সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

অন্যভাবনা : অমিতা মজুমদার


প্রকাশিত:
১৮ অক্টোবর ২০২১ ২০:১৮

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ০৩:৪৭

 

শিকড়চ্যুত হয়ে পড়ছি কি আমরা? আমরা যারা ষাট সত্তর দশকে জন্মেছি,বেড়ে উঠেছি তাদের বেশিরভাগের শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে তরুণ বয়সেরও অনেকটা সময় কেটেছে গ্রাম, গঞ্জ, মফঃস্বল শহর বা এই মহানগরে। কিন্তু সেই সময়টায় আমাদের ঘরবাড়ি, জীবনাচার কেমন ছিল?বেশিরভাগ বাড়িই কাঁচা মাটির মেঝে, কাঠ, দরমা বা ইটের দেয়াল ঘেরা টিন, গোলপাতা, ছন বা টালির ছাউনির ঘর। তখন ঘর লাগোয়া শৌচাগার, বা স্নানঘরের কথা কেউ ভাবেওনি। এক পরিবারের জন্য,আবার এক মহল্লার জন্যও একটিমাত্র শৌচাগার, একটি কলতলা হয়তো বরাদ্দ ছিল।তাতেই খুব মসৃনভাবে চলে যেত মানুষের জীবনের স্বাভাবিক গতিপ্রকৃতি। আজকে যারা নাগরিক জীবনের সকল সুবিধাভোগী মানুষ তাদের শুরুর জীবনটা এই নিয়মেই ছিল। এখন যারা আমরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে থাকি, শোবার ঘর লাগোয়া স্নানঘর, শৌচাগার ছাড়া জীবন ভাবতেই পারি না, বাইরে একপাও গাড়ি ছাড়া চলতে পারি না, তারাই হয়তো দুই তিন মাইল হেঁটে স্কুলে গিয়েছি অবলীলায়। আর খাদ্যাভ্যাস! সেখানেও এসেছে গরীব ধনী,গ্রাম শহরের শ্রেণিভেদ। আমাকে প্রায়ই সহকর্মীরা প্রশ্ন করে দিদি বাসায় এসি নাই? আমি অবলীলায় বলি না। না থাকার কারণ আমি যেটা বলি, সেটা সকলের কাছে হাসির খোরাক যোগায়।আমার শোবার ঘর, খাবার ঘরের দক্ষিণদিক খোলা,আর সেই খোলা জানালা দিয়ে পাশের বাড়ির কিছু গাছপালা দেখা যায়। একটি নিমগাছ কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করেই তার পাতা আর ফুলে ভরা ডালের অবৈধ অনুপ্রবেশ ঘটায় প্রায়শঃই।
এই দাক্ষিণ্যটুকু আমি কোনোমতেই হারাতে চাই না। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে শীতলতা পাবো শরীরের কিন্তু মনে যে রয়ে যাবে তৃষ্ণা।জানালায় রাতের একটুকরো আকাশ,তাতে মেঘেদের আনাগোনা, চাঁদের উঁকিঝুঁকি এসব খোয়াতে মন চায় না। সেদিন কথা হচ্ছিল শীতের কাঁথা নিয়ে।একজন বলল নঁকশী কাঁথা কিনে নিলেই হয়। আমার মনে হলো মায়ের পরনের শাড়ি হোক না পুরানো তাতে থাকবে মায়ের গায়ের পরশ,যা গায়ে দিয়ে ঘুমালে সন্তানের মনে হবে মাকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছে সে।আমাদের মাঝে এখন বড়ো বেশি অস্তিত্বের সংকট। এত বাহুল্যপ্রাপ্তি আমাদের হাতের মুঠোয় এসে গেছে যে, এক প্রজন্ম আগের পূর্বপুরুষ যে কৃষি নির্ভর জীবন, খাদ্যাভাসে অভ্যস্ত ছিল,সেটা যেন আমাদের উত্তরপ্রজন্ম জানতে না পারে সে চেষ্টা করি অবিরত। ভালো চাকুরী, ভালো ব্যাবসা সহ অধিকতর নাগরিক সুবিধা, রাষ্ট্রব্যবস্থায় সহজলভ্য হওয়ায় ষাট-সত্তর দশকের গ্রাম, গঞ্জে বড়ো হওয়া শ্রেণিই এখন মহানগরের অভিজাত নাগরিক।আমাদের বেশিরভাগের মধ্যে চলে এসেছে উন্নাসিক মনোভাব। ফলে আমাদের পরপ্রজন্মকে আমরা আমাদের পূর্বসূরীদের কল্পিত রাজপাটের কাহিনী শোনাই। তারা জানে না তাদের পূর্বপ্রজন্ম কেমন জীবনে অভ্যস্ত ছিল। কতটা শ্রম আর ত্যাগ আছে তাদের এই আরাম আয়েশের জীবনের ভিত তৈরীতে সেইসব মানুষের।
