সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

কমুনাল সংঘাত ও বাংলা ছোটগল্প : আরিফুল ইসলাম সাহাজি 


প্রকাশিত:
১৫ জুন ২০২১ ১৯:৪৯

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ০৩:৪৩

 

ড. বিপানচন্দ্রের মতে, উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত ভারতভূমিতে সাম্প্রদায়িকতার বিকাশ সেই অর্থে ঘটেনি । ভারতভূমিতে কমুনাল ভাবনার উদ্ভব মূলত ইংরেজ মস্তিস্ক প্রসূত । অর্থাৎ, সোনার ডিম দেওয়া ভারতবর্ষের উপর নিজেদের আধিপত্য সুদীর্ঘকাল ধরে রাখবার কূ উদ্দেশ্যই তাঁরা হিন্দু মুসলিমকে  একে অপরের সাথে লড়িয়ে দিল । ফলে, সুদীর্ঘ কাল পাশাপাশি থাকা দুই সম্প্রদায়ের মানুষের সম্পর্ক শিথিল হতে থাকল ।এক সময় শতাব্দীর পর শতাব্দী এক সাথে থাকা দুটি জাতির মানুষের মনে হল, কোন ভাবেই আর এক সাথে থাকা সম্ভবপর নয় । ফলে, দেশভাগটা অনিবার্য হয়ে পড়ে। ততদিনে হিন্দু উগ্রমৌলবাদি ও মুসলিম উগ্রবাদি অংশ নিজেদেরকে একত্রিত ও সংঘটিত করতে সক্ষম হয়। গড়ে উঠে একাধিক উগ্রবাদি সংঘটন। এই সংঘটনগুলি মুখে নিজেদের সম্প্রদায়ের মানুষের স্বার্থ রক্ষার কথা বললেও, বিভেদ মূলক ভাবনার বিকাশের তারা ইতিবাচক ভূমিকা নিল ।

দেশভাগটা  যেহেতু ধর্মের বিভাজনের ফলে হয়েছিল, ফলে স্থানগুলি নিয়ে বিরাট টানাটানি শুরু হয়। ফলে, এতদিন যে ধৰ্মীয় বিরোধ ছিল গোপনে, তাই এবার ব্যাপকভাবে প্রকাশ্যে এল। ১৯৪১ সালে সম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলেও, ব্যাপকভাবে সম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় '১৯৪৬ এর' The Great Calcutta Killing' সময় পর্বে। আত্মঘাতি বাঙালি এতদিন পাশাপাশি থাকা সত্ত্বেও এবারে একে অপরের রক্তে স্নান করতে বদ্ধপরিকর হয়। এই কমুনাল riots চলেছিল মাত্র চারদিন। ব্রিটিশ সরকার নিষ্ক্রিয় থেকে পূর্ণ ইন্ধন দিল। সম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে মানিকতলায়। এরপর বেলগাছিয়া, শ্যামবাজার, শোভাবাজার, রাজাবাজার, শিয়ালদহ ও মির্জাপুর অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। মাত্র চারদিনের এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডে কলকাতা শ্মশানভূমিতে পরিণত হয়। রেনু চক্রবর্তী তাঁর 'ভারতীয় নারী আন্দোলনে কমিউনিস্ট মেয়েরা' নামক গ্রন্থে একটি হৃদয়বিদারক তথ্য দিয়েছেন,

'অন্তত ৭৫,০০০ থেকে ১০০০০০ মেয়েদের পড়তে হয়েছিল লুটেরাদের হাতে। এরা লুঠ করেছিল মেয়েদের সম্পদ ও শরীর।'

 

কলকাতার মত নোয়াখালিতেও দাঙ্গা এক ভয়াবহ রুপ ধারণ করে। মহাত্মা গান্ধী অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে বলেছিলেন,
'Never in my life has the path been so uncertain and so dim before me'

মহাত্মা গান্ধী সারাজীবন অহিংস নীতির প্রচার করেছেন, তিনি পার্থিব শরীরে থাকাকালীন এই কমুনাল সংঘর্ষ শুরু হয়। গান্ধী ছুটে বেড়ালেন দাঙ্গার কেন্দ্রভূমিতে, বোঝাতে লাগলেন নিজের দেশের উন্মাদ রক্তপিপাসু জনতাকে । মর্মাহত গান্ধী এও বললেন,

