সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

শেরকো বিকাস: স্বাধীকারের উচ্চকিত কণ্ঠ : মীম মিজান


প্রকাশিত:
১৬ জুন ২০২১ ২২:৫৮

আপডেট:
১৭ জুন ২০২১ ১৮:০৩

ছবিঃ শেরকো বিকাস

 

কবিতা কালের আয়না। কোনো জাতির প্রতিচ্ছবি। কেননা, এ আয়নায় দেখা যায় স্বচ্ছ অবস্থা। ফুটে ওঠে সেসময়কার মানুষের সার্বিক বিষয়। দেখা যায় মানুষ কীভাবে হাসছে। কীভাবে রোদন করছে। কীভাবে স্বাধীকার অর্জনের জন্য রক্ত ঝরাচ্ছে। আবার গীতলতায় প্রেমিক-প্রেমাস্পদের আদান-প্রদান, মিলন বিরহ বাঙময় হয়। প্রকৃতি, নিসর্গ ঝংকৃত হয়। আকাশ থেকে ঝুম বৃষ্টি নামে। কনকন শীতে থুত্থুরে বুড়োর কাঁপুনি জেগে ওঠে। আবার হিমালয়  জয়ের অদম্য নেশার উন্মাদনা দৃষ্ট হয়। উপমা, চিত্রকল্প, অনুষঙ্গ, ভাবের সমন্বয়ে মানুষের মানসকে ভাবাপ্লুত করে।

পাঠক নিজেকে একজন অনুষঙ্গ মনে করেন সেই প্রকৃত কবিতার। পক্ষান্তরে স্বার্থান্বেষী মহল, কতিপয় কবি নামের কুলাঙ্গার কবিতাকে স্বার্থ লাভের হাতিয়ার হিশেবে ব্যবহার করে। লুটে নেয় অকবিতার বিনিময়ে পদ, পদবি, গাড়ি, নারী আর তকমা। বিশেষ মদদ লাভ করে উচ্ছিষ্টভোগী হয়ে কলুষিত করেন এই মহৎ বিষয়টির। আবার অনেক শাসকের শখ জাগে কবি বা লেখক পরিচয় ফুটিয়ে তোলার। তাই রাইফেল বসিয়ে দেয় বেঈমান কবির ঘাড়ে। বেঈমান চালায় গুলি। আর সেই অন্তঃসার শূন্য শাসক আওড়ায় কবিতার বুলি। ভরে যায় বেঈমানের নিকৃষ্ট মোহের ঝুলি।

এসব ঝুলিকে থোড়াই কেয়ার করে স্বজাতির কষ্টে পীড়িত হয়ে, স্বাধীনতা, মানবাধিকারের জন্য যিনি কবিতা নামক মহৎ বিষয়টিকে বেছে নিয়ে সেটির পরতে পরতে, শব্দ, উপমা, চিত্রকল্প আর ভাবে নিপীড়িত মানুষ আর স্বজাতের কষ্ট আর হাহাকারকে চিত্রায়িত করে বিশ্বসাহিত্যের প্রোজ্জ্বল কবি হিশেবে উচ্চাসনে আসীন হয়েছেন তিনি কুর্দিস্তানের মানুষদের স্বাধীনতা ও স্বাধিকারের প্রতীক শেরকো বিকাস।