সবাইকে একছাঁচে ফেলছি না, তবে এই প্রজন্মের সাথে কথা বললে এমনটাই ভাবতে হয়,দু-চারজন ব্যতিক্রম ছাড়া। শেকড়বিহীন জলজ শেওলার মতো বেড়ে উঠছে আমাদের উত্তর প্রজন্ম।আমার অপছন্দ হতেই পারে কোনো খাবার জিনিস। কিন্তু সেটাই হয়তো দেশের সিংহভাগ মানুষ স্বচ্ছন্দে খায় দুটো কারণে। এক ভালোবেসে, দুইক্রয় ক্ষমতার সামর্থ্যের অভাবে।কিন্তু আমরা খুব সহজেই ঠোঁট উলটে বলে ফেলি ওগুলো আমরা কখনো খাইনি। এইযে, সহজাত তাচ্ছিল্য আর অহংবোধ আমাদের ভুলিয়ে দিচ্ছে আমাদের অতীত। আমাদের চারপাশে এরকম মানুষের অভাব হবে না যে হয়তো দু'বেলা দু-মুঠো ভাত আর মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুতেই সন্তুষ্ট এমন জীবনের স্বপ্ন দেখে বড়ো হয়েছে,কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর রাষ্ট্রকাঠামো, সমাজব্যবস্থা তাকে পৌঁছে দিয়েছে তার স্বপ্নের অধিক স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনে।এদের অধিকাংশই এখন নিজের অতীতকে করে তুলেছে আতস বাজির মতো। ইচ্ছেমতো বারুদ পুরে ছুড়ে দেয় আকাশে। যা রঙ বেরঙের আলো ছড়িয়ে মিলিয়ে যায়। আর সেই একঝলক আলোকেই এই প্রজন্ম ধরে নেয়,তাদের কাছে অজানা থেকে যায় তাদের পূর্বপ্রজন্মের সংগ্রামের কথা। আজ যা অবহেলার তাই ছিল অতি যত্নের সম্বল। সে'কথা তারা অনুভব করতে পারে না। সমাজ সংসার রাষ্ট্র সব জায়গা এই বিস্মৃতির কালো চাদরে ঢেকে যাচ্ছে।
"আলেক্স হেলি” তাঁর সাত পুরুষ পূর্বের প্রজন্মের রেখে যাওয়া সূত্রকে ধরেই খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর শেকড় কোথায়! কীভাবে থাকত তাঁর পূর্বপ্রজন্ম,তাদের পেশা,জীবনাচার সবকিছু জেনেছিলেন এই পরম্পরা রক্ষার সুবাদে। যার ফলে আমরা পেয়েছি “শিকড়ের সন্ধানে”(ROOTS) এর মতো কালজয়ী কাহিনীর। দক্ষিণ আফ্রিকার মহান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা রাষ্ট্রনায়কের পদ থেকে অবসরের পর ফিরে যান তাঁর গ্রামের সেই ছোট্ট ঘরে। সেখানেই তিঁনি শেষ নিশ্বাঃস ত্যাগ করার ইচ্ছা পোষন করেছিলেন।
আমদেরকেও মৃত্যুর পরে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়,তবে তা বেশিরভাগ সময় দায় এড়ানোর উপায় হিসেবে।
লেখাটা কিছুটা অসংলগ্ন আর দীর্ঘ হয়ে যাওয়ার জন্য দুঃখিত। কথার আড়ালে রয়ে যাওয়া কথাগুলো বলা যায় না সব সময়।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top