সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১

নজরুলের জেলজীবন : এস ডি সুব্রত


প্রকাশিত:
২৬ মে ২০২১ ২০:০৯

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ০০:১৬

 

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সাম্যবাদের কবি, অসম্প্রদায়িক চেতনার কবি ,বিদ্রোহের কবি। কেউ কেউ তাকে স্বাধীনতার কবি বলেও উল্লেখ করেছেন। ভারতের আজাদি আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নজরুলের কবিতা ও গান অনুপ্রেরণা দিয়েছে,সাহস ও শক্তি যুগিয়েছে। কবির বড় হওয়ার সময়টাতে বিশ্ব রাজনীতিতে পরিবর্তনের হাওয়া, সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতা আন্দোলন। নজরুলের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদান এবং সেখান থেকে ফিরে এসে কলকাতায় কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এর সাহচর্য তাকে মানবধর্মের পথে ধাবিত করে এবং সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন। পত্রিকা সম্পাদনা র সাথেও যুক্ত হন। পত্রিকা এবং লেখালেখির কারণে নজরুল কে দু বার কারাগারে যেতে হয়। প্রথম বার ১৯২৩ সালে কারাগারে যান ধুমকেতু পত্রিকায় 'আনন্দময়ীর আগমনে " এবং বিদ্রোহীর কৈফিয়ত কবিতার জন্য। সে সময় এক বছরের জেল হয়, কিন্তু জেল খেটেছিলেন এগার মাস। দ্বিতীয় বার ১৯৩০ সালে "প্রলয় শিখা" কাব্যগ্রন্থের জন্য।

১৯২২ সালের ১১ই আগস্ট নজরুলের সম্পাদনায় ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ধূমকেতুতে কখনো লিখেন সম্পাদকীয়, কখনো কখনো কবিতা, আবার কখনো প্রবন্ধ। ধূমকেতুর একটি সংখ্যায় কবি নজরুল দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বললেন ......."সর্বপ্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। স্বরাজ টরাজ বুঝি না, কেননা এ কথাটার মানে এক এক মহারথী এক একেক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমানু অংশও বিদেশীদের অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পুর্ন দায়িত্ব, সম্পুর্ন স্বাধীনতা, শাসনভার থাকবে ভারতীয় দের হাতো।.......তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে বুচকা পুঁটলি বেঁধে সাগর পাড়ি দিতে হবে।" নজরুলের এমন লেখা সম্পর্কে কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ বলেন... অনেকে হয়তো নিজেদের বৈঠকখানায় বসে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা র ইচ্ছা পোষন করেছেন। কিন্তু নজরুলের মত এমন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় খবরের কাগজে কেউ দেশের স্বাধীনতার কথা তুলে ধরেছিলেন তা আমার জানা নেই। নজরুল ধূমকেতু তে একটি কবিতা লিখেছিলেন 'আনন্দ ময়ীর আগমনে'। কবিতার কিছু পংক্তি এরকম........

 

 "আর কতকাল থাকবে বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী ব্যক্তি চাড়াল।
দেব শিশুদের মারছে চাবুক বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ- ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?
মাদিগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা বোল নাকিনাকি
খাড়ায় কেটে কর মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি।

…….........................

অনেক পাঠা মোষ খেয়ছিস রাক্ষুসী তোর যায়নি ক্ষুদা 
আয় পাষানী এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত সুধা।
..........

ময় ভূখাহুমায়ি বলে আয় এবার আনন্দময়ী 
কৈলাস হতে গিরি রাণীর মা দুলালী কন্যা আয়!
আয় উমা আনন্দময়ী।'

ঊনআশি পংক্তির দীর্ঘ কবিতা।ভীরুদের প্রতি প্রচন্ড ধিক্কার ও ব্রিটিশদের প্রতি দূর্বার ঘৃনা আর দেশপ্রেমীদের বিদ্রোহের ডাক। সরকারের টনক নড়ল। পুলিশ আসল ধুমকেতু অফিসে। পত্রিকা বাজেয়াপ্ত হল। কবিতা নিষিদ্ধ হল। কবির বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীতার মামলা হল। অনেকেই তাকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিল। তিনি রাজি হলেন না। পরে অবশ্য কলকাতা পুলিশের চোখের আড়াল হয়েও রেহাই পাননি। কুমিল্লার ঝাউতলা থেকে গ্রেফতার হলেন। নিয়ে আসা হল কলকাতায়। বিচারের রায় হল এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। কবিতা লেখার জন্য কোন বাঙালির এই প্রথম কারাবরণ। বিচারাধীন অবস্থায় কয়েক মাস ছিলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে। আদালতে রাজবন্দী হিসেবে নজরুল যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন তা পরবর্তীতে 'রাজবন্দীর জবানবন্দি' নামে খ্যাত। পরে বদলী করা হয় আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে কলকাতায়। জেলে বসে লিখেন বিখ্যাত কবিতা 'সৃষ্টি সুখের উল্লাসে'।

'আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
আজ আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে
বাঁধ ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার ভাঙ্গা কল্লোলে!'

