সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

চোর-পুলিশ : প্রচেত গুপ্ত


প্রকাশিত:
১৩ মে ২০২১ ০১:৫৮

আপডেট:
১৩ মে ২০২১ ০৮:০৬

ছবিঃ প্রচেত গুপ্ত

 

আমাদের টেনশন হচ্ছে। টেনশনের কারণ একটা নয়, দুটো। এক নম্বর কারণ, ঠিক দশদিন পরেই শুরু হচ্ছে। আর দুনম্বর কারণ হল, গত দু-বছরে আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। এবারও যদি হতে পারি তাহলে পরপর তিনবার হবে। একেবারে হ্যাটট্রিক। হ্যাটট্রিকের সম্মানই আলাদা। সকলেই তাকিয়ে আছে, আমরা কি পারব? এতে টেনশন ডবল হয়ে গিয়েছে।

আমরা অবশ্য খুব পরিশ্রম করেছি। গত এক মাস ধরে খেটেছি। কিন্তু শুধু নিজেরা খাটলেই তো হবে না। যাঁদের সঙ্গে লড়তে যাচ্ছি তাঁদের ক্ষমতাটাও তো দেখতে হবে। আমাদের থেকে ‘অন্যরা’ কীসে কীসে এগিয়ে আছে জানতে হবে। ‘ওদের’ খবরাখবর পাওয়ার জন্য আমরা গুপ্তচর লাগিয়েছিলাম। গুপ্তচরের নাম সুমন মুনশি। ফুলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাস নাইনের ছাত্র সুমন বোকাসোকা মুখ করে আমাদের ‘শত্রু শিবির’ গুলোতে ঘুরেছে আর ‘গোপন সংবাদ’ এনেছে। এতদিন যেসব খবর পেয়েছি সেগুলো নিয়ে চিন্তা নেই, কিন্তু কাল বিকেলে সুমন যা বলল তাতে আমাদের মাথার চুল খাড়া হয়ে গিয়েছে। ঘটনা সত্যি হলে বিপদ। আমাদের ‘হ্যাটট্রিক’ করার আশায় ছাই পড়বে। এই কারণে আজ সন্ধেবেলা আমাদের জরুরি মিটিং বসছে। বিপদ থেকে বাঁচার পথ খোঁজা হবে।

ঘটনা প্রথম থেকে বলি।

এক-একটা জায়গার এক-এক কারণে নামডাক হয়। যেমন পবনপুরের খ্যাতি ফুটবল ম্যাচে। ফুটবল ম্যাচ নিয়ে সেখানে একমাস ধরে হইহই চলে। আশপাশের কুড়ি-পঁচিশটা ক্লাব নাম দেয়। খেলার দিনগুলোতে দর্শকে মাঠ একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। ফাইনালের দিন তো এলাহি কান্ড হয়। আবার মল্লিকডাঙ্গার খ্যাতি হল দুর্গাপুজোয়। সেখানকার ক্লাবগুলো দারুণ জাঁকজমক করে পুজো করে। মনভরানো প্রতিমা, চোখধাঁধানো আলো অবাক করা মন্ডপ। সঙ্গে প্রতিদিন পাত পেড়ে খাওয়া, ধুনুচি, নাচ, জলসা, যাত্রা। পুজো নিয়ে ক্লাবগুলোর মধ্যে রেষারেষিও আছে। কার প্রতিমা ভালো, কার আলো বেশী ঝলমলে। পুজোর ক-দিন সুযোগ পেলেই আমরা মল্লিকডাঙ্গায় ছুটি। আবার কল্যাণগড়ের নাম মাছ ধরায়। সেখানে বড়ো-বড়ো দিঘি রয়েছে। গোটা আষাঢ় মাস জুড়ে মাছ ধরার কম্পিটিশন হয়। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ে। দিঘির পাড়ে ঢাউস ছাতা মাথায়, হাতে ছিপ নিয়ে সবাই বসে থাকে। ছিপগুলোও যেমন-তেমন নয়, জাম্বো ছিপ। মাছ টোপ গিলে ছুট মারলে ছিপের হুইল বনবন করে ঘোরে, বাতাসে শনশন করে আওয়াজ হয়। মাছ ধরার লোভে কলকাতা থেকেও অনেকে আসে। রবিবার হাইওয়েতে গাড়ির ভিড় লেগে যায়। আমাদের ফুলপুরও নাম করেছে। তবে ফুটবল, দুর্গাপুজো বা মাছ ধরায় নয়, নাম করেছে নাটকে। পাঁচ বছর ধরে আমাদের এখানে ‘একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতা’ শুরু হয়েছে। হাইস্কুলের মাঠে স্টেজ বানিয়ে প্রতিযোগিতা হয়। প্রথম এক-দু-বছর জমতে একটু সময় লেগেছিল। বেশি কেউ নাম দিত না। একদিনেই প্রতিযোগিতা শেষ হয়ে যেত। এখন চলে টানা তিনদিন। ফুলপুরের ছোটো, বড়ো, মেজো সব ক্লাবই নাম দেয়। এই প্রতিযোগিতার কারণে ফুলপুরে বেশ কয়েকটা নাটকের দলও গড়ে ঊঠেছে। রোজ দুটো করে নাটক হয়। তারপরও চাপ বাড়ছে। কে জানে এরপর হয়তো সাতদিন ধরে চলবে।

