সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

নীল পাহাড়ের চূড়ায় (শেষ পর্ব) : শাহান আরা জাকির পারুল 


প্রকাশিত:
৯ নভেম্বর ২০২১ ০১:৪৪

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:১২

ছবিঃ শাহান আরা জাকির পারুল 

 

আজকাল খুব বেশি আনমনা আর অস্থিরতা বেড়ে যায় নিতু আর নীলিমার মধ্যে সমানে সমান ভাবে। দুজনের মধ্যেই সবকিছুই যেন সমান্তরালভাবে চলছে।

কত যুগ পরে দেখা হয়েছে দুজনের!সংসারের নানা ঘটনা দুর্ঘটনার কথা শুধু তাদের কথা প্রসঙ্গে হয়েছে। ঠিক পরিষ্কার করে কেউ কিছুই জানায়নি নিজেদের সম্পর্কে!যত দিন পেরুচ্ছে কেন যেন মনে হচ্ছে দুজনের দেখা না হওয়াই বুঝি ভালো ছিল!সমুদ্রসম যন্ত্রণার কথা ঢাকা ছিল দুজনের মধ্যে ,সেই বুঝি ভালো ছিল। কেউ কারো অতীত সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত জানেনা কিছুই। এই না জানাটাই বুঝি ভালো ছিল দুজনের।

- নিতু, তোকে বলা হয়নি, দুপুরের ফ্লাইটে আনন্দ আসছেরে। প্রায় ছয় বছর পর! ভেবেছিলেম আর হয়তো ছেলেটা আসবেনা আমার কাছে।
- তা আসছে বুঝি!
- হ্যারে নিতু! ও আসছে!

করিম এয়ারপোর্ট এ গেছে ওকে আনার জন্য। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে টেনে টেনে কথাগুলো বলে নীলিমা।

 

নিতুর ভেতরটাও কেঁপে ওঠে। ছেলে আসার খবর শুনেতো নীলুর খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু নীলু এমন অস্থির হচ্ছে কেন। যেমন অস্থির লাগে তার ..

রবির কথা মনে হলে।

ওদের কিছু প্রশ্নের বানে জর্জরিত হতে হয়!যার জবাব দিতে পারেনা সহজেই।

নীলুর ছেলের মতোই নিতুর ছেলে ও একদিন কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে!কোন খোঁজ খবর নেয়নি মায়ের!সে ও মায়ের কাছে একটি প্রশ্ন করে জবাব পায়নি। ছেলের সাথে শেষ দেখার দিনটি আজ এতো বেশি কেন মনে পড়ছে নিতুর ?

হঠাৎই সেদিন রবি এসে নিতুকে প্রশ্ন করে۔۔

- মা, সত্যি করে বলতো আমার বাবা কি মারা গেছেন ? নাকি এখনো জীবিত আছেন।
- রবি!
- কি বলছিস আবোল তাবোল।
- ঠিকই বলছি মা! জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই শুনে আসছি আমার চেহারাটা নাকি একদম ওই রাজাকারের মত ۔۔যিনি আমার বড় চাচা পৌরসভার চেয়ারম্যান সাহেব।

নিতু ছেলের কথা শুনে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক ঘৃণ্য রাতের বিভৎস দৃশ্য!

সুমন এর সাথে সেদিনই শেষ দেখা ছিল নিতুর!স্বাধীনতার ঠিক ক'মাস আগে সেপটেম্বর এর শেষ দিকে সুমন অনেক ঝুঁকি নিয়ে দেখা করতে এসেছিলো! ইতিমধ্যে সুমন এর বড় দুইভাই۔ই রাজাকার আলবদরের বড় মাপের নেতা হয়ে প্রায়শই বাড়িতে খাসি মুরগি জবাই করে পাকিদের দাওয়াত করে খাওয়ায় আর গ্রামের যুবতী মেয়ে সাপ্লাই করতে থাকে।

