সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

নিরুপমার পথ চলা : শাহানারা পারভীন শিখা


প্রকাশিত:
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৮:০৮

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ০৪:০৯

 

নিরুপমা খুব নিঃশব্দে নিজের ঘরে এসে ঢোকে। দরজা লাগিয়ে বিছানায় পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। 

ছোট বোনটা এখনো স্কুল থেকে ফেরেনি। ওর দাদা আর বাবা ফিরতে ফিরতে সেই সন্ধ্যা। দরজাতে আলতো টোকা পড়ে। চোখ মুছে দরজা খুলে দেয়। ওর বৌদি ঘরে এসে ঢোকে।  নিরুপমা একটু ঘাবড়ে যায়।এমনিতে বৌদি মানুষটা খুব বেশি খারাপ না। তারপর ও ওর বুকটা ঢিপঢিপ করে। বৌদি জেনে যায়নি তো তার পালিয়ে যাওয়ার কথাটা?

দরজা লাগিয়ে নিরুপমার পাশে এসে বসে বৌদি শিলা। 
- তোমার মনটা কি খুব বেশি খারাপ? আমাকে বলতে পারো। মনটা হালকা হবে। 
-না বৌদি কিছু হয়নি। মা কোথায়? মাকে তো দেখছি না! 
- মা ভাতঘুম দিচ্ছে। এই সময়টাতে মাকে কখনো জেগে থাকতে দেখেছো?

ঠিক মিলাতে পারে না নিরু।তাহলে মায়ের হাতে চিঠিটা পড়ে নি নাকি! 

দ্রুত খাট থেকে নামতে যাবে। বৌদি ওর হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে বলে,কি? এই চিঠিটা মায়ের ঘর থেকে আনতে যাচ্ছো বুঝি! 

মাথা নিচু করে থাকে নিরুপমা। হঠাৎ বৌদিকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। 

অরুণ আমার সঙ্গে এভাবে প্রতারনা করবে এটা বুঝতে পারলে ওর কথাতে এভাবে ঘর ছাড়ার কথা মাথায় আনতাম না। পাঁচ বছরের সম্পর্ক ও এভাবে শেষ করে দিলো! 

- ভালোই তো হলো!  ননদিনী আমাদেরই রইলো। 

নিরুর অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ভাবছো মায়ের চিঠি আমার কাছে এলো কি করে? 

দুপুরের আগে মায়ের ঘরে কি একটা আনতে যেয়ে চিঠিটা আমার চোখে পড়ে। খুলে দেখি তোমার চিঠি। ভাবো তো, চিঠিটা যদি মায়ের হাতে পরতো তাহলে এতক্ষণ পাড়ায় খবর হয়ে যেত।

এখন ওঠো তো। মুখহাত ধুয়ে খেতে এসো। তোমার টেনশনে আমিও না খেয়ে বসে আছি। 

 

খাবার টেবিলে নিরুপমা ভাত নাড়াচাড়া করতে থাকে। কিছুতেই গলা দিয়ে খাবার নামে না। অরুণ ওর জীবনে আর নেই। এটা ভাবতেই পারছে না।

 সবাই ওদের সম্পর্কের কথা জানে। দাদা কতোদিন ওকে বকাঝকা করেছে। অরুণের সাথে সম্পর্ক না রাখতে বলেছে। কিন্তু নিরুপমা কারো কথা শোনেনি। 

ছোটবোন রত্না দৌড়ে ঘরে এসে ঢোকে।

 নিরুপমাকে দেখেই বলে, দিদি! দিদি!  জানিস আজ অরুণদার বিয়ে। 

-তোকে কে বললো?  বৌদি জিজ্ঞেস করে। 
-কেন! ওই-যে বিশুর কাকিমা। 

স্কুল থেকে ফেরার সময় বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল। আমায় দেখেই কেমন সুর করে ডেকে বললো, এই রত্না তোর দিদি কোথায় রে? তোর দিদিকে বলিস আজ রাতে আমাদের ঔ গনেশদার ছেলে অরুণের বিয়ে। মেয়েরা বিরাট বড়লোক। দুতলা বাড়ি।

-দুতলা বাড়ি! তো আমার কি? মুখের উপর বলে এসেছি। 

আচ্ছা দিদি, সত্যি সত্যিই কি অরুণদার বিয়ে?

-রত্না ঘরে যাও। ফ্রেস হয়ে খেতে এসো। 

 

ওদের কথা শুনে ঘর থেকে ওদের মা সুরমা দেবী উঠে আসেন।

- কি হলো তোদের?  তোদের জন্য চোখের পাতা বন্ধ করার জো নাই দেখছি। 

-জানো মা। আজ অরুণদার.. 