এই তিনদিন ফুলপুর উৎসবে মেতে ওঠে। রাস্তার মোড়ে-মোড়ে রঙিন পতাকা, সঙ্গে আলো। হাইওয়ে আর রেলস্টেশনের সামনে বিরাট-বিরাট গেট। সেখানে বড়ো-বড়ো করে লেখা, ‘ফুলপুর নাটক প্রতিযোগিতা’। স্কুল মাঠের পাশে মেলা বসে যায়। শুধু যে এই তিনদিনের জন্য ফুলপুর নাটক নিয়ে মেতে থাকে তা কিন্তু নয়। পাড়ায়-পাড়ায় রিহার্সাল চলে প্রায় এক মাস ধরে। কোনো-কোনো ক্লাব, দল তাঁর চেয়েও বেশি সময় নেয়। এই সময় বাইরের কেউ যদি ফুলপুরে আসে, তাহলে ঘাবড়ে যেতে পারে। এক-একটা পাড়ায় এক-একরকম ডায়লগ, এক-একরকম আওয়াজ। কোনো ক্লাবঘরে রাজার হুঙ্কার, কোনো বন্ধ জানালার ওপাশে ভূতের হাসি। কোথাও আবার হেডমাস্টারমশাইয়ের ধমক কোথাও স্বাধীনতা সংগ্রামীর ভাষণ, কোথাও বাউল গান, কোথাও ব্যান্ডের গিটার। কোনো গলিতে হয়তো পরিচালকের চিৎকার শোনা যাচ্ছে দূর থেকে। কোনো বাড়ির একতলা থেকে ভেসে আসে প্রম্পটারের ফিসফিসানি। স্টেজে, উইংসের আড়ালে দাঁড়িয়ে নীচু গলায় প্রম্পট করতে হবে, তাই রিহার্সালেও এক কায়দা। এত কিছু শুনে ফুলপুরের নতুন অতিথি চমকে যেতেই পারেন। সেইসঙ্গে অবশ্য আনন্দ পাবেন। ফুলপুর থেকে ফিরে গিয়ে তিনি সকলকে বলবেন, ‘দারুণ একটা ব্যাপার দেখে এলাম। বাপ রে ! নাটক নিয়ে সবাই খেপেছে!’

ফুলপুর নাটক প্রতিযোগিতায় পর পর দু-বার জিতে যাওয়ায় অন্যরা আমাদের হিংসে করে। আমরা বয়সে অনেকের চেয়েই ছোটো। তবুও আমরা জিতেছি। আমরা কী করব? বিচারকরা এসেছিলেন বাইরে থেকে। তারা সকলে নাটকের এক-একজন নামি মানুষ। কেউ অভিনয় করেন, কেউ পরিচালক, কেউ স্টেজ সাজান। তাঁরা তিনদিন ধরে অত নাটক দেখে আমাদের নাটককেই সেরা বলেছেন। নিশ্চয়ই সবদিক বিচার করেই বলেছেন। আমরা কী করব?

আসলে আমাদের সবচেয়ে বড়ো গুণ হল, আমরা নিজেরাই সব করি। নিজেরা নাটক লিখি। নাটকের ভিতর যেসব গান থাকে আমরা লিখি, সুর দিই। স্টেজ সাজানোর জন্য যা-যা দরকার হয় সেগুলো ভাড়া করি না। অন্য কাউকে দিয়ে বানাইও না। বড়ো-বড়ো বোর্ড, রঙিন কাগজ দিয়ে নিজেরাই তৈরি করে ফেলি। আমাদের দেবরূপ খুব সুন্দর হাতের কাজ পারে, ছবিও আঁকে চমৎকার। ও দৃশ্য বুঝে-বুঝে জিনিস বানিয়ে দেয়। কখনো মুখোশ, কখনো যুদ্ধের ঢাল, কখনো ঝুলন্ত জানলা, কখনো ফাঁসির মঞ্চ। গতবার আমাদের নাটকের নাম ছিল ‘বারান্দা’। সপ্তর্ষির লেখা নাটক। নাটকে একটা বারান্দার কথা আছে। নাটকের দিন দেখি দেবরূপ একটা আস্ত বারান্দা বানিয়ে ফেলেছে! তক্তাপোশের উপর কাঠের রেলিং, পিছনে দরজার ফ্রেম। সেখানে পর্দা। বারান্দার টবে গাছ, খালি খাঁচা আর উপরে একফালি দড়িতে ক-টা জামাকাপড়ও ঝুলছে। নাটকের সময় কেউ পর্দা সরিয়ে প্ল্যাটফর্মটার উপর এসে দাঁড়াচ্ছিল, মনে হচ্ছিল, সত্যি দরজা খুলে বারান্দায় এসেছে। হয়তো এইসব কারণেই বিচারকরা আমাদের পছন্দ করে ফেলেন। অন্যরা হিংসে করলে আমরা কী করব?

