সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

বৃদ্ধ বয়সে নিঃসঙ্গতা এক দুঃসহ যন্ত্রণা : হাসান আলী


প্রকাশিত:
৭ এপ্রিল ২০২২ ০০:০৯

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১২:২৬

 

নিঃসঙ্গতা সব সময়ই কষ্টের। কারণ মানুষ একা থাকতে পারে না। মানুষ প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করেছিল এক হয়ে। দল বেঁধে শিকার, পরে কৃষিনির্ভর জীবন মানুষকে দলবদ্ধ হতে বাধ্য করেছে। সমাজ পরিবর্তনের প্রতিটি ধাপেই মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে উন্নততর জীবনের প্রত্যাশায়। মানুষ নিজের প্রয়োজনে গড়ে তুলেছে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অর্জিত সম্পদ জমা হয়েছে ব্যক্তির হাতে। ব্যক্তি হয়ে উঠেছে প্রভু। অশুভ প্রতিযোগিতায় মেতেছে সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ নিতে। বিজ্ঞানের অভূতপূর্ণ সাফল্য, চিকিৎসায় প্রযুক্তির উন্নতিতে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে গেছে অনেক। মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সম্পদ অর্জনে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে, নিজের হাতে নিয়ন্ত্রণ নিতে। ফলে তৈরি হচ্ছে মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, যুদ্ধ-বিগ্রহ আর অশান্ত পরিবেশ। ফলে কষ্টে পড়ে শিশু, নারী, বৃদ্ধ। জীবিকার জন্য মানুষ সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিচ্ছে। কাঁটাতার, গুলি উপেক্ষা করে সীমান্ত অতিক্রম করছে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কাছে বলি হচ্ছে মানবতা। উপেক্ষা করছে আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ। ফলে হতাশা, নিঃসঙ্গতা, বিষণ্নতা, দুশ্চিন্তার হাতে মানুষ বন্দি।
ক্ষুদ্রতম সামাজিক সংগঠনের নাম পরিবার। পরিবারে আমরা জন্মলাভ করি। পরিবারে বড় হয়ে ওঠি। যৌবনে নিজেরা পরিবার গড়ি। বার্ধক্যে নির্ভরশীল হয়ে অন্য কোনো পরিবার নতুবা ‘শূন্য বাসায়’ বসবাস। প্রবীণ বয়সে নিঃসঙ্গতা দু’ধরনের। একটি হলো স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধনের অভাব। অপরটি হলো সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। সাধারণত পুরুষের তুলনায় মহিলাদেরই অধিক হারে বৈধব্যবরণ করতে হয়। কারণ বিয়ের ক্ষেত্রে নারীর চেয়ে পুরুষের বয়স বেশি থাকে। আবার নারীর গড় আয়ু বেশি অর্থাৎ নারী বেশিদিন বাঁচে। কে বেশি নিঃসঙ্গতায় ভোগে বিপত্নীক নাকি বিধবা? একদল সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন, বৈধব্যে একজন প্রবীণ নারী সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়ে। সমাজ প্রবীণ বিধবার পুনঃ বিবাহকে সমর্থন করে না। একজন বৃদ্ধা তার চেয়ে কমবয়সী কাউকে বিয়ে করার সুযোগ পায় না বললেই চলে। অন্যদিকে বিপত্নীক বৃদ্ধ সহজেই তার চেয়ে কমবয়সী কোনো বিধবাকে বিয়ে করার সুযোগ পান। কখনও আবার কমবয়সী অবিবাহিত নারীকে বিয়ে করেন। বিপত্নীক প্রবীণ পুনঃবিবাহের মাধ্যমে নিঃসঙ্গতাকে মোকাবিলার চেষ্টা করেন। নতুন স্ত্রীর সঙ্গে বেশিরভাগ সময় সখ্যতা, ঘনিষ্ঠতা, নির্ভরশীলতা, আন্তরিকতা গড়ে ওঠে। অনেক সময় সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়স্বজনের অসহযোগিতায় দাম্পত্য জীবন গভীর সংকটের মুখে