সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

নোনাজল : শাহানারা পারভীন শিখা


প্রকাশিত:
২৩ আগস্ট ২০২১ ২১:৪৩

আপডেট:
২৪ আগস্ট ২০২১ ০০:৩২

 

নিম্মি! নিম্নি! 

ক্রমাগত ডেকেই চলেছি। কিন্তু ওর কোন সাড়া পাচ্ছিনা। কি এত ব্যস্ততা ওর? বেশ রাগ হলো আমার। একটা দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে গেছি।গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে। নিজেই হাত বাড়িয়ে পাশের ছোট টেবিলে রাখা গ্লাসটা নিতে গেলাম। গ্লাস টা মেঝেতে পড়ে যায়। ঝনঝন শব্দে দরজার ওপাশে থাকা সিস্টার দৌড়ে কেবিনে এসে ঢোকে। ভাঙা কাঁচের টুকরোর মাঝে আমাকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে।

আমি রাশিদ। নিম্মি আমার স্ত্রী। আমার থেকে কম করে হলেও পাঁচ বছরের ছোট হবে। ভীষণ ছটফটে। আনন্দ করতে পছন্দ করে। ঘুরতে পছন্দ করে। আর আমাকে ভালোও বাসে অনেক বেশি। ভালোবাসার প্রতিযোগীতায় ওর কাছে আমার সবসময়ই হার।কিভাবে যে মেয়েটার বুকে এতো মায়া।

আমার বাবা মা ভাইবোন সবার কাছে নিম্মি একটা প্রাণ। নিম্মির মতে, আমার পরিবারে এসেই নাকি ওর মাঝে মায়ার জন্ম হয়েছে সবার ভালোবাসা পেয়ে।

নিম্মির আছে এক দুঃখভরা জীবনের গল্প। হাসপাতালে ছোট্ট নিম্মির যেদিন জন্ম হোল সেদিন ওদের পরিবারে আনন্দ বয়ে যায়। কিন্তু চারদিনের মাথায় ওদের পরিবারের সব আনন্দ শেষ হয়ে যায়। নিম্মিকে নিয়ে বাসায় ফেরার পথে ভয়াবহ রোড এক্সিডেন্টে ওর বাবা মায়ের মৃত্যু হয়।অলৌকিক ভাবে বেঁচে যায় নিম্মি। অপয়া নামটা ওর নামের সাথে সেঁটে যায় সেই থেকে। অপয়া বলে ঠাঁই হয় না ওর বাবার পরিবারে। 

খালার সংসারে বেড়ে ওঠা ওর। জীবনের কঠিন বাস্তবতা খুব অল্প বয়সেই দেখেছে। তবুও হারতে চায়নি নিম্মি। হাসি আনন্দ দিয়ে জীবনের দুঃখগুলো থেকে দুরে থেকেছে।

নিম্মির সাথে আমার সম্মন্ধ আসার পর অপয়া বলে অনেকেই ওখানে বিয়ে না করতে বলে।  কিন্তু সংস্কারের মাঝে আমাদের বসবাস। তাই শেষমেষ আমাদের বিয়েটা হয়েই যায়। ওকে নিয়ে বেড়াতে গেছি বহু জায়গায়। নদী পাহাড় বন সাগরে গেলে আনন্দে হারিয়ে থাকতো সবসময়। ছবি তুলতে খুব পছন্দ করতো। 

আমাদের নিজেদের শোবার ঘরে নিম্মির বিশাল একটা ছবি টানিয়ে রাখা আছে। পিছনে ঝর্ণা পাহাড়। চমৎকার প্রকৃতির সামনে ও হাত বাড়িয়ে আছে। কি জীবন্ত সেই ছবিটা।যেন হাত বাড়িয়ে আমাকেই ডাকছে। 

সিস্টার তাড়াতাড়ি বড় ডাক্তারকে ডাকুন। রোগীর অবস্থা ভালো না।

ওদের কথা শুনে আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে। ভালো করে তাকিয়ে দেখি আমার নাক মুখে কি সব নল লাগানো। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। আমি হাত দিয়ে সরাতে চাচ্ছি কিন্তু আমার হাতেও কি সব লাগানো। কিছুতেই সরাতে পারছি না। 

আমি চিৎকার করে বলতে থাকি, আমি এখানে কেন? নিম্মি কোথায়? ওকে নিয়ে তো হাসপাতালে যেতে হবে।  আমাদের বাবুটার জন্মানোর তারিখ যে পার হয়ে যাবে। 

কিন্তু কেউ আমার কথা শুনতে পেল না।

 