আমাদের শত্রু বেড়েছে। সেই কারণে এবার সব কিছু আমরা খুব গোপন রেখেছি। কেউ জানে না এ-বছর আমরা একটা হাসির নাটক নিয়ে প্রতিযোগিতায় যাচ্ছি। চোরের গল্প। লিখেছে সায়ন। গল্পটা ভারি মজার। শ্যামাপদ গড়গড়ি ছাপোষা, ভালোমানুষ। একদিন মাঝরাতে তাঁর ঘরে চোর ঢুকেছে। খুটখাট আওয়াজে শ্যামাপদবাবুর ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ খুলে দেখেন চোর হাতুড়ি, স্ক্রুড্রাইভার, করাত দিয়ে আলমারি খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু আলমারি কিছুতেই খুলছে না। বেচারি ঘেমে গিয়েছে। গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছছে। চোরের এই পরিশ্রম দেখে মায়া হয় শ্যামাপদ বাবুর। তিনি চোরকে আলমারির চাবি দিতে চান। মজার ব্যাপার হল, চোর কিছুতেই নেবে না। সে বলল, “আমি চোর বলে কি আমার প্রেস্টিজ নেই স্যার? আমি ভিক্ষে করে আপনার কাছ থেকে চাবি নেব? তারপর সেই চাবি দিয়ে আলমারি খুলে চুরি করব? ছি ছি!”

শ্যামাপদবাবু বললেন, ‘আহা, তুমি তো চাইছ না, আমি নিজে থেকেই দিচ্ছি। রাত জেগে এত কষ্ট করছ দেখে আমার খারাপ লাগছে। নাও, লজ্জা কোরো না, চাবি ধরো”।

চোর বলল, ‘তা হবে না স্যার। চোরের নিয়মই হল নিজের কায়দায় কাজ করা। নিজের কায়দায়তেই সে জানলার গ্রিল ভাঙবে, নিজের কায়দাতেই দরজার ছিটকিনি খুলবে, নিজের কায়দাতেই আলমারির সিন্দুক ভাঙ্গবে। তারপর চুরির কাজ সেরে নিজের কায়দাতেই ছাদ টপকে পালাবে। এত সব কায়দা শেখার জন্য ওস্তাদের কাছে ট্রেনিং নিয়েছি। এখন যদি আপনার কাছ থেকে চাবি চেয়ে নিয়ে চুরি করি, তাহলে সেটা বিরাট লজ্জার ব্যাপার হবে। সবাই জানবে, আমি চুরির কায়দাকানুন কিছুই শিখিনি। চোর মহলে আমার নাম হবে ফেলু চোর। এটা আমি হতে দিতে পারি না স্যার। আমাকে মাপ করবেন। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন’।

শ্যামাপদবাবু বললেন, ‘আরে বাপু! তোমার চিন্তা নেই। আমি কাউকে বলব না’।

চোর কাঁচুমাচু মুখে বলল, ‘এই যে স্যার শব্দ পেয়ে আপনার ঘুম ভেঙ্গেছে তাতেই আমার নম্বর কাটা গেল’।

‘নম্বর! তোমাকে আবার নম্বর কে দেবে?’

চোর এবার কান্না-কান্না গলায় বলল, ‘ওস্তাদ দেবে, আমি স্যার চুরির হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় তিনটে সাবজেক্টে ফেল মেরেছিলাম’।

শ্যামাপদবাবুর চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। তিনি বললেন, চুরির হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা! বল কী হে!’

‘হ্যা স্যার। আমাদেরও রেগুলার পরীক্ষা হয়। পাঁচিল বেয়ে হাঁটা, ধরা পড়লে চোখে লঙ্কার গুঁড়ো ছুড়ে পালানো আর পা টিপে-টিপে ঘুরে বেড়ানো। তিনটে পেপারেই তিরিশের কম পেয়েছি। এখন অ্যানুয়াল পরীক্ষা দিচ্ছি। এবারও যদি পাশ করতে না -পারি, আমাকে স্যার এক ক্লাসেই থাকতে হবে’।

খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের এই নাটক দেখতে-দেখতে দর্শকদের হাসতে-হাসতে গড়িয়ে পড়ার কথা। তাঁর উপর চোরের পার্ট করছে নির্মাল্য। দারুণ করছে। ও এবারও ফুলপুর নাটক প্রতিযোগিতায় সেরা অভিনেতার প্রাইজটা পাবে। নির্মাল্য যে এবার অভিনয় করছে, বাইরের কেউ জানে না। দেবরূপ স্টেজ সাজানোর যা পরিকল্পনা করেছে সেটাও চমকে দেওয়ার মতো। স্টেজের একপাশে একটা জানলা থাকছে। সেখান দিয়ে চাঁদ দেখা যাবে। থালার মতো বড়ো। নাটক যত এগোবে সেই চাঁদ একটু-একটু করে সরে যাবে। একদম শেষে বাইরে ফুটে উঠবে ভোরের আলো। গোপনীয়তা রক্ষা করার জন্য আমরা রিহার্সাল ক্লাবঘরে করছি না। করছি টুটুনের বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে। অন্য ক্লাবের সবাই, ‘কিশোর সংঘ’র ব্যাপারে বিশেষভাবে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করছে। পারছে না। আমাদের সবার মুখে কুলুপ আঁটা। পরিকল্পনা একটু ফাঁস হয়ে গেলেই সর্বনাশ। নকল হয়ে যেতে পারে। হয়তো কোনো দল চোরের ব্যাপারটা নকল করে বসল। কেউ হয়তো শ্যামাপদ গড়গড়ির মতো একটা চরিত্র বানিয়ে নিল, কেউ আবার ওসব কিছু না-করে শুধু জানলার বাইরে ঝুলে থাকা চাঁদটাই টুকে দিল। ব্যস, আমাদের চমক শেষ, মজাও নষ্ট। বিচারকরা ভাববেন, আরে! এ-রকম আগের কোন নাটকে দেখলাম না? এতে যারা নকল করবে তাদের হয়তো কোন লাভ হবে না, কিন্তু আমাদের ক্ষতি হবে। নিজের নাক কেটে পরেরে যাত্রা ভঙ্গ করার মতো। সেই জন্যই এত গোপনীয়তা। এমন সময় সুমন খবর আনল…।

আমি চিন্তিত গলায় বললাম, ‘ছেলেটার নাম কী?’

সুমন বলল, ‘গৌরব। গৌরব নাগ’।

নির্মাল্য ভুরু কুঁচকে বলল, ‘গৌরব! ‘আমরা সবাই’ ক্লাবে গৌরব নামে কেউ আছে বলে তো জানতাম না!’

সুমন গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমি কি ভুল খবর এনেছি বলে তোর মনে হচ্ছে নির্মাল্য?’

নির্মাল্য বলল, ‘হতেই পারে। তুই হয়তো ভুল নাম শুনেছিস’।

সুমন রাগ দেখিয়ে বলল, ‘তাহলে আমি চুপ করে গেলাম, আর কোন কথা বলব না’।

নির্মাল্য ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, ‘না বললে বয়ে গিয়েছে’।

নির্মাল্যকে নিয়ে এই একটা মুশকিল। সুমনের সঙ্গে তার ঝগড়া লেগেই আছে। ছুতোনাতা একটা পেলেই হল। কে বলবে সে সুমনের চেয়ে বড়ো? এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে? আমি হাত তুলে দু-জনকে থামিয়ে বললাম, ‘তোরা তো অদ্ভুত! এখন কি আমাদের ঝগড়া করার সময়? এত বড়ো একটা সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে আর তোরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করছিস!’

দেবরূপ সুমনের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘রাগ করিস না, বল, আর কী খবর পেয়েছিস?’

সুমন ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে বলল, ‘বলব না। আমি যদি ভুল খবর আনি তাহলে সেই খবর শুনে তোদের লাভ কী?’

নির্মাল্য রেগেমেগে বলল, ‘বাড়াবাড়ি করিস না সুমন’।

সুমন চিৎকার করে বলল, ‘একশোবার করব। হাজারবার করব’।

এরপর শুভায়ন দু-জনকে ধমক দিয়ে শান্ত করল। বলল, ‘এটা নিজেদের বিষয় নয়, “কিশোর সংঘ” ক্লাবের প্রেস্টিজের বিষয়। সুমনের খবরের ভিত্তিতে আমাদের একটা কিছু প্ল্যান করতে হবে। নে সুমন, মাথা ঠান্ডা করে সবটা বল’।

সুমন একটুক্ষণ গোঁজ হয়ে বসে রইল। তারপর বলল, ‘সবই তো বললাম। “আমরা সবাই” ক্লাবের ছেলেরা সৌরভ বলে একজনকে পেয়েছে। জানতে পেরেছি, এই ছেলে মাধ্যমিক পরীক্ষার পর মাসখানেকের ছুটিতে ফুলপুরে মামার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। এসে দেখে, নাটক নিয়ে হইচই হচ্ছে। পাড়ায়-পাড়ায় রিহার্সাল। বাড়িতে-বাড়িতে আলোচনা। এতে খুব মজা পায়। মামাকে বলে “আমিও নাটক করব। তুমি কোনো একটা দলের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দাও। ভদ্রলোক তখন আলাপ করিয়ে দেন, “আমরা সবাই” ক্লাবের নাটক পরিচালক অবন্তী সেনের সঙ্গে। অবন্তী সেনকে চিনিস তো?’