কুর্দিস্তানি নির্বাসিত কবি ও স্বাধীনতাকামী নেতা শেরকো ইরাকি কুর্দিস্তানের সোলাইমানিয়াতে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২রা মে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ফায়েক বিকাস ছিলেন কুর্দিস্তানি প্রখ্যাত কবি ও স্বাধীনতাকামী। বাবার কাব্য প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে স্বজাতির যাতনাকে প্রত্যক্ষ করে মাত্র ১৭ বছর বয়সে শেরকো’র কাব্য প্রকাশ হয়েছিল। এই যাতনা ও স্বাধীনতাকামীতা তাকে দেদীপ্যমান করে রাখতো তাই সে-সম্পর্কিত নানা কাজে জড়িত থাকতেন। ফলে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে কুর্দিস্তান মুক্তি আন্দোলনে যোগ দেন ও আন্দোলনের রেডিও ‘দ্য ভয়েস অব কুর্দিস্তান’ এ কর্মরত হন। কুর্দিস্তানের স্বাধীকার ও স্বাধীনতার পক্ষে শক্ত অবস্থান ও আন্দোলনের একজন নিবেদিত প্রাণ কর্মী হওয়ায় তাকে ইরাকি সরকারের চাপে কুর্দিস্তান থেকে একাধিকবার নির্বাসিত হতে হয়েছিল।

বিশটির অধিক কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন তিনি। সুইডেন থেকে ‘দিওয়ানে শেরকো’ নামে তার কাব্য সংকলন ১০০০পৃষ্ঠা করে দু’খণ্ডে প্রকাশ হয়েছে। তিনিই প্রথম কুর্দিস্তানি কবিতায় ‘রুওয়াংগে’ বা ভিশন অনুষঙ্গের প্রচলন করেন। আর তার কবিতাই হয়ে ওঠে অনেক পোস্টার। যা সাধারণত স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে ব্যবহৃত হতো। এধরণের নব্য সংযোজন তাকে ইরাকি পোস্টার কবিতার জনক কবি হিশেবেও খ্যাত করেছে।

তিনি ১৯৮৭ সালে স্টকহোমের পেন ক্লাবের পক্ষথেকে ‘তুচোলস্কি স্কলারশিপ’ এবং ‘ফ্লোরেন্স সিটি স্বাধীনতা পদক’এ ভূষিত হন। তার কবিতা আরবি, সুইডিশ, ড্যানিশ, ডাচ, ইতালিয়ান, ফরাসি, ইংরেজিসহ বিশ্বের অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আর এদেশে লেখকের হাত ধরেই বাঙলায়ন হয়ে মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন পাঠক ও মানুষের মনে নাড়া দিয়েছে। তিনি সারাবিশ্বের কাছে মুক্তিকামী জনতার প্রতীক, নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর, জালিমের শোষণের বিরুদ্ধে বজ্রকণ্ঠ হিশেবেও পরিচিত।

তিনি ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে শিল্প-সাহিত্যের সেবক ও কতিপয় হৃদয়বান মহতের নিমন্ত্রণে আমেরিকা ভ্রমণ করেন। বিখ্যাত একবি সুইডেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকাকালীন ৪ আগস্ট ২০১৩ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

শেরকো’র কবিতা পাঠ করলে আমাদের হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে যায়। চোখের সামনে দেখতে পাই রক্তের সাগর। লাখো মানুষ স্বাধীকারের জন্য যূথবদ্ধ আন্দোলন করছে। আর জোচ্চোর শাসকরা তাদের উপর নিঠুর আদেশ জারি করে গুলি, হামলায় ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। গ্রামের পর গ্রাম ছাই হচ্ছে। লাখো মানুষ পিপড়ের সারির মতো আশ্রয়ের খোঁজে আর্তনাদ করে ছুটছে। একজন কিশোর তার হামাগুড়ি দেয়া সহোদরকে কোলে-পিঠে নিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে। মেহেদী রাঙা হাতের বধূয়া স্বামীর লাশ ডিঙিয়ে ছুটছে পার্শ্ববর্তী রাজ্যে।

শেরকোর কবিতা শুধু তার পিতৃকুলের স্বাধীকারের আরাধ্য স্থান কুর্দিস্তানের প্রতিচ্ছবি নয়। একবিতা ফিলিস্তিন, চেচনিয়া, ইউঘুর, তিব্বত, হংকং, কাশ্মির, আরাকানসহ এরকম ভূমিহারা, মৌলিক অধিকার হারা মানুষদের। আর এসব মানুষকে এরকম তপ্ত কড়াইয়ের টগবগে ফোটা তেলের উপর চুক্তি বা ভাগাভাগি নামক কলমের খোঁচায় মৃত্যু উপত্যকায় ছুড়ে মেরেছে শাদা চামড়ার তথাকথিত মানবতার ফেরিওয়ালারা, সভ্যতার উৎকর্ষতার বুলি কপচানো ব্যক্তিরা, কিংবা অহিংসা পরম ধর্মের ধ্বজাধারীরা।

