সিডনী বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১

বাঙ্গালীর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি: বর্ষবরণ যুগে যুগে : শাহান আরা জাকির


প্রকাশিত:
১৫ এপ্রিল ২০২২ ০২:২৩

আপডেট:
২৪ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:১০

 

পহেলা বৈশাখ (বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ) বঙ্গাব্দের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি সকল বাঙালি জাতির ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের দিন। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নিয়ে থাকে। সেজন্য এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন লোকউৎসব হিসাবে বিবেচিত।
বাংলাদেশে ১৯৬৬ সালে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর নেতৃত্বে গঠিত হওয়া ১৯৬৬ সালের একটি কমিটিতে পুরনো বাংলা দিনপঞ্জিকে সংশোধিত করা হয়। এখানে প্রথম পাঁচ মাসকে ৩১ দিন, আর বাকি মাসগুলোকে ৩০ দিন বানানো হয়। প্রতি অধিবর্ষে ফাল্গুন মাসে ৩১ দিন ধার্য করা হয়।১৯৮৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে এই দিনপঞ্জি গ্রহণ করা হয়। এরপর, জাতীয় দিনপঞ্জির সূচনা ও প্রতি বছর নববর্ষ ১৪ এপ্রিলেই হয়ে থাকে।১৪২৬ বঙ্গাব্দে দ্বিতীয়বারের মত সংশোধনী আনা হয়। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির সঙ্গে বাংলা বর্ষপঞ্জির বিশেষ দিনগুলোর সমন্বয় আনতে বাংলা একাডেমি এই পরিবর্তন আনে।নতুন বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র ও আশ্বিন—এই ছয় মাস ৩১ দিনে হবে। ফাল্গুন মাস ছাড়া অন্য পাঁচ মাস ৩০ দিনে পালন করা হবে। ফাল্গুন মাস হবে ২৯ দিনের, কেবল অধিবর্ষের বছর ফাল্গুন মাস ৩০ দিনের হবে।
১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর থেকে হিজরি, চন্দ্রাসন ও ইংরেজি সৌরসনকে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয় বলে জানা যায়। নতুন এ সনটি প্রথমে ফসলি সন নামে পরিচিত থাকলেও বঙ্গাব্দ হিসেবেই তা পরিচিতি পায়। বাংলা নববর্ষ সম্রাট আকবরের সময় থেকে পালন করা হত। ঐ সময় বাংলার কৃষকেরা চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূস্বামীদের খাজনা পরিশোধ করত। মেলা ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হত এ উপলক্ষে। পরবর্তী সময়ে বৈশাখ উপলক্ষে যে মেলার আয়োজন করা হতো, সে মেলাকে ‘বৈশাখী মেলা’ নামে নামকরণ করা হয়।
পহেলা বৈশাখ উৎসব শুরুর দিক ছিল মূলত গ্রামাঞ্চল। গ্রামীণ-মেলা, লোকজ খেলাধুলা ও নৃত্য-সংগীত ছিল প্রধান আকর্ষণ।
নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ। গ্রামে মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন জামাকাপড় পরে এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়। বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয় এবং মোটামুটি সুন্দর করে সাজানো হয়। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায়, কোন খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। মেলাতে থাকে নানা রকম কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানারকম পিঠা পুলির আয়োজন। অনেক স্থানে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এই দিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তি একসময় প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশে এরকম কুস্তির সবচেয়ে বড় আসরটি হয় ১২ বৈশাখ, চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে, যা জব্বারের বলি খেলা নামে পরিচিত
দিনে-দিনে তা শহরাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালির আদি সাংস্কৃতিক পরিচয় বহনকারী এ অসাম্প্রদায়িক উৎসব বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে আমাদের বিশেষ প্রেরণা জুগিয়েছে। এ ভূখণ্ডের বাঙালির ঐক্যবদ্ধ করেছে এ সাংস্কৃতিক-উৎসব ও চেতনা।
বাংলাদেশে
