সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

স্বাদ : কাজী জাকির হাসান


প্রকাশিত:
১৬ ডিসেম্বর ২০২১ ০৬:৫৭

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ০২:৩৬

ছবিঃ কাজী জাকির হাসান

 

অন্ধকারের বুক চিরে সামরিক কনভয়গুলো ছুটে চলেছে বিভিন্ন স্থানে।
সর্বত্রই একটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
সন্ধ্যা নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে গোটা শহরটাই যেন একটা ভূতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়ে যায়। নেমে আসে কবরের স্তব্ধতা।
কাফনের কাপড়ে মুখ ঢেকে নেয় ব্যস্ততা আর মানুষের কোলাহল মুখরিত শহরটি।
প্রতিটি মানুষের মধ্যেই একটা আতঙ্ক কি হবে শেষ পর্যন্ত।
কবে শেষ হবে এই অবরুদ্ধ অবস্থা।
প্রতি মুহূর্তে ছলাৎ করে ওঠা রক্তে কিসের যেন একটা শিহরণ খেলে যায়।
যুদ্ধটা এতদিন সম্পূর্ণ গেরিলা পদ্ধতিতে চলে আসলেও ইদানীং রণকৌশল পরিবর্তিত হওয়ার কারণে এর তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রচণ্ডভাবে।
সুযোগ বুঝে মুক্তিবাহিনী এখন আঘাত হানছে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে।
দখলদার বাহিনীর মুখোমুখি হচ্ছে তারা কখনো কখনো। বিকেল চারটে থেকে পরদিন সকাল সাতটা পর্যন্ত চলে কার্ফ্যু।
গোটা দেশটাই একটা বন্দী শিবির।
সারা শহর ঘিরে সামরিক চৌকিগুলোতে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে দখলদার বাহিনী।
এর মধ্যেও দিনে দিনে চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে মুক্তিবাহিনীর । চূড়ান্ত আঘাত হানার লক্ষ্যে মরণপণ লড়াইয়ের সংকল্প নিয়ে তারা ঢুকে পড়ছে শহরের আনাচে-কানাচে, অলিতে-গলিতে।
আচমকা ঝটিকা আক্রমণে দিশেহারা দখলদার বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ছে যত দ্রুত, নিরীহ জনসাধারণের উপর তাদের অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে ততই।
তাদের বর্বরতার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না কেউ। রাত বাড়ছে।
থিতিয়ে আসছে গোলাগুলির প্রচন্ডতা।
বারুদের ধোঁয়ায় ঢেকে আছে আকাশ।
সার্চ লাইটের আলোতে সাপের মতো পাকানো ধোয়ার কুগুলীগুলো ক্রমশ ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। বাতাসে ভূর ভুর করছে বারুদের গন্ধ।
দশ-বারো জনের একটি করে গ্রুপ বুটের একটানা মচমচ শব্দ করে টহল দিচ্ছে সমস্ত শহর।
বিক্ষিপ্তভাবে গুলির দু-একটা শব্দ মাঝে মধ্যে দূর থেকে ভেসে আসছে কানে।
একটি ছোট্ট শাখানদী।
শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়ে মিশে গেছে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে। সেই নদীর পাড় ঘেঁষে খুঁজে কাটা আর গাছগাছালির ছায়ায় আড়াল করে অত্যন্ত সন্তর্পণে ডান পা টেনে টেনে একজন তরুণ ক্রলিং-এর ভঙ্গিতে দুহাতে মাটি কামড়ে এগিয়ে চলেছে নদীর তীরে দাড়িয়ে থাকা টিনের দোতলা একটি বাড়ীর দিকে।
বাংলো প্যাটার্নের লাল রংয়ের বাড়িটাকে এক সময় শহরের কেন্দ্রস্থল হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। এর বাসিন্দা একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন সে সময়ের। কিন্ত কালের গর্ভে, নদীর ভাঙনে শহর সরে যাওয়ার কারণে এখন এ বাড়িটাকে শহরের উত্তর দিকের শেষ সীমানা হিসেবে ধরা হয়ে থাকে।
শেষ সীমানা রেললাইনেরও।
দিন রাত মিলে দুটি করে ট্রেন আসা যাওয়া করলেও কোন যাত্রী নামে না এখানে।
নামার প্রয়োজনও হয় না কোন।
