ইসলাম কর্তৃক স্বাক্ষরিত এবং ৫ ও ১০ টাকার নোটগুলিতে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আ ন হামিদ উল্লাহর স্বাক্ষর।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেই ভয়ংকর দিনটিতে বাংলাদেশের সব কিছু বদলে যায়। এর পরিণামে ১ মার্চ ১৯৭৬ সালে মুদ্রিত চতুর্থ সিরিজের ব্যাংকনোট থেকে মুছে দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি।

 

তথ্যসূত্র:

১. Cuhaj, G.S. (ed.)(2014). Standard Catalogue of World Paper Money, Modern Issues 1961-Present. 20th edition. Iola: Krause Publications. pp.95-97.
২. Symes, P. (2012) “The Banknotes of Bangladesh – The First Ten Years, Part 1” in International Bank Note Society Journal, Volume 51, Number 1, March 2012. pp. 20-32.
৩. Symes, P. (2012) “The Banknotes of Bangladesh – The First Ten Years, Part 2” in International Bank Note Society Journal, Volume 51, Number 2, June 2012. pp. 26-34.

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
লোকগবেষক প্রাবন্ধিক, অণুগল্প,রম্যরচনা এবং ভ্রমণকাহিনীর লেখক
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top