পহেলা বৈশাখের সবচেয়ে বড় উৎসব হয় ঢাকা শহরে। আর সে উৎসবের প্রাণকেন্দ্র বলা যেতে পারে রমনা বটমূলে আয়োজিত ছায়াানটের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে। ছায়ানটের শিল্পীরা এ দিন খুব ভোরবেলা থেকেই সম্মিলিত কণ্ঠে বৈশাখী আগমনী গানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে স্বাগত জানান।
এই উৎসবটিরও ইতিহাস আছে। পাকিস্তাানি শাসনামলে শাসকরা বাঙালি সংস্কৃতিকে দমিয়ে রাখার জন্য অনেক কিছুই করেছিল। একবার তো ওরা রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের উপরই নিষেধাজ্ঞা জারি করে বসে। এর প্রতিবাদেই ছায়ানট ১৩৭৫ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের আয়োজন করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ গানের মধ্যে দিয়ে স্বাগত জানানো হয় বৈশাখকে। সেই ধারা আজও অব্যাহত আছে। আর ১৯৭২ সালে এটিকে জাতীয় উৎসব হিসেবেই পালিত হয়ে আসছে।
ঢাকার পহেলা বৈশাখের জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের আরেক আকর্ষণ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’।
দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা; যা ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেসকো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়। এ মর্যাদা দেওয়ায় আমরা গৌরববোধ করি। পহেলা বৈশাখ তাই কেবল একটি তারিখ মাত্র নয়, বাঙালির উৎসবের দিন। এই দিন উপলক্ষে সরকার বাংলাদেশের
চাকরিজীবীদের
জন্য ঈদ-পূজার বোনাসের মতো ‘বৈশাখী ভাতা’ চালু করেছে। এটা আমাদের আনন্দের কথা।
এ ছাড়া প্রতি বছর বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নিতে ঢাকার রমনা পার্কে ছায়ানট আয়োজিত প্রাত্যোষিক সঙ্গীতানুষ্ঠান এবং একে ঘিরে আয়োজিত অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলা সাধারণ মানুষকে নিবিড়ভাবে আকৃষ্ট করতে থাকে এবং নাগরিক আবহে সার্বজনীন পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। ১৯৮০’র দশকে স্বৈরাচারী শাসনের বিরূদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্য এবং একইসঙ্গে শান্তির বিজয় ও অপশক্তির অবসান কামনায় সর্বপ্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রবর্তন হয়।ঐ বছরই ঢাকাবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় এই আনন্দ শোভাযাত্রা। সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীগণ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এই আনন্দ শোভাযাত্রা বের করার উদ্যোগ প্রতি বছর অব্যাহত রাখে।
শোভাযাত্রার অনতম আকর্ষণ - বিশালকায় চারুকর্ম পুতুল, হাতি, কুমীর, লক্ষ্মীপেঁচা, ঘোড়াসহ বিচিত্র মুখোশ এবং সাজসজ্জ্বা, বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্য।পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু থেকেই জনপ্রিয়তা পেয়ে আসছে। পরের বছরও চারুকলার সামনে থেকে আনন্দ শোভাযাত্রা বের হয়। তবে সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী জানা যায়, ঐ বছর চারুশিল্পী সংসদ নববর্ষের সকালে চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে বর্ণাঢ্য আনন্দ মিছিল বের করে। শুরু থেকেই চারুকলার শোভাযাত্রাটির নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল না।
মাহবুব জামাল শামীম নামক শুরুরদিকের একজন অংশগ্রহণকারীর কাছ থেকে জানা যায়, পূর্বে এর নাম ছিল বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। সেই সময়ের সংবাদপত্রের খবর থেকেও এমনটা নিশ্চিত হওয়া যায়। সংবাদপত্র থেকে যতোটা ধারণা পাওয়া যায়, ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এই আনন্দ শোভাযাত্রা মঙ্গল শোভাযাত্রা হিসেবে নাম লাভ করে।তবে বর্ষবরণ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা চারুকলায় ১৯৮৯ সালে শুরু হলেও এর ইতিহাস আরো কয়েক বছরের পুরানো।
