সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

রুসনী : কাজী কেয়া 


প্রকাশিত:
১৬ জুন ২০২১ ২১:৫৮

আপডেট:
২৬ জুন ২০২১ ২০:১২

 

এই আঁধার ঘিঞ্জি ছেঁড়াফাড়া বস্তির একটাই আলো- নাম তার রুসনী। যেন ঝোপঝাড়-উলুখাগড়ার মাঝে ফুটে উঠেছে একটা সোনালি স্বর্ণকমল। সাদা-হলুদে মাখা দেহখানি। উজ্জ্বল চোখজোড়ায় কী এক মায়ার আবেশ। হাসলে শারদশশির আলো যেন নীরবে দীপ্তি ছড়ায়। সবাই ভালোবাসে ওকে। ছোটরা বলে রুসিপ, বড়োরা রুসনী পরী। সদাহাসিখুশি রুসনীর জীবনের সবটুকু গল্প এই সুখ-দুঃখের বস্তিকে ঘিরে।

কালু সর্দারের মা-মরা একমাত্র কন্যা হিসেবে এই বস্তিতে ওকে সবাই জানে, চেনে। সবাই ভালোবাসে, স্নেহ করে। ছোটরা রুসিপু বলতে পাগল। কালু সর্দার একসময় সদরঘাটের কুলির সর্দার ছিল। সেখানেও তার দাপটের কমতি ছিল না। বয়সের সাথে তেজ একসময় কমে যায়। বছর পাঁচেক আগে সে কুলিগিরি ছেড়ে এই বস্তিতে থিতু হয়েছে। প্রায় বিশ বছর ধাে এই বস্তিতেই আছে কালু সর্দার। এখন বস্তির সর্বসের্বা। তার পরামর্শ মেনে বস্তিবাসীরা চলার চেষ্টা করে। রুসনীকে সেই শিশুকাল থেকে কোলে-পিঠে করে, আদর-যত্নে লালন করে চলেছে। রুসনী বাজান বলতে অজ্ঞান। বাজানের দিকে তার খেয়াল সবসময়। রুসনীররান্না শিখেছে বস্তির কলমি খালার কাছে। সে এখন নিজেই রান্না করে। বাজান ওর হাতের রান্না খেয়ে খুব তৃপ্ত হয়। খেয়ে বলে, রুসনী মাজান, তুমি এমন রান্না করতে শিখছ, এমন রান্না আমার মাও জানত না। একথা বলেই মেয়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসি দেয়। রুসনী বাবার প্রশংসায় মিটমিট হেসে বলে, বাজান কাল কিন্তু পদ্মার ইলিশ আইনো, সঙ্গে মুখিকচু। আমারে কলমী খালা কইছে, কচু দিয়া ইলিশ রান্নার স্বাদ কয়ে বোঝানো যায় না। কালু সর্দার হাসে। বলে, আনব মাজান। তোর হাতের ইলিশ-কচু না খাইতে পারলে আমার জীবন পানসে থাকবে যে। বস্তির সঙ্গে লাগোয়া একটা মুদিদোকান খুলেছে কালু সর্দার। নিত্য প্রয়োজনীয় সবই প্রায় এ দোকোনে থাকে। চায়ের ব্যবস্থাও আছে।। খরিদ্দারদের বসার জন্য দোকানের সামনে একটা লম্বা বেঞ্চ পাতা আছে। বস্তিবাসীরা এ দোকানের পাকা খরিদ্দার। পথচারিরাও এটাওটা কেনে। চা খেতে এখানেই আসে। কালু সর্দারই দোকানে বসে। তবে, সময় সময় রুসনীও বসে। রুসনীর হাতের চা নাকি খুব ফাইন। যে খায় সেই প্রশংসা করে। কালু সর্দার চায় না রুসনী দোকানে বসুক। সে চায় রুসনী লেখাপড়া শিখে বিএ-এমএ পাশ করুক। লেখাপড়া শিখে একটা সরকারি চাকরি পেলে মেয়েরে নিয়ে সে বস্তি ছেড়ে শহরের ভদ্রমহল্লায় চলে যাবে। ওর বিয়েশাদির কথাও ভাবে কালু সর্দার। ‘একটা ভালো ছাওয়াল যদি পাই। মেয়ে তো না আসমানের পরী। আমার মাইয়ারে কে না পছন করে!