সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১

'একুশে ফেব্রুয়ারি ' ও 'আরেক ফাল্গুন ': দায়বদ্ধতার আলোকিত কথামালা : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২১:৩৬

আপডেট:
১৮ এপ্রিল ২০২৪ ২৩:২১

 

জহির রায়হান বর্ণময় বাংলাদেশি চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক এবং গল্পকার। বহু মুখী প্রতিভার বর্ণিল ব্যক্তিত্ব। একটা যুগের স্তম্ভ। সমকাল দ্বারা বন্দিত,ভাবীকাল দ্বারা প্রশংসিত কথাশিল্পী। সৃষ্টিশীল মানুষ। তাঁর সৃষ্টিসম্ভার অতুলনীয়।সময়ের হাত ধরে তিনি আজও দুই বাংলার মানুষের হৃদয়ের মানচিত্রে চিরজীবী হয়ে আছেন।তাঁর ক্ষুরধার লেখনী মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যে নতুন জোয়ার এনেছিল।সামাজিক দায়বদ্ধতাই ছিল মূলমন্ত্র। সমাজের প্রতি অপরিসীম দায়বদ্ধতা ছিল। ব্যক্তিস্বার্থকে কখনো গুরুত্ব দেননি। বাংলাদেশের সোনার মাটি আর মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। আগামী প্রজন্মের কাছে এক ঐতিহাসিক মানবিক দলিল হয়ে থাকবে তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকর্ম।

জহির রায়হান (১৯ আগস্ট ১৯৩৫----৩০ জানুয়ারি ১৯৭২) একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশি চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক এবং গল্পকার। বাংলা সাহিত্যের গল্প শাখায় অবদানের জন্য তিনি ১৯৭২ সালে 'বাংলা একাডেমি' সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ১৯৭৭ সালে মরণোত্তর বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক এবং সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৯২ সালে মরণোত্তর বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে। চলচ্চিত্রে তাঁর সামগ্রিক অবদানের জন্য ১৯৭৫ সালে ১ম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তাঁকে মরণোত্তর বিশেষ পুরস্কার প্রদান করা হয়।

তাঁর রচিত প্রথম উপন্যাস 'শেষ বিকেলের মেয়ে' ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর রচিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো 'একুুশে ফেব্রুয়ারি ' 'হাজার বছর ধরে' ও 'আরেক ফাল্গুন'। 'হাজার বছর ধরে' উপন্যাসের জন্য ১৯৬৪ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র 'কখনো আসেনি' (১৯৬১)। ১৯৬৪ সালে 'কাঁচের দেয়াল' চলচ্চিত্রের জন্য তিনি নিগার পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর নির্মিত অন্যান্য চলচ্চিত্র গুলো হলো 'বেহুলা', 'সঙ্গম', 'আনোয়ারা' এবং 'জীবন থেকে নেয়া'। স্টপ জেনোসাইড প্রামাণ্যচিত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছিলেন। যারা ১৯৫২-এর রক্তক্ষয়ী ভাষা আন্দোলন দেখেননি ,মুুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা উপলব্ধি করেননি,সবেমাত্র সেই সময় যারা জন্মেছেন, দেশের স্বাধীনতার অমৃতস্বাদ উপভোগ করার সুযোগ হয়নি সেই নতুন প্রজন্মের কাছে ঐতিহাসিক দলিল হয়ে উঠবে জহির রায়হানের অনবদ্য সৃৃৃষ্টি সম্ভার।এটি আমার নিজস্ব বিশ্বাস ও ভাবনা ।সমকাল দ্বারা বন্দিত এবং ভাবীকাল দ্বারা বিশেষ ভাবে প্রসংশিত এক সৃষ্টিশীল বহুুকোণিক বিরল ব্যক্তিত্ব। আগামী প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত হোক তাঁর মহান ভাবাদর্শ।


