সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

ভোট এলো বঙ্গে দেওয়াল ভরলো রঙ্গে (রম্য প্রবন্ধ) : ডঃ গৌতম সরকার


প্রকাশিত:
১৩ এপ্রিল ২০২১ ১৮:৫২

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:১১

 

বাঙালির বারো মাসে তের পার্ব্বণের সাথে আরেকটা পরব হল ভোট পার্ব্বণ। প্রতি বছরই কোনও না কোনও ভোটপর্ব থাকে, আর সেই ভোটকে ঘিরে প্রতিপক্ষ দলগুলির রঙ্গ, তামাশা, কার্টুন এবং সর্বোপরি দেওয়াল লিখন খুব উপভোগ্য হয়ে ওঠে৷ স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই এই শুম্ভ-নিশুম্ভের যুদ্ধ চলে আসছে। প্রথমে ছিল দুই দৃপ্ত প্রতিদ্বন্দ্বী-জাতীয় কংগ্রেস এবং যুক্তফ্রন্ট। পরবর্তীতে নতুন নতুন দলের জন্ম হয়েছে, কিছু জাতীয় দল রাজ্য রাজনীতিতে জায়গা করে নিয়েছে, বদলে গেছে ভোট প্রচারের ধরণ ধারণ, তবে ছড়া-কবিতা-কার্টুনের গুঁতোয় প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করার সনাতনী খেলা কিন্তু রয়েই গেছে।

সালটা ১৯৬৯, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার ভোট; আগের বিধানসভায় জয়ী যুক্তফ্রন্ট কেবলমাত্র নমাস ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিল৷ পাহাড় থেকে সাগর, লাল মাটির দেশ থেকে বাংলাদেশ বর্ডার যুক্তফ্রন্টকে কটাক্ষ করে কংগ্রেসের লেখা ছড়ায় দেওয়াল ভরে উঠল, 'যুক্তফ্রন্টে কী পেলাম/ গুলি-বুলি-লাল সালাম।' যুক্তফ্রন্টও পিছিয়ে থাকার পাত্র নয়, তারাও ছড়ার ছররাতে বিপক্ষকে কাত করতে লিখল, 'কিল মারেনি, ঢিল মেরেছে!/ তাতেই তোমরা রুষ্ট হলে?/তোমরা যখন হুকুম দিয়ে/ চালাও গুলি দুষ্ট বলে।/ তার বেলা?’ কংগ্রেসীরা শাপমোচন ছবির এক বিখ্যাত গানের প্যারোডি বানিয়ে লিখল, 'শোন বন্ধু শোনো-/ ফ্রন্টের ওই ন-মাসের ইতিকথা/ চোদ্দ জনের গোঁজামিলের/ সে এক বীভৎসতা।/ ওদের নীতি নেই/ওদের স্থিতি নেই/ ভাঁওতা দিতেই ভুল বোঝাতেই/ ওদের দক্ষতা।' এর উত্তর দিতে যুক্তফ্রন্ট আবার অন্নদাশঙ্করের শরণ নিল। তারা শোনাল, 'তোমরা কেবল শৃঙ্খলা চাও/ আইন করো চাও বিচার/ বলছ না তো ব্যর্থ শাসন,/ অক্ষমতার দাও বিচার?/ তার বেলা?’ সেই সময় বামপন্থীদের আরেকটা প্যারোডি খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল- 'এক যে আছে মজার দেশ/ সব রকমের ভালো/ চালের বদলে খুদ দেয়/ খুদের বদলে মাইলো।' কংগ্রেস নেত্রী আভা মাইতি মেদিনীপুরে খেতে না পাওয়া মানুষের মধ্যে মাইলো বিতরণ করেছিলেন৷ সঙ্গে সঙ্গে দেওয়াল জুড়ে ফুটে উঠলো, 'আভা দিদির মাইলো/ সবাই মিলি খাইলো/ উদরাময় হইলো।'

ভোট নিয়ে এই ছড়াযুদ্ধ বাংলা সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে গেছে। ১৯৭৭ সালে জাতীয় কংগ্রেস লোকসভা ভোটে হেরে যায়। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে আবার কংগ্রেস জয়ী হয় এবং ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পুনর্নিবাচিত হন। এই ঘটনায় রাজ্যের কংগ্রেসীদের বুকের ছাতি কয়েক ইঞ্চি ফুলে উঠলো। পরের বিধানসভায় তাদের দৃপ্ত দেওয়াল লিখন, 'রায়বেরিলি ভুল করেছিল, চিক্নাগালুর করেনি/ সিপিআইএম মনে রেখো, ইন্দিরাজি মরেনি।' ওই সময়েই বামফ্রন্ট লিখল, 'হবে বাম হবে বাম হবে বাম হবে হবে।' তার উত্তরে কংগ্রেসিদের মধুর জবাব, 'হবে কষ্ট হবে কষ্ট হবে কষ্ট হবে হবে।'