আমি বললাম, ‘কেন চিনব না? গতবার অবন্তীদার নাটকটা অল্পের জন্য আমাদের কাছে হেরে গিয়েছিল। খুব ভালো করেই মনে আছে। ওদের অভিনয়ে কিছু গোলমাল ছিল। নইলে ওরাই জিতত’।

সুমন বলল, ‘এবার মনে হয় সেটাই হবে’।

দেবরূপ বলল, ‘মানে? ওরাই চ্যাম্পিয়ন হবে?’

সুমন দেবরূপের দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলল। বলল, ‘অত উত্তেজিত হচ্ছিস কেন? আগেই তো বলেছি, এবার আমাদের বিপদ আছে। অবন্তীদা প্রথমে ওই ছেলেকে ভাগিয়ে দিচ্ছিল। তারপর একটা ছোটো রোল দিয়েছে। যতই হোক, ওর মামা রিকোয়েস্ট করেছেন। কিন্তু সেই ছোটো রোলে নাকি ছেলেটা মাত করে দিচ্ছে। নাটক দারুণ জমে গিয়েছে। ওরা বলছে, এবার সেরা নাটকের প্রাইজ ওরাই পাচ্ছে। কেউ আটকাতে পারবে না’।

আমি ঝুকে পড়ে ফিসফিস করে বললাম, ‘রোলটা কিসের?’

সুমন নীচু গলায় বলল, ‘যত দূর খবর পেয়েছি, পুলিশের’।

নির্মাল্য বলল, ‘অ্যাঁ ! বলিস কী ! এ তো ‘কিশোর সংঘ’-র চোর বনাম “আমরা সবাই”-এর পুলিশের লড়াই !’

সুমন বাঁকা চোখে নির্মাল্যর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘লড়াইতে “কিশোর সংঘ”র পরাজয় নিশ্চিত। চোর পাকড়াও হবে। কোমরে দড়ি বেঁধে “আমরা সবাই”-এর পুলিশ তাঁকে হাজতে নিয়ে যাবে’।

নির্মাল্য লাফ দিয়ে উঠে বলল, ‘তুই আমাকে অপমান করছিস সুমন। তুই ভালো করেই জানিস চোরের পার্টটা আমি করছি’।

সুমন হাসি চেপে, অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘যা বাবাঃ ! তোকে কেন অপমান করতে যাব? তুই কি সত্যি চোর?’

“আমরা সবাই”-এর গেম সেক্রেটারি তমালকে টিফিনে এক প্লেট ঘুগনি খাইয়ে সব খবর বের করে নিয়েছি। তমালই বলল, সৌরভ এমন পার্ট করছে যে মনে হচ্ছে, একেবারে সত্যিকারের পুলিশ অফিসার। ওর অভিনয় দেখতে গিয়ে প্রম্পটার পর্যন্ত প্রম্পট করতে ভুলে যাচ্ছে।

সায়ন হতাশ গলায় বলল, ‘ওদের নাটক কি আমাদের মতো হাসির নাটক?’

সুমন বলল, ‘না, শুনেছি উলটোটা। দুঃখের নাটক। একজন পুলিশ অফিসার…’।

আমি হাত তুলে বললাম, ‘থাক, থাক আর নাটকের দুঃখের গল্প শুনে কাজ নেই। আমাদের নিজেদের অবস্থাই যখন দুঃখের হয়ে গিয়েছে। যে করেই হোক একটা কিছু করতে হবে। ওই সৌরভ ছেলেটাকে আটকাতে হবে’।

দেবরূপ বলল, ‘আটকাতে হবে মানে! কীভাবে আটকাব?’

সুমন বলল, ‘মারধোর করে হাত-পা ভেঙ্গে দেওয়ার কথা বলছিস নাকি?’

নির্মাল্য বলল, ‘গাধার মতো কথা বলিস না। এটা কি ফুটবল খেলার মাঠ যে ল্যাং মেরে ফেলে দিবি?’ এই প্রথম টুটুন কথা বলল। চোখ বড় বড় করে বলল, ‘আচ্ছা কিডন্যাপ করলে কেমন হয়? ধর, ওদের শো-এর ঠিক আগের দিন, আমরা ওই ছেলেকে ভুলিয়েভালিয়ে নিয়ে এলাম …তারপর হাত-পা বেঁধে এই চিলেকোঠার ঘরে …নাটক হয়ে গেলেই ছেড়ে দিব…কেমন হবে?’