- সময় সময় একথা ভেবে মৃদু হাসে কালু সর্দার। রুসনী লেখাপড়ায় খুবই ভালো। ছোটবেলায় একটা এনজিওর পাঠশালায় ওকে ভর্তি করা হয়। সেখানেই প্রাথমিক পাঠটা শিখেছে। হাতের লেখা মুক্তার মতো। ইংরেজি-বাংলা, আলিফ-বে-তে-ছে- সবই চোখ বুঁজে তরতর করে লিখতে পারে। এরপর হাই স্কুলে ভর্তি হয়। ক্লাস এইটে পড়ছিল, তো করোনার কারণে পরীক্ষা না দিয়েই অটোপাশ করে ক্লাস নাইনে উঠেছে। বোর্ডের বইপত্তর স্কুল থেকে ফ্রি পেয়েছে, আর কালু সর্দার ক্লাস নাইনের বাকিবইও কিনে দিয়েছে। বস্তির একমাত্র মেয়ে রুসনী- যে হাই স্কুলে পড়ে। মাঝে মাঝে সে বস্তির ছোটদের নিয়ে পড়াতে বসে। বস্তির ভেতরে একটা ছাউনি আছে। ওটাই রুসনীর পড়ালেখার জায়গা। ওখানেই সে বস্তির বাচ্চাদেরও অক্ষরজ্ঞান শেখায়। এখন করোনার কারণে স্কুল বন্ধ। রুসনী তাই ঘরে একা একা পড়াশোনা করে, পাশাপাশি ঘরের কাজকাম শেষে বাবার দোকানে বসে। বাবা নিষেধ করেও পারে না। আবার রুসনী দোকানে বসলেই বেচাবিক্রি বাড়ে। ওর হাতের চা বলে কথা। কালু সর্দার মনেমনে খুশিই হয়। ভাবে- মেয়ে ওর সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মী। ষোড়সীর ছোঁয়া লেগেছে রুসনীর গায়ে। অচেনা কেউ দোকানে এলে প্রথমেই রুসনীর দিকে নজর যায় তার। মনে মনে ভাবে, গোবরে পদ্মফুল এ যে। রুসনীর ইদানীং লজ্জা পায়, কেউ ওর দিকে অমন দৃষ্টিতে তাকালে। সে সংযত হয়। ওড়নাটা ভালো করে জড়িয়ে নেয়। বস্তি হলেও তার ছোট্ট ঘরটা বেশ সাজিয়ে রাখে রুসনী। বাজান কালু সর্দার পড়–য়া মেয়েটির প্রয়োজনীয় সবই কিনে দেয়। তার সাজগোজের টুকিটাকি জিনিস তো আছেই। একটা ছোট্ট ড্রেসিংটেবিলও আছে রুসনীর। রুসনী এখন প্রায় ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় নিজের অবয়ব দেখে। দেখে নিজেকেই চিনতে পারে না। বোঝে সে বড় হয়ে উঠছে। কিভাবে এতগুলো বছর সে পার করো এলো তা সে নিজেও ভেবে পায় না। শুধু একটা ভাসাভাসা ছবি তার স্মৃতিতে ইদানীং ভেসে ওঠে। একটা স্টিমার সিটি দিয়ে ভেসে চলেছে। এটুকুই। এর বেশিকিছু তার মনে পড়ে না। সবসময় না। কখনো কখনো। হঠাৎ কখনো আনমনা হলে স্টিমারটা তার চোখে দোল খায়। আর ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে সে এটা প্রায় দেখে। স্মৃতির মধ্যে এই দৃশ্যটা সে ছোটবেলায়ও দেখতো, তবে তখন এটা তার মধ্যে তেমন প্রতিক্রিয়া করতো না।