পিপি পরা চোখমুখ ঢাকা বেশ কজন আমার চারপাশে ঘিরে আছে। 
বড় ডাক্তার ঢুকলেন আইসিইউ রুমে। 
ঢুকেই জিজ্ঞেস করলেন, কোন রুগী? 
মিস্টার রাশিদ?
জ্বী স্যার। 
স্বামী স্ত্রী দুজন একসাথেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। 
উনার স্ত্রী ও করোনায় দুদিন আগে মারা গেছেন।
প্রেগন্যান্ট ছিলেন। 
আমরা বহু চেষ্টা করেছি মাকে বাঁচাতে। 
কিন্তু বাঁচানো সম্ভব হয়নি। একটা কন্যা জন্ম দেয়ার পর মারা গেছেন। বাচ্চাটা বেঁচে আছে। সুস্থ আছে। 

শেষ বারের মতো ডাক্তার সাহেব দেখলেন আমাকে।

বেশ কিছু সময় চেষ্টা করার পর ডাক্তার বললেন, ‘হি ইজ নো মোর। কি এক অদ্ভুত পৃথিবীর মধ্যে আমরা ঢুকে গেছি! এতো এতো মৃত্যু! হে আল্লাহ তুমি সহায় হও আমাদের।' অক্সিজেনের নলটা খুলে দিয়ে মুখের উপর কাপড় টা টেনে দিয়ে উনি চলে গেলেন। ওদের মধ্যে কেউ একজন বললো, ইস্!  একটা পরিবার শেষ হয়ে গেল। 

নিজেকে কেমন হালকা মনে হচ্ছে। আটকে ধরা নিঃশ্বাস নিতে আর কোন কষ্ট হচ্ছে না। দমবন্ধ ভাবটা কেটে গেছে। 

কিন্তু নিম্নির উপর খুব রাগ হচ্ছে। মেয়েটা সবসময় জিতে যায়। মাঝে মাঝে যখন আমি বলতাম, ওর আগে আমি হারিয়ে যাবো। ও কিছুতেই মানতে চাইতো না সেটা। সবসময় বলতো, ওই চলে যাবে আমার আগে। 

আমাদের হালকা রসিকতা আজ চির সত্য হয়ে গেল। নিম্মি আমার আগে চলে গেল। 

খুব দ্রুতই আমাকে রুম থেকে বাইরে বের করে আনা হলো। আইসিইউর জন্য কতো মানুষ অপেক্ষায় আছে। একটা মৃত্যু। আরেক জনের জীবন বাঁচানোর প্রচেষ্টা। আমার পাশ দিয়েই দ্রুত আইসিইউ তে একজনকে ঢুকিয়ে নিয়ে গেল। একটা বেড যে ফাঁকা হয়ে গেল এইমাত্র। 

হঠাৎ বুক চাঁপা কান্নার আওয়াজ পেলাম। আমার বাবা মা ভাইবোন সবাই কাঁদছে। শুধু আমার জন্য না নিম্মির নাম নিয়েও কাঁদছে। একটু দুরে দাঁড়ানো সবাই। হঠাৎ মায়ের দিকে চোখ পড়ে। দেখি মায়ের কোলে তোয়ালে মোড়ানো আমাদের ছোট্ট রাজকন্যা। একেবারে ওর মায়ের রূপ পেয়েছে।  মনে হলো ওর ছোট একটা হাত আমার দিকে বাড়িয়ে আছে। অন্য পাশে নিম্মির সেই হাত বাড়িয়ে রাখা ছবিটা দেখলাম। 

 

আমি নিম্মির দিকেই হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। 

মেয়েটার কাছে যেতে একটু ছুঁয়ে দিতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু পারিনি। কারণ আমার শরীরে এখনো করোনার জীবাণু সক্রিয়। বাবা হয়ে সন্তানের ক্ষতি হোক সেটা কিছুতেই চাইবো না।

নিম্নির জন্মের পর অপয়া অপবাদ দিয়ে ওর বাবার পরিবারে ওর জায়গা হয়নি।কিন্তু আমার সদ্য বাবা মা হারা কন্যাকে অপয়া বলে কেউ দুরে ঠেলে দেয়নি। বুকে তুলে নিয়েছে। আপন রক্তের মাঝে ওর ঠাঁই হয়েছে। 

বেঁচে থাক আমাদের সন্তান। নোনাজলে যেন আমার সন্তানের জীবন ভেসে না যায়।

নিম্মির বাড়িয়ে দেয়া হাত ধরে আমরা ফিরে চলি। পিছনে পড়ে থাকে আমার সংসার, সন্তান আর আমার পরিবার। 

 

শাহানারা পারভীন শিখা
কবি ও লেখক 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top