সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

সাঁঝবেলা : তাশরিক-ই-হাবিব


প্রকাশিত:
১০ এপ্রিল ২০২১ ১৯:১৩

আপডেট:
১১ এপ্রিল ২০২১ ২২:৫৬

 

মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। হিমশীতল বাতাসের তোড়ে পারদের মত স্বচ্ছ জলকণারাশি ছিটকে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে রাহাতের শার্ট, ট্রাউজার। বারান্দার গ্রিল এমন ঠান্ডা, মনে হয় হাতের আঙুলগুলো রক্ত-মাংসে নয়, যেন বরফের টুকরো দিয়ে তৈরি। চারদিক শুনশান। মাঝে মধ্যেই চলছে মেঘের গর্জন আর বিদ্যুতের আচমকা ঝলকানি। সামনের ছোট মাঠটাকে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকারের সঙ্গে সেটা যেন মিশে আছে। ইটের খোয়া বিছানো এক চিলতে রাস্তা আর এর বামপাশে পেয়ারা গাছের সারি মিলে চারপাশকে আরো খাঁ খাঁ করে তুলেছে। শেষ বিকেলের আবছা আলোর সঙ্গে অন্ধকারের মিতালি আর অবিরাম বৃষ্টির নাচন নিস্তব্ধ প্রকৃতির বুকে মুহূর্তগুলোকে করে তুলেছে অলস। সময় কাটছে না। রাহাত চোখ বন্ধ করেও স্বস্তি পাচ্ছে না। মাথার ভেতর নেচে চলেছে চঞ্চল টাপুর টুপুর। বাউন্ডারির দেয়াল ঘেষাঁ আম আর নারিকেল গাছের জটলায় থোকা থোকা অন্ধকার যেন জমাট বেঁধে আছে। বাতাসের একটানা শোঁ শোঁ গর্জনের সঙ্গে গাছের ডালপালার বারবার এপাশ ওপাশ ঝাপটানোর শব্দ থমথমে শিহরণ জাগিয়ে তুলছে। প্রেতের হাতছানির কথা বারবার মনে পড়ে। আষাঢ়ের মাঝামাঝি বৃষ্টির এ সাঁঝবেলায় হঠাৎ করেই ওর কানে এল ব্যাঙের উচ্ছসিত ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ। যাক, তবু যেন কাছেপিঠে কেউ আছে। এতক্ষণ ধরে ছয়টি আলাদা রুমের টিনশেডের ডর্মেটরিটাকে মনে হচ্ছিল কবরস্থান। ভেতরটা কেমন যেন শূন্য হয়ে ছিল। গলার মধ্যে কেমন এক খসখসে অনুভূতি। ঠান্ডা লাগার ভয় থাকলেও ভেতরের ঘরে ঢুকতে ইচ্ছা করছে না। মাথার ভেতরেটাও যেন অসাড় হয়ে আছে। অনেকক্ষণ ধরেই একনাগাড়ে একই দৃশ্য দেখে দেখে ওর মধ্যে তবে কি কোনো সাড়া জাগছে না! ওর মাঝেমধ্যে এমন হয়। চোখের সামনে থাকা সবকিছুই ও দেখে চলে, কিন্তু মনের ভেতর পাথরের মত জমাট নিথরতা ওকে আড়ষ্ট করে ফেলে।

পাশাপাশি দুই রুমের পর একটা করে দেয়াল। প্রতি দুই রুমে ঢোকার গেটও একটি করে। প্রতি রুমের সঙ্গে লাগোয়া বাথরুম আর এক চিলতে রান্নাঘর। ওদের পাশের রুমে যে ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোক থাকতেন, তিনি ছুটি নিয়ে গতকালই বাড়ি গেছেন। ঠাস করে একটা শব্দে ওর মনে হল - রান্নাঘরের কাঠের জানালার একটা পাল্লা খুলে গেছে। ডর্মেটরিতে উঠেই ওরা দেখেছিল, রুমটা অনেকদিন পড়ে থাকায় বসবাসের উপযোগী নয়। তবু, পরীক্ষার দিনগুলো, অন্তত একমাস এখানে পার করতে হবে বলে আব্বা জোড়াতালি দিয়ে সব সামলাচ্ছেন। বাতাসের আছড়ানি আর বৃষ্টির ধাক্কায় সেটার অবস্থা জবুথবু। কোনমতে দড়ি দিয়ে গ্রিলের সঙ্গে বেঁধে ঠেকা কাজ চলছিল এতদিন। না সারালে অন্যটাও যাবে। বৃষ্টির তোড়ে বোধহয় মেঝে ভিজে গেছে। যাকগে। অসহ্য! ও এখন এসব হাঙ্গামা পোহাতে রাজি নয়।