পড়ে। ফলে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা দিন দিন বাড়তে থাকে। ছেলেমেয়েরা নিজেদের জীবন-সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে অথবা কর্মস্থলে দূরে থাকায় মা-বাবাকে তেমন একটা সময় দিতে পারে না। বৈধব্য বিপত্নীক বিধবা দুইজনের জন্য বিরাট একাকিত্ব বা নিঃসঙ্গতা। শূন্য বাসায় বন্দি জীবন কাটানো সত্যিই দুঃসহ যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। বিধবা প্রবীণ অন্য বিধবা প্রবীণকে সমব্যথী হিসেবে গ্রহণ করে কিছুটা স্বস্তি পায়। বিবাহ বিচ্ছেদ হলে নারী-পুরুষ উভয়ই ভয়ানক সংকটে পড়ে। সামাজিক-পারিবারিক সংকট প্রবীণদের নাজেহাল করে তোলে। বিবাহবিচ্ছেদের জন্য কে দায়ী এর চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু হয়। বিপর্যয় ঘটে বৈবাহিক সূত্রে প্রাপ্ত আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক। প্রবীণ বয়সে বৈবাহিক সূত্রে প্রাপ্ত আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতা সমর্থন পাওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে পড়ে।
বিবাহবিচ্ছেদ হওয়ার ফলে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায়। ছেলেমেয়ে না থাকলে প্রবীণদের সঙ্কট আরও বেশি। আর্থিক সহযোগিতা, ভরণপোষণ, চিকিৎসা, সেবা-যত্ন পাওয়া কঠিন ব্যাপার। তালাকপ্রাপ্ত প্রবীণরা জীবনের শেষ দিনগুলোতে চরম নিঃসঙ্গতায় ভোগেন। চিরকুমার-চিরকুমারী জীবনের ওপর গবেষণা হয়েছে, তারা বিবাহিত নারী-পুরুষের চেয়ে বেশি অসুখী হয়ে থাকেন। তারা চাকরি থেকে অবসর নিলে মনোবল হারিয়ে ফেলেন। কোথায় কার সঙ্গে থাকবেন এ হিসাব-নিকাশ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বৃদ্ধ বয়সে সঠিক পরিচর্যা, সেবাযত্নের অভাবে শরীর ভেঙে পড়ে। নিকটতমদের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ কমতে থাকে। ফলে নিষ্ঠুর একাকিত্ব তার জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ায় চিরকুমার বা চিরকুমারী অথবা বিবাহবিচ্ছেদপ্রাপ্তরা পরিবার-পরিজন আত্মীয়স্বজনের সাহায্য-সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হন। শারীরিক, মানসিক প্রতিবন্ধী প্রবীণদের জীবন ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা-একাকিত্ব গ্রাস করে রেখেছে। শারীরিক প্রতিবন্ধী প্রবীণ ঘর থেকে কারও সাহায্য ছাড়া বাইরে বেরুতে পারেন না। স্বাধীনভাবে ইচ্ছামতো কোথাও যাওয়া অসম্ভব বলে বাইরের জগৎ থেকে নিজেকে ক্রমেই সরিয়ে নিয়ে আসে। মনোবল আস্তে আস্তে কমে যায়। এক সময় নিজেকে গুটিয়ে নেয়। আর যেসব প্রবীণ বিছানায় পড়ে আছেন তাদের একাকিত্ব অকল্পনীয়। যেসব প্রবীণ চোখে দেখেন না, কানে শোনেন না তারা সামাজিক জীবন থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রায় নিঃসঙ্গ জীবন কাটান। শারীরিক প্রতিবন্ধী প্রবীণের সেবাযত্ন ব্যয়বহুল এবং কষ্টকর। আর্থিকভাবে অসচ্ছল প্রবীণ যথাযথ সেবাযতেœর অভাবে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হন। সামাজিক যোগাযোগ একেবারেই কমে যায়। আত্মীয়স্বজন তেমন একটা খোঁজখবর নেয় না।
