সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

আমার বাড়ি বাংলাদেশঃ শেখ মুজিব : এস ডি সুব্রত


প্রকাশিত:
২৭ মার্চ ২০২১ ১৮:৪৭

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ০৩:৩৫

 

আজ আমরা যে স্বাধীন ভূখণ্ডের অধিবাসী, যে শ্যামল প্রান্তরে সুনীল আকাশের নিচে বুকভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছি তা এমনি এমনি আসেনি।এর জন্য জীবন দিতে হয়েছে, দিতে সম্ভ্রম।এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি লাল সবুজের পতাকা। প্রিয় বাংলাদেশ। এ অর্জনের পেছনে যে সংগ্রাম সে সংগ্রামের পেছনে রয়েছে যে মহান নেতার অগাধ দেশপ্রেম, ত্যাগ তিতিক্ষা তিনি হলেন আমাদের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। টুঙ্গিপাড়ার খোকা একদিন হয়ে উঠেন বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতির পিতা।

শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশকে, এদেশের মানুষ কে খুব ভালবাসতেন। তার কারাগারের রোজনামচা থেকে জানতে পারি তিনি মানুষ কে তো ভালবাসতেনই, তিনি প্রতিবন্ধী বা পাগলদেরও খুব ভালবাসতেন। তিনি ভালবাসতেন প্রকৃতি, ফুল পাখি কে। তিনি বাংলাদেশ কে কতটা ভালবাসতেন তা আমরা প্রবলভাবে জানতে পারি পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের " ঢাকার ডায়েরী" এবং শাহ এ এম এস কিবরিয়ার " বঙ্গবন্ধু; কাছে থেকে দেখা" বই থেকে।

বঙ্গবন্ধু দেশকে, দেশের মানুষ কে খুব ভালবাসতেন। ভালবাসতেন সকল মানুষ কে। তিল এ ভালবাসার ছোঁয়া পেয়েছিল জেলে তার পাশের শেলে থাকা প্রতিবন্ধী পাগলরাও। জেলে শেখ মুজিবুর রহমান কে প্রায়শই মানসিক রোগী দের শেলের পাশে রাখা হতো যাতে তাদের চিৎকার ও চেঁচামেচি তে তার ঘুমের অসুবিধা হয়। কিন্তু তার দরদী মন পাগলদের ভালবাসতে শুরু করে। তিনি বিরক্ত না হয়ে মানসিক প্রতিবন্ধী দের কাছে টেনে নেন। পাগলরাও হয়ে উঠে তার আপন। মানসিক প্রতিবন্ধী শেলের বর্ননা দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু মজা করে বলেছিলেন ......." এদের কাছে থাকতে আমার  আপত্তি নেই।করণ বোধ হয় আমি নিজেও ভয়ানক প্রকৃতির লোক। মনে ভয়ডর একটু কম।" পাগলদের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসা জন্মে গিয়েছিল। তাদের দূঃখ তিনি বুঝতে পারতেন। এই পাগল রা খুব কমই সুস্থ্য  হয়। আর সুস্থ  হলেও ছাড়া পেতে বিলম্ব হওয়ায় তারা আবার পাগল হয়ে যায়। একবার জেলের গল্প বলার সময় বঙ্গবন্ধু বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব কে বলেছিলেন-"যদি কোন দিন পাগল হয়ে যাই তবে জেলের পাগলখানায় আমাকে দিওনা। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে একজন পাগলও উচ্চ ধারনা করত এবং ভাবত বঙ্গবন্ধু কলম মারলে সে জেলখানা থেকে ছাড়া পাবে। এক পাগল সারাদিন নামাজ পড়ত আর সকলের জন্য দোয়া পড়ত। সে একদিন বঙ্গবন্ধু কে বলেছিলেন আমাকে ছেড়ে দেন। আপনি বললে ওরা আমাকে ছেড়ে দেবে। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন আমি তো তোমার মত একজন কয়েদি। আমার ক্ষমতা থাকলে আমিই বা জেলে থাকব কেন? এবার ফাইলটি বলল ....... আপনি কলম মাইরা দিলেই কাজ হয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু তখন বলেছিলেন কলম আছে, কিন্তু মাইরা দিবার ক্ষমতা নাই।