ছাদের সঙ্গে দেয়ালের সিলিং মেপে মেপে আঁটোসাটোভাবে ফিট করায় বৃষ্টি এলেই পানির স্রোত টিনের চালা গড়িয়ে সামনের বারান্দাকে ভিজিয়ে দেয়। তিন ধাপের সিঁড়িও তাই কদিনেই পিচ্ছিল হয়ে যায়। চারপাশের সোঁদা সোঁদা গন্ধ নাকে লাগে। ভাঙা পাল্লাটা লাগানো দরকার ভেবে ঘরের ভেতরে যেতেই একপাশ খোলা জানালার মুখোমুখি হতে হল। ওটাকে দেখে ওর ভেতর কেন যেন অস্বস্তিকর অনুভূতি জেগে উঠল। ওর মনে হল, একজন একচোখা বৃদ্ধ নীরবে হা করে ওর দিকে একঠায় চেয়ে আছে। জানালাটার খোলা পাল্লা যেন তার ছানিপড়া চোখ, যেটার মণিতে বাইরের আবছায়া জগৎ আটকে পড়েছে। বৃষ্টি প্রায় থেমে গেছে। ওপাশে বাতাসে দোল খাওয়া কলাগাছের কয়েকটা কালচে পাতার নাচন অস্পষ্ট আলোয় চোখে পড়ল। গলাটা জোর করে থুতু দিয়ে ভেজানোর চেষ্টা করতেই ওর মনে হল, জিভটা সাঁড়াশি দিয়ে আটকানো। অন্ধকারে খেয়াল না করে জানালার দিকে হুড়মুড় করে এগিয়ে যেতেই ডান কাঁধের ধাক্কা লাগল টেবিলের পাশে রাখা বাঁশের শেলফের সঙ্গে। অমনি ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল কাচের একটা বয়ম। কোনোমতে সাবধানে হাতড়ে হাতড়ে একটু এগিয়ে বন্ধ পাল্লাটাও খুলে দেবে কি না ভাবতে ভাবতে জানালার সামনে যেতেই ওর চোখ পড়ল ল্যাম্পপোস্টের দিকে। ওদিকে তো আলো দেখা যাচ্ছে! তাহলে! কলাগাছের সারি পেরিয়ে কোয়ার্টারের বাউন্ডারি দেয়ালের পেছন দিকটাতে পিডিবির ওয়ার্কারদের ছোট ছোট খুপরি। ল্যাম্পপোস্টের পেছন দিকে একটা সুপারি গাছের ছায়া চওড়া দেয়ালের ওপর এমনভাবে পড়েছে, মনে হল বৃদ্ধ লোকটা ওখানে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। শুয়ে আছে তো শুয়েই আছে। কোনো নড়াচড়া নেই। বুকের ভেতরটায় ধড়াশ ধড়াশ শব্দ ও নিজেই শুনতে পাচ্ছে। কবরস্থানের কথাটা ঠিক তখনই মাথায় এল। কে যেন বলেছিল না, দেয়ালের বামদিকে যেখানে পাওয়ার স্টেশনের নতুন প্ল্যান্ট, তার পেছন দিকে একটা কবরস্থান ছিল! মুক্তিযুদ্ধের সময় নাকি অনেক মানুষকে মেরে সেখানে ফেলে রাখা হয়েছিল। ওদিকটা এমনিতেই নির্জন, গাছপালার জঙ্গল আর সাপ-শিয়ালের ভয়ে পারতপক্ষে কেউ সেখানে যায় না।

