সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

চেনামুখ- অচেনা মানুষ: বাংলার রূপকার ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
১ জুলাই ২০২১ ২০:১৪

আপডেট:
১ জুলাই ২০২১ ২২:৪০

ছবিঃ ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়

 

স্বাধীন ভারতে বিখ্যাত নাগরিকদের ঘিরে পাঠযোগ্য জীবনকথা লেখার রেওয়াজ অনেকখানি উঠে গিয়েছে। যা এখন পাওয়া যায়, তা নমো নমো করে দায়সারা গোছের। সিলেবাসে খুব একটা গুরুত্ব পায় না। তাই নতুন প্রজন্মের নাগরিকদের হাতে নেই মহাত্মা গাঁধী, বল্লভভাই পটেল, ইন্দিরা গাঁধী, রাজীব গাঁধী, বাবা সাহেব আম্বেদকর, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান, সম্বন্ধে পাঠযোগ্য বই, ঘরের কাছে বিধানচন্দ্র রায় থেকে সত্যজিৎ রায় পর্যন্ত সকলেরই একই অবস্থা।

বিধানচন্দ্র রায় এ বিষয়ে কিছুটা ভাগ্যবান, চিকিৎসক হিসেবে তাঁর নানা গল্পগাথা আজও রূপকথার মতো বিভিন্ন মহলে ছড়িয়ে আছে এবং তাঁর গুণমুগ্ধ কর্মচারীরা পরবর্তী সময়ে কিছু মূল্যবান লেখা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আমাদের জন্য রেখে গিয়েছেন। সে সব ধৈর্যসহকারে উল্টে দেখলে বোঝা যায় এক কিংবদন্তি চিকিৎসক বঙ্গীয় ইতিহাসের এক কঠিন সময়ে তাঁর মাসিক লাখ টাকার প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়ে বিপন্ন বাঙালিদের রক্ষার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এই জীবনকথা কিছুটা জানা থাকলে নিরন্তর জীবনসংগ্রামে ক্লান্ত ও হতাশ বঙ্গবাসীরা কিছু নতুন পথ খুঁজে পেতে পারেন। এক সময়ে অনেকেই রসিকতা করে বলতেন, পরের ধন অপহরণ করে নিজের বলে চালানোয় আমরা কারও থেকে কম যাই না। তা না হলে কটকের সন্তান সুভাষচন্দ্র বসু এবং পাটনার সন্তান বিধানচন্দ্রকে আমরা সেন্ট পার্সেন্ট বেঙ্গলি স্ট্যাম্প দিয়ে দিলাম, চেপে গেলাম যে এঁদের কেউই এন্ট্রান্স পাশ করার আগে কলকাতায় বসবাস করেননি।

পরবর্তী কালে বিধানচন্দ্র বাংলা-বিহার সংযুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন কিন্তু পারেননি। তিনি সফল হলে কী হত তা আন্দাজ করতে আজ আর কারও আগ্রহ নেই। ঠাকুমা নাম রেখেছিলেন ভজন। আর তাঁর ভাল নাম রাখার দিনে হাজির ছিলেন কেশবচন্দ্র সেন। পাটনার মেধাবী ছেলে কলকাতায় উচ্চশিক্ষার জন্য এসে যে সব কাণ্ড করলেন তা বুলেট পয়েন্টে বলে নেওয়া যেতে পারে।

 ডাক্তারি পড়বার বিশেষ বাসনা বিধানচন্দ্রের ছিল না, শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ফর্মের জন্য আবেদন করেছিলেন। ডাক্তারির ফর্মটা আগে আসায় ওইটাই আবেদন করলেন। পূরণ করে পাঠিয়ে দিলেন। পরে শিবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ফর্ম আসায় আর আবেদন করলেন না।

 থাকতেন কলেজ স্ট্রিট ওয়াই এম সি এ-তে। অর্থাভাব প্রবল, মাস্টারমশায়রা ছাত্রকে অবসর সময়ে ধনী রোগীদের বাড়িতে মেল নার্স হবার সুযোগ করে দিতেন। রোগীর বাড়িতে বারো ঘণ্টার ডিউটিতে পারিশ্রমিক আট টাকা। মেল নার্স কথাটি আজকাল তেমন শোনা যায় না। কেউ কেউ এখন বলেন, নার্সিংটা মেয়েদের একচেটিয়া হওয়ার কোনও অর্থ হয় না।

 ক্যুইজ করা যায়, কলকাতার সব চেয়ে বিখ্যাত ট্যাক্সি ড্রাইভারের নাম কী? প্র্যাকটিস জমাবার প্রথম পর্বে বিধানচন্দ্র রায় যে কলকাতায় পার্ট টাইম ট্যাক্সি ড্রাইভার ছিলেন এই গল্প আমরা কমবেশি অনেকেই নানান ধরনের পত্রিকা জেনেছি। চালক ও মালিক হিসেবে মোটর গাড়ি সম্বন্ধে তাঁর যে আজীবন আগ্রহ ছিল তা অনেকের কাছে শুনেছি।

