সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

অদিন সুদিনের গল্প : এস ডি সুব্রত


প্রকাশিত:
১৭ জুন ২০২১ ২০:২৪

আপডেট:
২৮ মার্চ ২০২৪ ২১:৫৫

 

"শুকনো মৌসুমে কাঁচা সোনা ধানে
হাওর স্বপ্নের বুনন চলে
ভরা বর্ষার সীমাহীন অথৈ জলে
যৌবনবতী হাওরে প্রাণ আসে" 

উইকিপিডিয়ার মতে, "হাওর হল সাগর সদৃশ পানির বিস্তৃত প্রান্তর"। সায়র বা সাগর শব্দ থেকে হাওর শব্দের উৎপত্তি। হাওর হলো বিস্তৃত প্রান্তর, অনেক টা গামলা আকৃতির জলাভূমি যা ভূ আলোড়নের ফলে সৃষ্টি হয়। হাওর অঞ্চলে ছয় মাস শস্য ক্ষেত্র থাকে পানির নীচে আর গ্রামগুলো দ্বীপের মতো পানিতে ভেসে থাকে। এটাই বর্ষা কাল। আর  ছয় মাস থাকে শুকনো মৌসুম যখন  যতদূর চোখ যায় মাঠের পর মাঠ সবুজের সমারোহ ঢেউ খেলে যায়। বর্ষার হাওরের বুকজুড়ে চলে অপরুপ জলের নাচন।হিজল করচে শাপলা শালুকে হাওর সাজে অপরুপ সাজে। বর্ষার ভরা জলে হাওরে  যেন যৌবনের ডাকে আসে। শুকনায় উদাত্ত জলের দেশে সবুজের সমারোহ ঢেউ খেলে যায় অপরুপ সবুজে। বৈশাখে সোনালী ধানে স্বপ্নের চাঁদ জাগে হাওরে। হাওর বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে থৈ থৈ বিশাল জলরাশি।সে জলে চলে কখনো ভাঙ্গা গড়ার খেলা কখনো আফালের  ঢেউয়ের তোড়ে  ভাঙ্গে বসতি। কখনো বন্যায় ভেসে যায় গেরস্থালী।অকাল বন্যায় স্বপ্ন ভাসিয়ে নিয়ে যায়।আবার ফসল ভালো হলে হাওরে আনন্দ জোয়ার আসে। বর্ষার বিকেলে চলে নৌকাবাইছ। গ্রামে গ্রামে চলে গাজীর গান, যাত্রা পালা। 

হাওর অঞ্চল বলতে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এই ৭ টি জেলার হাওর অঞ্চলকে বুঝায়। ইতিহাস মতে সমুদ্র বক্ষ থেকে জেগে উঠেছে হাওর। হাওর অঞ্চলে ৩৭৩ টা হাওরের মধ্যে কিশোর গঞ্জে ৯৭ টি, সিলেটে ১০৫ টি, সুনামগঞ্জ এ ৯৫ টি, মৌলভীবাজারে  ০৩ টি, হবিগঞ্জে ১৪ টি, নেত্রকোনায় ৫২ টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৭টি। ৩৭৩ টি হাওর বেষ্টিত অঞ্চলে রয়েছে ৩০০০ অধিক জলমহাল যেখান থেকে বছরে আহরিত হয় প্রায় ৪ লাখ টন মাছ। বর্ষাকালে হাওর অঞ্চলে ১০- ৩০ ফুট পানিতে নিমজ্জিত থাকে। আবার বর্ষা শেষে হাওর অঞ্চলে শুকনা মৌসুমে যতদূর চোখ যায় সবুজের সমারোহ।

হাওরের সংখ্যা নিয়ে রয়েছে মতভেদ। বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুসারে দেশ হাওর রয়েছে ৪১৪টি। আবার বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী হাওরের সংখ্যা ৪২৩ টি। দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার ২৭ মে ২০১৯ মের তথ্যানুযায়ী হাওরের সংখ্যা ৩৭৩টি। হাওর অঞ্চলের জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি যার ৭০ ভাগ কৃষিজীবী।