কটা বাজল? ঘোড়ার ডিমের কারেন্ট কি আসবে না নাকি! নিজের ওপরই ঝাঁঝিয়ে ওঠে রাহাত। এমন সময় ঠন করে দূর থেকে ভেসে আসা আওয়াজ শুনে ও সটান হয়ে কান খাড়া করল। গেটের শব্দ! কেউ বুঝি এসেছে। ও সাবধানে পা ফেলে এটা সেটা হাতড়ে হাতড়ে বারান্দায় এসে একবার ভাবল, ওদিকের লাইনে যখন কারেন্ট আছে, তাহলে এদিকেও নিশ্চয়ই একটু পর চলে আসবে! কিন্তু এতক্ষণ ধরেও কারেন্টের চাঁদমুখ দেখতে না পেয়ে ও বাইরে বেরুতে চাইল। কোথায় যাওয়া যায়? ঘরে একটা মোম বা টর্চও কি নেই! থাকলেও আম্মা কোথায় রেখেছেন, কে জানে? এখন ও ওসবের হদিস পায় কীভাবে? নিজের ওপর ওর প্রচণ্ড রাগ লাগে। এরকম পরিস্থিতিতে ও এর আগে পড়েনি। এখান থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য ওর মনটা আকুপাকু করে। কিন্তু যাবে কোথায়? অপুদের বাসায়! তাও তো এখান থেকে কমপক্ষে পনের-বিশ মিনিটের পথ! কোনো রিকশা এখন পাওয়া যাবে? এই বৃষ্টির মধ্যে অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে যাওয়ার প্রস্তাবে ওর মন সায় দিল না। এমনিতেই এদিকে সাপখোপের ভয়। তাহলে? আচ্ছা, হারিকেনটা জ্বালালেই তো হয়, ভেবে একটু খুশি হয়ে উঠেই ওর মনে পড়ল, কেরোসিনই তো দোকান থেকে আনা হয়নি! কারণ এ কদিন তো কারেন্ট ভানুমতির খেল দেখায়নি! কাল অঙ্ক পরীক্ষা! পরীক্ষার কথা মনে হতেই ওর ভেতরটা কনকনে ঠান্ডায় ভরে গেল। ও বরাবর অঙ্ককে ভয় পায়। ধ্যৎ, কিছু ভাল লাগে না। কখন আসবেন আম্মা! কেন যে ছাই আব্বা এ সময়ে রিটায়ারমেন্টে গেলেন!

বারান্দা থেকে কোয়ার্টারে ঢোকার মূল গেট কমপক্ষে পনের-বিশ গজ দূরে। চারপাশ এতটাই নীরব, কলাগাছের পাতাগুলো বাতাসের দোলায় এদিক সেদিক আছড়ে পড়ার ঝটপটানি ছাড়া আর কিছুই কানে বাজে না। এমনকি বৃষ্টি বন্ধ হওয়ায় ব্যাঙদের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙও থেমে আছে। একটু পর ওর মনে হল, গেটের বাইরে কারো কথা শোনা যাচ্ছে। আম্মারাই বোধহয় এসেছে। রিকশাওয়ালার সঙ্গে কথা বলছে। স্কুল জীবনের কথা মনে হতেই ও ভেতরে ভেতরে উৎফুল্ল¬ হয়ে উঠল। সেই ক্লাস ওয়ান থেকে গোয়ালপাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্কুলে পড়েছে, আর ঠিক পরীক্ষার সময়ই কি না আব্বার রিটায়ারমেন্ট! মনে আছে, মাস তিনেক আগে সবকিছু গুছিয়ে ওরা যখন নানাবাড়ি ঢাকার মগবাজারে চলে যাবে, সেই রাতে কোনোভাবেই ও নিজেকে সামলে উঠতে পারছিল না। তাছাড়া কেউ কান্না দেখে ফেলবে, এই ভয় আর লজ্জায় ও ছিল উদ্বিগ্ন। ওর মন খারাপ ভাবটা বাসার সবার কাছে ধরা পড়লেও তা তেমন পাত্তা পায়নি। কারণ সবারই তখন এ অবস্থা। এত প্রিয় কোয়ার্টার, পনের বছর এখানে থাকার কত স্মৃতি। নিজেদের এত সুন্দর বাসা ইঞ্জিনিয়ার্স কোয়ার্টারের, সেটা ছেড়ে এখন এসে উঠতে হয়েছে ছাইমাথা টিনের চালাঘরে। নিজের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা অভিমান ও আক্ষেপ আবার ওকে স্মৃতিকাতর করে তোলে।