বাড়ির পাঁচশ গজ দুরে দক্ষিণ-পূর্ব কোণ দিয়ে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের একটি আধা পাকা রাস্তা সোজা ডাক বাংলোর পাকা রাস্তার সঙ্গে গিয়ে মিশেছে। লোকজন চলাফেরা এখন সেই রাস্তা দিয়েই করে।
সিঁড়ির কাছে এসে থেমে যায় তরুণ।
হাঁটু মুড়িয়ে পা’টা টেনে আনে পেছনে
সামান্য কিছু দূরে মচমচ শব্দ হয় বুটের।
ঘাড়ে ঝুলে থাকা এস. এম. জি-র নলটা তড়িৎ গতিতে ঘুরিয়ে তাক করে সেদিকে।
অপেক্ষা করতে থাকে।
না, শব্দটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় দূরে।
একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে তরুণ শরীরটাকে টেনে টেনে উঠতে থাকে সিঁড়ি ভেঙে।
ঘুটঘুটে অন্ধকার।
নিজের শরীরটাকেও চেনা যায় না ভাল করে।
অশরীরী বলে ভ্রম হয় বার বার।
রেলিং দিয়ে ঘেরা বারান্দায় উঠে আসে তরুণ।
পাগলের মতো চারদিক হাতড়িয়ে দরোজা খুঁজে পায় না কোথাও। সমস্ত শরীর ভিজে যায় ঘামে। নিঃশ্বাস পড়তে থাকে দ্রুত। হাপর পেটানোর শব্দ হয় বুকের ভেতর। তীব্র যন্ত্রণায় অস্ফুট আর্তনাদ করে ওঠে, 'দরোজাটা খুলুন।’ গভীর অন্ধকারের বুকে প্রতিধ্বনিত হয়ে শব্দটা বার বার ফিরে অসে কানে।
আর টানতে পারে না তরুণ অসাড় দেহটাকে। পাথরের মতো নির্জীব হয়ে আসা শরীরটাকে শুইয়ে দেয় সেখানেই।
- কে?
অন্ধকারের মধ্য থেকে নারী কণ্ঠের চাপা আওয়াজ ভেসে আসে। দরদ মেশানো সেই কণ্ঠের ডাকে সংবিৎ ফিরে পায় তরুণ। সমস্ত শক্তি একত্রিত করে ক্ষীণ কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে, ‘মাগো আমি।’
কপাট খুলে যায়।
কোন রকমে শরীরটাকে টেনে নিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে তরুণ।
কপাট বন্ধ হয়ে যায় আগের মতো কোন শব্দ না করে। ঘরের এক কোণে দুটো কাঠের আলমারী। তার মাঝখানে হার্ডবোর্ড দিয়ে আড়াল করে রাখা হয়েছে একটি হারিকেন বাতি।
বাতির ফিতেটা একটু উস্কে দিতেই আবছা আলোর ছায়া পড়ে ঘরের চারদিকে। ওই আলোতে অন্ধকারের ঘোর কেটে যেতেই চমকে ওঠে বৃদ্ধা সামনে মেঝোতে শুয়ে থাকা মৃতপ্রায় তরুণের দিকে তাকিয়ে।
গুলির আঘাতে ডান পায়ের হাড় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে চামড়ার সঙ্গে ঝুলে রয়েছে বিকৃতভাবে। আর ওই ঝুলন্ত ক্ষতস্থান দিয়ে রক্ত ঝরে পড়ছে অঝোর ধারায়।
লন্ঠন হাতে বৃদ্ধা ঝুঁকে পড়ে আহত তরুণের মুখের দিকে। ফ্যাকাশে মুখটা নারীর মতোই কোমল অথচ চোখ দু'টোতে ফুটে রয়েছে এক দৃঢ় প্রত্যয়।
বেদনায় টনটন করে ওঠে বৃদ্ধার হৃদয় মন। চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসে। স্থির থাকতে পারে না আর। উবু হয়ে দুহাতের তালুতে মুখটা চেপে ধরে চুম্বনে চুম্বনে সমস্ত রক্ত মুছে নেয় তরুণের ঠোট থেকে।
স্বাধীনতার নোনা স্বাদ অনুভব করে সে শিরায় শিরায়।
দ্রুত ঘটতে থাকে এর পরের ঘটনাগুলো।
বৃদ্ধা টেনে হিঁচড়ে কাঠের সিড়ি বেয়ে তরুণকে তুলে লুকিয়ে রাখে দোতলার ছাতে।
তারপর সিড়িতে লেগে থাকা রক্তের দাগ মুছতে থাকে কাপড় দিয়ে।
বাইরে মচমচ শব্দে অনেকগুলো বুটের আওয়াজ শোনা যায়। কান খাড়া করে বৃদ্ধা।
আওয়াজটা এক সময় নিকটে দরোজার সামনে এসে থেমে যায়।
খটখট শব্দে কড়া নড়ে ওঠে।
মরা মানুষের মতো ফ্যাকাশে হয়ে যায় বৃদ্ধার মুখ চোখ। সর্বঙ্গ কেপে ওঠে এক অজানা আতঙ্কে। মেঝেতে লেগে থাকা রক্তের দাগগুলো মোছা শেষ হয় নি তখনও।
মুহূর্ত কয়েক কি যেন ভাবে বৃদ্ধা।
তারপর ছুটে যায় রান্না ঘরের দিকে।
ফিরে আসে রক্তের জায়গায়
বাঁ হাতের তালুতে ধারালো ছুরি দিয়ে হ্যাচকা টান মারে কব্জি পর্যন্ত।