কল্লোল পত্রিকায় ছাপা হল আটচল্লিশ পংক্তির এই কবিতা। মাস কয়েক পরে নজরুল কে বদলী করা হল হুগলি জেলে। হুগলি জেলে নজরুলের রাজবন্দীর মর্যাদা কেড়ে নেয়া হল। রাখা হল সাধারণ বন্দী হিসেবে। হুগলি জেলে নজরুল একটা গান রচনা করলেন রবীন্দ্রনাথের একটা দেশাত্মবোধক গানের প্যারোডি করে।

'তোমারি জেলে পালিছ ঠেলে তুমি ধন্য ধন্য হে  
আমারি গান তোমারি ধ্যান তুমি ধন্য ধন্য হে।
রেখেছ শাস্ত্রী পাহাড়া দোরে 
আঁধার কক্ষে জামাই আদরে
বেঁধেছ শিকল প্রণয় ডোরে 
তুমি ধন্য ধন্য হে।'

হুগলি জেলে বসেই নজরুল লিখেছিলেন শিকল পরার গান।

'এই শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল পরা ছল
এই শিকল পরেই শিকল তোদের করবরে বিকল।'

হুগলি জেলে নজরুল অনশন শুরু করেন।কেউ তার অনশন ভাঙাতে পারেননি। ক্রমশ স্বাস্থ্যের অবনতি হতে লাগল। শেষে ৩৯ দিনের মাথায় বিরজা সুন্দরী দেবীর অনুরোধে অনশন ভেঙ্গেছিলেন কবি।

এরপর কবিকে পাঠানো হল বহরমপুর জেলে। সেখানে রাজবন্দীর মর্যাদা দেয়া হল। এখানে কবির পরম সঙ্গী হলেন নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। কবি সঙ্গীতবহুল ছোট একটা নাটক লিখেছিলেন এ জেলে বসে। এক বছরের মেয়াদ শেষ হলে বহরমপুর জেলে থেকে মুক্তি পায় ১৫ ডিসেম্বর।তাকে জেল খাটতে হয়েছিল বার মাসের পরিবর্তে এগার মাস।

নজরুল কে দ্বিতীয় বার কারাদন্ডের আদেশ হয় প্রলয় শিখা কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৩০ সালে। বিশেষ করে প্রলয় শিখা কাব্যগ্রন্থের নবভারতের হলদিঘাট ও যতিন দাস কবিতার জন্য। তবে সে বার নজরুল কে জেল খাটতে হয়নি। হাইকোর্টে আপিল করলে কারাদন্ডর আদেশ স্থগিত হয়। প্রলয় শিখা ব্রিটিশ শাসকদের বিচলিত করে ফেলে। বইটির ২০ টি কবিতায় প্রতিবাদের ঝড় ছিল। এর মধ্যে 'নবভারতের হলদিঘাট' ও 'যতীন দাস' নামের দুটি কবিতা শাসকদের কাছে বেশি আপত্তিকর লেগেছিল। আইন অমান্য আন্দোলন নিয়ে গান্ধী ডারউইন চুক্তির আওতায় সব রাজবন্দীর সাথে নজরুলও মুক্তি পান।

প্রলয় শিখা কাব্যগ্রন্থে কবির কন্ঠে ধ্বনিত হয় ..........

"ভাঙ্গি মন্দির ভাঙ্গি মসজিদ
ভাঙ্গিয়া গির্জা গাহি সঙ্গিত
একই মানবের একই রক্তমেশা
কে শুনিয়ে আর ভজনালয়ের হ্রেষা‌।"

প্রলয় শিখা কাব্যগ্রন্থের 'নবভারতের হলদিঘাট' কবিতাটি বাঘা যতীনের বীরত্বগাঁথা কে কেন্দ্র করে রচনা করেছিলেন। কবিতার কিছু পংক্তি নিম্নে তুলে ধরা হলো---

 বালাশোর বুড়ি বালামের তীর 
 নবভারতের হলদিঘাট
 উদয় গোধূলি রঙ্গে রাঙ্গা হয়ে
 উঠেছিল যথা অস্তপাঠ।

---------

দেবকী মাতার বুকের পাথর
 নড়িল কারায় অকস্মাৎ
 বিনামেঘে হল দৈত্যপুরীর 
প্রাসাদে সেদিন বজ্রপাত।

নাচে ভৈরব শিবানী প্রমথ 
জুড়িয়া শ্বশান মৃত্যুনাট
বালাশোর - বুড়ি বালামের তীর
 নবভারতের হলদিঘাট।

-------

ভাবি ভারতের না চাহিতে আসা
নবীন প্রতাপ নেপোলিয়ন,
ওই যতীন্দ্র রণোন্মত্ত
শনির সহিত অশনি রণ।'

নবভারতের হলদিঘাট কবিতায় নজরুল বাঘা যতীন কে নেপোলিয়ন এর সাথে তুলনা করেছেন।

যতীন দাস কবিতায় নজরুল লিখেছেন---

"আসিল শরৎ সৌরাশ্বিন
দেবদেবী যবে ঘুমায়ে রয় 
পাষাণ স্বর্গ হিমালয় চূড়ে
শুভ্র মৌলি তুষারময়।

.............

মহিষ -অসুর - মর্দিনী মাগো
জাগো এইবার খড়গ ধরো
দিয়াছি যতীন অঞ্জলী 
নব- ভারতের আঁখি ইন্দিবর।"

প্রলয় শিখা কাব্যগ্রন্থের উল্লেখিত কবিতা দুটি ব্রিটিশ শাসকদের চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছিল। যার ফলে কবির বিরুদ্ধে কারাদন্ডের আদেশ হয়। অবশ্য এই কারাদণ্ড থেকে শেষপর্যন্ত নজরুল মুক্তি পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় বার কারাদন্ডের আদেশ হলেও কারাবরণ করতে হয়নি।

 

এস ডি সুব্রত
কবি ও প্রাবন্ধিক
সুনামগঞ্জ, বাংলাদেশ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top