বৌদি ইশারা করতেই থেমে যায় রত্না। 

- কিছু না মা। বলেই ঘরে চলে যায় সে।

 

সন্ধ্যায় বাবা আর দাদা একসাথেই বাড়ি ফেরেন। থমথমে চেহারা। পথে বিশুর সাথে ওদের দেখা। ওর কাছ থেকেই শুনেছে সব।

শীলা!  শীলা! নিরুপমা কোথায়? ওর জন্য বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে নাকি? 

 শীলা বহু কষ্টে ওর স্বামীর রাগ থামিয়েছে। 

-ওতো আর ছোটটি নেই। এমনিতেই মেয়েটা ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। এরপর তোমরা যদি এমন করো মেয়েটা যদি কোন অনর্থ ঘটিয়ে বসে?  তখন কি হবে?

পাড়ার কে কি বললো তারচেয়ে নিরুপমার পাশে থাকাটা আমাদের বেশি জরুরি। পাড়ার লোক দুদিন পর থেমে যাবে। কিন্তু নিরুর বুকের ঘাঁ শুকোতে অনেক সময় লাগবে। ওকে সময় দাও। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের উচিৎ ওর পাশে দাঁড়ানো। 

 

পরদিন সকাল না হতেই বিশুর কাকিমা এসে হাজির। বারান্দায় বসে রসিয়ে রসিয়ে অরুণের বিয়ের গল্প করে।

হোন্ডা দিয়েছে। নগদ টাকা দিয়েছে নাকি কয়েক লাখ। আজ বিকেলে বৌ নিয়ে আসবে। 

নিরুপমার মা মুখ ভার করে নিজের কাজ করতে থাকে। নিরুর বাবা এই মহিলাকে দুচোখে দেখতে পারে না।খালি কূটনামি করে বেড়ায় এবাড়ি ওবাড়ি।

একটু কড়া গলায় বলেন,তুমি এখন যাও। আমাদের মেলা কাজ রয়েছে। 

রাগে গজগজ করতে করতে চলে যায় বিশুর কাকিমা। 

-যত্তসব। বলেই পেপারে চোখ রাখেন নিরুর বাবা। 

-উনার কি দোষ। তুমি পাড়ার ক'জনের মুখ আটকাবে শুনি! ধিঙ্গিপানা করার সময় মনে ছিল না। এখন হলো তো! মুখে ঝামা মেরে অন্য খানে বিয়ে করলো। 

- থামো তো নিরুর মা। মেয়েটাকে আর কষ্ট দিও না।

-কষ্ট কি ওর শুধু একা? বাড়ি বয়ে লোকজন এসে কথা শুনিয়ে যায়। হায় ভগবান!  আমি এমন মেয়ে পেটে ধরেছিলাম!  বলে ফোঁসফোঁস করে কাঁদতে থাকেন।

 

সেদিন সারাদিন নিরু ঘরের বাইরে বের হয়নি।

 বিকেলে ব্যান্ড বাজানোর আওয়াজ কানে আসে।

রত্মা ছুটতে ছুটতে এসে বলে, দিদি!  দিদি!  অরুণদা বৌ নিয়ে বাড়িতে ফিরছে। সারা পাড়ায় ব্যান্ড বাজিয়ে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। কি সুন্দর লাল গাড়িতে বসে আছে অরুণদা। 

-রত্মা?বৌদির রাগী স্বর শুনে দৌড়ে পালিয়ে যায় ও।

 

ওকে বকছো কেন বৌদি। ও তো ছোট মানুষ। আমি যখন এতোবড় একটা ভুল করে বসলাম!

- আসলে নিরুপমা জানো তো, যা হয় সেটা ভালোর জন্যই হয়। তোমার এতেই হয়তো মঙ্গল হবে। তাছাড়া শুনেছি অরুণের মা খুবই খারাপ। সবাই নিন্দে করে। ওরকম একজন থাকলে তুমি কখনো শান্তিতে থাকতে?