সুমন সে রাতে দেখা করে বিদায় নিয়ে যাবার পর পরই দারুম দুড়ুম বেশ কয় রাউন্ড গুলির আওয়াজ শোনা যায়। বাড়ির আনাচে কানাচে ফাসুর ফুসুর দৌড়াদৌড়ির শব্দ শুনতে পেয়ে নিতুর বুকটা ধুক ধুক করে ওঠে।

আসলে সুমনকে পাকিদের হাতে ধরিয়ে দেয় তারই বড় দুই ভাই!লাশটাও গুম করে ফেলে।

সকাল হলে নিতু দেখে পুরো বাড়ি সুনসান!বড় দুই জা ছেলেমেয়ে নিয়ে কোথাও সোরে গেছে।

বুড়ো শশুর শাশুড়ি বসে আছে বারান্দায় মনমরা হয়ে। সন্ধ্যের দিকে নিতুর বড় ভাসুর এসে বাবা মাকে বাড়ি ছেড়ে তাড়াতাড়ি সরে যেতে বলে!মিলিটারি আসতে পারে বাড়িতে।

এ বাড়িতে মুক্তিবাহিনী আছে। তারা খোঁজ পেয়েছে। শিশু বাচ্চা জয়িতাকে নিয়ে নিতু এক কাপড়েই ভয়ে ভয়ে শশুর শাশুড়ির সাথে যাবার জন্য তৈরী হয়।

বড় ভাসুর বাধা দিয়ে নিতুকে ঘরে ডেকে নিয়ে বন্দি করে ফেলে। পরনের কাপড় এক টানে খুলে ফেলে। নিতু আচমকা ভয়ে চিৎকার শুরু করে!জয়িতাও চিৎকার করে কাঁদতে থাকে!দৌড়ে আসে নিতুর শশুর শাশুড়ি। নিতুর এ অবস্থা দেখে একজন নারী ও মা হিসেবে প্রতিবাদ করে ওঠে দুজনেই।

- কি করছিস রাব্বি। তুই কি পশু হয়ে গেছিস নাকি। আমার এক ছেলে মুক্তিযোদ্ধা। আর তুই কিনা ۔۔۔

কথা শেষ হতে না হতেই পেছন থেকে কেউ একজন গুলি করে দুজনকেই।

পড়ে থাকে তাদের নিথর দেহ!নিতুর ও সমাধি হলো সেই রাতেই। আপন ভাসুরের দ্বারা ধর্ষিত হলো। গৃহবন্দী হয়ে থাকলো।

একদিন দেশ স্বাধীন হলো। সবাই জানলো নিতু এ বাড়িতে ভাসুরের তত্ত্বাবধানে নিরাপদেই ছিল। শশুর শাশুড়ি মিলিটারির হাতে শহীদ হয়েছেন। সব ঘটনা চাপা পড়ে গেলো।

সুমন এর বড় দুই ভাই রাজাকার আলবদরের নেতা। স্বাধীনতার পর মুখোশ পাল্টিয়ে ফুলে ফেঁপে এলাকায় বিত্তশালী নেতা বনে গেলো। ক’মাস পরেই নিতুর গর্ভে স্বাধীন দেশে জন্ম হলো পুত্র সন্তানের। পাড়া প্রতিবেশী সুমনের শোকে ছেলেকে দেখে আকুলি বিকুলি করলো। কেউ জানলোনা চরম সত্যটাকে।

নামহীন ভাবে বড় হতে লাগলো ছেলে। একদিন ওই বদমাইশটাই নিজের নামের সাথে মিল করে ছেলের নাম রাখলো রবিউল। বড় চাচা হিসেবে ধুমধাম করে আকিকা দিয়ে পাড়া প্রতিবেশীর বাহবা কুড়ালো।

দিনে দিনে রবিউল যত বড় হতে থাকলো, বিড়ম্বনা ততই বাড়তে লাগলো।

রবিউল এর চেহারা আর গড়ন নিয়ে মহা ফ্যাসাদ বেঁধেই চললো।

রবিউল এর চেহারা তার বাবা সুমনের মতো নয় মোটেই। হুবহু তার বড় চাচার মতো!চাচার আসল কুকীর্তির কথা জানতো এলাকার অনেকেই।

রবিউলকে সবাই বলতো মাঝে মাঝেই ۔۔۔۔"রবি, তোর বাপ ছিল একজন মহান বীর শহিদ মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের গর্ব । জাতির গর্ব!তোর চেহারা এমুন হইছে  কেনরে।

একদম তোর চাচা রাজাকার রাব্বির ল্যাহান!বুঝলামনা!তোর মায়েরে জিগাইসতো"!