'আমি যদি ব্যর্থ হয়, ঈশ্বর যেন আমাকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে নেন।' সমকালীন এই রক্তক্ষয়ী কমুনাল সংঘর্ষের ছবিপট অঙ্কিত হয় সমকালীন প্রকাশিত সব পত্র পত্রিকার পাতায়। এই সব পত্রপত্রিকার মধ্যে 'সার্চ লাইট', 'দ্য ইন্ডিয়ান নেশন', ও 'বঙ্গশ্রী' অন্যতম।

দেশভাগের মত দাঙ্গার উৎপীড়নও ভারতীয় জীবনের এক বিরাট সমস্যা। ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের মৃত্যুর চরম অভিশাপ নেমে আসে ভারতভূমিতে। চেনা মানুষগুলোর মুখ হঠাৎ করে কেমন বদলে যায়। এক দানবীয় শক্তিতে ভরপুর হয়ে উঠল দাঙ্গাকারীর হৃদয়পুর। হত্যা, সম্পদ লুন্ঠন, নারীর ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলার মত ভয়ঙ্কর সব অপরাধ সংঘটিত হল সেই কালপর্বে। আমরা জানি, সাহিত্য সমাজ জীবনের আরশি রুপ। অর্থাৎ সমাজে ঘটমান সব বিষয়ের চালচিত্র ধরা পড়ে সাহিত্যধারার ছেঁকনিতে। সাহিত্যের এ এক অমোঘ বিধান। কেননা, কবি কিম্বা লেখক, নামের আগে সামান্য পদ নয়। একজন সাহিত্য সাধক সমাজের অন্যতম বৌদ্ধিক অংশ। সমাজের প্রতিনিধিত্ব করার এক বিরাট দায় তার। মননদীতে নৌকায় প্রবাহমান হয়ে অচিনপুরের প্রেমিকার জন্য সোনায় ডোবানো লাল গোলাপ আনলে হয়ত  কবি সত্তার বিকাশ সম্ভব, কিন্তু সময়কে ও কালকে নিজ সাহিত্য কথনে না ধরাও এক ধরনের অপরাধ। কেননা, সময়ের প্রসববেদনায় সাহিত্যের দিকপ্রবাহ নিদিষ্ট করে দেয়, সাহিত্য সাধক এক প্রকার নিরুপায়। সময়ের ইশারায়, সকল প্রকার অসাম্যর বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন অবলীলায়।

পঞ্চাশের দশকের সাহিত্য সাধকগণ দাঙ্গায় পীড়িত জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। এই সর্বনেশা কমুনাল ভাবনা যে কত্তটা ক্ষতিকর, তা তাঁরা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই উপলব্ধিই তাঁরা তাঁদের সাহিত্য শরীরে প্রবলভাবে অঙ্কন করেছেন। বিশেষ করে বাংলা কথা সাহিত্যে দাঙ্গার বিরাট ছবিপট ধরা পড়েছে, যা তৎকালীন সময়ের ভয়ঙ্কর চিত্রপটকে জীবন্ত করে তোলে। এমনই কিছু ছোটগল্প নিয়ে আমরা আলোচনা করব। সেগুলি হল, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের 'স্বাক্ষর' (১৩৫৩ বঙ্গাব্দ ), 'দাঙ্গা' (১৩৫২ বঙ্গাব্দ ), মানিক বন্দোপাধ্যায়ের 'খতিয়ান' (১৩৫৩ বঙ্গাব্দ ), তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের 'কলিকাতার দাঙ্গা ও আমি' (১৩৫৩ বঙ্গাব্দ ), বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের 'কলিকাতার নোয়াখালি - বিহার' (১৩৫৪ বঙ্গাব্দ ), রমেশচন্দ্র সেনের 'সাদা ঘোড়া' (১৩৫৩), সমরেশ বসুর 'আদাব' (১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দ ) অন্যতম।

