সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

কুকুর : কান্তি ভূষণ তরফদার


প্রকাশিত:
৬ মে ২০২১ ২৩:৩১

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ২০:৪৮

 

বাসা থেকে বেরিয়ে গলির মাথায় আসতেই একটা কুকুর আমার পিছু নেয়া শুরু করলো। কুকুরটা বুবুক্ষ, জরাজীর্ণ। ভ্রূক্ষেপ না করে হাঁটা শুরু করলাম। গন্তব্য ২০০ মিটার দূরবর্তী চায়ের দোকনটা। এদিকে রাত বারোটার পর এই একটা দোকানই খোলা থাকে। চায়ের পিপাসা আর মধ্যরাতের অযাচিত খিদে মেটানোর জন্য এটাই একমাত্র ভরসা। দোকানের কাছে পৌঁছাতেই খেয়াল করলাম কুকুরটা এখনো পিছু ছাড়েনি। মনে মনে একটু বিরক্ত হলাম। ঢাকা শহরে এরকম কুকুর হরহামেশায় চোখে পড়ে। যেগুলো প্রচন্ডরকম ভীতু আর নিরীহ। পা দিয়ে মাটিতে একটা লাথি দিলেই ছিঁটকে দূরে সরে যায়। এই কুকুরটাকে ব্যাতিক্রম মনে হলো। ব্যাতিক্রম মনে হলো এই কারণে, ও বাসা থেকে বেরোনোর পর এ পর্যন্ত পুরোটা পথ আমাকে অনুসরণ করেছে। ওর চাহনিতে একটা নিদারুণ অসহায়ত্ব, যেটা সচারচার সব কুকুরের মধ্যেই থাকে, ওর ক্ষেত্রে একটু বেশিই মনে হচ্ছে। 

ঢাকা দক্ষিণের নগরপিতা ঘোষণা দিয়েছেন শহর থেকে কুকুর অপসারণের। বুঝলাম না, জগতের এতকিছু থাকতে এই নিতান্ত নিরীহ প্রানীটির উপর তাঁর চোখ পড়ল কেন! মশার কামড়ে শত শত লোক ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে, ময়লা-আবর্জনায় ভরে যাচ্ছে পুরো ঢাকা শহর, এসব অপসারণের দিকে উনার দৃষ্টিপাত নেই! একারণেই চাণক্য বলেছেন, 'সবচেয়ে সোজা গাছটায় আগে কাটা হয়।' মেয়র সাহেবের কিছু সমর্থকও জুটে গিয়েছে। যারা পোষ্টার, ব্যানার ছাপিয়ে জোর গলায় কুকুর অপসারণের দাবি জানাচ্ছে। অবশ্য হিটলারের 'সবুজ চোখের দর্শনেও' লক্ষ লক্ষ মানুষ সমর্থন জানিয়েছিল। নিধন করা হয়েছিল লক্ষ লক্ষ অনার্যকে। মাও সে তুংয়ের হঠকারী সিধান্তে নিধন করা হয়েছিল লক্ষ লক্ষ 'ফসল বিনষ্টকারী' চড়ুই! 

কেউ কেউ দাবি তুলছেন কুকুর তাদের চলার পথে বাধা সৃষ্টি করছে। এই শহরেই লক্ষ লক্ষ পথশিশু ফুটপাতে, রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দৃশ্যত কুকুর আর তাদের জীবনাচরণের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তাহলে কি এইসব যাযাবর, চলার পথে বাধাসৃষ্টিকারী,  বেওয়ারিশ শিশুদেরকেও নিধন করা হবে? এইসব ভাবতে ভাবতে প্রচন্ড খিদে লেগে গেল। রুটি-কলায় এই খিদে মিটবে না। বাজারগেটের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। এক কিলোমিটার। ক্ষুধার্ত পথিকের কাছে অনেক পথ। কুকুরটা যথারীতি আমাকে অনুসরণ করে চলেছে। ভাবছি এই শহরে একজন ধর্ষকের, একজন লুটেরার, একজন খুনীর, একজন মুখোশধারী ভালো মানুষের জায়গা হয়, অথচ একটি অবলা কুকুরের জায়গা নেই! সবাই সোজা গাছটাকেই আগে কাটতে চায়, ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতে চায় না। 