১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে চারুপীঠ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রায় ছিল - পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরানো বাদ্যযন্ত্রসহ আরো অনেক শিল্পকর্ম। শুরুর বছরেই যশোরে শোভাযাত্রা আলোড়ন তৈরি করে। পরবর্তীতে যশোরের সেই শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকার চারুকলা থেকে শুরু হয় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা।
বিশ্বায়নের ফলে আধুনিক যুগের বাংলা নববর্ষ উদযাপনের মনোহরি চাকচিক্য বাড়লেও আন্তরিকতার যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান সময়ের ‘নববর্ষ’ উদযপানে পান্তাভাত ও ইলিশ ভাজাসহ মুখরোচক অনেক খাবারের সমারোহ ঘটালেও এতে প্রাণের স্পর্শ পাওয়া যায় না। ধনী ও বিলাসী মানুষের বিনোদনের ব্যবস্থা হলেও দরিদ্র ও অসহায় মানুষের অন্তরে প্রকৃত সুখ আসে না। আধুনিক যুগের শহরের মানুষের প্রাণহীন জমকালো বর্ষবরণের কৃত্রিম নিবীঢ় পল্লীর প্রীতিপূর্ণ ছোট ছোট উৎসব অতল গহবরে হারিয়ে যায়। শিল্পপতি, চাকরিজীবী ও টাকাওয়ালাদের উৎসবের আবর্তে পিষ্ট বাঙালি কৃষকদের নববর্ষ উৎসব। অথচ বাংলা নববর্ষের সূচনা হয়েছে বাঙালি কৃষকের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করেই। বাংলা নববর্ষের মূল উৎস কৃষক ও কৃষি।
বাংলা ‘নববর্ষ’ কেন্দ্র করে গ্রামগঞ্জে যে বৈশাখী মেলা বসে,সেখানে নানারকম কৃষিজ পণ্য, কুঠির শিল্প দ্রব্য, মৃৎ ও হস্তশিল্প দ্রব্য প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, খেলনা ইত্যাদি ক্রয়-বিক্রয়ের ধুম পড়ে
যায় ।
তখনকার দিনে মেলায় প্রদর্শনী হতো বাঁশের বেতের তৈজষ পত্র, নানা জাতের খেলনা সামগ্রী, নারকেল মুড়কিসহ কত কি থাকে মেলায় তার ইয়ত্তা নেই। মেলার সময় নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, কুস্তির আসর এমন কি মেলায় ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, বলী খেলা ইত্যাদি বিনোদন অনুষ্ঠান বসতো। তখন মেলা ছিল বাঙালির প্রাণের উৎসব। মেলা উপলক্ষে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়ানো ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা হতো। আর বিবাহিতা মেয়েরা নাইয়র আসতো বাপের বাড়ি। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই বৈশাখী মেলায় আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠতো।
বাড়ি বাড়ি লেগে থাকতো নানান পদের মনোহরি রান্নার ধুম!
এমনিভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপন বাংলার গ্রামে গ্রামে আনন্দের ফোয়ারা বয়ে যেতো।
বৈশাখী মেলার আগের দিন কৃষকদের লাঙ্গল জোয়াল মইসহ বিভিন্ন কৃষি সরঞ্জামাদি, গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় মাটির হাড়ি-পাতিলসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র, শিশুদের খেলাধুলার জন্য ঘুড়ি মাটির তৈরি হাতি ঘোড়া ইত্যাদি বেচা-কেনা হতো। মেলায় মেয়েদের হাতের চুড়ি, কানের দুল গলার হার ইত্যাদি দ্রব্যও বেচা-কেনা হতো। এছাড়া চিনি ও গুড়ের তৈরী বাতাসা,গোজা,সন্দেশ,
খুরমা,খাগড়াই,মোয়া, মুড়কি, জুড়ি-বুন্দি জিলাপি রসগোল্লাসহ মুখরোচক খাবারের সমারোহ ছিল চমৎকার।
প্রাচীন রীতির সাথে অঙ্গাঅঙ্গি ভাবেই জড়িত ছিল শুভ হালখাতা। প্রত্যেক চাষাবাদি চৈত্র মাসের শেষ দিনে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করে দিত। এরপর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ ভূমির মালিকরা তাদের প্রজা সাধারণের জন্য মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা রাখতেন। পরবর্তীতে তা ব্যবসায়িক পরিমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। দোকানীরা সারা বছরের বাকীর খাতা সমাপ্ত করার জন্য পহেলা বৈশাখের দিনে নতুন সাজে বসেন দোকানে। গ্রাহকদের মিষ্টিমুখ করিয়ে শুরু করেন নতুন বছরের ব্যবসার সূচনা। এ উৎসব গুলো সামাজিক রীতির অংশ হিসেবে পরিণত হয়েছে প্রতিটি বাঙালির ঘরে। এখনো ‘নববর্ষে’ হালখাতার হিড়িক পড়ে প্রত্যেক গ্রামগঞ্জে।
দূর অতীতে বাংলায় তেমন কোনও অনুষ্ঠান হত না। পয়লা বৈশাখ মানে ছিল হালখাতার দিন।

