সিডনী মঙ্গলবার, ২৩শে এপ্রিল ২০২৪, ১০ই বৈশাখ ১৪৩১

গোয়েন্দা অপ্সরা ও ধাঁধাল পত্র (পর্ব চার) : আসিফ মেহ্‌দী


প্রকাশিত:
৮ জুন ২০২১ ১৮:৫৯

আপডেট:
২৩ এপ্রিল ২০২৪ ২২:৫৭

 

অপ্সরার কথায় আলিম সাহেব কিছুটা স্থিরতা হারিয়ে বললেন, ‘কিন্তু দোকানে কোথায় চিঠি রাখা থাকবে?’
‘সেটা লেখা নেই। তবে আমি ধারণা করছি…। আচ্ছা, আপনাদের দুজনকে চেনেন, এমন কেউ কি আছেন দোকানে?’

‘আমি আগেই বলেছি, আমাদের দুজনের বিষয়টা আর কেউই জানে না, অপ্সরা। তবে তন্ময়ের সঙ্গে আমার প্রায়ই কথা হয়, এটা মিথির জানা আছে। তোমরা তদন্ত করছ বলে কারণটা তোমাদেরও জানিয়ে রাখি। মিথির জন্য শুধু রুমাল না; বেশ কিছু গিফট আইটেম আমি কিনেছিলাম ওই দোকান থেকে। সেসময়ের খুব নামকরা দোকান। এ কারণে তন্ময়ের বাবার সঙ্গে আমার একসময় সখ্যতা গড়ে ওঠে। যখন আমার বেশ টাকাপয়সা হলো, স্মৃতিময় দোকানটা কিনতে চেয়েছিলাম। তন্ময়ের বাবা রাজি হননি। তবে তিনি আমাকে বললেন, দোকানটা দ্বিগুণ করবেন; আমি চাইলে দোকানের অর্ধাংশের শেয়ারহোল্ডার হতে পারি। বিনা বাক্যব্যয়ে রাজি হয়ে গেলাম। তাই ওই দোকানের একজন অংশীদার বলতে পারো আমাকে। এ কারণেই তন্ময়ের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ আছে।’

‘আমার মনে হয়, তন্ময়কে একবার কল দিয়ে দেখতে পারেন। হতে পারে, তার কাছেই কেউ চিঠি রেখে গেছে।’
‘ঠিক আছে, আমি কল দিয়ে জানাচ্ছি তোমাকে।’

আলিম সাহেব কল কেটে দিলেন। কিছুক্ষণ পরই তিনি আবার কল দিলেন অপ্সরাকে। রুদ্ধশ্বাসে বললেন, ‘অপ্সরা, তুমি ঠিক ধরেছ। এক ছেলে নাকি আমাকে দেওয়ার জন্য তন্ময়ের কাছে একটা চিঠি রেখে গেছে। তন্ময় ভেবেছে কোনো ছেলে চাকরির খোঁজে সিভি দিয়ে গেছে; তাই আমাকে আর কল দিয়ে বিরক্ত করেনি।’

অপ্সরা বলল, ‘এই চিঠির কথাই আগের চিঠিতে লেখা আছে।’
আলিম সাহেব বললেন, ‘কিন্তু মিথি তো এভাবে দুটো চিঠি কখনোই পাঠায়নি। যাহোক, আমি রওনা দিচ্ছি চিঠিটার জন্য।’
অপ্সরা বলল, ‘আপনার যাওয়া লাগবে না, ভাইয়া। এ কাজ আমাদের। আপনি তন্ময়কে কল দিয়ে বলে দিন অপ্সরা নামে একজন যাবে চিঠি নিয়ে আসতে। তবে আজকে না ভাইয়া; কাল সকালবেলাতেই আমি যাব। কারণ, আজকে রওনা দিলেও নীলক্ষেতে আমি সময়মতো পৌঁছতে পারব না।’

আলিম সাহেব নিজে গিয়েই চিঠিটা আনতে চাইলেন। এ ব্যাপারে অপ্সরাকে কয়েকবার সম্মত করার চেষ্টা করলেন। লাভ হলো না। অগত্যা তিনি অপ্সরার কথায় রাজি হলেন। অপ্সরা ঘটনার আপডেট তার টিমের গোয়েন্দা জ্যাকলিনকেও জানিয়ে রাখল।