মাটি ফুল পাখি ও প্রকৃতির প্রতি শেখ মুজিবের ছিল গভীর প্রেম। ঢাকা জেলখানায় রাজবন্দী শেখ মুজিব ছিলেন একাকী, কথা বলার মানুষ ছিল না। দ্রুত বন্ধুত্ব হয় মাটি গাছপালা আর প্রকৃতির সাথে। তিনি সেখানে লাউয়ের বীজ ও ঝিঙার বীজ লাগান। বেড়ে উঠে লাউগাছ ও ঝিঙ্গা। করেন ফুলের বাগান। জেলখানার সামনে ছোট মাঠে লাগান দূর্বা ঘাস। বৃষ্টি পেয়ে এগুলো বড় হয়। তখন মাঠের কোণে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু দেখতেন মোরগ মুরগির চড়ে বেড়ানো, খাবার খুঁটে খাওয়া। নিজে খাওয়াতেন সেগুলো কে।

একবার একটা মোরগ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। বাবুর্চি বলেছিল মোরগটা জবাই করে ফেলি। বঙ্গবন্ধু বললেন, না, দরকার নেই। ও বেশ বুক ফুলিয়ে বেড়ায়। ওর চলাফেরার ভঙ্গিমা দেখে আমার বেশ ভালো লাগে।

নিখোঁজ পাখির প্রতি বঙ্গবন্ধুর হাহাকূ দেখে কঠিন অপরাধী হতে বাধ্য। বঙ্গবন্ধু বলেন--- "বহুদিন পর্যন্ত দুটি হলুদ পাখি কে আমি খোঁজ করছি। ১৯৫৮-৫৯ সালে যখন এখানে ছিলাম ঐ জায়গাটি যে প্রায়ই ১০/১১টার দিকে আসত আর আমগছের এক শাখা  থেকে আরেক গুড়ে বেড়াত। মাঝে মাঝে পোকা ধরে খেতো। আজ ৪০ দিন এখানে আছি কিন্তু হলদে পাখি দুটি এল না, আর আসবে না। ১৬ মাস এই ঘরটিতে যখন একাকী ছিলাম তখন সকাল বেলা রোজ পড়া বন্ধ করে তখন বাইরে যেয়ে বসতাম তাদের দেখার জন্য। মনে হলো ওরা আমার উপর অভিমান করে চলে গেছে। মাটির মতই পাখির প্রতি ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রবল টান। না খেয়ে খাবারের টাকা জমিয়ছিলেন একবার। সেই টাকা দিয়ে কিনে ফেললেন দুটি মুরগি। সূর্য অস্ত গেলে নিজে সেলে ঢুকার আগে মুরগি গুলো কে পরম মমতায় রেখে দিতেন খাঁচায় আর বলতেন আরামে থাক, চোর ডাকাতের ভয় নাই। পাহাড়া রাখলাম।

বঙ্গবন্ধু নিজের চেয়ে দেশকে, দেশের মানুষ কে বেশি ভালবাসতেন। তিনি সারা বাংলাদেশ কে ভালবাসতেন। বঙ্গবন্ধুর প্রথম পাসপোর্ট তৈরির ঘটনা। পাসপোর্ট তৈরির প্রস্তুতি হিসেবে একটি ফরম  নিয়ে  শাহ এ এম এস কিবরিয়া গেলেন তার অফিসে। তিনি বঙ্গবন্ধু কে বলেছিলেন আমি সমস্ত ফরম পূরণ করে দিচ্ছি। আপনি শুধু স্বাক্ষর করবেন। কিবরিয়া আরও বললেন পাসপোর্টে জন্মস্থান দিচ্ছি ফরিদপুর। সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু গর্জে উঠলেন। না, লেখো আমার জন্মস্থান বাংলাদেশ। কোন জেলা বা অঞ্চলের মনে করতেন না নিজেকে। মনে করতেন সমগ্র বাংলাদেশের তিনি।

১৯৭২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে দেখা করতে গেলেন প্রবোধ কুমার স্যানাল, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সন্তোষ কুমার ঘোষ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ। অভ্যর্থনা জানিয়ে সবাইকে পাশে বসালেন। এবার পরিচয়ের পালা সবাই নিজের পরিচয় দিতে লাগলেন। প্রবোধ কুমার স্যানাল পরিচয় দিতে গিয়ে বললেন আমার বাড়ি ফরিদপুর। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বললেন আমার বাড়ি ফরিদপুর। সবশেষে শেখ মুজিব বললেন, আমার বাড়ি কোথায় জানেন? প্রশ্ন শুনে সবাই হতবাক। শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি কোথায় এটা কে না জানে। সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই জবাব দিলেন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ আমার বাড়ি।

 

এস ডি সুব্রত
কবি ও প্রাবন্ধিক
সুনামগঞ্জ, বাংলাদেশ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top