কাশ্মিরকে ওরা ভাগ করেছিল ওভাবেই। যাতে কলোনি গুটিয়ে পালালেও নিজেদের মধ্যে যেন সবসময় যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। কী এক লোভে পড়ে গেরুয়া পোশাকধারীরা মানবতার সর্বনিকৃষ্ট বিভৎসতা দেখিয়েছে! চরম হিন্দুত্ববাদের রক্তাক্ত হাতের দানব মোদির ক্রীড়নক আজ শানাচ্ছে হাতিয়ার আমাদের দেশের সীমানার পাশের মানুষদেরও সেই ভাগ্য জোর করে চাপিয়ে দেয়ার। আমরা আমাদের ভাইদের হত্যা করি। ওরা মিটমিট করে হাসে। আবার ছেলেখেলার মতো মধ্যস্থতা করতে আসে। ঠিক সেরকমই স্বাধীন জাতি ছিল কুর্দিগণ। অথচ আজ কী দুরবস্থা তাদের! বর্তমান চরম নিপীড়িত খণ্ড খণ্ড  কুর্দি জাতির পিছনে রয়েছে দীর্ঘ হতভাগ্য ইতিহাস। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে কুর্দিরা আজকের এই শোচনীয় অবস্থার মধ্যে পতিত হয়েছে।

নাজুক অবস্থার কুর্দিদের ইতিহাস বেশ পুরনো। সর্বপ্রথম ১২শ শতকে সেলজুক সুলতান সাঞ্জার কুর্দিস্তান নামটি সরকারীভাবে ব্যবহার করেন। তিনি এই কুর্দিস্তানকে একটি প্রদেশের মর্যাদা প্রদান করেন এবং এর রাজধানী নির্ধারণ করেন বাহার নামক মনোরম শহরকে। সেলজুকদের পর এই অঞ্চলের ক্ষমতা চলে যায় প্রতাপশালী অটোমানদের হাতে। মুসলিম অটোমানরা দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলে তাদের শাসন ক্ষমতা পরিচালনা করেন। এই সময়ে কুর্দিদের স্বাধীন হবার কোন সুযোগ ছিল না। কেননা তৎকালীন সময়ে অটোমানরা তাদের দক্ষ সৈন্যবাহিনী দিয়ে তাদের বিশাল সাম্রাজ্যকে কঠোর হাতে শাসন করত ও একচ্ছত্র বজায় রাখত। ফলে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো ক্ষমতা কুর্দিদের ছিল না।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ইহুদি-খ্রিস্টান্দের ষড়যন্ত্র ও দুর্বল শাসকের কারণে অটোমান সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক পতন শুরু হয় তখন অন্যান্যদের মতো কুর্দিরাও তাদের স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার হয়ে উঠে। শুরুর দিকে তুর্কিদের সাথে পশ্চিমাদের সেভরা চুক্তির খসড়াতে কুর্দিদের স্বাধীনতার জন্য গণভোটের উল্লেখ ছিল। কিন্তু এই চুক্তি ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে ১৯২৩ সালে লুসান চুক্তির মাধ্যমে তুরস্ককে স্বাধীনতা দেয়া হয় এবং এই চুক্তির মাধ্যমে কুর্দিদের গণভোটের বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করা হয়। ফলে এর সাথে সাথে কুর্দিদের স্বাধীনতার প্রশ্নও চাপা পড়ে যায়। এর পর ব্রিটিশ ও ফ্রান্সের সিদ্ধান্ত মোতাবেক কুর্দিস্তান কে তাদের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের (ইরাক, ইরান, তুরস্ক, সিরিয়া ও আর্মেনিয়া) মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়।    