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের 'স্বাক্ষর' নামক গল্পটি দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে রচিত অন্যতম একটি সাহিত্য কাজ। গল্পটা দুই বন্ধুর। প্রধান দুই চরিত্র হল দিননাথ ও জহুর আলি। একজন হিন্দু ও অন্যজন মুসলিম হলেও দুইজনের জীবিকা একই। দুইজনই ফেরিওয়ালা। দীননাথের বাড়ি যশোর এবং জহুর আলীর বাড়ি বরিশাল। দুইজনই জীবিকার সন্ধানে পাড়ি জমায় শহর কলকাতায় ।উভয়ই পরিশ্রম করে বেশি বেশি অর্থ দেশে পাঠাবে বলে। স্মৃতিতে প্রায় ভেসে ওঠে ফেলে আসা দেশবাড়ির মাঠ ঘাট আর মানুষগুলোর কথা ।দীননাথ বরফ, কুলফি, আলতা, কাঁটা বিক্রি করে। জহুর আলি বিক্রি করে ডিম কখনও সবজি। ভারী মিল দুই বন্ধুতে। একে অপরের সাথে অর্থের আদান প্রদানের পাশাপাশি, হৃদয়েরও বিরাট মেলবন্ধন ঘটে। এমন কালপর্বেই শহরে নেমে আসে দাঙ্গার কালো রাত। দুই বন্ধুর মধ্যে এক বিরাট পরিণত লক্ষ্যগোচর হয়। প্রাণপ্ৰিয় দুই বন্ধুর মেলবন্ধনের মাঝখানে আড়াআড়িভাবে দাঁড়িয়ে যায় ধর্ম। একে অপরের বিরুপে কমুনাল সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুজনে। গল্পের শেষ দিকে দাঙ্গার আগুন একটু শিথিল হতেই, একটি পোড়া বাড়িতে আশ্রয় নেয় দুইজন। তখন তাঁরা দুটি ধর্মের মানুষ মাত্র, বন্ধু নয়। দুইজনেই অসহায়। চারিদিকে ভয়ের পরিবেশ, বুটের খটমট শব্দ। সমরেশ বসুর আদাব গল্পের কথা মনে পড়ে যায় গল্পটি পাঠ করতে করতে। প্রাণভয়ে আশ্রয় নেয় দুই বন্ধু, দুটি ধর্মের প্রতিনিধি তাঁরা। অথচ, কেউ কাউকে আক্রমন করছে না। বরং কাছাকাছি বসল তাঁরা। এবার একে অপরের কন্ঠ শুনে চিনতে পারল। দীননাথ ও জহুর আলীর সেই পুরনো বন্ধু প্রেম জাগ্রত হল আবার।

 

'তোর চোট লেগেছে কোথায়?
- মাথায়, বুকে। তোর?
- আমারও।'

কমুনাল ভাবনা অল্প কিছু প্রহরের জন্য দুই বন্ধুর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটালেও, শেষ পর্যন্ত বন্ধুত্বর জয় ঘটল। অর্থাৎ এ জয় অশুভ শক্তির উপর শুভশক্তির। একই বিড়ির টানের মধ্য দিয়েই তাঁরা বিসর্জন দিল উগ্রধর্ম ভাবনার দিক প্রবাহকে।

মানিক বন্দোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাকার। দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে লিখিত তাঁর অন্যতম একটি সাহিত্য কাজ হল, 'খতিয়ান' নামক ছোটগল্পটি। এখানে গল্পকার একটি কারখানার শ্রমিকদের চরিত্র বিচার করেছেন। এক সাথে কাজ করা, কিম্বা ধর্মঘট, মিটিং, মিছিল এক সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে করলেও, দাঙ্গার আগুন লাগলেই, হিন্দু মুসলমান শ্রমিক দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ল ।হিন্দু মুসলিম দুই ধর্মের প্রতিনিধি হিসাবে গল্পকার দুই বন্ধুর গল্প শুনিয়েছেন। দাঙ্গার পূর্বে যাঁদের মধ্যে ছিল গভীর প্রেম, কমুনাল সংঘর্ষের পরিআবহে তারাই হয়ে উঠল একে অপরের শত্রু।

'দারুণ আক্রোশে হন্যে হয়ে দুটি দল চালিয়েছে হানাহানি খুনোখুনি লুটতরাজ আগুন দেওয়া। হৈ চৈ হল্লার আওয়াজ এসে অবিরাম ভয়চকিত মনে হানা দিয়ে সচেতন করে রাখছে।'