পরদিন সকাল ঠিক সাড়ে দশটায় অপ্সরা পৌঁছল তন্ময় উপহার বিতানে। দোকানের ক্যাশে বসে আছে ম্যানেজার তন্ময়। প্রথম দেখায় বয়স আলিম সাহেবের চেয়ে বেশি মনে হয়; প্রকৃতপক্ষে চল্লিশোর্ধ পুরুষ, গায়ের রঙ চাপা, মাথার সামনে চুল কমে টাক তৈরি হচ্ছে। তন্ময়কে অপ্সরার কথা আলিম সাহেব বেশ ভালোভাবেই বলে রেখেছেন। কারণ, অপ্সরা নিজের পরিচয় দিতেই সে বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘জি, আলিম আঙ্কেল বলেছেন আপনি আসবেন। কফি দিতে বলি?’
‘ধন্যবাদ। আরেকদিন আসব। আপনার দোকানটা বেশ সুন্দর।’
‘সবই আল্লাহর দয়া আর আপনাদের দোয়া।’
‘চিঠিটা কি কাছে আছে?’
‘জি, অবশ্যই।’ তন্ময় পাশের ড্রয়ার থেকে একটি খাম বের করে অপ্সরাকে দিল।
অপ্সরা হাতে নিতেই নিশ্চিত হলো, আগের চিঠির সমাধান এই চিঠি! কারণ, একই রকম ঠিকানা প্রেরক ও প্রাপকের স্থানে, সেই একই হাতের লেখায়। অপ্সরা বলল, ‘চিঠি যে ছেলেটা দিয়ে গেছে, সে দেখতে কেমন ছিল মনে আছে?’
‘ইয়াং ছেলে; ভার্সিটিতে পড়ে এমন। লম্বা, শ্যামলা, বেশ ভদ্রচেহারা, চোখে চশমা।’
‘ছেলেটার মোবাইল নম্বর কি আছে?’
‘না। ওইদিন এত ভিড় ছিল যে ছেলেটার নাম জিজ্ঞেস করারও সময় পাইনি। চিঠি দিল, চিঠির ওপর আঙ্কেলর নাম দেখে রেখে দিলাম।’
‘ঠিক আছে, অনেক ধন্যবাদ।’

অপ্সরা খামটি না খুলেই তার মিরপুরের অফিসে নিয়ে এল। দ্বিতীয় চিঠিটা খোলার আগে নিজেকে একটু অ্যানার্জাইজ করতে চায় অপ্সরা। তাই খাম অফিসের টেবিলের ওপর রেখে বাইরে বেরিয়ে এল। তার অফিসের সামনে গলির রাস্তা; রাস্তার ওপাশে ছোট একটি হোটেল। সেখানে বানায় ছোট সাইজের ডালপুরি। স্বাদের জন্য যে সাইজ বিষয় না, তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ এই পুরি। অপ্সরা আগেও দুদিন এই হোটেলে বসে ডালপুরি খেয়েছে; সঙ্গে ছিল দুধ চা। দুধ চায়ের মধ্যে ডালপুরি ডুবিয়ে খেয়ে নিজেকে চাঙা করল অপ্সরা। তারপর ফিরে এল অফিসরুমে। টেবিলের ওপর রাখা চিঠি খুলে যা দেখল, তা রীতিমতো বিস্ময়কর! তাতে লেখা শুধু কিছু সংখ্যা:

৩০   ১১    ০৩   ০৪
০৬   ৩০   ০৭   ০২
৫৬   ২৪   ০৬   ০৫
৭১    ০৩   ০৫   ০১

অপ্সরার মন বলছে, আলিম সাহেব ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছেন। কারণ, মিথির পক্ষে এই ধাঁধা তৈরি করা সম্ভব না। অপ্সরা এ ধরনের সংখ্যার ধাঁধা দেখেছে বিভিন্ন গোয়েন্দা বইতে। তাছাড়া যে ছেলেটা চিঠি দিয়ে গেছে, সে-ই বা কে? নিশ্চয়ই নিজের ছেলের মাধ্যমে এসব চিঠি পাঠাবেন না মিথি। অপ্সরা দ্বিতীয় চিঠির ছবি তুলে হোয়াটস অ্যাপে জ্যাকলিনকে পাঠাল।