ওদের বাসাই ছিল ইঞ্জিনিয়ার্স কোয়ার্টারের সোজা রাস্তার সর্বশেষ বাসা। এরপর ‘প্লেয়ার ক্যাম্প’ নামে বেশ পুরাতন আমলের সাদা ও মেরুন রঙওঠা একটা বড় দোতলা বাড়ি। ওটা দেখতে ঠিক হিন্দু মন্দিরের মত। বড় বড় থাম, সিমেন্টের মসৃণ মেঝে, ডানে-বায়ে দুটি করে এবং সামনে একটি মোট পাঁচটি চার ধাপবিশিষ্ট সিঁড়ি। প্রতি ধাপের সামনের জমিটুকুতে গোলাপসহ নানা ফুলগাছ লাগানো হত। একতলায় ছয়টা রুম ছিল। ঠিক মাঝের রুমটা ছিল বড়, অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা। ওটার ভেতরের দিকেই আরেকটা রুম, বাথরুম ও রান্নাঘর নিয়ে একটা আলাদা বাসা যেন। সেটার সামনে পিছনে দুদিকেই ছিল ঢাউস সাইজের দরজা। একতলা থেকে দুদিক দিয়েই দোতলায় ওঠা যেত। এর সিঁড়িগুলো ছিল প্যাঁচানো আর ছোট ছোট, খাড়া ধরনের। ভেতরে ডানদিকে দুটি ঘর। সঙ্গে বাথরুম ও রান্নাঘর। সামনের দিকে বেশ খোলা ছাদ। ছাদের ওই মাথায় ছিল আরেকটা রুম। একটা জামগাছ ছাদের বাউন্ডারিতে এসে পড়েছিল। ওটা ছিল নিচতলার পেছন দিকে। ওই জামগাছের রসালো জামের লোভে সুযোগ পেলেই ভরদুপুরে আম্মার চোখ ফাঁকি দিয়ে ও প্লেয়ার ক্যাম্পে আসত। রুমগুলোতে ছোট পরিবারবিশিষ্ট ওয়ার্কাররা ভাড়া থাকত। রাজুরা থাকত নিচতলার মাঝের বড় রুমটায়। কালীপূজার এক রাতে যখন রাজুদের বাসায় ও আর স্বাধীন গিয়েছিল, দেয়ালে ঝোলানো ভয়ঙ্করদর্শন দেবীকে দেখে ও বেশ ভয় পেয়েছিল। টকটকে লাল জিভ বের করা, কয়লাভাটার মত জ্বলন্ত চোখের সেই নারীর চেহারা মনে পড়তেই ও ভয়ে কেঁপে ওঠে। রাজু যখন সন্ধ্যা নামলে স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলা শেষে পুকুরপাড়ে হাতমুখ ধুতে ধুতে শিবঠাকুরের বুকে পা তুলে দেয়া মা কালীর গল্প ওকে বলত, সেই বলার মধ্যে ভয়ানক একটা কিছু ছিল। তাই কালীপূজার রাতে অন্ধকারের বুকে দীপাবলির ¯িœগ্ধ আলোয় কেটে যাওয়া মনোরম শোভা দেখে স্বাধীন আর রাজুর সঙ্গে মাঝরাত পার করেও বাসায় এসে ও ভয়ে ঘুমাতে পারেনি। আম্মাকে বলেছিল, ‘ভয় লাগছে’। আম্মা হেসে বলেছিল, ‘যাও, রাতটা ওদের বাসায় কাটিয়ে আসো! কেন গিয়েছিলি বাঁদর! এতই যদি দেবী দেখার শখ, ভয় পাস কেন? স্বাধীন এবার আসুক! তোর আব্বাকে বলব?’ প্রায় কাঁদোকাঁদো ছেলেকে জড়িয়ে পাঁচ-ছয় বছর আগের সেই রাতে আম্মা ওর পাশেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।

প্রায় প্রতিদিন বিকেলেই ওরা প্লে¬য়ার ক্যাম্পে লুকোচুরি খেলত। তবে সেটা সবচেয়ে বেশি জমত হঠাৎ করে কোনো রাতে কারেন্ট চলে গেলে, আর স্কুলের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে সন্ধ্যার পর। গোয়ালপাড়ায় রাতে কারেন্ট চলে যাওয়ার ঘটনা রাহাত ও তার সমবয়সীদের কাছে ছিল ইদের আনন্দের মত। কোনো কারণে কেবল রিপেয়ার বা অন্য কাজে, কখনো বা ঝড়ের সময় কানেকশন অফ থাকত। সেকারণেই পাড়া-প্রতিবেশীদের ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে সেখানে লুকোচুরি খেলতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত। একবার তো রাজন ছিল চোর, স্বাধীন আর রাহাত ছাদের কার্নিশে জামগাছের ডালের আড়ালে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল আধঘণ্টা। সেবার খুব মজা হয়েছিল। বদমাশ টিমন রাতের বেলা যখন কোয়ার্টারের পার্কে বসে ড্রাকুলার গল্প বলত, তখন রাতের অন্ধকারে অনেকেই যেন পেনসিলভেনিয়ার কফিনে ঘুমন্ত ড্রাকুলাকে চোখের সামনে দেখে মুর্ছা যেত!