দুই বন্ধু বেমালুম ভুলে গেল তাদের বন্ধুপ্রীতির কথা। মানিক বন্দোপাধ্যায় বরাবরই অনন্য ভাবনার লেখক। মার্কসবাদি ও কমিউনিস্ট ভাবনার পূর্ণতা রয়েছে তাঁর গল্পের গাঁথুনির অন্দরে। এ গল্পটিও ব্যতিক্রম নয়। মানিক লিখছেন,

'মড়া পচা গন্ধ শুঁকে বুঝতে পারছ কোনটা হিন্দুর, কোনটা মুসলমানের?'

মানিক জানেন, গরিবের কোন ধর্ম, কোন জাত নেই। অথচ দাঙ্গাপীড়াই তাঁদেরকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। কেননা, গরিবের জীবনের দাম কতটুকুই বা ! কারখানার গেটে ১৪৪ ধারা জারি হয়। এক বন্ধু উন্মাদ হয়ে, অন্য বন্ধুর কলার চেপে ধরে বলে,

'আজ শালা তোকে খুন করব।'
উত্তরে বন্ধু নিরুপায় হয়ে বলে, 'কর'। এভাবেই যুগের পর যুগ গরিবের হাতে খুন হয় গরিব প্রান্তিক মানুষজন। অথচ দাঙ্গা যারা বাঁধায়, চিরকাল তাদের এই দাঙ্গা বাঁধানোর পিছনে কূউদ্দেশ্য থাকে। সম্পদ লুন্ঠন, জমির দখল নেয় তারা, আর মৃত্যু শিবিরে ভর্তি হয় হতভাগ্য সব গরিবের দল। মানবদরদী কথাকার মানিক বাবু এখানে একটা অনন্য বার্তা দিলেন, শ্রমিকের এক জোট হওয়া দরকার, প্রয়োজনে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের প্রতিস্পর্ধা গড়ে তুলতে হবে।

দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে লেখা তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের 'কলিকাতা দাঙ্গা ও আমি', এ ধারার অন্যতম সেরা সংযোজন। দাঙ্গার ভয়াবহতার এক বীভৎস বর্ণনা দিয়েছেন গল্পকার। গল্পের শুরুতেই, এক প্রচন্ড ভয়ের পরিবেশময় ছবিপট তৈরি করেছেন লেখক। 

'মায়ের কোল থেকে ছেলে ছিনিয়ে নিয়ে.... নারীকে ধর্ষণ করে খন্ড খন্ড করে কাটা'

এমন সব শিউরে উঠবার মত চিত্রপট অঙ্কন করেছেন লেখক, যা মোটেও বাড়াবাড়ি পর্যায়ের নয়। কেননা, প্রতিটি দাঙ্গার চরিত্র এমনই ভয়াবহ হয়। একই সাথে প্রতিটি দাঙ্গা বা কমুনাল হিংসার পিছনে থাকে রাজনৈতিক ইন্ধন, সেটাও গল্পকার উপলব্ধি করেছিলেন। কেননা, তারাশঙ্কর নিজেই ছিলেন একজন সক্রিয় ও দক্ষ রাজনীতিবিদ। তিনি খুব ভালো রকম চিনতেন এই রাজনীতির কারবারিদের। লেখকের মতে,

'কতিপয় স্বার্থন্বেষী রাজনীতিকের আপন সম্প্রদায় সমাজ এবং রাজনৈতিক দলের মধ্যে আসন কায়েমী করার জন্য এটা একটা সামন্ততান্ত্রিক নীতি।'

গল্পের অন্যতম একটি চরিত্র হাফিজ। দাঙ্গার আগুন তখন সর্বত্র। হিন্দু মুসলমানকে মারছে, মুসলমান হিন্দুকে। প্রাণ বাঁচাতে হাফিজের ধর্মপরায়না স্ত্রী সিঁথিতে সিঁদুর লেপন করে, হাফিজ হিন্দুদের মত পরিধান করে নেয় ধুতি আর পাঞ্জাবী। হিন্দু পাড়া দিয়ে বেঁচে ফিরে, হাফিজ বলে,'নামাজ সেরে নি ধীরে সুস্থে খোদাতালাকে আল্লার রসুলকে প্রাণ ভরে ডাকি। বড় বেঁচে এসেছি।'