এখন সে প্রায়ই এ দৃশ্যটা দেখতে পায়। বছরখানিক ধরে এমন হচ্ছে। কালু সর্দারের বয়স হয়েছে। দিন কেটে যাচ্ছিল বেশ। হঠাৎ কঠিন পীড়ায় পড়লো। একেবারে মরো মরো অবস্থা। রুসনীকেই সব সামলাতে হয় এখন। বস্তির রহমত চাচা তাকে অনেক কাজে সহযোগিতা করে। বাজার-সদাই, রান্নাবান্না, দোকানে বসা, বাবার ওষুধপথ্য , সেবা- সবই করতে হয় রুসনীকে। রহমত চাচা বাজার-সদাই করে দেয়া আর দোকানের কাজো তাকে সহযোগিতা না করলে সবদিক সামাল দেয়া খুব কঠিন হতো রুসনীর পক্ষে। এরমধ্যে হঠাৎ এক মাঝরাতে কালু সর্দার শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট অনুভব করলো। মৃত্যুভয় তাকে জেঁকে ধরলো। রুসনীর ভবিষ্যত নিয়ে সে শঙ্কিত হলো। সে মরে গেলে রুসনীর কী হবে! ব্যাপারটা ভাবিয়ে তুললো তাকে। সে সিদ্ধান্ত নিলো, এতোদিন গোপন করে রাখা পরিচয়টা সে প্রকাশ করবে। রুসনী এখন বড়ো হয়েছে, সত্যটা জানা তার অধিকার। সে নিজেকে সামলে নিতে পারবে। নিজের পথ সে বেছে নিতে পারবে। হয়তো তার হারিয়ে যাওয়া বাবা-মা, স্বজন-পরিজনদেরকেও সে খুঁজে নিতে পারবে। আত্মপরিচয়ে সে বাকিজীবন কাটাতে পারবে। এই বস্তির ঘিঞ্জি পরিবেশ থেকে সে মুক্তি পাবে। এসব ভেবে রুসনীকে ডেকে কাছে বসতে বলল। রুসনী তার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলল, বাজান, তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে? ‘না, মা, তুই বস। মনে হয় আমি আর বাঁচবো না। দিন আমার শেষের দিকে। তো আমি তোরে আজ একটা সত্য কথা বলে যেতে চাই।’ কালু সর্দারের এমন কথায় রুসনী অবাক হলো।আবার অজানা কথাটা জানার জন্য বেশ উৎসুক হয়ে উঠল। বলল, বাজান, কী এমন কথা যা আমারে তুমি কওনি? তুমি তো আমারে সব কথাই কইছো। খুব ছোটকালে আমার মা মরে গেছে। তারপর তুমি মনের দুঃখে শহরে চলে আসলে। নিজের জীবনডারে জীবন মনে করোনি। আমার জন্য তুমি সারাজীবন কী কষ্টেই না কাটায়ে দিলে। এটাই তো আমি জানি।,, রুসনীর কথা শেষ হতেই কালু সর্দার ডুকরে কেঁদে ওঠে একবার। তারপর ওর দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে অপরাধীর মতো ওর হাত দুটো মুঠোয় নিয়ে বলল, মা-রে, আসল সত্যটা আমি তোরে জানাইনি। আমার কোনো ফাঁকি ছিল না তাতে। বাধ্য হয়েই তোরে তা কইনি। তোরে আমি কখনো ভাবতে দিতে চাইনি, তুই আমার মেয়ে না। সত্যি কথাটা আজ বলতে না পারলে মরেও আমি শান্তি পাবো না। আসল কথা, তুই সত্যিই আমার কেউ না। তোর নামডা, এটাও আমর রাখা নাম। এত ছোটবেলায় তোরে পাইছি আমি, তোর নামডা যে কি, সেডাও বলার মতো বয়স হয়নি তোর। তো পরীর মতো দেখতে এই সুন্দর মাইয়াডার নাম রাখলাম রুসনী। মা রে, সে অনেক কথা, অনেক বড় কাহিনীরে মা। তোরে আমি আজ সব কবো।, সব..