রবি মাঝে মাঝেই এসে কাঁদো কাঁদো হয়ে নিতুকে বিরক্ত করতো ۔۔۔۔۔মা, বাবার চেহারা কি বড় চাচুর মতো ছিল ?

নিতুর বুকটা ধড়ফড় করতো। রবিকে বুকে জড়িয়ে রাখতো। বলতে পারতোনা কিছুই। এভাবে বড় হতে হতে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করে একই প্রশ্নের বানে তিক্ততায় একদিন নিতুকে না জানিয়ে রবি নিরুদ্দেশ হয়!জয়িতা প্রেম করে বিয়ে করে সংসার পাতে!নিতুর আর ঠাঁই থাকেনা শশুর বাড়ির ভিটেয়। অত্যাচার জুলুম দিনে দিনে বাড়তেই থাকে।

একদিন নিতুও অজানা ঠিকানায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালিয়ে আসে!কোন একজন শুভাকাংখীর সহযোগিতায় শপিং মল এ চাকরিটা পায়।

এরপরের ইতিহাস এভাবেই চলতে থাকে!তা চলছিলতো একরকম। কিন্তু আজ এমন করে হঠাৎ ভূমিকম্পনের মতই সব ওলোট পালট হয়ে যাচ্ছে যেন আচমকা।

- নিতু, তুইতো বাসায় আছিস। আজ নাকি ছুটি তোর বলছিলি।
- হ্যারে নীলু।
- ভালোই হলো। দুজনে মিলে ভালো মন্দ রান্না করবো আজ প্রান ভরে, কেমন!
- নিতু, তোর ছেলেটাকেও বলনা আসতে। দুভাইয়ের পরিচয় হবে। ওরা তো ভাই ই হয় সম্পর্কে। তোর ছেলেতোআমার ও ছেলে! আর আমার ছেলে তোর! ঠিক না ?
- হুঁ ۔۔তা ঠিক নীলু! কিন্তু তোর ছেলে ফিরে এলেও আমার ছেলে ফিরবেনা কোনদিন ও!আর আমিও ওর সামনে দাঁড়াতে পারবোনা কোনদিন নীলু।
- নিতু ۔۔۔۔

নীলুর শরীরে ঝাকুনি লাগে!

তবে কি নিতু ও আমার মতো ۔۔۔۔۔۔

নিতু নীলুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে অসহায় এর মত।

দুজন দুজনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে বিষ নীল একই প্রশ্ন নিয়ে।

তবে কি নিলু ও আমারই মতো ۔۔۔۔۔۔

গাড়ির হর্ন শুনে দুজন দুদিকে ছিটকে যায়।

এতো তাড়াতাড়ি এয়ারপোর্ট থেকে আনন্দ চলে এসেছে।

কিছুইতো গোছাতে পারে নাই দু বান্ধবী চোরা জালে আটকে গিয়ে।

- আপু মনিরা দেখেন কেডা আইছে!

করিমের পিছু পিছু আনন্দ ছুটে আসে।

- মা ۔۔মা ۔۔۔মাগো ۔۔۔আমার গর্বিত মা, আমার সোনা মা! আমার জীবন সার্থক মাগো!

নীলুকে কদমবুসি করে নিতুর দিকে উৎসুকভাবে তাকাতেই নীলু বলে।

আনন্দ ۔۔ইনি তোর আর একটা মা! আমার ছোটবেলার বান্ধবী নিতু!

তোকে অনেকবার বলেছি ওর কথা!কোনদিন দেখা হবে ভাবিনি।

- আমি আন্টিকেও চিনি মা!