তাছাড়া অরুণ তোমার যোগ্যই নয়। আত্মসম্মানহীন একজন কাপুরষ। যে মায়ের ভয়ে অর্থ সম্পদের লোভে দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক শেষ করে দেয়। আবার নির্লজ্জের মতো ব্যান্ডপার্টি বাজিয়ে তোমার বাড়ির পাশ দিয়ে যায়। 

যা হয়েছে,ভালোই হয়েছে। যত তাড়াতাড়ি তুমি এগুলো ভুলে যাবে ততই তোমার মঙ্গল। নিজেকে নতুন ভাবে গড়ে নাও নিরু। আমরা সবাই আছি তোমার পাশে। 

 

নিরুপমার জীবন থেমে থাকেনি। সরকারি ব্যাংকে চাকরি হয়ে যায় । চলে যায় দুরের শহরে। 

সততা আর কাজের প্রতি একনিষ্ঠতার জন্য পদোন্নতি হয় বেশ দ্রুত।বিয়ে হয় আরেক ব্যাংকের অফিসার রন্জন মিত্রের সাথে। 

ভালোই চলছে রন্জন আর নিরুপমার জীবন। দুসন্তান নিয়ে বেশ সুখেই আছে ওরা। 

 

নিরুপমা মনি আর মনির বাবার জন্য যথাসাধ্য সাহায্য করে থাকে। 

মনির পঙ্গু বাবার জন্য ভাতার ব্যবস্হা করে দিয়েছে।

 

নিরুপমা এখন ব্যাংকের মস্ত অফিসার।

নিজের এলাকায় ম্যানেজার হিসেবে জয়েন করেছে কদিন হয়।

 

নতুন অফিস। ফাইলগুলো চেক করতে যেয়ে একটা ফাইলে চোখ আঁটকে যায় নিরুপমার।

ফাইলটা অরুণের। লোনের জন্য আবেদন করেছে ওর ব্যাংকে।

 অফিস সহকারীকে ডেকে লোন আবেদনকারী অরুণকে দেখা করতে বলেন। 

 

দুদিন পর। মুখোমুখি অরুণ আর নিরুপমা। 

চেহারায় মলিনতা আর দুশ্চিন্তার ছাপ অরুণের। সেই ধারালো চেহারায় আজ বয়সের ছাপ আরো বেশি স্পষ্ট। 

 

মাথা তুলে কোনমতে বলে, নিরু আমাকে ক্ষমা করে দাও।

-নিরু না। বলুন নিরুপমা মিত্র।

 আর তুমি না। বলুন আপনি। 

দেখুন অরুণ বাবু, আপনাকে আমাদের ব্যাংক কোন লোন দিতে পারবে না। আপনার আগের লোনের বেশ বড় এমাউন্ট এখনো বাকি আছে। I am sorry অরুণবাবু।

 

চমকে তাকায় অরুণ। মনে পড়ে যায় বহু বছর আগে নিরুপমাকে পাঠানো শেষ ম্যাসেজটার কথা। 

লোভের আগুনে পা দিয়ে নিরুপমাকে ঠকিয়ে ছিল সে। অপমান করেছিল ওর ভালোবাসাকে। "I am sorry নিরুপমা "ছোট  এই বাক্যটা লিখে তাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্কটাকে ভেঙে দিয়েছিল। 

 

শাস্তি পেয়েছে অরুণ। জীবনে দুদন্ড শান্তি পায়নি সে। 

ছেলেমেয়ে দুটো মানুষ হয়নি। আর জয়া তো ওকে স্বামী হিসেবে কখনো সম্মানই দেয়নি। টাকার লোভে বিয়ে করেছে বলে সবসময় খোটা দেয়।

ছেলেটা ব্যবসা করার কথা বলে টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে ওকে। সেকারণেই লোনটা করতে হচ্ছে ওকে। 

এসব ভাবতে ভাবতে অরুণ আনমনে উঠে পড়ে। দরজার কাছে যেতেই নিরুপমা ডাক দেয়, দাঁড়াও অরুণ। 

আমি প্রতিশোধ নিচ্ছি না তোমার উপর। অভিশাপ ও দেয়নি কখনো। সবসময় চেয়েছি তুমি ভালো থাকো।

তবে প্রকৃতি তোমাকে শাস্তি দিয়েছে। 

কারো ভালোবাসাকে অসম্মান করবে না। ঠকাবে না। তাহলে নিজেই ঠকে যাবে নিজের জীবনের কাছে। তোমার জন্য কষ্ট নয়, বরং করুণা হচ্ছে ভীষণ। 

 

তোমার লোনটা যাতে পেতে পারো আমি তার ব্যবস্থা করবো। 

মাথা নিচু করে অরুণ রুম থেকে চলে যায়।  

নিরুপমা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাজে মন দেয়। 

 

নিরুপমারা কখনো হেরে যায় না। জীবনের বাঁধা যত আছে সেগুলো কাটিয়ে ঠিক পৌঁছে যেতে পারে নির্দিষ্ট গন্তব্যে।

অরুণের মতো কাপুরুষরা পরাজিত হয় জীবনের কাছে। 

 

শাহানারা পারভীন শিখা
কবি ও লেখক 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top