সংখ্যাগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে অর্থবহ কিছু খুঁজে পাচ্ছে না অপ্সরা। কল দিল আলিম সাহেবকে।
‘ভাইয়া, দ্বিতীয় চিঠিটা আমার হাতে।’
‘দারুণ! কী লেখা আছে দেখেছ?’
‘জি। চিঠিতে শুধু কিছু সংখ্যা লেখা আছে।’
‘ঠিক বুঝতে পারলাম না!’

‘চিঠিতে শুধু ষোলোটা সংখ্যা লেখা। আপনাকে সামনাসামনি দেখাতে পারলে ভালো হতো। এই সংখ্যাগুলো কোনো না কোনোভাবে সিগনিফিকেন্ট। হয়তো আপনি দেখলে বুঝতে পারবেন। হতে পারে, আপনাদের দুজনের প্রথম দেখা হওয়ার তারিখ, আপনার জন্মতারিখ বা মিথি আপুর জন্মতারিখ কিংবা অন্য কোনো বিশেষ রহস্য লুকিয়ে আছে সংখ্যাগুলোতে।’
‘আমি তোমাকে এক্ষনি গাড়ি পাঠাচ্ছি। চলে এসো আমার বাসায়। তোমার ঠিকানা আমাকে এসএমএস করো।’
‘ওকে, ভাইয়া।’

অপ্সরা গাড়ির ব্যাপারে আপত্তি করল না। কারণ, পাবলিক যানবাহনে যেতে হলে তার অনেক সময় লেগে যাবে। আলিম সাহেবকে নিজের অফিসের ঠিকানা এসএমএস করে দিল অপ্সরা। আধ ঘণ্টার মধ্যে গুলশান থেকে গাড়ি চলে এল মিরপুরে অপ্সরার অফিসের সামনে। বেগুনি রঙের ব্যাগটি কাঁধে ঝুলিয়ে বের হলো অপ্সরা। কালো রঙের সেই প্রাডো জিপ। অপ্সরা গাড়ির পেছনের সিটে বসল। গাড়ি ছুটল মিরপুর দশ, মিরপুর চৌদ্দ, কচুক্ষেত, ক্যান্টনমেন্ট হয়ে গুলশানে। আলিম সাহেবের বাসায় পৌঁছতে আধঘণ্টার মতোই লাগল।

আলিম সাহেব অপ্সরাকে নিয়ে সোজা তার ঘরোয়া অফিসরুমে চলে এলেন। অপ্সরা চিঠিটি আলিম সাহেবের হাতে দিল। চিঠির দিকে তাকাতেই ভদ্রলোকের মুখ শুকিয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ তিনি চিঠির দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটিবারের জন্যও তার পাংশু মুখে হাসির রেখা দেখা গেল না। সামনে বসে থাকা অপ্সরা বুঝতে পারল, এই সাংখ্যিক ধাঁধার রহস্য সমাধান করা সহজ হবে না। অনেকক্ষণ পর ক্লান্ত ভঙ্গিতে আলিম সাহেব বললেন, ‘না, কোনো সংখ্যাই তো মিলছে না। দুজনের জন্মদিনের তারিখ, দেখা হওয়ার তারিখ, মিথির বিয়ের মানে আমাদের কষ্টের তারিখ-কিছুই না!’ 

অপ্সরা সান্ত্বনার সুরে বলল, ‘ভেঙে পড়বেন না, ভাইয়া। আমার মনে হয় আমাদের ভিন্ন কোনো উপায়ে এগোতে হবে।’