একুর্দিস্তান হচ্ছে বর্তমান পৃথিবীর সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রবিহীন ভাগ্যাহত জাতির আবাসভূমি। মধ্যপ্রাচ্যে আরব, তুর্কি এবং ফারসিদের পরেই কুর্দিরা চতুর্থ বৃহৎ জাতিগোষ্ঠী। তুরস্ক, ইরাক, ইরান, সিরিয়া এবং আর্মেনিয়ার ২ থেকে ৩ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের আধুনিককালে কুর্দিস্তান বলতে তুরস্কের পূর্বের কিছু অংশ (তুর্কি কুর্দিস্তান), উত্তর ইরাক (ইরাকী কুর্দিস্তান), দক্ষিণ-পশ্চিম ইরান (ইরানি কুর্দিস্তান) এবং উত্তর সিরিয়ার (সিরীয় কুর্দিস্তান) কুর্দি-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিকে বোঝায়। ভৌগলিকভাবে কুর্দিস্তান অঞ্চলটি জগ্রোস পর্বতমালার উত্তর-পশ্চিম অংশ এবং তোরোস পর্বতমালার পূর্বাংশ নিয়ে গঠিত। এছাড়া আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার সামান্য কিছু এলাকাকেও কুর্দিস্তানের অন্তর্গত গণ্য করা হয়।

পাশাপাশি পাঁচটি দেশ জুড়ে বিস্তৃত হলেও ধর্মীয়, ভাষাগত এবং সংস্কৃতিগত দিক থেকে কুর্দিরা মূলত একই জাতি। কুর্দিরা অধিকাংশই সুন্নী মুসলমান, তবে তারা আরব না। তাদের ভাষা কুর্দি ভাষা, যদিও বিভিন্ন এলাকায় এর আঞ্চলিক রূপভেদ আছে।

উপর্যুক্ত প্রায় সবদেশেই কুর্দিরা চরমভাবে নিপীড়িত। আমরা মাঝে মাঝে দেখেছি, দেখছি, দেখবো তাদের উপর নিষ্ঠুরতম আচরণ। আর আমরা চোখের পানি ফেলে আফসোস করি। এতে কী লাভ হবে! যেখানে মোড়লরা মোড়লী করার জন্য ইঙ্গিতেই মানুষ মারে লাখে লাখে। অকার্যকর জাতিসংঘ। তবে আমরা আশাবাদী হিশেবে আগামী সুন্দর পৃথিবীর প্রত্যাশা করি।

শেরকো বিকাশের কাব্যমালা থেকে লেখকের দ্বারা বাঙলায়ন দশটি কবিতার বক্ষ জুড়ে যে আহাজারি, আর্তনাদ, শাসকদের বিভৎসতা তা খুঁজে বের করা যাক।

স্বাধীনতা কতটুকু প্রয়োজন তা কেবল তারাই জানেন, যাদের এ নিয়ামকটি নেই। পারে না বলতে নিজের কথা। ব্যথা রয়ে যায় বুকে। কোনও দুরারোগ্য  আক্রান্ত যেমন মরে ধুকে। স্বাধীনতা মানে পানিহীন নদী। পাতাহীন গাছ। সন্তানহীন মা। শেরকো এই প্রত্যয়টির প্রয়োজন বর্ণনা করছেন এভাবে:

 

‘যদি আমার কাব্য থেক
প্রসূনকে মোচড়িয়ে বের করো।
আমার কাব্যের চারটি ঋতু হতে
আমার একটি ঋতু মারা যাবে।
তুমি যদি ভালোবাসাকে বাদ দাও
আমার দু'টো ঋতু প্রাণ হারাবে।