 মহাপুরুষরা সমকালের অক্লান্ত যন্ত্রণা থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকতে পারেন না। জেনে রাখা ভাল, যাঁর চিকিৎসাখ্যাতি এক দিন কিংবদন্তি পর্যায়ে চলে গিয়েছিল তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এমবি পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন। আবার তিনিই মাত্র ১২০০ টাকা সম্বল করে বিলেত গিয়ে দু’বছরে মেডিসিন ও সার্জারির চূড়ান্ত সম্মান এম আর সি পি এবং এফ আর সি এস প্রায় একই সঙ্গে অর্জন করেছিলেন। বিভিন্ন অপমান কাণ্ডের সঙ্গে সহেবরা জড়িত ছিলেন। কিন্তু দেশবাসীরা তাঁর জীবনকালে যে সব যন্ত্রণা ও অপমান তাঁকে করেছিলেন তা ভাবা যায় না।

বিধানচন্দ্র যখন পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী হলেন তখন লাখ টাকার প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়ে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন তখন হাওড়া-কলকাতার দেওয়ালে দেওয়ালে কুৎসিত ভাষায় লেখা হল: ‘বাংলার কুলনারী হও সাবধান, বাংলার মসনদে নলিনী বিধান। ’

ডাক্তার রায়ের নিকট-বন্ধু নলিনীরঞ্জন সরকার ছিলেন আর এক আশ্চর্য বাঙালি, যাঁকে নানাবিধ দুর্নাম দেওয়া ছাড়া সমকালের নিন্দুকেরা বিশেষ কিছুই করেননি। আমরা শুনেছি এবং বিশ্বাস করতাম না, বিধানচন্দ্র রায় বড় ডাক্তার, কিন্তু মদ্যপ এবং জেলে যেতে ভয় পেতেন ইংরেজের অত্যাচারে। ১৯১১ সালে ডাক্তার রায় বিলেত থেকে যখন কলকাতায় ফিরলেন তাঁর কাছে মাত্র পাঁচ টাকা। বিলেত যাবার আগে কলকাতায় বিধানবাবুর ফি ছিল দু’টাকা।

আদিতে তাঁর ঠিকানা ৬৭/১ হ্যারিসন রোড, পরে দিলখুশ কেবিনের কাছে, ৮৪ হ্যারিসন রোড।  সেখানে ছিলেন ১৯১৬ পর্যন্ত, এর পর আসেন ওয়েলিংটন স্ট্রিটের বাড়িতে। শোনা যায়, উপার্জন বৃদ্ধির প্রচেষ্টায় তিনি বাড়িতে রক্ত ইত্যাদি পরীক্ষার জন্য প্যাথলজিকাল ল্যাবরেটরি স্থাপন করেন।

পেশায় বিপুল সাফল্য বিধানচন্দ্রকে বিশেষ সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। মাত্র সাড়ে আট বছরের প্র্যাকটিসে কলকাতায় প্রাসাদোপম বাড়ি এবং গাড়ির মালিক হওয়া সহজ ব্যাপার ছিল না।

তাঁর রোগীর তালিকায় তখন কোন বিখ্যাত মানুষ নেই? এর মধ্যে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও আছেন। শোনা যায়, গোড়ার দিকে জোড়াসাঁকোর জন্যও ভিজিট নিতেন, যদিও পরবর্তী সময়ে দু’জনে খুব কাছাকাছি আসেন। চিত্তরঞ্জন দাশের মহাপ্রয়াণের পর দেশবন্ধুর একটা ছবি বিক্রি করে বিধানচন্দ্র কিছু টাকা তোলবার পরিকল্পনা করেন। এ বিষয়ে পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য একটি চিঠিতে লেখেন, “চিত্তরঞ্জনের একটা ছবি নিয়ে বিধানচন্দ্র রায় কবির কাছে গিয়ে বললেন এর উপর একটা কবিতা লিখে দিন।

“ডাক্তার, এ তো প্রেসক্রিপশন করা নয়। কাগজ ধরলে আর চটপট করে লেখা হয়ে গেল। ”

উত্তর: “বেশ অপেক্ষা করছি। ”

কিন্তু বেশি ক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। ছবির উপর সেই অপূর্ব কবিতাটি লেখা হল এসেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ/ মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান। ”

বিধানচন্দ্র যখন কলকাতার মেয়র, তখন (১৯৩১) কবিগুরুর সপ্ততি বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে তাঁকে যে সংবর্ধনা দেওয়া হয় সেখানে কবিগুরুর উত্তর আজও স্মরণীয় হয়ে আছে।

“এই পুরসভা আমার জন্মনগরীকে আরামে, আরোগ্যে, আত্মসম্মানে চরিতার্থ করুক, ইহারা প্রবর্তনায় চিত্রে, স্থাপত্যে, গীতিকলায়, শিল্পে এখানকার লোকালয় নন্দিত হউক, সর্বপ্রকার মলিনতার সঙ্গে সঙ্গে অশিক্ষার কলঙ্ক এই নগরী স্খালন করিয়া দিক পুরবাসীর দেহে শক্তি আসুক, গৃহে অন্ন, মনে উদ্যম, পৌরকল্যাণ সাধনে আনন্দিত উৎসাহ। ভ্রাতৃবিরোধের বিষাক্ত আত্মহিংসার পাপ ইহাকে কলুষিত না করুক শুভবুদ্ধি দ্বারা এখানকার সকল জাতি, সকল ধর্মসম্প্রদায় সম্মিলিত হইয়া এই নগরীর চরিত্রকে অমলিন ও শান্তিকে অবিচলিত করিয়া রাখুক, এই কামনা করি। ”

