সিডনী মঙ্গলবার, ২৩শে এপ্রিল ২০২৪, ১০ই বৈশাখ ১৪৩১

পহেলা বৈশাখ : এস ডি সুব্রত


প্রকাশিত:
১৫ এপ্রিল ২০২১ ২১:৩৭

আপডেট:
১৫ এপ্রিল ২০২১ ২১:৪৬

ছবিঃ এস ডি সুব্রত

 

ইতিহাস ঐতিহ্য আর উৎসব পার্বণের দেশ প্রিয় বাংলাদেশ। অতিথি পরায়ণ আর উৎসব প্রিয় বাঙালির সত্তায় অনুভবে জড়িয়ে আছে নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ। বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। মিশে আছে বাঙালির শেখরে , মিশে আছে বাঙালির আত্মার সাথে একাত্ম হয়ে। পহেলা বৈশাখ আমাদের জাতি সত্তা, চেতনা আর অনুভবে মিশে আছে প্রবলভাবে।বালার চিরায়ত জীবন যাপনের এক সার্বজনীন উৎসব বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখ এখন গ্রাম থেকে ছড়িয়ে পড়েছে নগর জীবনে এক অপরূপ নান্দনিকতা নিয়ে ‌।তবে নববর্ষের এই রুপ অনেক আগে এরকম ছিল না। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সমাজের পরতে পরতে এখন মিশে আছে নববর্ষ পহেলা বৈশাখ।

বাংলা নববর্ষের প্রবর্তন কখন কে কিভাবে করেছেন ,তা নিয়ে ঐতিহাসিক পণ্ডিত ও গবেষকদের মধ্যে রয়েছে নানা মত। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ইতিহাসের  মতই বাংলা নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ প্রবর্তিত হয়েছে মুল্য শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্টপোষকতায়। নানা প্রেক্ষিত থেকে বাংলা সন তথা পহেলা বৈশাখের যে ইতিহাস পাওয়া যায় তার প্রেক্ষিতে বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে এর প্রবর্তক মোঘল সম্রাট আকবরকেই স্বীকৃতি দেয়া হয়। তবে এর পটভূমি তৈরির পেছনে সুলতান হোসেন শাহ ,রাজা শশাঙ্ক এবং তিব্বতের রাজা স্রংসনের

অবদানের কথা পাওয়া যায় গবেষক দলের গবেষণা ও ইতিহাস থেকে।

৫৯৮: হিজরী তে মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের ফলে হিজরী সন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পায় । হিজরী সনে চন্দ্র বর্ষ অনুযায়ী দিন গণনা করা হতো ‌ 

গবেষকদের ব্যাখা বিশ্লেষনে মোঘল সম্রাট আকবরের ভূমিকা উঠে এসেছে স্পষ্টভাবে। গবেষকগণ সম্রাট আকবরের সভাজন আবুল ফজলের " আইন -ই- আকবরী " গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন.......  সম্রাট আকবর প্রজাদের চাষাবাদে চন্দ্র বছর হিজরী সন ব্যবহারের অসুবিধা বিষয়ে অবগত হন। তিনি হিজরী সন ব্যবহারের বিরোধী ছিলেন। সম্রাট আকবর বহুদিন ধরে হিন্দু স্থানের বিভিন্ন অঞ্চলের দিন গণনার সমস্যা কে সহজ  করে দেয়ার জন্য একটি নতুন বছর ও মাস গণনা ক্রম প্রবর্তন করতে আগ্রহী ছিলেন। সম্রাট আকবরের "ইলাহী সন বা অব্দ " হল সাধারণ কৃষক দের মাঝে চাষাবাদের সুবিধার জন্য প্রবর্তিত দিন মাস গণনার একটি সমন্বিত রূপ।১৫৫৬ সালে সম্রাট আকবর যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন ছিল হিজরী ৯৬৩ । তার সিংহাসনে আরোহণ এর সময় থেকে চন্দ্র বর্ষ হিজরী র পরিবর্তে সৌর বর্ষ " ইলাহী সন' গণনা শুরু হয়। ইলাহি  বর্ষ এর পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত রুপই হল বাংলা সন। মোঘল আমলে রাজারা খাজনা আদায় করত চন্দ্র বর্ষ অনুযায়ী। চাঁদের উদয় অস্ত অনুযায়ী  গননা করা হয় চন্দ্র বর্ষ। আরবী হিজরী সন হল চন্দ্র বর্ষ। অন্যদিকে সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর পরিক্রমনের উপর ভিত্তি করে হিসাব করা হয় সৌর বর্ষ। সেই সময়ে চন্দ্র বর্ষ অনুযায়ী কৃষককে  খাজনা দিতে হতো। কিন্তু কৃষকের ফসল ঘরে তুলতে পারতো নির্দিষ্ট সময় পর পর। চন্দ্র বর্ষ প্রতি বছর ১১ দিন করে এগিয়ে যেতো।ফলে কৃষকের খাজনা দেয়া ও ফসল তোলার মধ্যে একটা সমস্যা তৈরি হতো। কৃষকের খাজনা  দিতে সমস্যা হতো। সম্রাট আকবর সে সমস্যা সমাধানের জন্য সে সময়ের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ সিরাজীকে  দায়িত্ব দেন। ফলশ্রুতিতে ১৯৮৪ সালের ১১ই মার্চ " ইলাহী সন " নামে নতুন সন চালু হয়। তখন সেটা ফসলী সন নমেও পরিচিতি পেয়েছিল  যা পরবর্তীতে বঙ্গাব্দ  বা বাংলা সন নামে পরিচিতি পায়।

