সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

পহেলা বউ-শাক ট্রিট : সত্যজিৎ বিশ্বাস


প্রকাশিত:
১৪ এপ্রিল ২০২২ ০১:৪৪

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ১১:৪৭

 

‘ইংরেজি নতুন বছরের উৎযাপন, শুভেচ্ছা বিনিময় যদি আমরা রাত ১২টার পরপরই শুরু করি তবে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় কখন থেকে শুরু করা উচিত?’ এই নিয়ে পহেলা বৈশাখে মোড়ের টং দোকানে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। আলোচক আমরা আমরাই। মানে বন্ধুরাই। আলোচনার আলো উধাও হয়ে চোনা নিয়ে যখন তর্কাতর্কি চলছে, তখনই সভাস্থলে উপস্থিত হলেন চোপাবাজ কামাল ভাই।

কিছু মানুষ চাপাবাজ হয়।তাদের চাপায় চাপায় চন্দ্র, সূর্য সব চাপা পড়ে যায়। কিন্তু আমাদের কামাল ভাই পিস হিসেবে ওয়ান এন্ড ওনলি। ওনার চাপা এবং চোপার মিলিত কম্বিনেশন বিরল। স্টার্ট হলে ইঞ্জিনের নৌকাও এক সময় বন্ধ হয় কিন্তু ভাইয়ের চোপা একবার স্টার্ট দিলে আর বন্ধ হয় না। সে কারণে কামাল ভাইয়ের নাম চোপাবাজ কামাল ভাই।

কামাল ভাইকে সামনে পেয়ে পহেলা বৈশাখে ঈদের চাঁদ হাতে পেলাম আমরা। আলোচনার টপিকস সাথে সাথে বদলে গেল। হইহই করতে করতে ভাইকে ঘিরে ধরলাম। চাপার জোরে চোপা চালিয়ে বিয়েটা পর্যন্ত চুপিচুপি সেরেছেন, দাওয়াত দেননি। আজ ট্রিট দিতেই হবে। রোমেল সাথে সাথে শ্লোগান তুলল-
‘বিয়ের দাওয়াত পাই নাই;
পহেলা বৈশাখে ছাড় নাই...’

আমাদের অতর্কিত হামলায় চোপাবাজ কামাল ভাই একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নিমিষেই নিজেকে সামলে নিলেন। আরে তোরা খেতে চাস, সেটা বলবি তো। অবশ্যই খাওয়াব। একথা শুনে বিগলিত হয়ে মোটু রাকিব জিজ্ঞাসা করল, তা আমাদের ভাবি কেমন হয়েছে? কামাল ভাই গর্বের হাসি হেসে বললেন, এ ব্যাপারে আমার কপাল খুব ভালো রে। বউটা পেয়েছি বেশ। এমন বউ, এ যুগে মেলে না।
কেন ভাই, ভাবি কি আদিম যুগের? লিটন দুম করে প্রশ্ন করে বসে। আমরাও উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি কামালভাইয়ের দিকে।
কামাল ভাই ক্ষেপে গিয়ে বললেন, কীসের মধ্যে কী? তোদের ভাবির রান্না সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে কারো?

আমরা একে অপরের দিকে তাকালাম। না, কারোরই কোনো ধারণা নেই। অভিমানের সুরে তুহিন বলল, কি করে থাকবে শুনি? নিয়ে গেছেন কখনো বাসায়?

কামালভাই জিহ্বা প্রায় পুরোটাই বের করে কামড় দিয়ে বললেন, ‘চল, তোরা আজই চল। পহেলা বৈশাখের ট্রিটটা আজ বাসাতেই দেব। তোদের ভাবি তো কোনোদিন বিশ পদের নীচে রান্নাই করেনা। যদি কোনোদিন বিশ পদ রাঁধতে না পারে, কাঁদতে বসে যায়।

ভাবির রান্না কিংবা কান্না সম্পর্কে কোনও ধারণা না থাকায় বেকুবের মতো তাকিয়ে রইলাম কামাল ভাইয়ের দিকে। কামাল ভাই বলেই চলছেন।
‘আজ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে কয় পদ রান্না করছে জানিস?’
ঠোঁট উল্টিয়ে ডানে বামে মাথা নাড়ালাম। কামাল ভাই চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হিসাব করে বললেন, কম সে কম চল্লিশ পদ তো হবেই।