কী ব্যাপার! কে আসল রিকশায় করে? গেটের ভেতর তো কাউকে দেখা যাচ্ছে না! উহ! বৃষ্টির মধ্যে মশার ভনভনানি শুরু হয়েছে। মেজাজও তিরিক্ষি হয়ে উঠেছে ওর, ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। সেই দুপুরে পরীক্ষা দিয়ে এসে গোসল করেই ঘুম, হাত-পা ছেড়ে। আগে তো এই কোয়ার্টারেও লুকোচুরি আর শীতের সময় ব্যাডমিন্টনের আসর জমত। নভেম্বরের শেষ থেকে প্রায় পুরো ডিসেম্বর, স্কুল খোলার আগ পর্যন্ত। ব্যাচেলরস কোয়ার্টারের বাউন্ডারি বেশ বড়। এদিকে টিনশেডের ডর্মেটরি আর মাঠ, তার সামনে পায়ে হাঁটার বাঁধানো রাস্তার ওপাশে দোতলা আরেকটা প্রকাণ্ড বাড়ি, প্লেয়ার ক্যাম্পের মত। ওটার বামদিকে পেছনে কবরস্থানের কিছুটা পড়েছে, ডানদিকে পিডিবির নিজস্ব হাসপাতাল আর ফরেনার্স হোস্টেল, পুকুর। আগে মাজেদুলরা যখন এর দোতলায় থাকত, তখন অঙ্ক প্রাইভেট পড়তে সপ্তাহে তিনদিন রাহাত আসত ওদের বাসায়। তিন দিকে ঢাউস বারান্দা, বিশাল উঁচু সিলিং তৈরি লোহার বিমে। লোহার রডে ঝুলন্ত ফ্যান আর খড়খড়ি দেয়া প্রকাণ্ড জানালাঘেরা, চুন-পলেস্তারা খসা এ ফ্যাকাশে হলদেটে বাড়িটায় লুকিয়ে আছে যেন অনেক দিন আগের রহস্যমাখা গল্পকথা। কার্নিশে বৃষ্টির পানি জমায় শ্যাওলার আচ্ছাদন দোতলার বারান্দা থেকে দেখা যায়। কয়েকটা গাছও জন্মেছে সেখানে। একবার তো রান্নাঘরের জানালার খড়খড়ির ভেতর একটা কুচকুচে কালো চিকন সাপ দেখে মাজেদুলদের কাজের মেয়ে বানুর মুর্ছা যাওয়ার দশা। নিচতলা অনেক দিন থেকেই তালাবদ্ধ। মাঝেমধ্যেই ঠেলা গাড়িতে করে কী সব ভর্তি বড় বড় বস্তা নিয়ে ওয়ার্কাররা এসে সেখানে রাখত। এ বিল্ডিংয়ের আশেপাশেও গাছপালা, ফাঁকফোকর ছিল ঢের। তাই ছেলেবেলায় লুকোচুরি আর শার্লক হোমসের দুঃসাহসিক অভিযানের আগ্রহে কোয়ার্টারটার প্রতি ওর বয়সীদের দুর্দান্ত আগ্রহ ছিল।