সবচেয়ে বেশি নিঃসঙ্গ হলো মানসিক প্রতিবন্ধী প্রবীণ। শিশুকালে, যৌবনকালে মা-বাবা, ভাইবোনরা সেবাযত্ন, খাওয়া-দাওয়ার দায়িত্ব পালন করে। এক সময় মানসিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিটি প্রবীণ বয়সে উপনীত হন। তখন মা-বাবা জীবিত থাকেন না। ভাইবোন থাকলে তারাও প্রবীণ হন। আর্থিকভাবে সচ্ছল হলে আত্মীয়স্বজন সেবাদানকারী নিয়োগ দেন। আর্থিকভাবে অসচ্ছল মানসিক প্রতিবন্ধী প্রবীণ সীমাহীন দুর্ভোগ আর নিঃসঙ্গতায় ভোগেন। প্রবীণ জীবনের শেষের দিনগুলো অর্থাৎ ৭০ বছরের পর থেকেই অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ আসতে শুরু করে। প্রথম আসে আর্থিক চ্যালেঞ্জ, এরপরই আসে নিঃসঙ্গতা। নিঃসঙ্গতা থেকে প্রবীণ শারীরিক মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কারও সঙ্গে দুদ- কথা বলার সুযোগ নেই। সুখ-দুঃখের কথা শুনতে চায় না। নানা অজুহাতে প্রায় সবাই এড়িয়ে যান। বয়সের ও অভিজ্ঞতার কারণে প্রবীণ ব্যক্তিরা কিছুটা বেশি বলেন। এটাকে অনেকেই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেন না। তারা প্রবীণ প্যাঁচাল শুনতে বিরক্তবোধ করে এবং অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করে। প্রবীণ জীবনের শেষ দিনগুলোতে আর্থিক, সামাজিক, শারীরিক, মানসিক শক্তি অনেক বেশি দুর্বল থাকে। ফলে সংসারে-সমাজে প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। প্রবীণ বয়সে দুইটি বিষয়ে বেশি নিঃসঙ্গতা সৃষ্টি হয়। একটি হলো স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হওয়া, আরেকটি হলো ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হওয়া। ডিমেনশিয়া হলো স্মৃতি ক্ষয়জনিত রোগ অর্থাৎ নিকট অতীতের অনেক কিছু ভুলে যাওয়া, যেমন চেনা পথ হারিয়ে ফেলা, ছেলেমেয়েদের নাম ভুলে যাওয়া, উদ্যম হারিয়ে ফেলা ইত্যাদি। তাদের সঙ্গে সঙ্গ দিতে অনেকই আগ্রহবোধ করেন না।
তারা সামাজিক এবং পরিবারিকভাবে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকেন। ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। বৃদ্ধবয়সের নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য প্রবীণরা নাতি-নাতনিদের সঙ্গে খেলাধুলা, গল্প করা, সেবা যত্ন করা, অভিযোগ শোনা, দাবি-দাওয়া মেটানোর চেষ্টা করেন। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে থাকতে চেষ্টা করেন। যাদের এ সুযোগ থাকে না তারা ধর্মীয় কাজ, সামাজিক কাজ করে নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্ত থাকার চেষ্টা করেন। এখন সময় এসেছে প্রবীণ জীবনের নিঃসঙ্গতা কাটাতে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেয়া। প্রবীণদের নিঃসঙ্গতা কাটাতে ডে-কেয়ার সেন্টার, প্রবীণ ক্লাব, প্রবীণ হোটেল, বিনোদন ক্লাব তৈরি করতে হবে। প্রবীণের কর্মদক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা। সামাজিক অনাচার প্রতিরোধে প্রবীণদের সামনের কাতারে অংশ নেয়ার সুযোগ দান। ঝগড়া-বিবাদ, সম্পদের মালিকানা বণ্টন, বৈবাহিক সংকট নিরসনে প্রবীণদের দায়িত্ব প্রদান। প্রবীণ যত বেশি কাজেকর্মে থাকবে নিঃসঙ্গতা তত দূরে থাকবে। শারীরিক, মানসিক প্রতিবন্ধীদের উপযোগী বিনোদন অনুষ্ঠান, গান-বাজনা, ছায়াছবি তৈরি করতে হবে। এ বিশেষ প্রবীণদের সঙ্গদানে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

 

হাসান আলী
সভাপতি, এজিং সাপোর্ট ফোরাম
ট্রেজারার, বাংলাদেশ জেরাটলজিক্যাল (বিজিএ) অ্যাসোসিয়েশন

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top