আজ আমরা পয়লা বৈশাখের যে দিনটিকে নববর্ষ বলি, দুশো বছর আগে বাংলায় তার প্রচলন ছিল না। সে সময়ে নববর্ষের উৎসব বলতে ইংরেজি নববর্ষকে বোঝানো হত। সে কালের কবি ঈশ্বর গুপ্ত এই উপলক্ষে একটি কবিতা লিখেছিলেন,
খৃষ্ট মতে নববর্ষ অতি মনোহর।
প্রেমানন্দে পরিপূর্ণ যত শ্বেত নর!
চারু পরিচ্ছদযুক্ত রম্য কলেবর।
নানা দ্রব্যে সুশোভিত অট্টালিকা ঘর॥
এর আগে বাংলা নববর্ষে এই অট্টালিকা সুশোভিত করার কথা কোথাও পাওয়া যায় না।

তখন বর্ষবিদায়ে গাজনের উৎসব, চড়ক পালন হত। উনিশ শতকে ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’-য় সে কালের বর্ষশেষের ভারী সুন্দর বর্ণনা রয়েছে— “এদিকে আমাদের বাবুদের গাজনতলা লোকারণ্য হয়ে উঠল, ঢাক বাজতে লাগল, শিবের কাছে মাথা চালা আরম্ভ হল, সন্নাসীরা উবু হয়ে বসে মাথা ঘোরাচ্ছে, কেহ ভক্তিযোগে হাঁটু গেড়ে উপুড় হয়ে পড়েছে— শিবের বামুন কেবল গঙ্গাজল ছিটুচ্ছে, আধ ঘণ্টা মাথা চালা হল, তবু ফুল আর পড়ে না।”

এর পরের দিন, পয়লা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের প্রজাদের মিষ্টান্ন বিতরণ করতেন, আপ্যায়ন করতেন। এই উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন হত। এই উৎসব ছিল একান্ত ভাবেই নতুন ফসলের অনুষ্ঠান। বাংলার সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে এর ছোঁয়া পড়েনি।

আসলে সে যুগে নববর্ষের ধারণা ছিল অন্য রকম। দূর অতীতে হিম (শীত) ঋতু থেকে বর্ষ গণনা আরম্ভ হত। তাঁরা বলতেন, আমরা যেন শত শরৎ জীবিত থাকি। এই ‘শরৎ’ শব্দের অর্থ বৎসর। আর তিথি-নক্ষত্র দেখে বর্ষা আর শরৎকালের সন্ধিক্ষণকেই বলা হত নববর্ষ প্রবেশের উৎসব। অষ্টমী পুজো শেষে নবমী শুরুর সন্ধিক্ষণ ছিল পুরনো বছর শেষ, নতুন বছরের শুরু। তখন ১০৮টি প্রদীপ জ্বালিয়ে বরণ করা হত নতুন বছরকে।