জহির রায়হানের'একুশে ফেব্রুয়ারি ' উপন্যাসটি ১৯৯২ সালের ঢাকার পল্লব পাবলিশার্স প্রকাশ করে। লেখক একজন বরেণ্য চিত্রপরিচালক।বিভিন্ন ধরণের তথ্য থেকে জানা যায় তিনি ১৯৬৬ সালেই ঠিক করে ফেলেছিলেন যে,'একুশে ফেব্রুয়ারি 'নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি ফিচার ফিল্ম বানাবেন। পরম পরিতাপের ও অত্যন্ত দুঃখের বিষয় তৎকালীন সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন মেলেনি বলেই বিষয়টি আর এগোয়নি। ১৯৭১ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি জহির রায়হান-এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন-
'আগামী গণতান্ত্রিক সরকারের উচিৎ হবে একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে একটি ছবি করা।বাংলার জন্যে যাঁদের প্রাণ এত কাঁদে ,তাঁরা একুশে ফেব্রুয়ারির উপর একটা ছবি করবে না ,যে একুশেতে বাংলা পুনর্জন্ম লাভ করেছে। তাদের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব তো হবে এটা।'
সেই দিনের সাক্ষাৎকারে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন, আজকের সময়ে যা অত্যন্ত তাৎপর্যময় ও প্রাসঙ্গিক:
'

'একুশের ওপর ছবি করা আমার জীবনের প্রধান বাসনা। ' চরম দুর্ভাগ্যের বিষয় মুক্তিযুদ্ধের শেষে তিনি খুন হয়ে যান । কিন্তু বেঁচে আছে, তাঁর অমলিন সৃষ্টিকর্ম কোটি কোটি বাঙালির হৃদয়ের মানচিত্রে। ফলে এক ভাষাসৈনিকের শেষ স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেছে।ফলে তাঁর রচিত কাহিনীটি পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে থাকে। এটা বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের এক চরম দুর্ভাগ্যের , সেই সঙ্গে চরম লজ্জার বিষয়। তাঁর প্রতীকী চলচ্চিত্র 'জীবন থেকে নেয়া' মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময়ে প্রদর্শিত হলে বাঙালি জনমানসে গভীর উত্তেজনার ঢেউ সঞ্চারিত হয়েছিল। সেই সঙ্গে ডকুমেন্টারি-ফিল্ম ' লেট দেয়ার বি লাইট' ভাষা-আন্দোলনকে পরিস্ফুট করে। কিন্তু সিনেমাটি নির্মিত হলে একটি ঐতিহাসিক দায় পালিত হতো বলে, আধুনিক গবেষকদের অভিমত। বেশ কিছুদিন পরে উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিটি লেখক-সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মাসিক 'সমীপেষু '-তে 'একুশে ফেব্রুয়ারি 'প্রকাশিত হয়। পরে এটি পল্লব পাবলিশার্স প্রকাশ করলে বাংলা একাডেমী 'একুশের উপন্যাস' সংকলনে সংকলিত করে এক সামাজিক ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে।বাংলা ভাষা প্রেমিক মানুষের কাছে এক আকাশ অহংকার হয়ে থাকবে বলে আমার নিজস্ব বিশ্বাস।