এরপর পশ্চিমবঙ্গে শুরু হল দীর্ঘ বামশাসন। একসময় কংগ্রেস লিখল, 'চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে/ ছাদনা তলায় কে?/ হাতি নাচছে, ঘোড়া নাচছে/ জ্যোতিবাবুর বে।' সঙ্গে সঙ্গে বামফ্রন্টের জবাব, 'ঠিক বলেছিস ঠিক বলেছিস ঠিক বলেছিস ভাই/ ইন্দিরাকে ছাদনাতলায় সাজিয়ে আনা চাই।' আবার কখনও কখনও ব্যক্তিগত আক্রমণ খেলার নিয়ম ভেঙে 'বিলো দ্য বেল্ট' হয়ে যেত। এরকম একটা উদাহরণ, 'দেহের শত্রু প্যাঁচড়া খোস/ দেশের শত্রু জ্যোতি বোস।' তবে সর্বকালের সেরা দেওয়াল লিখন বোধহয় বফর্স কেলেঙ্কারির প্রেক্ষিতে 'গলি গলি মে শোর হ্যায়/রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়।'

২০০৯ সালে লোকসভা ভোটে কংগ্রেস আর তৃণমূল জোট করে। সঙ্গে সঙ্গে বামফ্রন্টের ব্যঙ্গোক্তি- 'হাত উঠেছে ফুল ফুটেছে/ জোট করেছে কে!/ দিদি নাচছে দাদু নাচছে/ দেশ ভোগে যাক গে।' তৃণমূলের উত্তর, ‘টাটা আর ন্যানো গেল/ বাংলা হল শুদ্ধ/ আর কটা দিন সবুর করো/ এবার যাবে বুদ্ধ।' বামফ্রন্টের জবাব, 'দিদিরা যখন ন্যানো তাড়ায়/ দাদারা যায় সাথে/ বেকার যুবক ভোট দেবেনা/ ফুলে কিংবা হাতে।'

২০১১ সালে সারা রাজ্য জুড়ে পালাবদলের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। দুই যুযুধান প্রতিপক্ষ বিনা যুদ্ধে কাউকে সূচ্যগ্র মেদিনী ছাড়তে নারাজ। তৃণমূলের দেওয়াল লিখন, 'মাসিক বেতন বিশ হাজার/ বিপিএল পায় তারা/ রিকশা চালায় যে বন্ধুরা/ ঘৃণার পাত্র তারা/ ঘর নেই চাষ নেই/ পায় না খেতে ভাত/ সিপিএমকে ভোট না দিলে/ কেটে নেবে হাত।' ওই সময়ে তৃণমূলের যে দেওয়াল লিখনটি সবচেয়ে বেশি হিট করেছিল, '১৯৭৭ নং বামফ্রন্ট ডাউন লোকাল ৩৪ নং প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যাচ্ছে, ২০১১ নং আপ মা-মাটি-মানুষ এক্সপ্রেস ঐ প্ল্যাটফর্মে আসছে।' অন্যদিকে পরিবর্তন আসার কিছুদিন পর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হল, 'কী পরিবর্তন আনলে কাকা/ বাজার করতে পকেট ফাঁকা!'

গদি হারিয়ে ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের দেওয়াল লিখন আরোও আক্রমনাত্মক হয়ে উঠলো৷ তৃণমূল নেত্রী দিল্লি জয়ের স্বপ্ন দেখছেন। বামফ্রন্ট লিখল, 'মানুষের পাশে আছে কাস্তে হাতুড়ি/ সেই দেখে মুষড়ে পড়েছে মুকুল/ দিল্লির স্বপ্ন দেখোনা দিদিমনি/ বাংলার মানুষ করবে না আর ভুল।' এর সাথে তিনবছরের ব্যর্থ শাসনকে কটাক্ষ করে, 'যে বেকারের জ্বলছে পেট/ ঘুষ না দিয়ে পায়নি টেট/ সেই বেকারেরা দিচ্ছে ডাক/ তৃণমূল সরকার নিপাত যাক।' বিজেপিও দেওয়াল যুদ্ধে সামিল হল, তৃণমূল ও বামফ্রন্টকে বিদ্ধ করে তাদের দেওয়াল লিখন, 'বন্ধু, পরিবর্তন কাহারে কয়!/ সিপিআইএম হল তৃণমূল/ প্রকৃত তৃণমূল হল নির্মূল/ 'মা' সইবে না আর ভুল/ 'মাটি'-তে ফুটবে না আর জোড়া ফুল/ 'মানুষ' করবে না আর ঐতিহাসিক ভুল/ এখন একমাত্র বিকল্প পদ্মফুল।' রাজ্যে নারী নিরাপত্তাহীনতার ভয়ংকর অবস্থার দিকে আঙুল তুলে বামফ্রন্ট লিখল, 'ভাইয়ের আয়ু বাড়বে বলে/ ফোঁটায় ফোঁটায় বর্ষণ/ বোনের জন্যে থাকে কেবল/ ইভ-টিজিং আর ধর্ষণ।' নরেন্দ্র মোদীর সার্বিক ইমেজকে ব্যবহার করে ওই লোকসভা ভোটে বিজেপি লিখল, 'দুপুর গেল সন্ধ্যা হল/ ফিরল পাখি বাসায়/ পথ চেয়ে বসে আছি/ নরেন্দ্র মোদীর আশায়/ ঢোল বাজায় কাঁসি বাজায়, বাজায় বিরোধী দল/ উঠছে মোদীর ঝড়, পারবি কি রুখতে/ ক্ষমতা থাকলে বল?’ এইসব বিরুদ্ধ বক্তব্যের জবাবে তৃণমূলের দেওয়ালে ফুটে উঠলো, 'হাত হাতুড়ি কাস্তে তারা/ এবার হবে বাংলা ছাড়া/ ফুটবে নাকো পদ্মফুল/ ভারত গড়বে তৃণমূল।' সেই সময় তৃণমূলের সবচেয়ে স্মার্ট দেওয়াল লিখন ছিল 'ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল/ সব কেন্দ্রে তৃণমূল।'