আবার প্রাচীনকালের মানুষ যারা চন্দ্র-সূর্যের গতি লক্ষ করে বছর গণনা করতে জানত না, তারা অগ্রহায়ণ (অগ্র অর্থাৎ প্রথম, হায়ন অর্থ বৎসর) মাসকেই প্রথম মাস হিসেবে বিবেচনা করত। এবং এই মাস থেকে নতুন বৎসর গণনা করত। এর পিছনে কারণ ছিল কৃষিপ্রধান এই দেশে সেই সময়ে কৃষকের ঘর নতুন ফসলে ভরে উঠত। তাই তাদের কাছে হেমন্ত ঋতুর অগ্রহায়ণই ছিল শ্রেষ্ঠ মাস, মার্গশীর্ষ বা প্রথম মাস। নববর্ষের এই ভাবনা একান্তই সীমাবদ্ধ ছিল গ্রামীণ কৃষিজীবীদের মধ্যে।

তখন চৈত্র শেষে বাংলার প্রান্তে প্রান্তে হত গাজন, চড়ক। এটি সম্পূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান, যা প্রধানত নিম্নবর্গের মানুষরা পালন করতেন। অন্য দিকে ফসল তোলা শেষ হওয়ার পর যে পুণ্যাহ উৎসব পালন করা হত, তার সঙ্গে জড়িত ছিল মানুষের অর্থনৈতিক জীবন। এক দিকে রাজস্ব জমা দেওয়া হত, তার সঙ্গে বাকি রাজস্ব ছাড় করা হত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনও কারণে রাজস্ব দিতে না পারলে তাও মকুব করা হত। জমিদাররা এই সময় প্রজাদের ঋণ দিতেন। রায়তরা জমিদারের কাছারিতে একত্রিত হয়ে জমিদার বা নায়েবের কাছ থেকে পান বা পানপাতা উপহার পেতেন। এই দিনটি ছিল সামাজিক আদানপ্রদানের দিন। স্বাভাবিক ভাবেই ধীরে ধীরে সেই দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম হয়ে ওঠে। ক্রমে তা গোটা সমাজ জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে পড়ে। প্রথমে যা ছিল শুধু কৃষি উৎসব বা রাজস্ব আদায়ের বিষয়, এক সময় তা হয়ে উঠল নতুন সংস্কার, নতুন সংস্কৃতি, নতুন চিন্তাধারা, তার সঙ্গে নব জীবনের আহ্বান। যা কিছু অসুন্দর, জীর্ণ, পুরাতন, তা শেষ হয়ে যাক। পয়লা বৈশাখ সেই শুভ সূচনার দিন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, প্রথম থেকেই নববর্ষের উৎসব কোনও ধর্মের বাঁধনে বাঁধা পড়েনি। সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ এই উৎসবে বাংলার মানুষ— সে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ কি খ্রিস্টান— মহানন্দে যোগ দিতেন। একে অন্যের বাড়িতে যাওয়া-আসা, শুভেচ্ছা, বিনিময়, খাওয়াদাওয়া, আনন্দ উৎসব মিলে সারা বছরের অন্য দিনগুলির থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হয়ে উঠত এই দিনটি।
চৈত্রের সংক্রান্তি আসার কয়েক দিন আগে থেকেই গ্রামে সবার ঢেঁকিঘরটা মুখর হয়ে উঠতো। নববর্ষের প্রথম দিন ছেলেমেয়েদের হাতে নাড়ু-মোয়া, ছানার মুড়কি ও সরভাজা দিতে হবে; তারই আয়োজন চলতে থাকতো। বাড়ির বাইরে গোলাবাড়িতে চৈতালী ফসল উঠতো। আর আঙিনার প্রান্তে তৈরি হতো বড় বড় খড়ের গাদা।