'একুশে ফেব্রুয়ারি' মাত্র চল্লিশ পৃষ্ঠার বই। অথচ বিষয় ভাবনায় অনন্য ।এটি সর্বকালের রাজনৈতিক ও মানবিক দায়বদ্ধতার আলোকিত এক কথামালা। সেই সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের এক ঐতিহাসিক দলিল, যে কোন দেশের কাছে অমূল্য সম্পদ। আয়তনের দিক থেকে অনেক গবেষকদের মতে একে বড় গল্প বা নভেলেট বলা যেতে পারে। তবে সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন, বাংলা সাহিত্যে ভাষা- আন্দোলন সংক্রান্ত সেরা রচনা বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। ভাষা- আন্দোলন নিয়ে এটি প্রথম দিকের একটি অসাধারণ সৃজনকর্ম।সমকালের ও পরবর্তীকালে বহু ঘটনার উপস্থাপন ঘটেছে। কিন্তু জহির রায়হানের'একুশে ফেব্রুয়ারি'তে ঐতিহাসিক তথ্যের ঘনঘটা নেই। তিনি এই কাহিনীকে অবলম্বন করে চলচ্চিত্র করার তীব্র বাসনায় ছিলেন আমৃত্যু। এটাই ইতিহাস। ফলত,চিত্রার্পিত ছবির মতো এর ভাষাভঙ্গি।নিজস্ব মেধাবী শৈলীতে সহজ-সরল ভাষায় তিনি এই উপন্যাসে কয়েকজন মানুষের সংলাপ বর্ণনা করেছেন। সেখানে চরিত্রের কোন মোচর নেই। নিছকই 'একুশে ফেব্রুয়ারির' ঠিক প্রাক-মুহূর্তে এবং ফেব্রুয়ারি দিনটিতে কয়েকজন মানুষ কি ভেবেছিলেন, দেশের সেই ক্রান্তিলগ্নে ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে কি ধরনের মানসিক ও বোদ্ধিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছিল, এই গ্রন্থে অলংকারহীন ব্যঞ্জনায় তা বর্ণিত হয়েছে। ঐ সব মানুষের মানসিক প্রতিক্রিয়া ও মনোভাব একটু স্পর্শ করেছেন।মনে হয় এটা তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতা ও মানবিক ভাবনা প্রসূত। বইটির ভুমিকা ছিল এই রকম--(ভূমিকা লিখেছিলেন লেখক--সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির)

" বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের সম্পর্কে সাধারণভাবে একটি ধারনা রয়েছে এটি বুঝি নিছক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আন্দোলন। বদরুদ্দীন উমর যদি তিনটি বিশাল খণ্ডে ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস না লিখতেন, আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব হতো না সেই সময়কার আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা বা ভাষা আন্দোলনে শ্রমিক--কৃষকসহ সাধারণ মানুষের সমর্থন ও অংশ গ্রহণের বিষয়টি--- বর্ণনায় বরং কাব্যিক ব্যাঞ্জনা রয়েছে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। "
এখানে তিনি রাজনৈতিক ও মানবিক। এখানেই তাঁর দায়বদ্ধতা। কাহিনিতে চরিত্র ছয়টি।তাঁরা সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষ । ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঐ দিনের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে এদের প্রতিক্রিয়া ও মানসিক দ্বন্দ্বে এই কাহিনীর বৃত্ত তৈরি হয়েছে।
'একুশে ফেব্রুয়ারির ' এর কাহিনীবিন্যাস দেখলে একে উপন্যাস হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার কোন দায় ছিল না বলে আধুনিক গবেষকদের অভিমত। আসলে চিত্রনাট্য তৈরির জন্য তিনি কাহিনী সাজিয়েছেন। তবুও এই লেখার তাৎপর্য ও গুরুত্ব খুব বেশি।