ডাক্তার রায়ের বিশাল প্র্যাকটিসের কোনও মাপজোক আজও হয়নি। কলকাতার বাইরেও বার্মা থেকে বালুচিস্তান পর্যন্ত তাঁর ডাক্তারি দাপট, যার একমাত্র তুলনা স্যর নীলরতন সরকার। শোনা যায়, তাঁর এক আপনজনের প্রতি তরুণ চিকিৎসক এক সময় আসক্ত হন, কিন্তু আর্থিক বৈষম্য সেই শুভকর্মকে সম্ভব করেনি।

মতিলাল নেহরু, মহাত্মা গাঁধী, জওহরলাল নেহরু, কমলা নেহরু, বল্লভভাই পটেল, ইন্দিরা গাঁধী থেকে কে না তাঁর চিকিৎসা পরামর্শ নিতেন! ১৯১৩-১৯৪৮ পর্বে মহাত্মা গান্ধিজী আঠারো বার অনশন ব্রত পালন করেছিলেন। এবং বহু বারই বিধানচন্দ্র তাঁর শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত হয়েছেন। একবার (১৯৩১) অসুস্থ মতিলাল নেহরুকে দেখতে ডা. রায় ইলাহাবাদে যান। সেখানে গাঁধীও উপস্থিত। তখন মহাত্মাজি দুধ ও শস্য ছেড়ে দিয়ে কেবল কাঁচা সব্জি খাচ্ছেন। ব্যাপারটা ডা. রায়ের পছন্দ হল না। এই সময় গাঁধীজির ওজন ৯৯ পাউন্ড।

বিধানচন্দ্র বললেন, আপনার ওজন অন্তত ১০৬ পাউন্ড হওয়া উচিত। অনুগত রোগীর রোগীর মতো মহাত্মা গাঁধী বললেন, দশ দিন সময় দাও। এই খাবার খেয়েই দেহের ওজন ১০৬ পাউন্ড করে দেব। বিখ্যাত ডাক্তারকে বিস্মিত করে মহাত্মা গাঁধী এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন।

দেশ যখন স্বাধীন হল, তখন বিধানচন্দ্র চোখের চিকিৎসার জন্য বিদেশে। তার কিছু দিন আগে জওহরলাল নেহরু তাঁকে তারবার্তা পাঠিয়ে ইউপি-র গভর্নর হবার প্রস্তাব দিলেন। সেই মতো ভারত সম্রাটের বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশিত হল। বিধানচন্দ্র জানালেন চোখের চিকিৎসা সম্পূর্ণ না করে তাঁর দেশে ফেরা সম্ভব নয়। যখন ফিরলেন, তখন সরোজিনী নাইডু ওই পদে রয়েছেন, তাঁকে সরিয়ে নতুন পদে বসতে বিধানচন্দ্র রাজি হলেন না।

গাঁধীজি রসিকতা করলেন, “তুমি গভর্নর হলে না। ফলে তোমাকে ইওর এক্সেলেন্সি সম্বোধন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলাম। ”সুরসিক বিধানচন্দ্রের উত্তর: “আমার পদবি রায়, আপনি অবশ্যই আমাকে ‘রয়াল’ বলতে পারেন, আমি অনেকের চেয়ে লম্বা, সে হেতু আমাকে ‘রয়াল হাইনেস’ বলতে পারেন। ”

শোনা যায়, দিল্লির এক পার্টিতে নিমন্ত্রিত হয়ে গভর্নর জেনারেল লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন বিধানচন্দ্র সম্বন্ধে এতই মুগ্ধ হন যে তিনি জওহরলালকে বলেন, লাট সাহেবের পদে না বসিয়ে এঁকে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব দিন।

প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের পর বিধানচন্দ্র এই দায়িত্ব নিয়েছিলেন নেতাজির জন্মদিন ২৩ জানুয়ারি ১৯৪৮ এবং তার সাত দিন পর সেই অশুভ শুক্রবার দিল্লিতে গাঁধীজি নিহত হলেন। সেদিন সন্ধ্যায় বিধানচন্দ্র হাওড়ার রাস্তায় দাঁড়িয়ে নেহরু ও ডা. রায়ের যে কণ্ঠস্বর রেডিয়োতে বেজেছিল তা আজও কানে বাজে। যত দূর মনে পড়ে, ‘প্রিন্স অফ পিস’ শব্দটি সেদিন ব্যবহৃত হয়েছিল। এবং সেই শব্দটি আজও আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে।