দেবরূপ বলল, ‘হেরে যাওয়ার ভয়ে এই ছেলের তো দেখছি মাথার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে। সত্যি সত্যি জেল খাটবার প্ল্যান করছে। আরে বাবা এটা কি তোর নাটক? ওই ছেলেকে ধরে এনে তুই বেঁধে রাখবি আর ওরা সবাই আঙুল চুষবে? পুলিশ ডাকবে। পুলিশ এসে আমাদের সবাইকে ধরে নিয়ে যাবে’।

আমাদের পরিচালক সপ্তর্ষি এতক্ষন চুপ করেছিল। মন দিয়ে আমাদের কথা শুনছিল। এবার খানিকটা যেন অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘আমার মাথায় একটা প্ল্যান আসছে’।

আমি ঢোকা গিলে বললাম, ‘কী প্ল্যান? গোলমালের কিছু নয় তো?’

সপ্তর্ষি হেসে বলল, ‘না, গোলমালের নয়, বরং উলটোটা। হাসতে-হাসতে বুক ফুলিয়ে কাজটা করা যাবে’।

নির্মাল্য আর সুমন একসঙ্গে বলল, ‘কী সেটা?’

সপ্তর্ষি সিরিয়াস মুখ করে বলল, ‘তাঁর আগে সুমন বল তো তোর ওই সৌরভ ছেলেটার নাটক করার শখ কেমন?’

সুমন হাত উলটে বলল, ‘এ আর বলার কী আছে? বোঝাই তো যাচ্ছে খুব শখ। মামাবাড়ি বেড়াতে এসে মানুষ নাটক দেখে বলে শুনেছি, নাটক করে বলে তো কখনো শুনিনি। তার উপর একটা ছোটো রোলেও রাজি হয়ে গিয়েছে। শুনেছি নাকি অবন্তীদাকে বলেছিল, আপনি আমাকে একবার স্টেজে ওঠার সুযোগ দিলেই হবে। ফুলপুরের নাটক কম্পিটিশনে আমি যোগ দিতে পারলেই খুশি’।

সপ্তর্ষি বা-হাতের তালুতে নিজের ডান হাত দিয়ে ঘুসি মেরে বলল, ‘ব্যস এতেই হবে। আমার প্ল্যান হয়ে গিয়েছে। তোদের কথা দিচ্ছি, ওই ছেলে “আমরা সবাই” ক্লাবের নাটকে নামবে না। ওর সঙ্গে আমার একটু কথা বলা দরকার। এই দায়িত্ব সুমন তোর। তুই ওদের গেম সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বল। দরকার হলে আর এক প্লেট ঘুগনি খাওয়া। তারপর ম্যানেজ করে কালই সৌরভকে আমার কাছে নিয়ে আয়। শুধু একটা কথা……’

নির্মাল্য বলল, ‘কী কথা?’

সপ্তর্ষি নির্মাল্যর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, ‘কথাটা তোকে আলাদা করে বলব’।

দু-দিনের মাথায় ম্যাজিকের মতো ঘটনা ঘটল। টুটুনদের চিলেকোঠায় আমরা সৌরভকে দেখতে পেলাম। “আমরা সবাই” ক্লাবের পুলিশ “কিশোর সংঘ”-তে এসে চোর হয়ে গিয়েছে! সপ্তর্ষি তাকে মন দিয়ে পার্ট বোঝাচ্ছে। জোরকদমে চলছে রিহার্সাল। একমাসের কাজ দশদিনে শিখে নিতে হবে না? সৌরভ দারুণ উত্তেজিত। শুধু উত্তেজিত নয়, খুশিও। ‘পুলিশ’ থেকে ‘চোর’ হতে পেরে খুশি কিনা বোঝা যাচ্ছে না, তবে খুশি বড়ো রোল পেয়ে। শুধু বড়ো রোল নয়, একেবারে নাটকের মেন রোল। “আমরা সবাই”-এর নাটকের রিহার্সালে ও যতই ভালো অভিনয় করুক, নাটকটাকে উতরে দিক, অভিনয়ের সুযোগ ছিল মাত্র অল্প কিছুক্ষনের। আর এখানে সারাটা সময় স্টেজে থাকবে। সারাক্ষন দর্শকদের হাততালি পাবে। এই লোভ সামলানো যায়? সপ্তর্ষি এই সুযোগটাই নিয়েছে। সুমন ওকে ধরে নিয়ে এসেছিল। সপ্তর্ষি তাকে বলছে, ‘ভাই তুমি যখন এত ভালো অভিনয় কর, তোমার আরও বড়ো রোল পাওয়া উচিত। তুমি তো আর “আমরা সবাই” ক্লাবের কেউ নয়, ওদের সঙ্গেই যে তোমাকে অভিনয় করতে হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। তোমার মামা তোমাকে প্রথমেই আমাদের কাছে নিয়ে আসতে পারতেন। যাক, যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এখনও সুযোগ আছে। আমরা “কিশোর সংঘ”-র পক্ষ থেকে তোমাকে একটা বড়ো চরিত্রে কাজ করার সুযোগ দিতে চাইছি। আমাদের ক্লাবে যে-ছেলেটি এই রোলে পার্ট করছিল তার নাম নির্মাল্য। সে তোমার জন্য স্যাক্রিফাইস করতে চায়। আত্মত্যাগ। রোলটা তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছে। বলছে, তুমি ফুলপুরের অতিথি। তোমাকে সম্মান দেওয়াটাই প্রধান কাজ। এবার তুমি রাজি কি না বলো। রাজি হলে ক্লাব বদলে চলে এসো। হাতে মাত্র দশদিন সময়। খুব খাটতে হবে’।