কোন কোন পণ্ডিত বাংলা সন প্রবর্তনে গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক , তিব্বতের রাজা স্রংসন এবং সুলতান হোসেন শাহ কে কৃতিত্ব দেন। কোন কোন পণ্ডিত দের মতে শশাঙ্ক ৫৯৪ খ্রীষ্টাব্দে র ১২ এপ্রিল স্বাধীন রাজত্ব শুরু করেছিলেন। এবং তখন থেকেই বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়েছিল।অন্য পণ্ডিতদের মতে স্রংসন নামে এক তিব্বতী রাজা ৬০০খ্রিষ্টাব্দের কিছু আগে মধ্য ও পূর্ব ভারত জয় করে তিনি তিব্বতের কৃষি কাজের প্রচলিত রীতি ভারতবর্ষে চালু করেন ।স্রংসনের  নামের শেষাংশ থেকে সন শব্দ টি এসেছে বলে তারা মত দেন। অপর এক দল পণ্ডিত মনে করেন সুলতান হোসেন শাহ এর আমলে বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন চালু হয়। সুলতান হোসেন শাহ নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করতেন।তার আমলেই প্রথম কৃষকদের  " ফসলী সন " শাসকগোষ্ঠীর সহযোগিতা ও আনুকূল্য পায় ।

 শশাঙ্ক, স্রংসন ও হোসেন শাহের বাংলা সন প্রবর্তনের বিষয়টি লোকমুখে প্রচলিত এবং অনেকটা অনুমান নির্ভর। কিন্তু সম্রাট আকবরের বাংলা সন প্রবর্তনের বিষয়টি আবুল ফজলের " আইন-ই- আকবরী " তে  উল্লেখ থাকায় বেশীরভাগ গবেষক, অর্থনীতি বিদ ও পণ্ডিত সম্রাট আকবরের বাংলা সন প্রবর্তনের বিষয়টি সমর্থন করেন।

 পহেলা বৈশাখ বাংলা প্রথম মাসের প্রথম দিন। তাই এটা বাংলা নববর্ষ। দিনটি বাংলাদেশ সহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা,আসামে নববর্ষ হিসেবে পালন করা হয়। আগের কৃষি কাজের ফসলী সন আজকের বাংলা সন শুরু হতো অগ্রহায়ণ মাস থেকে।তখন কৃষকেরা মাঠের ফসল ঘরে তুলে নববর্ষ উৎসবে মেতে উঠত। কৃষকের এই ফসলী সন কে নতুন করে বিন্যস্ত করেন সম্রাট আকবর। ঐতিহাসিক দের মতে সম্রাট আকবরের সময় থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে কৃষকদের খাজনা মাশুল পরিশোধ করতে হতো। এবং পরের দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ ভূমি মালিকগণ  নিজ নিজ অঞ্চলের লোকজনদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন এবং উৎসবের আয়োজন করতেন।তখন এ উৎসবের একটা প্রধান ঘটনা ছিল হালখাতা। তখন  পহেলা বৈশাখে গ্রামীন সমাজে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হতো।নগর জীবনে এ উৎসব তখন অনুপস্থিত ছিল। কলকাতা ও ঢাকায় প্রথম নববর্ষ পালন করা হয় ১৯১৭ সালে। ছায়ানটের বর্ষবরণ শুরু হয় ১৯৬৭ সালে। চারুকলা ইনস্টিটিউটের মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয় ১৯৮৯ সাল থেকে যা পহেলা বৈশাখের এক অন্যতম আকর্ষণ এখন পর্যন্ত। ১৯৭২ সাল থেকে পহেলা বৈশাখ জাতীয় উৎসবের মর্যাদা পায়।১৯৮৮ সালের ১৯ জুন থেকে বাংলা একাডেমি র সুপারিশ করা পঞ্জিকা গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ নববর্ষ পালন করা হয়।

 

এস ডি সুব্রত
কবি ও প্রাবন্ধিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top