যখন ডা. রায় মুখ্যমন্ত্রী হলেন তার আগের মাসে ডাক্তারি থেকে আয় ৪২০০০ টাকা, মুখ্যমন্ত্রী হয়ে নিজেই মাইনে ঠিক করলেন ১৪০০ টাকা, বয়স ৬৫। নিকটজনদের বললেন, “দশটা বছর কম হলে ভাল হত। ” তার উপর চোখের সমস্যা, ম্যাগনিফাইং গ্লাস ব্যবহার করতেন এবং খুব লম্বা কিছু পাঠ এড়িয়ে চলতেন। এই জন্যই বোধ হয় নিন্দুকেরা প্রচার করেছিল, ডা. রায় বাংলার দিগ্বিজয়ী লেখকদের কোনও লেখাই পড়েন না, যদিও ক্ষণজন্মা লেখকরা সানন্দে তাঁকে স্বাক্ষরিত বই দিতেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি খুবই খাতির করতেন। এবং স্বাভাবিক সৌজন্যে বলতেন, লেখার অভ্যাসটা যেন ছেড়ে দেবেন না।

তবু বাংলা সাহিত্য ও সিনেমার মস্ত উপকার তিনি করেছিলেন। বান্ধবী বেলা সেনের কথায়, সত্যজিৎ রায়ের অসমাপ্ত ছবি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত ‘পথের পাঁচালী’ তিনি দেখেন এবং সরকারি নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে এই ছবিটির সরকারি প্রযোজনার ব্যবস্থা করেন।

শোনা যায়, বিভূতিভূষণ যে তখন প্রয়াত তাও তিনি জানতেন না, বইটি পড়া তো দূরের কথা। আরও একবার তিনি বাঙালি লেখকদের উপকার করেছিলেন। লালবাজারের একটি বিশেষ বিভাগ পত্রপত্রিকা ও বাংলা বইয়ে আপত্তিকর অংশ সম্বন্ধে অতি উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন। বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রবোধ সান্যাল ইত্যাদি পুলিশের বিষনজরে পড়ে গিয়েছেন বলে গুজব রটল। এঁরা আতঙ্কিত হয়ে তারাশঙ্কর ও সজনীকান্ত দাসকে ধরলেন, তারপর লেখকরা দলবদ্ধ হয়ে ডাক্তার রায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন, নামী সাহিত্যিকদের বই অশ্লীল বলে বাজেয়াপ্ত হবে এ কেমন কথা!

বিধানচন্দ্র বললেন, তাই নাকি, এটা তো বড় অন্যায় ব্যাপার। রুনুকে ডাকো। হোম সেক্রেটারি আই সি এস রুনু গুপ্ত আসতেই ডা. রায় বললেন, এ কি সব তুঘলকি কাণ্ড। বিখ্যাত লেখকদের বই পুলিশ বাজেয়াপ্ত করছে, অ্যারেস্টের ভয় দেখাচ্ছে। আই সি এস রুনুর নিবেদন, আইনের ধারা অনুযায়ী পুলিশ কাজ করছে।

বিধান রায় তাঁকে পাত্তা না দিয়ে বললেন, ওসব আইনটাইন কী আছে দেখে পাল্টাতে বলো। এঁদের অসম্মান করে এবং চটিয়ে সরকার চালানো যায়?তারাশঙ্কর ও অন্যান্য লেখকদের নিশ্চিন্ত করে তিনি জানালেন, আমি বলে দিচ্ছি, পুলিশ আপনাদের আর বিরক্ত করবে না।

এবার সেক্রেটারিকে নির্দেশ, “তুমি পুলিশকে বলে দাও, এঁদের বাদ দিয়ে সিনেমার পোস্টারে যে সব প্রায়-ল্যাংটো মেয়েদের ছবি ছাপে সেগুলো আটকাতে। ”

১৯৪৮ থেকে বাংলার ইতিহাসের কঠিনতম সময়ে বিধানচন্দ্র রাইটার্সের লালবাড়িতে সাড়ে চোদ্দো বছর বসেছিলেন। তাঁর সেক্রেটারি সরোজ চক্রবর্তী জানিয়েছেন, প্রথম দু’বছর তিনি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছেন। জমি বিক্রি করলেন, শেয়ার বিক্রি করলেন, এমনকী শৈলশহর শিলং-এর প্রিয় বাড়িটাও বিক্রি করলেন।

মুখ্যমন্ত্রী হয়ে বাড়িতে বিনা পয়সায় নিয়মিত রোগী দেখতেন সকাল সাতটায়। এবং তার জন্য দু’জন ডাক্তারকে নিজের পয়সায় নিয়োগ করেছিলেন। ব্যক্তিগত স্টাফের মাইনে দিতেন নিজের গ্যাঁট থেকে ডাক্তার রায়ের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে নানা রকম গুজব রটত। কিন্তু তাঁর প্রথম জীবনীকার কে পি টমাস স্পষ্ট বলেছেন, তিনি ধূমপান বা মদ্যপান কোনওটাই করতেন না।

কে পি টমাস লিখেছেন, তাঁর চিরকুমারত্বের পিছনে কোনও কাহিনি আছে কিনা তা তিনি কখনও জানতে চাননি। একদিন (১৯৫৫) দিল্লি-বোম্বাই পরিভ্রমণ করে বিমানে ফিরলেন দুপুর একটায়। সঙ্গে সঙ্গে রাইটার্সে চলে গেলেন, ফিরলেন সাড়ে ৭টায়।

দু’একটা ছবির ক্যাপশনের জন্য লেখক টমাস ওঁর বাড়িতে বসেছিলেন। কিন্তু ডা. রায় ফাইলের মধ্যে ডুবে আছেন। রাত সাড়ে ৯টা। তখনও ডা. রায় পড়ে যাচ্ছেন। লজ্জিত টমাস বললেন, এখন আপনার শোবার সময়। ডা. রায়ের উত্তর, তা হলে আমার কাজগুলো কে করবে?