সৌরভ লাফাতে-লাফাতে চলে এসেছে। ‘আমরা সবাই’ আটকানোর চেষ্টা করেছিল, পারেনি। সত্যি তো সৌরভ তাদের ক্লাবের কেউ নয়। আমরা খুব খুশি। একেই বলে ‘এক ঢিলে দুই পাখি মারা’। ‘আমরা সবাই’ ক্লাব একজন ভাল অভিনেতাকে হারিয়ে ধরাশায়ী হল, আর আমরা একজন ভালো অভিনেতা পেয়ে জেতার দিকে আরও কয়েক পা এগিয়ে গেলাম। ফুলপুর নাটক প্রতিযোগিতায় আমাদের হ্যাটট্রিক ঠেকায় কে? আমরা খুশি হব না?

আচ্ছা নির্মাল্য কি খুশি হয়েছে? মনে হয় হয়েছে। তাকে সপ্তর্ষি বুঝিয়েছে দলের জন্য তাকে এইটুকু ত্যাগস্বীকার করতেই হবে। সপ্তর্ষি কথা দিয়েছে, পরেরবার সে বড়ো রোল পাবেই। তাহলে সমস্যা কোথায়? মনে হয় সমস্যা নেই। তবে দু-দিন পর থেকে নির্মাল্য সন্ধেবেলা রিহার্সালে আসা বন্ধ করে দিল। একদিন আমার সঙ্গে বাজারে দেখা। শুকনো হেসে বলল, ‘পার্ট যখন করছি না তখন সময় নষ্ট করে লাভ কী বল? তার চেয়ে বাড়িতে বসে বইপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করি। ক-দিন পরেই তো রেজাল্ট বেরোবে। উঁচু ক্লাসের পড়া, আগে থেকে দেখে রাখা ভালো’।

আমার কেমন সন্দেহ হল। সুমনকে বললাম। সুমন এমনিতেই নির্মাল্যর উপর চটা। সে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, ‘রাগ করলে বয়ে গিয়েছে। ওই ছেলে নির্মাল্যর চেয়ে অনেক ভালো পার্ট করছে। দেখিস, দশদিনেই বাজিমাত করে দিবে’।

‘তাও তুই একবার খবর নে সুমন। আমার কেমন জানি লাগছে। সত্যি-সত্যি কি ও সন্ধেবেলা পড়াশোনা করছে? নাকি অন্য কিছু…’

খবর যোগার করতে সুমন ওস্তাদ। সে একদিন সটান নির্মাল্যর বাড়িতে গিয়ে হাজির। নির্মাল্য সত্যি বই-খাতা নিয়ে বসে ছিল। সুমনকে খাতির করে ঘরে বসাল। বাড়িতে রসগোল্লা ছিল। সুমনকে প্লেটে করে দুটো রসগোল্লা দিল। সুমন বেরিয়ে আসার সময় মুচকি হেসে বলল, ‘আমি জানতাম তুই আসবি। তোদের সঙ্গে নাটকের দিন দেখা হবে। ‘কিশোর সংঘ’ নাটক করবে আর আমি থাকব না, তা কখনো হতে পারে?’

সুমন আমার কাছে এসে বলল, ‘না, ছেলেটা সত্যি বইপত্র নিয়ে বসে’।

পরের ক-দিন আমাদের মাথা থেকে নির্মাল্য উধাও হয়ে গেল। আমরা নাটকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। পতাকা, আলো, ঝলমলে গেটে ফুলপুরও সেজে উঠল। স্কুল মাঠে তৈরি হল স্টেজ। বিচারকরা আসতে শুরু করে দিয়েছেন। আমাদের টেনশন বাড়তে লাগল। রিহার্সাল এক বেলার জায়গায় দু-বেলা করে দেওয়া হল। ‘কিশোর সংঘ’ আর ‘আমরা সবাই’-এর নাটক প্রথম দিনেই পড়েছে। প্রথমে আমাদের, তারপর করবে ওরা। ভালোই হল। গোড়াতেই টেনশন শেষ হয়ে যাবে। বাকি দিনগুলো হালকা মনে জমিয়ে বসে অন্যদের নাটক দেখতে পারব।