একটা ফ্রেমে তিনি উচ্চবিত্ত,মধ্যবিত্ত, শ্রমিক, কৃষকদের ধরতে চেয়েছেন। এর মধ্য দিয়েই জহির রায়হানের বাস্তবতার উপলব্ধি ও সময়, ঘটনা, মনুষ্যচরিত্র বিশ্লেষণের মুন্সিয়ানা প্রমাণিত হয়ে যায়। কথাসাহিত্যিক সত্যেন সেনের মতে জহির রায়হান ছিলেন --" নিপীড়িত ও সংগ্রামী মানুষের স্বপ্নপূরণের রূপকার"। তাঁর 'আরেক ফাল্গুন ' (১৯৬৯) উপন্যাসটি বিষয় -গৌরবে আজও অনন্য। এই উপন্যাস জুড়ে শুধুই একুশে ফেব্রুয়ারি নানান ঘটনা বারবার এসেছে। যদিও এই উপন্যাসে ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস মুখ্য ভূমিকা নিতে পারেনি, বলে মনে করেন বহু গবেষক। তবে এই উপন্যাসে বেশি বেশি করে গুরুত্ব পেয়েছে ছাত্র সমাজের গৌরবময় ভূমিকা।১৯৫২সালের ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র সমাজের ওপর নির্মম ভাবে গুলি চালিয়েছিল পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী। সেই রক্তাক্ত দিনের কথা বেশি গুরুত্ব পেয়েছে উপন্যাসে। ১৯৫২ সালের মতোই ১৯৫৫ সালের ছাত্ররাও একুশে ফেব্রুয়ারির কালো পতাকা শোকমিছিল বার করবেই। সেই কাহিনীই ' আরেক ফাল্গুন '--এর মূল বিষয়। এই উপন্যাসে সমস্ত তরুন-তরুণী মিলে একটি অখণ্ড চরিত্রের বলয় সৃষ্টি করেছে।আলাদাভাবে কাউকেই চেনা যায় না। উপন্যাসে জহির রায়হানের সমাজবাদী চেতনার সঙ্গে রোমান্টিক মানসপ্রবনতা একাকার হয়ে গেছে।তাঁর উপন্যাসে এসেছে অতি নাটকীয়তা।উপন্যাসের ভাষাচিত্র নাট্যধর্মী এবং কবিতাক্রান্ত। আধুনিক গবেষকদের মতে নানান ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও রাজনৈতিক ও মানবিক দায়বদ্ধতার আলোকিত কথামালা হিসাবে দুই উপন্যাসের গুরুত্ব আজও অসাধারণ।