রক্ত পড়তে থাকে টপটপ করে।
কাপড় দিয়ে তাড়াতাড়ি জড়িয়ে ফেলে হাতটা।
পুনরায় কড়া নড়ে ওঠে।
আগের চেয়ে কিছুটা জোরে।
দরোজা খুলে দিয়ে বৃদ্ধা সরে দাঁড়ায় কপাটের আড়ালে। ভাবখানা দেখায় ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে সে।
সাত আটজন সৈন্যসহ ঘরে ঢোকে মেজর। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে দেখে ঘরের চারদিক। তারপর বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনার বাড়িটা আমরা সার্চ করবো।’
- এত রাতে?
দৃঢ়তার সঙ্গে বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করে মেজরকে।
- আমাদের সন্দেহ একজন দেশদ্রোহী ঢুকে পড়েছে এ বাড়িতে। মেজরের কথায় বাঁকানো তলোয়ারের মত রহস্যময় একটি হাসির রেখা খেলে যায় বৃদ্ধার চোখে মুখে। দৃঢ়তার সঙ্গে কেঁপে ওঠে তার ঠোট দুটো।
- দেশের সকল মানুষই তো আজ দেশদ্রোহী। তুমি কাকে খুঁজছো?
বৃদ্ধার ধৃষ্টতাপূর্ণ কথা শুনে ক্রুরহাসি ফুটে ওঠে মেজরের ঠোঁটের কোণে।
দরোজার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে বৃদ্ধা। মুখোমুখি হয় মেজরের।
মেজর টর্চ লাইট হাতে এগিয়ে যায় সামনে।
- এ বাড়ি সার্চ করতে হলে আমার রক্তের উপর দিয়েই তা করতে হবে।
বুক চেতিয়ে পথ রোধ করে দাঁড়ায় বৃদ্ধা।
কি ভেবে থেমে যায় মেজর।
টর্চের আলো ফেলতে থাকে এদিকে সেদিকে। হঠাৎ আলোটা মেঝেতে পড়তেই দৃষ্টি পড়ে মেজরের রক্তের দিকে।
- আনাজ কাটতে গিয়ে বটিতে হাতটা কেটে গেছে আজ। কাপড় দিয়ে জড়ানো বাঁ হাতের তালু বৃদ্ধা মেলে ধরে মেজরের দিকে।
টর্চের আলোতে কাটা-হাতের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মেজর মেঝেতে ঝুঁকে খানিকটা রক্ত আঙ্গুলে তুলে নিয়ে জিহ্বায় স্পর্শ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে মারবেলের মতো গোল চোখ দুটো ঘুরাতে থাকে যত্রতত্র ।
পেছনে সৈন্যরাও সতর্ক অবস্থান নেয়।
- দোতলার ছাতটা দেখবো একটু। সরে দাঁড়ান।
কাঠের সিড়ির দিকে পা বাড়ায় মেজর।
- বেশ তো দেখবে। তবে বাড়িটা প্রায় দু'শ বছরের পুরনো। ছাতে উঠিনা প্রায় পঁচিশ বছর। খোদা না করুন কোন দুর্ঘটনা ঘটলে তার জন্য তোমরা আমাকে দায়ী করতে পারবে না।
কণ্ঠটা সামান্য কেঁপে উঠলেও সহজভাবে কথাগুলো বলে যায় বৃদ্ধা।
থমকে দাঁড়ায় মেজর।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় বৃদ্ধার মুখের দিকে।
ঝুলেপড়া চামড়ার ভেতর থেকে চোখ দুটো বৃদ্ধার জ্বলজ্বল করে জ্বলে ওঠে। টানটান হয়ে ওঠে কুঁচকে আসা মুখের চামড়াগুলো। একটা তীব্র ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে থাকে সে মেজরের দিকে।
কর্তব্যে অটল মেজর মুখ ফিরিয়ে নিয়ে প্রথম পা’টা সিঁড়িতে রাখে। দ্বিতীয় পা তুলতে গিয়ে আরেকবার থামতে হয় তাকে। পেছনে দাঁড়ানো বৃদ্ধা তখন কঠোর অথ্চ নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘কি জানো মেজর, একটা কথা এখনো বলা হয় নি তোমাকে। আজ এ বাড়িতে একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আমাদের সন্তানদের আর কামানের খোরাক হতে দেবো না। আজ থেকে আমরাই লড়বো তোমাদের বিরুদ্ধে।’
বাইরের দমকা বাতাসে হঠাৎ কেপে ওঠে হারিকেনের আলোটা। সেই আলোতে বৃদ্ধার দিকে তাকাতে গিয়ে আর্তনাদ করে ওঠে মেজর!
এক সময় গভীর রাতের মতই স্তব্ধতা নেমে আসে বাড়িটাতে।

 

কাজী জাকির হাসান
কথা সাহিত্যিকনাট্য ব্যক্তিত্বমুক্তিযোদ্ধাজাতীয়  স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top