আমাদের নাটক যে কী দারুণ হল তা মুখে বলে বোঝানো যাবে না। নাটক শেষের পর দর্শকদের হাততালি থামতেই চায় না। শুধু হাততালি নয়, সঙ্গে হাসি। চোরের পার্টে সৌরভ ভেলকি দেখিয়ে দিল। নাটক শেষ হওয়ার পর স্টেজে এসে তাকে দর্শকদের অভিনন্দন গ্রহন করতে হল। সকলে জানতে চাইছে, ছেলেটা কে? একে তো ফুলপুরে আগে কখনো দেখেনি। সপ্তর্ষি স্টেজে উঠে মাইক হাতে বলল, ‘চোরকে দেখা যাবে কী করে? সে কি দিনের ফটফটে আলোয় ঘুরে বেড়াবে? সে দেখা দেবে গভীর রাতে’। আর একচোট হাততালি আর হাসি।

আধঘন্টা বিরতির পর শুরু হল ‘আমরা সবাই’-এর নাটক। আমরা একেবারে স্টেজের সামনে গিয়ে জমিয়ে বসলাম, দেখি ওরা কী করে।

যা দেখলাম তাতে আমাদের চোখ একেবারে ছানাবড়া হওয়ার উপক্রম। সবার মুখ হা। সেই হা বন্ধ হল নাটক শেষ হওয়ার পর। চোর-পুলিশে যে পুরো বদলাবদলি হয়ে গিয়েছে। পুলিশ যেমন চোর হয়েছে, চোর তেমন হয়েছে পুলিশ। ধাঁধার মত লাগছে কি? লাগারই কথা। ‘আমরা সবাই’-এর নাটকে পুলিশের পার্ট করল আমাদের নির্মাল্য। সত্যি ছোট রোল, কিন্তু তাতেই সবাইকে কুপোকাত করে দিয়েছে! নাটকের শেষ দৃশ্যে গুণ্ডা ধরতে গিয়ে পুলিশ অফিসার জখম হবেন। নির্মাল্যর পার্ট দেখে সেই সময় সবার চোখে জল। সত্যি কথা বলতে কী, আমারও! নাটক শেষ হলে দর্শকরা উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে লাগলেন। উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দেওয়া একটা বিরাট সম্মানের ব্যাপার। এমনকী, বিচারকরা পর্যন্ত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ড়ালেন। সুমন মাথা চুলকে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘নির্মাল্য আমাকে বোকা বানিয়ে দিয়েছে। আমার গুপ্তচরগিরি ফেল মেরেছে। সন্ধেবেলা বাড়ি গিয়ে দেখলাম বেটা পড়ছে, তার মানে অন্য সময় রিসার্সাল দিত। আমাকে একটা জোর শিক্ষা দিল।

আমরা সুমনে কথায় কান না-দিয়ে হাততালি দেব বলে তাড়াতাড়ি ঊঠে দাঁড়ালাম।

সেবার ফুলপুর নাটক প্রতিযোগিতার রেজাল্ট কী হয়েছিল?

আমরাই সেরা ‘দল’ হয়েছি। পরপর তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে হ্যাটট্রিক করেছি। কিন্তু আমাদের মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছে। ফুলপুরের সবাই এখন জেনে গিয়েছে ‘কিশোর সংঘ’ নাটকের জন্য জেতেনি, জিতেছে নির্মাল্যর জন্য। সেদিন সৌরভ আমাদের কাছে চলে আসার পর নির্মাল্য ‘আমরা সবাই’ ক্লাবের ছেলেদের কাছে যায়। তাদের তখন মাথায় হাত। দশদিন আগে অভিনেতা চলে গিয়েছে, নাটক বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। নির্মাল্য বলল, ‘হঠাৎ করে অভিনেতা চলে যাওয়ায় তোমরা নিশ্চয়ই বিপদে পড়েছ? নাটক বন্ধ করে দিতে হচ্ছে তো? যদি রাজি হও, ওই পার্ট আমি করে দেব। কথা দিচ্ছি, আমার অভিনয় কারো চেয়ে খারাপ হবে না। তবে একটা শর্ত আছে। কম্পিটিশন থেকে তোমাদের নাম তুলে নিতে হবে। তোমাদের নাটক হবে নাটকের জন্য, প্রাইজের জন্য নয়। যদি রাজি থাক বলো’। ওরা লাফিয়ে উঠে রাজি হয়ে গেল।

ঘটনার বহুদিন পরে একদিন নির্মাল্যকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এ-রকম করলি কেন? এভাবে আমাদের অপমান না-করলেই কি হত না?’

নির্মাল্য হেসে বলল, ‘অপমান কোথায় করলাম? “কিশোর সংঘ” যা করেছিল সেটা আসলে চুরি। প্রাইজের লোভে অন্য নাটকের অভিনেতা চুরি করেছিল। সৌরভ বেচারিকে সেই চোরের পার্টই করতে হল। কাজটা আমার পছন্দ হয়নি। মনে হল, পুলিশ সেজে তোদের একটু শিক্ষা দিই। খারাপ করেছি?’

আমি চুপ করে রইলাম।

সমাপ্ত 

 

প্রচেত গুপ্ত
সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top