চ-ল্লি-শ পদ! শুনে আমাদের মাথা চল্লিশ চক্কর দেয়া শুরু হয়ে গেল। এত পদ খাওয়া তো দূরের কথা এক সঙ্গে চোখেও দেখিনি। মুন্না জিভে চলে আসা জল চাটান দিয়ে বলল, সত্যি কামালভাই? মুখ ভেংচি দিয়ে কামাল ভাইয়ের চোপা চলতে লাগল, শোন তবে আজ কি কি রান্না হচ্ছে বাসায়। শাকই তো রান্না হয়েছে চৌদ্দ পদের।

‘চৌদ্দ পদের শাক! কেন ভাই? আজ কী শাক দিবস?’ আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম।কামাল ভাই মুচকি হেসে বললেন, আজ তো শাক দিবসই। ‘পহেলা বৈশাখ’ শব্দ দুটো কোথা থেকে এসেছে, বলতে পারবি? আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে কোন ক্লু না পেয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালাম।

কামাল ভাই চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে আবার বলা শুরু করলেন। শোন রে বেকুবের দল, পহেলা বৈশাখ এসেছে পহেলা ‘বউ-শাক’ থেকে। আমাদের দাদার দাদার দাদার দাদার আমলের ‘বউ-শাক’ মানুষের মুখে মুখে বিকৃত হতে হতে আজ শর্টকাটে বৈশাখ হয়ে গেছে। আজ হলো বাংলা বছরের প্রথম দিন। এই দিনে বউয়ের হাতে রান্না করা শাক খেতে হয় বলেই তো আজ পহেলা বউ-শাক। যাকে তোরা পহেলা বৈশাখ বলে জানিস।

লিটন চোখ প্রায় কপালে তুলে বলল, আজ পহেলা বৈশাখ সরি পহেলা বউ-শাক বলে চৌদ্দ পদের শাক?
কামাল ভাই গর্বের হাসি হেসে বলল, তা না হলে কী আর বলি? এমন বউ আজকালকার দিনে দেখা যায়?বল, যায় দেখা? ভোর থেকেই ও শাক রান্না করতে বসেছে। লাল শাক, ডাঁটা শাক, কলমী শাক, গিমা শাক, কচু শাক, মুলা শাক, পাট শাক, পুঁই শাক, পালং শাক, সরিষা শাক, ঢেকি শাক, লাউ শাক, কুমড়া শাক, হেলেঞ্চা শাক।
এ তো গেল শুধু শাকের কথা। তারপর ভাজি ভর্তা।
বেগুন, পটল, কাকরুল, পেঁপে, আলু, কুমড়া, সীম, চিচিঙ্গা, ঢেঁড়স, বরবটি এগুলো আলাদা করে ভাজি, ভর্তা দুইই হচ্ছে।
এরপর মাছ। শুধু ইলিশ মাছই রান্না হয়েছে সাত ভাবে। শর্ষে ইলিশ, ইলিশ চর্চরি, ইলিশের কালিয়া, ইলিশ ভাজা, ইলিশ দোপেয়াজী, ভাপা ইলিশ, ইলিশের মালাইকারী। অন্য মাছের কথা কি বলব কী আর?রুই, চিতল, কই, বাটা, পাবদা, গলদা চিংড়ি এগুলোতো আছেই।
তারপর মাংস। শিক কাবাব, কারি, কোর্মা, মোরগ মোসাল্লাম, মাটন রোস্ট, চপ, ফ্রাই, কাটলেট...
একেবারে শেষে চাটনী, পায়েস, দই আর মিষ্টি।
একটু হাঁপ ছেড়ে কামাল ভাই আমাদের দিকে যখন তাকালো, তখন আমাদের মাথা বনবন করে ঘুরছে। কামাল ভাইয়ের তো দেখি, কামাল করা বউভাগ্য!

আমাদের সবাইকে রাতে তার বাড়িতে খেতে যাওয়ার দাওয়াত দিয়ে চলে যাবার অনেক পরে ঘোর কাটলো। আরে দাওয়াত খেতে যাবো-টা কই? কামাল ভাই বাসার ঠিকানাটা দিয়ে গেল না যে?
---

সত্যজিৎ বিশ্বাস
রম্য লেখক ও শিশু সাহিত্যিক
* রম্য বিভাগীয় সম্পাদক- কিশোর বাংলা
* নির্বাহী সম্পাদক- কিশোরকাল
* কন্ট্রিবিউটার – মাসিক স্যাটায়ার কার্টুন ম্যাগাজিন ‘উন্মাদ’, জাতীয় দৈনিক যুগান্তর ‘বিচ্ছু’, দৈনিক ইত্তেফাক ‘ঠাট্টা’।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top