সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

অন্তহীনা : কৃষ্ণা গুহ রায়


প্রকাশিত:
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৯:০৬

আপডেট:
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২১:৩০

 

পরমা নেই ৷ আজ বছর তিনেক হলো ৷ প্রিয়ব্রতর তাই বড় ফাঁকা লাগে ৷ জীবনের এই গোধূলিবেলায় বড় নিঃসঙ্গ সে ৷ অথচ পরমা যতদিন বেঁচেছিল তাকে সর্বক্ষণ শিশুর মতন বুক দিয়ে আগলে রেখেছিল ৷ কোথাও কোনও অসুবিধা প্রিয়ব্রতকে ছুঁতে পারে নি ৷
- কাকাবাবু আপনার চা ৷
- হ্যা দে ৷
রমা চায়ের কাপটা দিয়ে চলে যায় ৷ পরমা বেঁচে থাকতেই রমা এ বাড়িতে কাজ করে ৷ এখন প্রিয়ব্রতর সংসারের চাবিকাঠি রমার হাতে ৷
একমনে চোখবুজে বসে রইলেন প্রিয়ব্রত৷ স্মৃতির সরণী বেয়ে মনের মানসপটে ভেসে উঠতে লাগলো কত শতশত সাদা কালো ছবি ৷ যা আজও অমলিন৷ মনের চোরাগলিতে এখনও সেসব লুকোচুরি খেলে ৷
পরমার বড় সাধ ছিল চাকরি থেকে অবসর নেবার পর কলকাতার কোলাহলের বাইরে কোনও মফস্বলে এসে জীবনের বাকীটা সময় কাটিয়ে দেবে ৷ ওর ইচ্ছেতেই দত্তপুকুরে তিনকাঠা জমি কিনে ছোট্ট একটা দুকামরার বাড়ি বানিয়েছিলেন প্রিয়ব্রত ৷ কিন্তু ভগবানের ইচ্ছে বোধহয় অন্যরকম ছিল ৷ নতুন বাড়িটা পরমার সহ্য হলো না ৷ বাড়ি করার বছর তিনেকের মধ্যেই পরমার হঠাৎ করে স্ট্রোক হলো ৷ তিনদিন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে যমে মানুষে টানাটানি ৷ তারপর সব শেষ ৷
আজকে প্রিয়ব্রত এই যে বেঁচে আছে সেতো পরমার জন্যই ৷ পরমাই ওকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছিল৷ সেদিনের সেই দুঃসময়ের প্রহরগুলো প্রিয়ব্রত আজও ভুলতে পারেন না ৷ কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানে অতসীর গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন প্রিয়ব্রত৷ তারপর বছর চারেক প্রেমের বাঁধনে নিজেকে বেঁধে ব্যাঙ্কের চাকরিটা পেয়েই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল ৷ এরমধ্যে অতসীও নিজেকে গানের জগতে মেলে ধরতে শুরু করেছে ৷ দুএকটা ক্যাসেটও বেড়িয়েছে৷ উঠতি গায়িকা হিসেবে সঙ্গীত শিল্পীমহলে তখন বেশ নামডাক৷ বিয়ের পর বছর দুয়েকের মাথায় একদিন এক বর্ষণক্লান্ত রাতে প্রিয়ব্রত অতসীকে বুকে টেনে নিলেন ৷ নিবিড়ভাবে তাঁর মনের গোপন ইচ্ছের কথা বললেন ৷
- এবারতো একটা ছোটোছোটো টলমল পায়ের হাটিহাটি পা পা , আর তার সঙ্গে আধোবোলের ডাক শুনতে ইচ্ছে করে অতসী ৷
এক ঝটকায় প্রিয়ব্রতকে দূরে সরিয়ে দেয় অতসী৷
- তুমি কি ক্ষেপেছো নাকি ? আমি এখন ওসব নিয়ে ভাবতে চাই না ৷ আমার কাছে প্রথম প্রায়রিটি কেরিয়ার৷
মাথাটা দুহাতে চেপে ধরেন প্রিয়ব্রত ৷ বুকের ভেতরটা যেনো দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যায় ৷ এরপরে আর কখনও সে অতসীর উপরে পুরুষত্বের অধিকার ফলাবার চেষ্টা করেননি৷ বরাবরই প্রিয়ব্রতর ভেতরে এক অদ্ভুত সহিষ্ণুতা ছিল যা আজও আছে৷ হাত বাড়িয়ে চাওয়া বা জোর করে আদায় করা তার স্বভাববিরুদ্ধ৷
এভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল৷ এরই মধ্যে একদিন সন্ধেবেলা প্রিয়ব্রতর মাসতুতো দাদা অনিমেষ ওদের বাড়িতে এলেন ৷ একথাসেকথার পর প্রিয়ব্রত জানতে পারলেন গত সপ্তাহে অতসী শিলিগুড়িতে ফাংশানের কথা বলে সেখানে আর
যায়নি৷ গিয়েছিল দীঘায়৷ রেকর্ড কোম্পানীর কোন এক মিউজিসানের সঙ্গে সময় কাটিয়ে এসেছে৷
মুহূর্তের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে গেলেন প্রিয়ব্রত৷পরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত৷ মুমূর্ষ সম্পর্কটা একটা মৃত শবদেহের আকার নিল৷ আর শ্মশানে শবদেহের মত তার নিষ্পত্তিও হলো বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে৷