বাঙালির হাজার বছরের যে ঐতিহ্য, শিল্প সংস্কৃতি তার এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে হাওর অঞ্চলের মানুষের আনন্দ বেদনার গল্প। বাউল জারি সারি , আধ্যাত্মিক আর ধামাইল গানের মূল উৎস স্থল হচ্ছে হাওর অঞ্চল। হাওরের রাজধানী আর লোক সংস্কৃতির অন্যতম আধার সুনামগঞ্জে জন্ম নিয়েছেন  মরমি সাধক দেওয়ান হাসন রাজা, বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম,ধামাইল গানের জনক রাধারমণ দত্ত, দুর্বিন শাহ এবং পন্ডিত রামকানাই দাশ প্রমুখ। বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের  বর্ননায় বর্ষার ভাসান জলে হাওরের মানুষের মাছ ধরে খাওয়া আর মনের আনন্দে গান গাওয়ার চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। নৌকা বাইচ আর যাত্রা পালার দেখা মেলে বর্ষার হাওরে। অন্যদিকে অকাল বন্যা অথবা হাওর রক্ষা বাঁধে অনিয়মের কারনে ফসল তলিয়ে গেলে হাওরের সহজ সরল মানুষের জীবনে দুঃখ দুর্দশার চিত্র দেখা যায় প্রায়শই। বাংলাদেশে প্রাপৈ প্রায় ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৩০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় মিঠা পানির এ হাওর অঞ্চলে। 

প্রায় ২৬ হাজার গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত হাওর অঞ্চলের বিষাদের গল্প ফুটে উঠে এভাবে..........

"মাটির উপরে জলের বসতি, জলের উপর ঢেউ
তরঙ্গের সাথে পবনের পিরিতি   নগরের জানে না কেউ"।

হাওরের অপরুপ রুপ বৈচিত্রের আড়ালে লুকানো বেদনার শ্বাশত রুপ ফুটে উঠেছে লোকগীতির চরন দুটি তে।

অপর দিকে হাওরের অনন্য রুপ বৈচিত্রের দেখা মেলে কবিতার পংক্তি তে .......

"পৃথিবীর সব রুপ লেগে আছে জলে
পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দুজনার মনে 
 আকাশ ছড়ায়েছে শান্তি হয়ে আকাশে আকাশে
 ছুটছে প্রকৃতিপ্রেমী মহোৎসবের প্রশান্তি লাভে অসীমের পানে।"

 

 হাওরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন বিখ্যাত চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং 

সহ দেশী বিদেশী পর্যটক। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা হাওরের অপার সৌন্দর্য অবলোকন করে হাওরকে উড়াল পঙ্খির দেশ বলেছেন। বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ হলেও হাওরে মূলত দুটো ঋতু প্রভাব ফেলে। একটা হচ্ছে বর্ষাকাল। আঞ্চলিক ভাষায় যাকে বলে বাইরা মাস বা বাইসসা কাল বা অদিন। আরেকটি হচ্ছে শুকনো মৌসুম বা সুদিন। শুকনো মৌসুমে বা সুদিনে হাওর জুড়ে সবুজের সমারোহ ধান আর ধান এক সময় সোনালী ধান , বৈশাখে উঠে কৃষকের গোলায়। আনন্দে ভরে উঠে হাওরের কৃষাণ কৃষানীর মন। অন্যদিকে বর্ষায় বা অধিনে চারিদিকে থৈ থৈ  পানি। নৌকা হয়ে উঠে যাতায়াতের একমাত্র বাহন। যৌবনবতী হয়ে উঠে হাওর। ফসল ভালো হলে হাওরে বিয়ে শাদির ধূম লাগে হাওরে। গ্রামে গ্রামে চলে যাত্রা পালা আর মালজুড়া গান। গ্রামের বধুরা অবসর পেয়ে নৌকা করে নাইর যায় বাপের বাড়ি তে মনের আনন্দে। আনন্দ আহ্লাদের মাঝে দুঃখও আছে। আছে অকাল বন্যা বা পাহাড়ী ঢলে ফসল তলূ যাওয়ার দীর্ঘশ্বাস, আছে ধানের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় তিক্ত অভিজ্ঞতা ।আছে ওয়াটার লর্ডদের  জুলুমে নিষ্পেষিত জেলেদের চাপা কান্না। হাওরের চাপা কান্না ভেদ করে এর শান্ত জলে অবগাহনে  হাজারো পর্যটকের মনে প্রশান্তির ঢেউ জাগে। প্রাকৃতিক রুপ বৈচিত্রের অপরুপ নান্দনিক ছোঁয়ায় হাওর যেন এখন হয়ে উঠে স্বপ্নের দেশে। হাওর এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এবং বৈচিত্রের এক অপার লীলাভূমি।

 

এস ডি সুব্রত
কবি ও প্রাবন্ধিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top