নিতুকে কদমবুসি করে আনন্দ।

নিতু জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দেয় আনন্দকে।

আনন্দ মাকে জড়িয়ে আবেগে ভেঙ্গে পড়ে।

- মা কেন তুমি এতো বড় সত্যটাকে যুগের পর যুগ লুকিয়ে রেখেছিলে?কেন বলোনি আমায় মাগো ?
- আয় ---সোনা আমার---- কি বলছিস তুই!
- হ্যা মা, বাবার বন্ধু কায়সার কাকুর সাথে কানাডায় একটা সেমিনার এ দেখা হয়েছিল! সে আমাকে সবকিছু খোলাখুলি জানিয়েছে! যা তোমরা কোনদিন বলতে পারোনি আমায়! লুকিয়ে রেখেছো নিজেকে। আর আগুনে পুড়িয়েছো নিজেকে!আমাকেও পুড়িয়েছো। কেন মা ? কেন ? এই দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য তুমি তোমার সর্বস্ব বিকিয়েছো দুশমনদের কাছে!সেই দুশমনের ঔরসজাত হলেও তোমার গর্ভে ধারণ করে আমি তোমার হীরের টুকরো ছেলে হয়ে জন্ম নিয়েছি মাগো!

কায়সার কাকু আমাকে সব বলেছেন! সব বলেছেন মা! সব বলেছেন! বলেছেন বাবার উদার মনের কথা! যিনি একজন বীরাঙ্গনাকে বিয়ে করে দেশান্তর হয়েছিলেন!আমি ধন্য মাগো! আমার লক্ষী মা!

আমার চিরকালের গর্ব! আমি তোমাদের সন্তান!

দূরে দাঁড়িয়ে করিম ও নিতু খুশিতে চোখ মোছে নিরবে।

- চল ঘরে চল বাবা!

আনন্দকে নিয়ে ঘরে যায় নীলু।

বেশ কিছুক্ষন পর নীলুকে ডাকে ۔۔۔

- নীলু এদিকে আয়!
- তুই ছেলের সাথে গল্প কর নীলু! আমি আর করিম রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করি!
- করতে হবেনা নিতু! এদিকে আগে আয়তো!প্রেসার কুকার আর রাইস কুকারে রাঁধবো গল্প করতে করতে!আয় জলদি নিতু!

নিতু অগত্যা আর কি করে।

রবির কথা আজ এতো বেশি মনে পড়ছে কেন ? ছেলের কথা মনে করে দুচোখ গড়িয়ে পানি পড়ে নিতুর!

ঘরের ভেতর পা রেখে চক্ষুস্থির হয়ে যায় নিতুর!

- মা ۔۔۔মাগো!
- কোথা থেকে এলি বাবা!কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলি বাবা!পথে ঘাটে আনাচে কানাচে এতো বছর ধরে কোথায় না খুঁজে বেড়াচ্ছি তোকে!

রবিকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে নিতু।

- মা ۔আমার লক্ষী মা!

তুমিও আমার গর্বিত মা, মাগো!

তোমরা দু বান্ধবী ই যে আমাদের জাতির গর্ব মা!

আনন্দ ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় ছিল আগে থেকেই। আমি আনন্দ ভাইয়ার সাথেই এক জায়গাতেই ছিলাম মা।

কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমরা দুজনই আমাদের নিজেদের জন্ম ইতিহাস ঘেঁটে ঘেঁটে সব উদ্ঘাটন করেছি। আমরা দুই ভাই ই গর্বিত আমাদের দুই বীরাঙ্গনা মা'কে নিয়ে!আর আমাদের কোন আক্ষেপ নেই মা।

- আমার সোনারা ۔۔আয় আয় আমাদের দুজনের বুকে আয় তোরা!

নীলু আর নিতুর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে রবি আর আনন্দ।

নীল পাহাড় এর চূড়া থেকে ঘন নীল মেঘ এসে ঝির ঝির বৃষ্টিতে প্রকৃতিকে রাঙিয়ে দেয় অপরূপা করে। সে রূপে মুগ্ধ হয় ধরিত্রী।

সমাপ্ত

 

শাহান আরা জাকির পারুল 
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top