এ কোয়ার্টারের দারোয়ান ব্যাটাও পটল তুলল নাকি? আগে তো মাঝেমধ্যে রোগাপটকা আজগর আলিকে রাতে হুইসেল বাজাতে দেখা যেত। সেও কি রিটায়ারমেন্টে? আনমনে এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ওর মনে হল, কে যেন আসছে। গেট কি খোলাই ছিল? পুরোনো আমলের গেট, সাড়া শব্দও তো পাওয়া গেল না। যাকগে! ওই যে! সাদা পাঞ্জাবি পরনে ... যাক, আব্বা এতক্ষণে আসলেন!। রাস্তার রোডলাইটগুলোর কয়েকটা ততক্ষণে জ্বলে উঠেছে। কী ব্যাপার? এ ডর্মেটরির কানেকশন আলাদা নাকি? ইঞ্জিনিয়ার্স কোয়ার্টারের মতো? সেখানে তো ঝড় শুরু হলেই কানেকশন বন্ধ রাখা হয়। এখন তো বৃষ্টিও নেই। তাহলে? কিছু বোধহয় ছিঁড়ল! ও আচ্ছা, সেদিন সানাউল্লাহ আর বাতেন মিস্ত্রি যে এসেছিল ওরা এখানে ওঠার পর, কি যেন বলছিল না ... কেবল রিপেয়ার ... পাওয়ার প্ল্যান্টের লাইন নতুন করে কানেক্ট করা ... একমাস আগে নাকি সমস্যা হয়েছিল ঝড়ের সময় আমগাছের ডাল কেবলস্ট্যান্ডের ওপর আছড়ে পড়ায়! থাকগে। বৃষ্টি থেমেছে। দশ মিনিট হাঁটলেই রাজ্জাকের চায়ের স্টল আর মুদি দোকান। মোম কিনে আনতে হবে। রাত জেগে অঙ্ক করতে হবে। এমনিতেই টেস্ট পরীক্ষায় অঙ্কে লেটার পায়নি বলে আব্বার মেজাজ গরম ছিল। ‘পয়সা খরচ করে প্রাইভেট পড়ে কি লাভ!’ অমুক তমুক! ও! কী দরকার এখন দোকানে যাবার! এক রুম পরেই তো আনিস চাচা থাকেন। লিলি চাচীর কাছে গিয়ে একটা মোম চাইলেই তো হয়। ঘরে ঢুকে ও সাবধানে একজোড়া স্যান্ডেল পরে অন্ধকারে পা ফেলে রান্নাঘরের চুলার কাছে আসে। কেরোসিনের স্টোভের পাশে ম্যাচটা পাওয়া গেল। চাচীর তিন বছরের মেয়ে রিনি যা কিউট! বড় বড় টলটলে দুটি চোখ, ব্যাকরণ বইয়ের ঠিক ‘পদ্মলোচন’ নাম ওরই জন্য। ও বেরিয়ে যায় বাইরের গ্রিলের গেটে হুড়কোটা নকশাকাটা ফোকর দিয়ে হাত গলিয়ে বন্ধ করে।