তারাশঙ্কর এমন ভয়াবহ ভাতৃঘাতি দাঙ্গার জন্য রাজনীতিক অস্থিরতাকেই দায়ী করেছেন। গল্পে তিনি একটি বাউল গানের ব্যবহার করেছেন, যা তাঁর এই ধারণাকে পরিপুষ্ঠতা দান করেছে।

'জ্ঞান বুদ্ধির বড় লাইন গিয়েছে হেরে/

ভক্তিপথের ছোট গাড়ি হায়রে আগে দিয়েছে ছেড়ে /আমার নিতাই চাঁদের ডেরাইবারির - কি কারিগরি / মরি রে মরি । হায় তামাশায় হেসে যে মরি।'

রমেশচন্দ্র সেনের 'সাদাঘোড়া' সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিপরীতে দাঁড়িয়ে সম্প্রীতির ঐক্যর কথার প্রতিস্থাপনা দিয়েছে। একটি সাদা ঘোড়া। বলে নিই, সাদা রংটি শান্তির প্রতীক । সাদাঘোড়াটিও গল্পে শান্তির দূত হিসাবে নিয়ে এসেছেন গল্পকার ।গল্পের কাহিনীটি এইরূপ, চাঁদ নামের ঘোড়াটি নিয়ে হিন্দু পাড়ায় বিরাট আলোচনা ও গুঞ্জন। সাদা ধবধবে রংয়ের ঘোড়াটিকে খুব পবিত্র মনে হয়। মনে স্বর্গ থেকে এসেছে যেন। অভূক্ত ঘোড়াটিকে দেখে ছেলের দল পূজা করার কথা বেমালুম ভুলে যায়। ঘোড়াটির তখন আলাদা কদর সবার কাছে। সকলেই আদর করতে চাই। পাড়ার ছেলেরা পিঠে চেপে বেড়ায়। মাত্র কয়েকদিনেই হিন্দুপাড়ার সকলের প্ৰিয় হয়ে ওঠে চাঁদ। অথচ মালিকের অভাবে ঘোড়াটি শীর্ণপ্রায় হয়ে পড়ে। কারও হাতে সে খেতে চাই না। হঠাৎ একদিন ঘোড়াটির মনিবের আবির্ভাব ঘটে। মানুষটি মুসলমান। লুঙ্গিপরা, মাথায় ফেজটুপি। ঘোড়াটি দেখতে পেয়ে মানুষটি মহা আনন্দ পাই। সাদাঘোড়াটিও মনিবের হাতের খাবার খায়। গল্পে এবার আসে চরম ক্লাইমাক্স। হিন্দু পাড়ায় একজন ফেজটুপি পড়া মুসলমান দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে হিন্দু উন্মাদ জনতা। শেষ পর্যন্ত গুলির আঘাতে মারা গেল চাঁদ নামক সাদাঘোড়াটি। তার মৃত্যুর মধ্যেই শান্তি স্থাপিত হয়।

'সোরাব তখন আকাশের দিকে চাহিয়া আছে। হীরক স্বচ্ছ আকাশের মত নির্মল দৃষ্টি। সে চাহনিতে কোন বেদনা নাই, গ্লানি নাই, হৃষিকেশও পাশে দাঁড়াইয়া ছিল।'

সোরাবের চাহনির মধ্যে আমরা যেন গফুরকে খুঁজে পায়। মহেশের মৃত্যুর পরও তাঁর চাহনি এমন নির্মল ছিল।