যদি তুমি রুটি বাদ দাও
আমার তিনটি ঋতু মৃত্যুবরণ করবে।

আর যদি স্বাধীনতা বের করে নাও
চারটি ঋতু এবং আমি মরে যাবো।’
(বিচ্ছেদ)

এই স্বাধীকার তার বা তাদের কখনোই পাওয়া হবে না বলে করুণ হতাশা প্রকাশ করেছেন কবি। কারণ পূর্বপুরুষদের যাতনা দেখেছেন। যেই তারা এটা চেয়েছে অমনি ঝাপিয়ে পড়ে তাদের নিঃশেষ করার চেষ্টা করেছে। যেটিকে কবি দু’টি রেললাইনের কখনোই যে মিলন ঘটে না তার সাথে উপমা দিয়েছেন। যদি তারা মিলতে চায় তাহলে তাদের উপর দিয়ে অস্বস্তিকর গমনরত মালগাড়ি উল্টে যায়, আর তাদের নানা ময়লা-আবর্জনা দিয়ে ঢেকে দেয়। যেমনটি ‘মালগাড়ি’ কবিতায় লিখেছেন:

‘আমি জ্ঞাত আছি, আমরা...তুমি ও আমি
কখনওই মিলতে পারবো না
যদিও আমরা সম্মত
আমরা রেললাইনের মতো
কখনওই সাক্ষাৎ হবে না
আর যদিও আমরা পরস্পরের দিকে হামাগুড়ি দেই
হৃদয়ের মালগাড়ি উলটে যাবে।’

এই স্বাধীকারই কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা আজ এই পীড়িত জনগোষ্ঠীর। কিন্তু তা দূর আকাশের নীহারিকার মতোই অধরা অসহায়দের নিকট। গোটা জাতির মনোভাব তাই ব্যাক্ত করতে কাব্য করছেন:

‘ঢেউ জেলেকে বলছে:
অনেক কারণ আছে
কেনো আমার ঊর্মিমালা ক্রোধান্বিত।
সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হচ্ছে
যে আমি মাছেদের স্বাধীনতার জন্য
আর জালের বিপক্ষে’
(ঝড়োঢেউ)

অর্থাৎ জালের মতোই ঘিরে রেখেছে এজাতিকে শাসকেরা। জাতির সামগ্রিক চাওয়া স্বাধীকার হলেও বাস্তবতার মুখ দেখে না।

বাস্তবতার মুখ না দেখাই শুধু নয়। এই কষ্টের সাগরে পাড়ি জমানো হাবুডুবু খাওয়া মানুষদের ভাগ্যে জোটে কাবাবের মতো পুড়ে পুড়ে যাওয়ার। এলাকার পর এলাকা যেন একটি রান্নার কড়াইয়ে ঝলসাচ্ছে আর চামুচ দিয়ে নাড়ছে ভিলেন পাচক। এপাচক প্রয়াত সাদ্দাম হোসেন। ১৯৮৮ সালে ১৬ মার্চ ইরাকের কুর্দিস্তানের নিরীহ জনতার ওপর রাসায়নিক গ্যাস ব্যবহার করে তার লেলিয়ে দেয়া বাহিনী। যার প্রতিক্রিয়ায় ৩২০০ থেকে ৫০০০ মানুষ মারা যায়, যাদের বেশিরভাগই ছিল সাধারণ নাগরিক। গণহত্যায় মৃতের সংখ্যা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। মানবাধিকার সংস্থার মতে মহিলা ও শিশুসহ এ অভিযানে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল।

তবে কুর্দি কর্মকর্তাদের দাবি ১ লাখ ৮২ হাজার মানুষ নিহত হয় এ লড়াইয়ে। কুর্দিস্তানের ৪৬৫৫টি গ্রামের মধ্যে চার হাজার গ্রাম ধ্বংস হয়ে যায়। ১৭৫৪টি স্কুল, ২৭০টি হাসপাতাল, ২৪৫০টি মসজিদ এবং ২৭টি চার্চ ধ্বংস করা হয়। কুর্দিদের নিশ্চিহ্ন করার যে পরিকল্পনা তারা নিয়েছিল তার ৯০ ভাগ লক্ষ্য সফল হয়। উক্ত গণহত্যা অভিযানকে আনফাল অভিযান বলত সাদ্দামের সেনাদল। আর উক্ত ঘটনাকে হালজাবা বলে। সেই হালজাবার রক্তাক্ত কান্নার কাব্য:

‘হালজাবার স্বাশরুদ্ধের পরে,
আমি প্রভুর নিকট অনেক বড় একটি অভিযোগ লিখেছি
প্রত্যেকের পূর্বে,
আমি গাছের কাছে এটা পাঠ করলাম।
গাছটি কেঁদে উঠলো।
একদিকে একটি পাখি, একজন পোস্টম্যান বলল
“ঠিক আছে, কে এটা সরবরাহ করবে?
তুমি যদি আশাকরো যে আমি এটাকে গ্রহণ করব,
আমি পারব না প্রভুর তখত পর্যন্ত পৌঁছতে।”
(প্রতিক্রিয়া)

তাদের উপর এরকম অত্যাচার করে পুড়ে মারার পর কঠিন আক্ষেপ করে বিশ্ববাসীকে ধিক্কার দিয়েছেন কবি। কারণ তারা মাত্র এক মিনিটের নীরবতা পালন করে আর মোমবাতি প্রজ্জ্বলিত করে। কোনও প্রকার  সমাধান দিতে পারেন না। খেদোক্তি করে শেরকো লিখছেন:

‘৮৮ সালে
সকল প্রভু
দেখতে পায়
গ্রাম্যলোকদের দেহগুলো
তারা দগ্ধিতের মত ছড়িয়ে আছে,
কিন্তু কেউই নড়তে পারছে না।
শুধু রাত্রে
তাদের ঠোঁটে সিগারেট
তারা তাদের মাথাকে নত করেছে
সেই অগ্নির নিকট।’
(প্রভুগুলো)

এরকম ধ্বংসযজ্ঞের ভেতর মানুষ কীভাবে বাঁচে! নেই জীবনের নিরাপত্তা। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান সব মিশে উড়ে যায় উদ্বায়ী পরমাণু হয়ে। শেরকো নিজে অজস্র কষ্টে বেঁচে বেড়ে ওঠার সময় দেখেছেন তাদের উপর কী খড়গ! ওরকম খড়গ তার আগের প্রজন্মও পেয়েছিল। পৃথিবীর অন্যান্যদের কী বিলাসবহুল বাড়ি! আর সেখানে ধ্বংসস্তুপের কোনও একটি ফাঁকে উঁকি মারে আকাশের দিকে বালক। এটাই তার বাড়ি। এটাই তার পরিণতি। খাবার জোটে না একমুঠো। এরকম নিদারুণ খেদোক্তি দিয়ে কবিতা সাজিয়েছেন:

‘যখন আমি বেড়ে উঠেছি,
আমি একবারও আমার উনুনে অগ্নি প্রজ্জ্বলন করিনি
ছিল না একটি গৃহ বসবাসের জন্য।
যখন আমি বেড়ে উঠেছি, খাদ্যহীন
সেটার স্বাদ নিয়েছি গুলির জারানো রসের থেকে।’
(যখন আমি শিশু ছিলাম)

টি. এস. ইলিয়টের(১৮৮৮-১৯৬৫) ভাব ও স্টাইল পরিলক্ষিত হয় এই স্বাধীনতাকামীর কবিতায়। রূপকের খুব বেশি আশ্রয় প্রয়োজন পড়েনি তার। যে জাজ্জ্বল্যমান উপমা তার জীবন ও জাতি সেখানে মিইয়ে যায় কল্পচিত্র। তার ঐশ্বর্য বৈচিত্র্য যুদ্ধ বিরোধী, স্বাধীকারের উচ্চকিত কণ্ঠ।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top