তারপর থেকে যণ্ত্রণার এক নিদারুন দাবদাহে পুড়ে ছারখার হতে থাকলেন প্রিয়ব্রত৷ সে যণ্ত্রণা হলো বিশ্বাশভঙ্গের,নিঃসঙ্গতার৷ একাকীত্ব আর অবসাদে বিস্ত্রস্ত অবস্থায় দিন কাটছিল তার৷ এরকমই একটি দিনে কলেজস্ট্রীট বইপাড়ায় একটি বই খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন প্রিয়ব্রত ৷ ওখানেই পরমার সঙ্গে দেখা৷ পরমা প্রিয়ব্রতর স্কুলের বন্ধু হিমাংশুর বোন৷ পরমার কাছেই প্রিয়ব্রত জানতে পারে হিমাংশু এখন স্টেটসে থাকে৷ বাড়ির সাথে এখন আর যোগাযোগ নেই বললেই চলে৷ আরও জানতে পারে হিমাংশুর বাবা এখন আর বেঁচে নেই৷ পরমা একটা স্কুলে চাকরি করে৷মা আর মেয়ের সংসার ৷
দূর থেকে বাস আসতে দেখে পরমা পা বাড়ায়৷ যেতে যেতে বলে — প্রিয়দা আসছি ৷ একদিন আমাদের বাড়িতে আসুন না, মা আপনাকে দেখলে খুব খুশী হবে৷
স্কুলজীবনে প্রিয়ব্রত অনেকবারই হিমাংশুদের বাড়িতে গেছে৷তারপর যা হয় দুই বন্ধুর পড়াশুনার দিক ভিন্ন হয়ে যাওয়ায় যোগাযোগও ছিন্ন হয়ে গেছে৷ এতবছর বাদে তাই স্কুলজীবনের স্মৃতিগুলো প্রিয়ব্রতর মনে ভেসে উঠতে লাগলো৷ এরঠিক সাতদিনবাদে কি এক অদ্ভুত আকর্ষণে প্রিয়ব্রত পরমার বাড়িতে গিয়েছিল৷ অনেকদিন পর পুত্রসম ছেলের বন্ধুকে কাছে পেয়ে পরমার অসুস্থ মা নিভাদেবীও উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েছিলেন৷
প্রিয়ব্রত সেদিন থেকেই একটা কর্তব্যবোধ অনুভব করেছিলেন৷ প্রায়দিনই অফিস ফেরত পরমাদের বাড়িতে উপস্থিত হতেন৷ ক্রমে সম্পর্কের একটা টানাপোড়েন তৈরী হতে থাকলো দুজনের মধ্যে৷
দ্বিতীয়বার সাতপাঁকের বাঁধনে ধরা দিলেন প্রিয়ব্রত৷ ফুলশয্যার রাতে প্রিয়ব্রত তার ব্যাথা ভরা বুক নিয়ে পরমার সারা শরীরে আলতো করে ঠোটের ছোঁয়া এঁকে দিলেন৷ পরমাও দুহাত দিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরলো৷ চূড়ান্ত সন্ধিক্ষণে এসে প্রিয়ব্রত বুঝতে পারলেন তার সব শেষ হয়ে গিয়েছে৷ এতদিনের মানসিক অবসাদ তার সবকিছু শেষ করে দিয়েছে৷ ডুকরে উঠলেন প্রিয়ব্রত৷ অতৃপ্ত বাসনা বুকে নিয়েই পরমা স্নেহে প্রিয়ব্রতর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো৷
প্রিয়ব্রতকে ডাক্তার দেখানো হলো৷ কিন্তু সেরকম আশানুরূপ ফল কিছু হলো না৷ এসব নিয়ে পরমার আচরণে কোনওদিনও বিরক্তির প্রকাশ ঘটেনি৷ বরং প্রিয়ব্রতর মানসিক চাপ হাল্কা করার জন্য পরমা বলতো— তোমার সঙ্গে কি আমার এক জন্মের সম্পর্ক? এই জন্মেই যদি সব হিসেব মিলে যায়, তবে আগামী জন্মেতো হিসেবের খাতায় গরমিল থেকে যাবে৷
খট করে একটা শব্দে প্রিয়ব্রতর স্মৃতিস্বপ্নের ঘোর কেটে যায়৷ চোখ মেলে তাকালেন৷ সূর্য পশ্চিমে ডুবে গেছে৷ চারিদিকে একটা আবছা অন্ধকার৷ পাখীরা আপন ঘরে ঠাঁই নিয়েছে৷ আশেপাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসছে শঙ্খধ্বনি৷
প্রিয়ব্রত ইজিচেয়ার থেকে উঠে ঘরের আলোটা জ্বালালেন৷ বুঝলেন টেবিলের বন্ধ ড্রয়ারটা থেকে আওয়াজটা আসছে৷ এগিয়ে গিয়ে ড্রয়ারটা টানতেই একটা ইদুর লাফ দিয়ে পালিয়ে গেল৷ ড্রয়ারের ভেতর অনেক অগোছালো কাগজের মাঝে একটা লাল মলাটের খাতা৷খাতাটা টেনে বের করতেই বুঝতে পারলেন এটা পরমার কবিতা লেখার খাতা৷ খাতার বিবর্ণপাতাগুলো ওল্টাতে ওল্টাতে একটা কবিতার কতগুলো পঙক্তিতে প্রিয়ব্রতর চোখটা আটকে গেল৷

আজ থেকে অনেক দূরে
স্মৃতির কথার পাড়ে
আবছা হয়ে আমায় যদি কখনও মনে পড়ে
একবার কান পেতে শুনো আমার ডাক
বুঝিয়ে বোলো সময়টাকে
একটু থমকে থাক
খাতাটা দুহাত দিয়ে বুকে চেপে ধরলেন প্রিয়ব্রত৷ চোখদুটো জলে ভরে উঠল ৷

সমাপ্ত

 

কৃষ্ণা গুহ রায়
সাহিত্যকর্মী

পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top