সমরেশ বসুর 'আদাব' নামক গল্পটি দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে রচিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য প্রতিফলন। দাঙ্গার ভয়াবহতা, হত্যা, লুন্ঠনের মাঝখানে দুটি চরিত্র এক সাথে আশ্রয় নেয়। রাস্তায় তখন কার্ফু জারি হয়েছে। দুটি চরিত্রই প্রান্তিক সমাজের প্রতিনিধি। একজন মুসলমান মাঝি, অন্যজন হিন্দু শ্রমিক। প্রথম দিকে একসাথে থাকলেও গল্পের মাঝে উভয় উভয়ের ধর্ম পরিচয় জানতে পারে। অর্থাৎ মাঝি মুসলিম, শ্রমিক মানুষটি হিন্দু, এই পরিচয় তখন একে অপরের মাঝে চরম অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। কেননা, দাঙ্গার সময় হিন্দু মুসলিম একে অপরের শত্রু। দুটি চরিত্র এক সময় একে অপরের বিশ্বাস অর্জন করতে সক্ষম হয়। আসলে, গরিবের তো কোন ধর্ম নেই, জাত নেই। তারা গরিব, এটাই তাঁদের একমাত্র পরিচয়। সমস্ত কমুনাল হিংসা কিম্বা যেকোন পীড়ার শিকার হন একমাত্র গরিব প্রান্তিক সমাজের গণমানুষরা। এ গল্পেও মাঝি ও শ্রমিক দুইজনই মৃত্যুর মাঝামাঝি এসে দাঁড়ায়। পরের দিন ঈদ। মাঝি বাড়ি যেতে চাইলেও, সুতোর শ্রমিক পরম মমতায় অচেনা ও অন্য ধর্মের মানুষ মাঝিকে যেতে নিষেধ করে।'যায় ও না ভাই'। কিন্তু মাঝিকে যে যেতে হবে, বিবি বাচ্চারা সব পথ চেয়ে আছে, সে না গেলে ঈদের আনন্দটাই বৃথা যাবে। মাঝি বেরিয়ে আসে রাস্তায়। সুতোর মিস্ত্রি হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও মুসলমান মাঝির জন্য প্রথনা করে। পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয় মুসলমান মাঝি। বন্ধু হারানোর মত কষ্ট পায় সুতাকলের শ্রমিক। ক্ষতবিক্ষত হয় হিন্দু শ্রমিকের হৃদয়পুর।

গল্পটিতে সম্প্রদায়িক হিংসার পাশেই সম্প্রীতির বার্তা দিলেন লেখক। ধর্ম উন্মাদ মানুষের শহরে দুইজন ভিন্ন ধর্মের মানুষের গভীর মেলবন্ধন এই গল্পের মূল সুর হিসাবে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। হিংসা কখনই সভ্যতাকে দিশা দেখাতে পারে না, মানব প্রেমই মানুষের মুক্তির একমাত্র উপায়।

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় 'কলিকাতা নোয়াখালি - বিহার' গল্পটা এই দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে লিখিত। দাঙ্গার আগুন কিভাবে নোয়াখালি ও বিহারে ছড়িয়ে পড়ল, তার মর্মান্তিক আলোকপাত করেছেন লেখক। দেশভাগ, চারিদিকে ভাঙ ভাঙ রব। মসজিদ ভাঙ, মন্দির ভাঙ চিৎকার এবং মানুষের ভয়াবহ যন্ত্রনা এ গল্পের ছবিপট। একদিকে 'লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান', অন্যদিকে 'জয়হিন্দ', 'বন্দেমাতরম' ধ্বনিতে তখন মুখরিত কলকাতার আকাশ বাতাস। দাঙ্গার পীড়ায় তখন বাতাসে বারুদের গন্ধ আর হায়েনার চিৎকার।

'ঘর সাত আট হিন্দু বাড়ি নিয়ে একটা ছোট্ট গ্রাম - একটা উঁচু জমির -  ওপর, যেমন ওদিককার গ্রামগুলো হয়, তারপর বিঘে দশেক একটা নীচু মাঠ, তারপরেই বড় একটা গ্রাম, মুসলমানদের বসতি। পুড়িয়েছে গ্রামটাকে। টাটকা ধ্বংস, তাজা রক্তের মতো আগুনের ছাপ এখানে - ওখানে জমাট বেঁধে রয়েছে।'

 

তথ্য সূত্র:

ছেচল্লিশের দাঙ্গা: সন্দীপ বন্দোপাধ্যায়
দাঙ্গা ও দেশভাগের গল্প: সুদীন চট্টোপাধ্যায়
একশ এক গল্প: অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
ছোটগল্পে দাঙ্গার প্রেক্ষিতে - প্রেক্ষাপট: দীপন দাস 

 

আরিফুল ইসলাম সাহাজি 
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top