 কালু সর্দার রুসনীকে আরো কাছে টেনে নেয়। রুসনী কি এমন কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল? সে একেবারে স্থবির, বধির হয়ে যায় যেন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কালু সর্দারের দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন, বাকি কাহিনিটা সে শুনতে ব্যাকুল হয়ে আছে। সর্দার একটু থেমে আবার বলতে থাকে, মা-রে, আমার বয়স হইছে। হঠাৎ কহন যে ওপারের ডাক আসে, তা তো কবার পারি না। তয়, তোরে আসল কথাটা কয়েই যাই। আমি তোর আসল বাপ না, এডা তো কইছিই তোরে। আমি তোরে শেখের ঘাটের পারে কুড়ায়ে পাইছিলাম। তুই ভাসতে ভাসতে ঘাটের কানায় আইসে দোল খাচ্ছিলি। বয়স তহন দুই-আড়াই হবে বড়জোর। তো শুনছিলামওই ঘাটের মাইল দশেক তফাতে নাকি জাহাজ ডুবি হইছিল। একটা স্টিমারের সাথে নাকি একটা জাহাজের ধাক্কা লাগছিল। বর্ষাকালের নদী তখন রানের তোড়ে ফুলে-ফেঁপে পাগলী হয়ে উঠিছিল। জাহাজটা মুহূর্তে তাল হারায়ে কয়েকটা পাঁক খাইয়ে গেল উল্টায়ে। জাহাজ তো গেল উল্টায়ে, সেই মহা ধাক্কায় স্টিমারের অনেক যাত্রীও ছিটকায়ে ভরা গাঙে তলায়ে গেছেঁ। হয়তো কেউ কেউ বাঁচবারও পারে। হয়তো আল্লর ইচ্ছায় কারো পরান রক্ষা পাইছে। সবার ধারণা তুই সেই জাহাজে বা স্টিমারে বাবা-মার লগে ছিলিস। তো আমার দুই কুলে কেউ ছেলো না, সংসারধর্মেও মন টানে নাই। ভাবলাম তোরে যখন আল্লায় পাওয়াইছে, আর চিন্তা কিসের। বাপ-বেটিতে আমরা বাকি জীবন পার কইরা দেবো সুখে-দুখে। তাও ভাবিনি আগে। খুব খুঁজছি তোর আসল বাপ-মারে। জাহাজ ছাড়ছিলো হুলার হাট থে। সেই জায়গাতেও তোর আসল ঠিকানার তালাসে কয়দিন সবাইরে জিগাইছি। কেউই সঠিককিছু কইতে পারে নাই। তোর জ্ঞান ফিরলে তুইও কোনো কান্নাকাটি করিস নাই। কী সোন্দর টুকটুকির মতো আমার কোলে শুয়ে শুয়ে এদিক-ওদিক চাচ্ছিলি। তারপর তো ইতিহাস। কবে যে তুই আমার পরানের পরান রুসনী মা হয়ে উঠছিস তা এহন আমি মনে করতেই পারি না।.. এ-কটা কথা বলেই রুসনীকে জড়িয়ে আবারো ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে কালু সর্দার।