শেষকথা--
একুশের' ভাবনার কিছু কথা:--- বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর অতিক্রান্ত হবে ২০২২শের-২১ শে ফেব্রুয়ারি ।১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে সম্মানিত করে'মাতৃভাষার অধিকারের' বিষয়ে আরো বহুমাত্রিক সচেতন ও অধিক দায়িত্বশীল হতে ইউনেস্কো এই দিনটিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস 'হিসেবে পালনের কথা ঘোষণা করেছে। ফলে এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের কাছে দিনটির মহিমা ও গুরুত্ব অনেক খানি তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির বা ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের স্বায়ত্তশাসন, সাংস্কৃতিক আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও আত্ম মর্যাদা এবং বাঙালি জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষার বহু রক্তাক্ত স্মৃতি জড়িত থাকলেও, একথা আজ সর্বজনবিদিত যে,এই নিরন্তর সংগ্রামের পরিণতিতেই " বাংলাদেশ "নামের ভাষাভিত্তিক একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম। ভাষিক বিচারে এই রাষ্ট্রের অধিবাসীদের একমাত্র পরিচয় 'বাঙালি 'আর রাষ্ট্রিক মর্যাদায় তাঁরা 'বাঙলাদেশী'। পৃথিবীর তাবৎ বাঙালির কাছেই ২১শে ফেব্রুয়ারি একটি অত্যন্ত পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ দিন। এইদিনকে নিয়ে অনেক দেশাত্মবোধক গান, কবিতা, নাটক, উপন্যাস লেখা হয়েছে এবং হচ্ছে অবিরত। বহু কালজয়ী উপন্যাস ও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। যে গুলো ঐতিহাসিক দলিল হয়ে উঠবে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। মুনীর চৌধুরির,'কবর', শামসুর রাহমানের ' বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা ' আল মাহমুদের'একুশেরকবিতা ' উপন্যাস,'একুশে ফেব্রুয়ারি ও 'আরেক ফাল্গুন ' ( জহির রায়হান), 'যাপিত জীবন' (সেলিনা হোসেন),পুলিশও শিমূলের গল্প' আবু রুশদের ' ডোবা হল দীঘি, শওকত ওসমান,' আর্তনাদ ' 'এই সময়ের বিশ্বস্ত দলিল হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয় এগুলি ভাষা আন্দোলনের চেতনা বীজ। এই ভাষা আন্দোলনই ১৯৭১সালের স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৯৯৯সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কো দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আসলে ফেব্রুয়ারি মাস বাংলাদেশের 'ভাষার মাস'হিসেবে পরিচিত। দুই বাংলার লক্ষ লক্ষ ছাত্র ছাত্রীরা বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাবে ভাষা-সৈনিকদের প্রতি। করোনার তৃতীয় ঢেউ-এর প্রতিকূলতা অতিক্রম করে এ বছরও কোলকাতা ও ঢাকা মহানগর জুড়ে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে। বাঙালি জাতি ভুলে যেতে পারে না 'একুশ'কে।একুশ কোন সংখ্যা নয়,একটা জাতীয় আবেগ। বাংলা ভাষার নিবিড় চর্চার মাধ্যমে অমর একুশে বেঁচে থাকবে দুই দেশের বাঙালির হৃদয়ে ও মননে। ভাষার মর্যাদা রক্ষায় লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মদানের কথা স্মরণ করার জন্য এই দিনটিকে বিশেষ ভাবে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। তবে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্নতর। মাতৃভাষাতেই শিশুর প্রথম বোল ফোটে কিন্তু আধুনিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত মানুষ সারা বছর যথাযথ ভাবে মাতৃভাষার চর্চা ও মর্যাদা রাখতে পারছে না অনেক খানি। এপার বাংলায় আছো বাংলাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয় নি। নিজভূমে বাংলা ভাষা উপেক্ষিতও ব্রাত্য। ই ঘটনা ভীষণ ভাবে পীড়া দেয় মনে। আনন্দের বিষয় বাংলাদেশের সবত্রই বাংলার গুরুত্ব বেড়েছে। । তাই এই বিশেষ দিনটি পালন করা হয় যাতে প্রতিটি বাঙালি ও বাংলা ভাষী মানুষ নিজ নিজ মাতৃভাষা ও সাহিত্যকে বিশেষ ভাবে স্মরণ করতে পারে। এই দিনটি যথাযথ ভাবে পালন করার মাধ্যমে প্রতিটি বাঙালি ও বাংলা ভাষী মানুষ নিজ নিজ মাতৃভাষার প্রতি দায়িত্বশীল করে তোলার একটি শুভ প্রচেষ্টা নিহিত আছে। শুধু একটি দিনই নয়, সারা বছরব্যাপী মাতৃভাষার চর্চা ও ব্যবহার এবং আন্তরিক অনুশীলন যথাযথভাবে করতে হবে। মাতৃভাষায় সাহিত্য, গান, কবিতা ও নাটক চর্চা এবং ছোট গল্পের নিরাবিচ্ছিন্ন নিবিড় মেধাবী পাঠ আরো বাড়ানো দরকার। নিজের মাতৃভাষা নয়,অন্যান্য ভাষার প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজন। তবেই এই দিনটির পালন যথার্থ হবে আমর নিজস্ব বিশ্বাস। আমাদের সকলের আগামী দিনের ভাবনা হোক

" ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অশ্রু অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?
বরকতের রক্ত।
হাজার যুগের সূর্যতাপে
জ্বলবে এমন লাল যে,
সেই লোহিতেই লাল হয়েছে
কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে !
প্রভাত ফেরী মিছিল যাবে
ছড়াও ফুলের বন্যা
বিষাদগীতি গাইছে পথে
তিতুমীরের কন্যা ।
প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী
আমায় নেবে সঙ্গে ,
বাংলা আমার বচন,
আমি জন্মেছি এই বঙ্গে ।" ( একুশের কবিতা, কবি আল মাহমুদ(তথ্যসূত্র, আনন্দবাজার পত্রিকারআর্কাইভ, বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনের গবেষণামূলক গ্রন্থ। বলাকা সাহিত্য বিষয়ক পত্রিকা,বিষয় বাংলাদেশ , সম্পাদক ধনঞ্জয় ঘোষাল )


ডঃ সুবীর মণ্ডল
বাঁকুড়া ,পশ্চিমবঙ্গ ,ভারত
লোকগবেষক,প্রাবন্ধিক, অণুগল্প ,রম্যরচনা ও ভ্রমণকাহিনীর লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top