 কোয়ার্টারের গেটের দিকে তাকিয়ে ও ধাক্কা খেল। আব্বা কোথায়? না, এখনো তো কেউ আসেনি। তাহলে? একটু আগে সাদা পাঞ্জাবি পরে ও কাকে আসতে দেখল, মাথায় ছাতা নিয়ে? আব্বা বলেই তো মনে হল! কেন যেন ওর গায়ে কাটা দিয়ে উঠল। দূরের রোডলাইটের ক্ষয়াটে আলোয় দেখা যাচ্ছে, গেটের পাল্লা ঠেলে দেয়া। বৃষ্টির পানিতে মাঠ কাদাকাদা হয়ে আছে বলে পায়ের স্যান্ডেলও ভিজে একাকার। রিনিদের রুমের দিকে সাবধানে এগিয়ে যেতে ও পকেট থেকে ম্যাচ বের করে জ্বালিয়েই খেয়াল করল, কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। ওরাও কি বাসায় নেই নাকি? অন্যদিন তো রিনির কান্না বা টেলিভিশনের শব্দ শোনা যায়। হ্যা, ওই তো রিনি কাঁদছে। আহা! গরমে আর অন্ধকারে বাচ্চাটা নিশ্চয়ই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। থাক, এখন আর চাচীকে বিরক্ত করার দরকার নেই। একটু পরেই কারেন্ট চলে আসলে খাওয়া-দাওয়ার পর পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়া যাবে। হঠাৎ ওর মনে হল, পায়ের পাশ দিয়ে কিছু একটা একেবেঁকে দ্রুত চলে গেল। একছুটে নিজেদের বারান্দায় এসে দরজার পাশে রাখা চেয়ারে ও একঠায় বসে সাপের কথা মনে হতেই ও দুই ঠোঁট কামড়ে ধরল। বুকটা ধড়ফড় করছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে। বাথরুমের কল দিয়ে পানি পড়ার শব্দ আসছে। যাক, আব্বা তাহলে ফিরেছেন বাইরে থেকে। বোধহয় অযু করছেন, সন্ধ্যার নামায পড়বেন! কিন্তু ওই রুমের মেঝেতে তো কাচের বয়ম ভাঙা টুকরো। আব্বাকে সতর্ক করার জন্য ও অপেক্ষা করতে লাগল। তখনই গেটের শব্দ শুনে বাইরে উঁকি দিয়ে ও ভেতরে ঢুকতে দেখল আম্মা আর আনন্দকে। ওরা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ওদের রুমের বারান্দায় হলুদ আলো জ্বলে উঠল। আম্মা ঘরে ঢুকে লাইট ও ফ্যানের সুইচ অন করে বললেন, ‘মোম-টোম কিছুই তো ছিল না, হারিকেন ... ও! কেরোসিনও তো নেই। খাওয়া দাওয়া করেছ ঘুম থেকে উঠে?’ রাহাত মাথা নাড়ে। ‘যাও, খেয়ে নাও। আমি রাতের রান্নার বন্দোবস্ত করি। তোমার আব্বার সঙ্গে কাল রফিক ভাইয়ের দেখা হয়ে ...’। আম্মার কথা শেষ হওয়ার আগেই রাহাতের চোখ পড়ল প্রথমে তার হাতে তালাসহ চাবির গোছার দিকে, তারপর ঘরের মেঝেতে। তখন ঘাড় ঘুরিয়ে রান্নাঘরের জানালায় ও কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল। ওর দিকে তাকিয়ে আম্মা অবাক হলেন। কী ব্যাপার! ছেলেটার চেহারা অমন লাগছে কেন? ফ্যাকাশে মুখে, চোখের দৃষ্টি কেমন এলোমেলো! ঠোঁটজোড়া কাঁপছে। মনে হচ্ছে, ও কথাগুলো শুনছে না। ‘রাহাত! অ্যাই রাহাত!’ বলে তিনি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে কাছে টেনে নিলেন। ততক্ষণে রাহাতের দৃষ্টি পড়েছে বাথরুমের দরজায়। কানে আসছে আম্মার উচ্চারিত কথাগুলোর অর্থহীন প্রতিধ্বনি - ‘তোমার আব্বা গেছে খালিশপুরে, রফিক ভাইয়ের বাসায় ...’। রাহাতের কপাল আগুনের মত গরম। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে । হাত-পা যেন অসাড় হয়ে আছে। শরীর অল্প অল্প ঘামছে, ফ্যানের স্পিড যেন কমে গেছে। নিঃশ্বাস নিতেও হাঁপিয়ে উঠছে। আম্মা বলে চলেছেন ‘ভীষণ ভ্যাপসা গরম। আনন্দ, রান্নাঘরের জানালাটা খুলে দাও। ভাগ্যিস, ভাঙা পাল্লাটা সেদিন কামাল মিস্ত্রি এসে লাগিয়ে গেছে, তা না হলে তো বৃষ্টির চোটে সারা ঘর ভিজে সয়লাব হত’। রাহাত প্রায় গোঙানির মত শব্দ করে ‘আব্বা ...’ বলেই থেমে যায়। ‘হ্যা, তুমি তো সেই পরীক্ষা দিয়ে এসে গোসল সেরেই ঘুম। কতবার বলি, রাত জেগে কাজ নেই। এখন তো শুধু অঙ্কগুলোতে চোখ বুলানো। তুমি এসে এমন বেহুশের মতো ঘুম দিলে, তাই বাইরের গ্রিলে তালা লাগিয়ে আমরা অপুদের বাসায় বিকেলে গেলাম। ওদুদ ভাবী আমাদের আসার কথা শুনেই খবর পাঠিয়েছিলেন যেতে। ওখান থেকে তোমার আব্বা গেল রফিক ভাইয়ের মেয়ের বিয়েতে। তোমার পরীক্ষা বলে আমরা আর যাইনি। কারেন্ট এসেছে, খেয়ে দেয়ে পড়তে বস।’ রাহাত কোনো কথা না বলে চট করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। এক দৌড়ে রিনিদের রুমের সামনে এসে দেখে, গ্রিলের হুড়কোতে একটা বড় তালা ঝুলছে।

 

তাশরিক-ই-হাবিব
সহযোগী অধ্যাপক
বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কথাসাহিত্যিক ও গবেষক



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top