টমাস বললেন, কাজের একটা সীমা থাকা উচিত। আপনি বিয়ে করেননি। তাই চলছে। আপনার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা থাকলে তাঁরা আপনাকে বিশ্রামের কথা বলতেন। ডাক্তার রায়ের তাৎক্ষণিক উত্তর, আপনি জানেন না, কাজের সঙ্গেই আমার বিয়ে হয়েছে।

৬৫ বছর বয়সে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে বিধানচন্দ্র যে অমানুষিক পরিশ্রমের বোঝা বহন করেছেন তার কিছু বিবরণ জীবনীকাররা আমাদের দিয়েছেন। ভোর পাঁচটায় উঠে গীতা ও ব্রহ্মস্তোত্র পড়ে, স্নান সেরে, সাড়ে ৬টায় ব্রেকফাস্ট খেয়ে, দু ঘণ্টা ধরে বিনামূল্যে ১৬ জন রোগী দেখে রাইটার্স বিল্ডিংস-এ আসতেন সবার আগে। ব্রেকফাস্টে থাকত একটি টোস্ট, একটি ডিম, বেলপানা অথবা পেঁপে ও এক কাপ কফি। ভাল কফির সমঝদার ছিলেন। ভাল কফি পেলেই বন্ধুদের খাওয়াতেন।

তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন তাঁকে ডিফেন্স কারখানায় বিশেষ ভাবে তৈরি কফি গ্রাইন্ডার উপহার দিয়েছিলেন। খুবই মিতাহারী ছিলেন। সাধারণত বাইরে নিমন্ত্রণ খেতে যেতেন না। রসিকতা করতেন হসপিটালিটি অনেক সময় হসটিলিটি হয়ে যায়। রাইটার্সে সকাল ন’টা থেকে দশটা জরুরি ফাইল দেখতেন। তারপর সচিবদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা।

দর্শনার্থীদের সঙ্গে কথাবার্তা চলত বারোটা থেকে সাড়ে বারোটা, তারপর অ্যান্টি চেম্বারে গিয়ে মধ্যাহ্নভোজন ও বিশ্রাম। পরবর্তী সময়ে অসুস্থতার পরিপ্রেক্ষিতে বাড়ি চলে এসে খাওয়াদাওয়া করে সামান্য বিশ্রামের পরে আবার রাইটার্স। এবং সেখানে রাত ৮টা পর্যন্ত। তাঁর ছিল দুটি দুর্বলতা। কয়েকবার স্নান করে নিতেন এবং সবাইকে বলতেন রাত ন’টায় শুয়ে পড়া ভাল।