ঠিক এমন সময় অপ্সরার মোবাইলে জ্যাকলিনের কল এল। অপ্সরা কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শোনা গেল জ্যাকলিনের কণ্ঠস্বর, ‘আপু, এ ধরনের সংখ্যার ধাঁধা বেশ কিছু গোয়েন্দা বইতে পড়েছি। সাধারণত পছন্দের সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন বা বই থেকে এসব ধাঁধা করা হয়। আলিম সাহেবের বাসার ড্রইংরুমের একপাশে একটা বুকশেলফ দেখেছিলাম। আমার মনে হয়, কোনো স্মৃতিবিজড়িত বইকেন্দ্রিক এই ধাঁধা। দেখুন, চিঠির প্রতিটি লাইনে চারটি করে সংখ্যা লেখা। হতে পারে, প্রথম লাইনের প্রথম সংখ্যা কোনো বইয়ের পৃষ্ঠা নম্বর বোঝাচ্ছে, দ্বিতীয় সংখ্যা নির্দেশ করছে ওই পৃষ্ঠার বাক্য নম্বর, তৃতীয় ও চতুর্থ সংখ্যা দুটো দিয়ে বোঝা যাবে যথাক্রমে কততম শব্দ ও বর্ণ। এভাবে চারটি লাইনের বর্ণ উদ্ধারের পর হয়তো অর্থপূর্ণ কিছু পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রথমেই যা দরকার, তা হলো আলিম সাহেব আর মিথি আপুর স্মৃতিময় কোনো বইয়ের নাম।’

অপ্সরা এতক্ষণ আলিম সাহেবের সামনে বসেই মোবাইল কানে দিয়ে জ্যাকলিনের কথা শুনল। ওপাশ থেকে কথা থামলে অপ্সরা বলল, ‘ঠিক আছে জ্যাকলিন, এ ব্যাপারে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করছি।’
কল কেটে দিয়ে অপ্সরা আলিম সাহেবকে বলল, ‘ভাইয়া, আপনার আর মিথি আপুর জীবনে এমন কোনো বই কি আছে, যেটি নিয়ে সুন্দর স্মৃতি রয়েছে?’
আলিম সাহেব প্রশ্নটি শুনে চিন্তামগ্ন হলেন। একসময়ে ধীরলয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পছন্দের বই?’
‘জি, সেটি আপনাদের কারও পছন্দের বই হতে পারে।’

আলিম সাহেব বলতে শুরু করলেন, ‘প্রায় তিন যুগ আগের ঘটনা। মিথি বেশ বইপাগল। মিথির বিয়ে হয়ে গেছে কিন্তু বইয়ের নেশা যায়নি। আমিও পড়তাম বা এখনো পড়ি; তবে নন-ফিকশন। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে মিথির সঙ্গে বাৎসরিক সাক্ষাতের সময় আমার পড়ার জন্য সে বইটা নিয়ে এল। বইটা নাকি ওর প্রিয় বইগুলোর একটি। আমি হেসে বললাম, এই বই তো আর এই বছরে ফেরত দিতে পারব না! মিথিও হেসে জানাল যে সে বইটা একজোড়া কিনেছে- একটা আমার জন্য; আরেকটা তার জন্য!’

‘দারুণ! তার মানে বইটা আছে আপনার কাছে!’
‘ড্রইংরুমে যে বুকশেলফ দেখেছ, সেখানে খুঁজতে হবে।’
‘কী নাম বইয়ের?’
‘কালজয়ী বই- বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা।’
‘চমৎকার! বইটা কাইন্ডলি আনার ব্যবস্থা করুন।’

‘দাঁড়াও আসছি।’ বলে রুম থেকে বের হয়ে নিচের দিকে গেলেন আলিম সাহেব। প্রায় আধঘণ্টা পর সেবা প্রকাশনীর পেপারব্যাক সাইজের বইটি নিয়ে ওপরে এলেন! বোঝা যাচ্ছে, আনার আগে বইটা মোছার চেষ্টা করা হয়েছে। শেলফে তিন যুগ পড়ে থাকা তো কম ব্যাপার না! অপ্সরা তার বেগুনি ব্যাগ থেকে ডায়েরি আর কলম বের করল।

আলিম সাহেব বললেন, ‘তুমি রহস্যভেদের ব্যবস্থা করো আর আমি লাঞ্চের ব্যবস্থা করি।’ অপ্সরার মানা সত্ত্বেও শুনলেন না আলিম সাহেব। লাঞ্চের ব্যবস্থা করতে নিচে চলে গেলেন।

চলবে

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top