রুসনীও যেন কিছু বুঝে উঠতে পারে না। এতদিন পর কালু সর্দারের কাছে তার নতুন পরিচয় পেয়ে সে বিস্মিত হয়ে পড়ে। সে নির্বাক। সে মনে করতে থাকে তার ছোটবেলার সেই অদ্ভুত স্বপ্নের কথা। যা সে অনেক দিন পর আবারও ঘুমঘোরে প্রায় দেখে। একটা স্টিমার ভরানদীতে সিটি দিয়ে ঢেউ ভেঙে ভেঙে এগিয়ে চলেছে। একই স্বপ বার বার। স্বপ্রে কথা ভেবে সে বিনাশর্তে বিশ্বাস করে নিলো পালকপিতা কালু সর্দারের সবকথা কেমন বিভোরতা পেয়ে বসে রুসনীকে। সে হারিয়ে যায় অচেনা এক গ্রামে। অনেকটা গঞ্জের মতো জায়গা। অনেক দোকানপাট। একটা ব্যস্ত বাজার। অনেক মানুষ। সে যেন হাঁটছে বাজারের রাস্তা দিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে বাঁদিকের খোয়া বিছানো নতুন রাস্তা দিয়ে এগুতে থাকে। যেতেযেতে ডান দিকে গাছপালা ঘেরা একটা সাদা দোতলা বাড়ি। বাড়িটা দেখে সে থমকে দাঁড়ায়। হঠাৎ যেন বাড়ির ভেতর থেকে নারীকণ্ঠ ভেসে এলো- খুকি আইছিস? কই ছিলি মা? সেই ডাকে চমকে ওেেঠ রুশনী। সম্বিৎ ফিরে আসতেই দেখে কালু সর্দরের মাথাটা বালিশ থেকে ঢলে পড়েছে। বাঁ হাতটা বিছানা থেকে সরে গিয়ে ঝুলছে। গায়ে হাত ছোঁয়াতেই বুঝে যায় মুহূর্তেই, তাঁর বাজান আর নেই। চিৎকার করে কেঁদে ওঠে রুসনী- বাজান, তুমি যা কইছো সব মিথ্যা। আমি কিছুই বিশ্বাস করি না। তুমিই আমার সব। তুমিই আমার বাপ, তুমিই আমার মা। আমি আর কাউরে চিনি না। আমি হুঁশ হবার থে জানি তুমিই আমার সব। বাজান, এহন আমার কি হবে! আমারে তো আর কিছুই কয়ে গেলে না। কিছুই জানায়ে গেলে না। বাজানরে..! কখন যে ভিড় জমে গেছে রুসনীর তা খেয়াল নেই। রুসনীর আহাজারির ভাষায় বস্তির অনেকে জেনে গেছে রুসনীর ভাসা ভাসা পরিচয়। ভাসা ভাসা হলেও তারা এটুকু বুঝেছে রুসনী আসলে কালু সর্দারের কেউ না। কিন্তু রুসনীর প্রতি কারোই ভালোবাসার কমতি নেই। তাদের আশঙ্কা রুসনী যদি বস্তি ছেড়ে চলে যায়। রুসনী তাদের হৃদয় দখল করে আছে। সুখ-দুঃখে কালু সর্দারের মতোই সবার পাশে থাকে।

। দুই। এই তল্লাবাগ বস্তির বড় সর্দার কালু মিয়া। কালু সর্দার নামে বস্তির বাসিন্দারা তাকে সমীহ করত। বস্তির বাইরেও একনামে তার পরিচিতি ছিল। বস্তির মানুষের সুখদুঃখের সাথে কালু সর্দার জড়িয়ে ছিল দু যুগ ধরে। ঢাকা শহরের অন্যান্য বস্তিতে নানাধরনের ক্রাইম হয়। নেশাদ্রব্যের কেনাবেচা থেকে শুরু করে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, এমনকি খুনোখুনির ঘটনাও নৈমিত্তিক ব্যাপারে দাঁড়িয়েছে। সেখানে প্রতিদিনই পুলিশি তল্লাসি চলে। কিন্তু কালু সর্দারের কারণে তল্লাবাগ বস্তিুর একটা আলাদা সুনাম গড়ে উঠেছে। আজ কালু সর্দার নেই। তিন দিন হয়ে গেল সর্দারের শেষ বিদায়ের। সারা বস্তি জুড়ে শোকের নিস্তব্ধতা। থানার পুলিশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি- সবার কাছেই কালু সর্দারের একটা সুনাম ছিল। ভালো মানুষ হিসেবে জানত সবাই। সেই সুবাদে ওরা বস্তিতে এসেছিল। রুসনীকে সবাই সান্ত¦না দিয়ে গেছে। বলে গেছে তাকে তারা সহযোগিতা করবে। তার লেখাপড়ায় যেন কোনো ছেদ না পড়ে সে ব্যাপারে তারা লক্ষ্য রাখবে। অনেক আশ্বাস তারা দিয়ে গেছে। রুসনী ওদের কথা শুনেছে শুধু। শুনে মাথা নিচু করে নীরবে কেঁদেছে হয়তো। সে মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে তার ভবিষ্যত করণীয়। সে এখানেই থাকবে। অন্য কেউ নয়, কালু সর্দারই তার বাবা। বাবার স্মৃতি ওই দোকানটা সে রক্ষা করবে। ওটাই তার একমাত্র অবলম্বন। পড়াশোনাও চালিয়ে যাবে সে। বাজানের স্বপ্ন- তার রুসনী বিএ-এমএ পাশ করে একটা ভালো চাকরিতে ঢুকবে। এসব ভাবতে ভাবতে কী এক শক্তি তার ভেতরে ভর করে। সে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। ডাক দেয়, রহমত চাচা কি আছেন? রুসনীর ডাকে রহমত মিয়া এসে সামনে দাঁড়ায়- “কিছু কইবি রুসিমা?’ ‘হ চাচা। বাজান তো আল্লার ডাকে চলে গেছেই। তো আপনে তো আছেন। আজ হইতে আপনিই আমার বাজান। আপনার পরে দোকানডার ভার দিতে চাই। আমার আরো অনেক কাজ আছে। পড়াশোনা, বস্তির ছাওয়াল-মাইয়াদের লেখাপড়া শেখানো- আরো কতো কি..। আমি চাই এই বস্তিতেই একটা ইসকুল খুলব। পড়ালেখার ব্যাপারে সবারই সহযোগিতা পাবো। সরকারও চাই সবাই লেখাপড়া শিখুক। আর সেই ইসকুলের নাম দিবো- কালু মিয়া পাঠশালা। সবাইরে কযে দিন, বস্তির সকল বাপ-মা যেন এ ব্যাপারে আমারে সহযোগিতা করে।’

রুসনীর কথার মাঝেই তাকে ঘিরে বেশ ভিড় জমে যায়। কথা ফুরোতেই শতকণ্ঠে সমর্থনের আশ্বাস, আমরা সবাই তোমার কথায় আছি। আমাগোর ছাওয়াল-মায়ে শিকখিত হইতে পারলে আমাগেরই লাভ। আমাগের জীবন খুব কষ্টের। ওরা যেন লেহাপড়া শিখে একটু ভালো থাকবার পারে। এটাই তো আমরা চাই।.. তখন সন্ধ্যার আজান ভেসে আসছে। প্রতিদিন এসময় কালু সর্দার ডাকত রুসনীকে- কইরে মা আমার টুপিটা দে, মসজিদে যাই। রুসনীর কানে যেন সেই ডাকটি ভেসে আসে। রুসনী ভুলে যায় তার বাজান নেই।.. ‘আসতেছি বাজান- বলেই ঘরের দিকে যেতেই থমকে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়েই থাকে রুসনী। ভাবে, সে কোথায় যাবে এই বস্তি ছেড়ে? কোথাও যাবে না। এখানেই তার বাজান আছে। বাজানরে ছেড়ে সে কোথাও যাবে না।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top