দমদম বিমানবন্দর। দিল্লি যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী নেহরুমুখ্যমন্ত্রী ডা. রায়ের বুকে গোলাপ লাগিয়ে দিচ্ছেন। ডাক্তার রায়ের প্রভাবে রাইটার্সের বড় বড় অফিসাররাও অভ্যাস পাল্টালেন। এর আগে তাঁরা ১১টার আগে হাজিরা দিতেন না। টমাস জানিয়েছেন, লর্ড কার্জন এমন ডিসিপ্লিন চেয়েছিলেন। তখন ১১টায় এসে বড় বড় অফিসাররা ১টায় লাঞ্চে বেরোতেন, ফিরতেন ৩টায় এবং সাড়ে চারটে বাজলেই দপ্তরত্যাগ। লর্ড কার্জনের লিখিত নির্দেশ এল, পদস্থ অফিসাররা কেরানিদের আগে অফিস ছাড়বে না। চিকিৎসক বিধানচন্দ্র সম্বন্ধে সামান্য কিছু বলে নেওয়ার লোভ ছাড়া যাচ্ছে না। তাঁর রোগীদের তালিকায় বিশ্ববিখ্যাতরা দেশবন্ধু, মোতিলাল নেহরু, মহাত্মা গাঁধী, বল্লভ ভাই পটেল, মৌলানা আজাদ, জওহরলাল, তাঁর কন্যা ইন্দিরা। তাঁর গুণগ্রাহীদের মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি এবং ব্রিটেনের প্রাইম মিনিস্টার ক্লেমেন্ট এটলি। মোতিলাল নেহরু দুই ডাক্তার আনসারি ও রায়কে তাঁর দেহের দুই ট্রাস্টি বলে পরিচয় দিতেন। আর গাঁধী-রায় সম্পর্ক তো কিংবদন্তি পর্যায়ের। গাঁধী অনশন করলেই সব কাজ ছেড়ে বিধান রায় ছুটতেন তাঁর পাশে থাকবার জন্য। অনশনরত মহামানব ও সব চেয়ে বিখ্যাত চিকিৎসকের ভূমিকা নিয়ে পুরো একটা বই লিখে ফেলে যায়। পুণের আগা খাঁ প্যালেসে বন্দি গাঁধী, সব রকম ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন, দেহাবসান অনিবার্য ও আসন্ন জেনে, ইংরেজ জেলর তাঁর দেহের জন্য চন্দন কাঠও জোগাড় করে রেখেছেন। বিধানের অনুরোধ, একটা ওষুধ তিনি গ্রহণ করেন। গাঁধী রাজি নন, কঠিন ভাবে বললেন, “কেন আমি তোমার কথা শুনব? তুমি কি এদেশের চল্লিশ কোটি মানুষকে আমার মতো বিনামূল্যে চিকিৎসা করো?”“না গাঁধীজি, সবাইকে বিনামূল্যে চিকিৎসা করা সম্ভব নয়, কিন্তু মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীকে চিকিৎসা করার জন্য এখানে আসিনি, আমি এসেছি এমন একজনকে চিকিৎসা করতে যিনি আমার কাছে আমার দেশের চল্লিশ কোটি মানুষের প্রতিনিধি। ”গাঁধীজির স্মরণীয় উত্তর: “মফস্সল আদালতের থার্ড ক্লাস উকিলের মতন তর্ক করছ। ঠিক আছে, ওষুধ নিয়ে এসো, আমি খাবো। ”আর একবার ডা. রায় বলেছিলেন, “উকিল হয়ে আমি হয়তো আরও অনেক বেশি রোজগার করতে পারতাম, কিন্তু তা হলে আমি তো মহামানব গাঁধীর চিকিৎসা করতে পারতাম না। ”আর একবার স্বয়ং গাঁধীর সামনে বিধানের দেহ-প্রশস্তি করে সরোজিনী নাইডু বলেছিলেন, “বিধান, তুমি হাসলে এখনও গালে টোল পড়ে ব্যাপারটা কী?”ডাক্তার রায় উত্তর দিয়েছিলেন, সেই টোলে কেন বয়োজ্যেষ্ঠর নজর পড়ে যায়। তারপর এই প্রাণবতী মহিলাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল— আপনি মহাত্মা গাঁধীর মধ্যে মিকিমাউসকে খুঁজে পেয়েছিলেন। নেহরু-বিধান পত্রাবলি খুঁটিয়ে দেখলে অনেক ঘটনা পাওয়া যায়, যা হৃদয় স্পর্শ করে। সিরিয়াস বিষয়ের মধ্যেই নেহরু তাঁর বন্ধুকে অনুরোধ করছেন, কলকাতা থেকে গোটা বারো ডাব পাঠিয়ো। ইন্দিরার পেটের রোগ কমছে না। এক সময় গোটা ভারতের ধারণা ছিল, কলকাতার ডাবই পৃথিবীর সেরা। পরের দিন একজন বিড়লা দেখা করতে এলে ডাঃ রায় বললেন গোটা কয়েক ডাব আজকেই প্রাইভেট বিমানে দিল্লি পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য। নেহরুর আরেক প্রিয় খাবার উত্তরপাড়ার ‘তরমুজ রসগোল্লা’, বিধানচন্দ্রের এই বিখ্যাত উপহারের জন্য জওহরলাল অপেক্ষা করে থাকতেন। সময়ের স্রোতে সবই হারিয়ে যায়, বিধানচন্দ্র কোন দোকান থেকে এই রসগোল্লা আনতেন তা আমি খুঁজে বার করতে পারিনি। পরিবারের প্রিয় চিকিৎসক বিধানের ওপর এতই বিশ্বাস যে ইন্দিরার অস্ত্রোপচারের জন্য তিনি কলকাতাকেই নির্বাচন করেছিলেন। আবার নানা বিষয়ে দু’জনের মধ্যে পত্রযুদ্ধ লেগেই ছিল। সেই সব চিঠি এত দিন পরে পড়তে আশ্চর্য লাগে। নেহরু জানতে চাইছেন বাংলার সমস্যাটা