বাজারগেটে এসে প্রচন্ড হতাশ হলাম। যা ভেবেছিলাম তাই। গেট বন্ধ। দারোয়ান কোনোভাবেই বারোটার পর গেট খুলবে না। চার নাম্বার গেটের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। আরো আধা কিলোঃ। মগজ খাবারের জন্য মানসিকভাবে তৈরী হয়ে গেছে, যা ক্ষুধাকে আরো তীব্র করে তুলছে। না খেয়ে আর কিছুতেই ফেরা সম্ভব না। যেহেতু এতটা পথ এসে পড়েছি। এসময় বাজারগেটে একটা দোকানই খোলা থাকে। ওখানকার ডিম-খিচুড়িটা চমৎকার! কিন্তু হায়! সে পর্যন্ত পৌঁছাতে তো হবে! 

চার নাম্বার গেটে এসেও বিফল হলাম। দারোয়ান গেট খুলতে অপারগ। এতরাতে গেট খুললে তার বেতন কাটা পড়বে। অন্যের বিনিদ্র রাতের কষ্টার্জিত উপার্জন কাটা পড়ুক তা চাই না। দ্বাররক্ষীকে দ্বিতীয়বার তোষামোদ না করে চলে আসলাম। এখন বাজারগেটে ঢোকার একটাই পথ। দুই নাম্বার গেট দিয়ে হেঁটে আসতে হবে। রাতে এই একটা গেটই খোলা থাকে। ওদিক দিয়ে ঘুরে আসতে হলে দুই কিলোমিটার হাঁটতে হবে। এতরাতে রিকশা নেই। অগত্যা পেটের ভেতর আগ্রাসী ক্ষুধা জিঁইয়ে রেখেই ফেরার পথ ধরলাম। কুকুরটাও যথারীতি সঙ্গ নিলো। এখন আর ওর সঙ্গ বিরক্তিকর লাগছে না। মাঝে একবার ভেবেছিলাম তাড়িয়ে দিই। তা আর হয়ে ওঠেনি। 

আমার কুকুরভীতি নেই। অনেকে কুকুর দেখলে ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। ছোটবেলায় একটা কুকুর আমার বুকের উপর উঠে কামড়েছিলো। আমার এক কাকা বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে কুকুরটাকে মেরে ফেলে। পাগলা কুকুর। আরেকবার শীতের সময় আমার এক বন্ধুর সাথে বাড়ির উঠোনে খেলা করছিলাম। এক মাদী কুকুর দূর থেকে ভেবেছে আমরা তার বাচ্চাদের বিরক্ত করছি। সে ছুটে এসে আমার বন্ধুকে কামড়ে দেয়। ফলে তাকেও পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। তার সদ্য প্রসূত বাচ্চাদের অবোধ্য আর্তনাদ কেউ শোনেনি। 

আবার চায়ের দোকানটাতে এসে বসলাম। খিদেই পেট চোঁ চোঁ করছে। এক নিমিষে দুইটা পাউরুটি, একটা কেক সাবাড় করলাম। পেটের ভিতর যুদ্ধের দামামা থামলো। উদরপূর্তির পর উঠে দাঁড়ালাম। বাসায় ফিরতে হবে। বেঞ্চ ছেড়ে উঠতেই দেখি কুকুরটা অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে। ওর খালিপেট পিঠের সাথে লেগে যাওয়ার অবস্থা। দৃষ্টিজুড়ে ক্ষুধার জ্বালা। কিছুক্ষণ আগে নিজের ক্ষুধার্তাবস্থার কথা মনে পড়ে গেল। দোকান থেকে একটা কেক নিয়ে ওর দিকে ছুঁড়ে দিলাম। ও বিদ্যুৎগতিতে কেকটার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে চোখের পলকে কেকটা গিলে ফেলল। তারপর সুকরুণ চোখ তুলে আমার দিকে তাকালো। আরো একটা কেক ছুঁড়ে দিলাম।

ফেরার পথে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগলাম, আমি না হয় শহরের একটা কুকুরের ক্ষুধা নিবারণ করলাম, বাকি কুকুরগুলোর ক্ষুধা মেটাবে কে?

 

কান্তি ভূষণ তরফদার
সহকারী পরিচালক, বাংলা নাটক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top