২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বামফ্রন্টের পতন আর বিজেপির উত্থান ঘটল। ভোট যুদ্ধটা শুরু হল মূলতঃ মোদী আর মমতাকে ঘিরে। তৃণমূল তাদের প্রচারে মোদীজিকে নিশানা করল- 'বঙ্গে আসছে ঝড়, ভাঙবে মোদীর ঘর, বাংলা দেখাল পথ, ছুটবে দিদির রথ, দিদির বিকল্প নেই, ভারতে তৃণমূল চাই।' এছাড়া তৃণমূল নেত্রী 'দু হাজার উনিশ, বিজেপি ফিনিশ' স্লোগানের মধ্য দিয়ে সারা দেশে শাসক বিরোধী হাওয়া তুলেছিলেন৷ বিজেপি নেতৃত্ব দেওয়াল লিখনকে পাত্তা না দিয়ে আসল কাজ সেরে রাজ্যের আঠারোটি আসন দখল করে তৃণমূল সরকারকে পরবর্তী বিধানসভার আগে চরম বার্তা দিয়ে গিয়েছিল৷

ছোটবেলার একটা স্লোগানের কথা মনে পড়ল, 'দিল্লি থেকে এল গাই/ সঙ্গে বাছুর সিপিআই।' সেই ধারা বজায় রেখে প্রতিটি ভোটই শুরু হয় একটা 'ট্যাগলাইন' দিয়ে। ২০২১ সালের বিধানসভার ট্যাগলাইন হল 'খেলা হবে'। ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলি এই ট্যাগলাইনের সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়ে শিলিগুড়ি থেকে সিঙ্গুর, ফলতা থেকে ফারাক্কার দেওয়াল ভরিয়ে তুলেছে। এবারে বিজেপিকে টার্গেট করা ছাড়াও তৃণমূল বিদ্ধ করেছে দল ছেড়ে যাওয়া নেতাদের। একটা পোস্টারে লেখা, 'মার ঝাড়ু মার, ঝাড়ু মেরে, ঝেঁটিয়ে বিদেয় কর, যতসব মীরজাফর...'৷ খেলা নিয়ে দক্ষিণ কলকাতার এক দেওয়ালে দেখা গেল, 'খেলবে তুমি, খেলব আমি/ খেলবে আম জনতা/ পাহাড় থেকে সাগর বলছে/ নবান্নে ফের মমতা।' দেওয়াল লিখনে বিজেপিও পিছিয়ে নেই। পূর্ব মেদিনীপুরে পতাশপুরে দলীয় প্রার্থীর সমর্থনে তারা লিখেছে, 'শিক্ষক পেটায় রাস্তায় ফেলে/ চাইলে ডিএ কুকুর বলে/ মিথ্যা গর্ব নিজেকে নিয়ে/ বাংলা চায়না এমন মেয়ে।' বোঝাই যাচ্ছে এই বার্তা তৃণমূলের 'বাংলা নিজের মেয়েকেই চাই'-স্লোগানের এক সপাট জবাব। শাসকদল স্বাভাবিক কারণেই দশবছরের শাসনে যা কিছু করেছে তার খতিয়ান দিয়ে ছড়া বুনছে। উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর কেন্দ্রের এক দেওয়ালে লেখা- 'দু টাকা কিলো চাল পায়/ সবুজ সাথী স্কুলে যায়/ কন্যাশ্রী লেখাপড়ায়/ স্বাস্থ্য সাথী রোগ সারায়/ জিতবে বাঙালি এই বাংলায়/ বাংলা তার মেয়েকেই চায়।' ঠিক তার পাশে বিজেপির পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে বিনীত আহ্বান- 'দশটা বছর চোরকে দিলেন/ চৌত্রিশ বছর বাম/ পাঁচটা বছর দিয়েই দেখুন/ কেমন রাখে রাম।'

তথ্যঋণ: ইন্টারনেট

 

ডঃ গৌতম সরকার
অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক
যোগমায়া দেবী কলেজ, কলকাতা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top