কী? বিধানের সেই ঐতিহাসিক উত্তর যা আজও নির্মম সত্য হয়ে আছে। তিনি লিখলেন, “ভেবেচিন্তে দেখলাম, বাঙালিদের তিনটে সমস্যা: ১. খাওয়াদাওয়ার সমস্যা, ২. রুজিরোজগারের সমস্যা, ৩. মাথা গোঁজবার সমস্যা। এমন সহজ ভাবে অন্ন, কর্ম ও আবাসন সমস্যায় জর্জরিত বাঙালির রোগনির্ণয় আর কেউ কখনও করেছেন বলে আমার জানা নেই। জওহরলাল নেহরুর চিকিৎসায় ডাক্তার বিধানচন্দ্রের ভূমিকার ছোট্ট একটি বিবরণ দিয়েছেন নীতীশ সেনগুপ্ত। দিল্লির সব নামকরা ডাক্তার সে বার নেহরুর অসুস্থতার ধরনটা বুঝতে পারছেন না। বিচলিত হয়ে ইন্দিরা খবর দিলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রীকে। মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হল। ইন্দিরা ও লালবাহাদুর সমস্ত রাত জেগে, অস্বস্তিতে নেহরু ঘুমোতে পারছেন না। ভোরবেলা লালবাহাদুর ফোন করলেন ডাঃ রায়কে এবং তাঁকে দ্রুত দিল্লি আসতে বললেন, তখনই একটা বিশেষ বিমান দমদমে অপেক্ষা করছে। ডাক্তার রায় নেহরুর ঘরে ঢুকতেই মেডিক্যাল বোর্ডের রিপোর্ট তাঁর হাতে দেওয়া হল। ডাক্তার রায় তা সরিয়ে দিয়ে বিখ্যাত বাঙালি চিকিৎসক ডা. সেনকে তিরস্কার করলেন, “তুমি এ রকম অপদার্থ!”এ বার নিজে স্টেথোস্কোপ দিয়ে পরীক্ষা করলেন। পেটে থাবড়া মেরে শব্দ শুনলেন। কাপড় কাচার সাবান এবং গরম জল আনতে বললেন। ডাঃ রায় নিজের হাতে ওই সাবান গুললেন এবং লালবাহাদুর ছাড়া সবাইকে বাইরে যেতে বললেন। এ বার তিনি নেহরুর পাজামার গিঁট খুলে দিতে নেহরু ধমকে উঠলেন। তখন ডা. রায় ধমক দিয়ে বললেন, “আমি ডাক্তার, তুমি রোগী। একদম চুপ করে থাকবে। ”অয়েল ক্লথ বিছিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ডাঃ রায় দু’বার ডুস দিলেন। এবং বেডপ্যান পেতে নেহরুকে পায়খানা করালেন। কলকাতায় ফোন করে একটা হোমিওপ্যাথিক ওষুধ, কয়েকটা ডাব ও ডানলোপিলো পাঠাতে বললেন। এর পর নেহরুকে পুরো সুস্থ করার জন্য ডা. রায় প্রায় এক সপ্তাহ ধরে নিঃশব্দে কলকাতা-দিল্লি ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেছিলেন এয়ারফোর্সের বিমানে। এ বার ডাক্তার রায়ের নিজের চিকিৎসা সম্বন্ধে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। মুখ্যমন্ত্রী হবার কিছু পরেই একবার তাঁর জ্বর হয়েছিল। ফিনান্স মিনিস্টার নলিনীরঞ্জন সরকার জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার অসুখ হলে কে আপনার চিকিৎসা করে?ডাক্তার রায় “বিধান রায়। আয়নার দিকে তাকাই আর অমনি সেই প্রতিচ্ছবি বি সি রায় আমার চিকিৎসা করে। ”হোমিওপ্যাথি সম্বন্ধে এক ইন্সিওর কোম্পানির বোর্ড মিটিং-এ তিনি সকৌতুক বলেছিলেন, এক রোগী একটা ছুরি গিলে ফেলেছেন। বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ প্রথম ডোজ দিল, অমনি পেটের ছুরির ফলার ধারটা ভোঁতা হয়ে গেল। দ্বিতীয় ডোজে ছুরির ফলাটা কাঠের হাতলের ভাঁজে ঢুকে গেল। তৃতীয় ডোজের পরে ছুরিটি সর সর করে বেরিয়ে এল রোগীর কোনও ক্ষতি না করে!নিজের পেশার ডাক্তারদের নিয়েও যে তিনি রসিকতা করতে ছাড়তেন না, তার নানা প্রমাণ আছে। হায়দরাবাদের এক সভায় তিনি ভাষণ শেষ করেছিলেন এই গল্পটি বলে। লন্ডনের উপকণ্ঠে একদল গুন্ডা পিস্তল দেখিয়ে একটা বাস থামালো। তাদেরই একজন বাসে উঠে প্রত্যেক যাত্রীর টাকার ব্যাগটা হাতিয়ে নিচ্ছিল। সবার শেষে বাসের শেষ প্রান্তে এক বুড়োর কাছে দাঁড়াল। বুড়ো তার ব্যাগ খুলে দিতে দিতে একটু হেসে বলল, “দেখো ছোকরা তোমার বিনয় দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমি ডাক্তার। আমরা ডাক্তাররা মানুষের টাকা আর জীবন দুই-ই নিয়ে থাকি। ”এ বার ধন্বন্তরির নিজের স্বাস্থ্য! সর্দিকাশি ইত্যাদি ছোট ছোট রোগে সেই ছোটবেলা থেকেই ভুগতেন। তাঁর প্রথম হার্ট অ্যাটাক করেছিল ১৯৩০ সালে, তখন তিনি কংগ্রেসের কাজে আমদাবাদ থেকে দিল্লির পথে। এই অ্যাটাক নিয়ে তেমন হইচই হয়নি। তাঁর দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাক মুখ্যমন্ত্রিত্ব কালে। এবারেও তাঁকে অমানুষিক পরিশ্রম থেকে সম্পূর্ণ দূরে সরে যেতে হয়নি। শুধু দৈনিক রুটিনের পরিবর্তন করে দুপুরে ওয়েলিংটন স্ট্রিটের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করতে আসতেন এবং বাড়িতেই ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম করে আবার রাইটার্সে যেতেন। অন্তিমপর্বের শুরু ২৪ জুন ১৯৬২। রাইটার্সে ওইটাই তাঁর শেষ দিন। নিমপীঠের এক সন্ন্যাসীকে বললেন, “শরীর যেমন ঠেকছে কাল নাও আসতে পারি। ’ মাথায় তখন যন্ত্রণা। পরের দিন বাড়িতে ডাক্তার শৈলেন সেন ও যোগেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ডাকা হল। তাঁদের সিদ্ধান্ত হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। ৩০ জুন ডাক্তার রায় তাঁর প্রিয় বন্ধু ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে বললেন, ‘‘আমি তিরিশ বছর হৃদরোগের চিকিৎসা করে আসছি, আমার কতটা কী হয়েছে আমি তা ভাল করেই বুঝতে পারছি। কোনও ওষুধই আমাকে ভাল করতে পারবে না। ”১ জুলাই তাঁর জন্মদিন। সেদিনই তাঁর তিরোধান দিবস। ওই দিন তাঁর আত্মীয়স্বজনরা এলেন। পরিচারক কৃত্তিবাসের হাত থেকে এক গ্লাস মুসুম্বির রস খেলেন। বন্ধু সার্জেন ললিতমোহনকে দেখে খুশি হয়ে বললেন, ললিত আমার গুরুও বটে, ওর কাছ থেকে কত কিছু শিখেছি। তার পর এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে বললেন, “আমি দীর্ঘ জীবন বেঁচেছি। জীবনের সব কাজ আমি সমাধা করেছি। আমার আর কিছু করার নেই। ” এর পর বললেন, আমার পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। এর পরেই নাকে নল পরানো, ইঞ্জেকশন এবং ১১টা ৫৫ মিনিটে অমৃতপথ যাত্রা। দুঃসংবাদ পেয়ে দেশবন্ধুর স্ত্রী বাসন্তীদেবী বলেছিলেন, বিধান পুণ্যাত্মা, তাই জন্মদিনেই চলে গেল। ভগবান বুদ্ধও তাঁর জন্মদিনে সমাধি লাভ করেছিলেন। দেহাবসানের কয়েক বছর আগে কেওড়াতলা শ্মশানের বৈদ্যুতিক চুল্লির সূচনা করতে এসে বিধানচন্দ্র বলেছিলেন, “ওহে আমাকে এই ইলেকট্রিক চুল্লিতে পোড়াবে। ” ২ জুলাই ১৯৬২ তাঁর সেই ইচ্ছা পূর্ণ করা হয়েছিল। সীমাহীন প্রতিভা, মানুষের জন্য অনন্ত ভালবাসা, বিস্ময়কর পরিশ্রমের ক্ষমতা নিয়ে বিধানচন্দ্র সংখ্যাহীন মানুষের ভালবাসা অর্জন করেছিলেন। কিন্তু জীবনকালে তিনি যে সব নিন্দা অকারণে নতমস্তকে গ্রহণ করে গিয়েছেন তারও তুলনা নেই। তাঁর চরিত্র নিয়ে দেওয়াল লিখন ছড়িয়েছে। নিন্দুকরা তাঁকে ঘিরে ধরে কুৎসিত গালাগালি করেছে, এমনকী জামা গেঞ্জি ছিঁড়ে দিয়েছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তাঁর বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। এবং যিনি দেশের কাজে একের পর এক সম্পত্তি বন্ধক দিয়েছেন অথবা বিক্রি করে দিয়েছেন, তাঁকে চোর বলা হয়েছে এবং সরকারকে ঠকিয়েছেন বলা হয়েছে। আঘাত পেলেও ডাক্তার রায়কে বিচলিত দেখাত না। তিনি মাঝে মাঝে বলতেন, “তোমার সাধ্যমতো চেষ্টা করো, এবং বাকিটা ভগবানের উপর ছেড়ে দাও। ” আবার কখনও কখনও মেডিক্যাল কলেজের প্রিয় মাস্টারমশাই কর্নেল লুকিসকে স্মরণ করে বলতেন, “হাত গুটিয়ে বসে থাকার চেয়ে চেষ্টা করে হেরে যাওয়া ভাল। ”আবার কখনও কখনও মা-বাবাকে স্মরণ করতেন। “মা-বাবার কাছ থেকে তিনটে জিনিস শিখেছিলাম স্বার্থহীন সেবা, সাম্যের ভাব এবং কখনও পরাজয় না মেনে নেওয়া। ” আর যাঁরা তাঁর নিন্দায় মুখর ছিলেন তাঁদের সম্বন্ধে জীবনসায়াহ্নে বলেছিলেন, “আমি যখন মরব তখন ওই লোকগুলোই বলবে, ‘লোকটা ভাল ছিল গো, আরও কিছু দিন বাঁচলে পারত’। ”

তথ্যসূত্র-আনন্দবাজার পত্রিকার আর্কাইভ ও বিভিন্ন গবেষণা মূলক পত্রিকার।  

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
লোকগবেষক, প্রাবন্ধিক, অণুগল্প, ছোটগল্প, ফিচার ও রম্যরচনা এবং ভ্রমণকাহিনীর লেখক 
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top