কোন কোন গ্রামের হাটে বাজারে দোকানদারেরা সারি সারি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অস্থায়ী চালা তুলে তার মধ্যে দোকান খুলে বোসতো। এক এক রকম জিনিসের দোকান এক এক দিকে। কোথাও কাপড়ের দোকান, কোথাও বাসনের, কোথাও নানাবিধ মনিহারি দ্রব্যের দোকান। এত রকম সুন্দর পিতল-কাঁসার বাসন আমদানি হতো যে, দেখলে চক্ষু জুড়ায়। কৃষ্ণনগর হতে মাটির পুতুলের দোকান আসতো ; নানা রকম সুন্দর সুন্দর পুতুল...। জুতার দোকানে চাষীর ভয়ঙ্কর ভিড়। কাপড়ের দোকান, লোহালক্কড় হতে ক্যাচকেচের পাটী পর্যন্ত কত জিনিসের দোকান। এসব মেলায় সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষের আনাগোনা। পুতুল, কাঠের ঘোড়া, টিনের জাহাজ, মুড়ি-মুড়কি, খই-বাতাসা, কদমা-খাগরাই, জিলিপি-রসগোল্লা!
কমতি থাকতোনা কোনকিছুরই !
ব্যক্তিগতভাবে ছোট সময় আমিও দেখেছি,
আমাদের পরিবারের সঙ্গে যেসব হিন্দু পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল সেসব বাড়ি থেকে মুড়ি-মুড়কি, মোয়া, নাড়ু এগুলোর হাঁড়ি আসতো। এ হাঁড়িগুলো ছিল নানারঙে চিত্রিত।
কদমা,গজা,বাতাসা ,নাড়ু দিয়ে ঠাসা থাকতো হাঁড়িগুলি!
আর আমাদের বাড়িতে আম্মা নানান পদের রান্না করতেন!নতুন জামা পরে সারাদিন ঘুরতাম!
তখন পয়লা বৈশাখকে আমরা খুব মজা করে স্বাগত জানাতাম।
নববর্ষ এলেই মনে আসে কালবৈশাখীর ঝড়ে আম কুড়ানো, মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, শুকনো মাটিতে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার পর সোঁদা গন্ধ, শিল পড়ার অপেক্ষায় বসে থাকা, হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানি,ঝড় বৃষ্টি থামলেই বন্ধুদের সাথে আম কুড়ানোর প্রতিযোগিতা আজো মনে নাড়া দেয় !
মূলত পয়লা বৈশাখকে যিনি বাঙালির প্রাণের সঙ্গে জুড়ে দিলেন, তিনি রবীন্দ্রনাথ। যা ছিল বাণিজ্যিক, তা চিরকালের জন্যে ধরা পড়ল আমাদের চিন্তা-চেতনার মধ্যে। তাঁর কবিতা, গান, প্রবন্ধ, নাটকে বার বার এসেছে নতুন বছরের স্বাগতবাণী। এ তাঁর কাছে নবজন্ম। পুরনো জীর্ণ জীবনের অস্তিত্বকে বিদায় দিয়ে নতুন জীবনে প্রবেশের আনন্দ অনুভূতি। ১৯৩৯ সালের ১৪ এপ্রিল (পয়লা বৈশাখ) শ্যামলী-প্রাঙ্গণে সকালবেলায় রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘নববর্ষ-ধরতে গেলে রোজই তো লোকের নববর্ষ। কেননা, এই হচ্ছে মানুষের পর্বের একটা সীমারেখা। রোজই তো লোকের পর্ব নতুন করে শুরু।’

কিন্তু আজ আর নববর্ষ নতুন চেতনার আলোকবর্তিকা নিয়ে আসে না। উৎসব আছে, প্রাণ নেই। এক সময় সব ধর্মের মানুষ বিভেদ ভুলে উৎসবের দিনে একই সঙ্গে মাতোয়ারা হয়ে উঠতেন। সেখানে এখন ধর্ম আর রাজনীতির প্রচ্ছন্ন শাসন মানুষের থেকে মানুষকে আলাদা করে দিচ্ছে। অথচ পয়লা বৈশাখ তো দ্বিধাহীন মহামিলনের উৎসব। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ, শামসুর রহমানরা এই দিনটিকে কেন্দ্র করে মিলনের গান গেয়েছেন, অশুভকে দূর করে শুভর বার্তা।

রাত পোহালেই
সকালের রাঙা সূর্যের দিকে চেয়ে বলতে হবে, “রাত্রির অন্ধকার কেটে যাক,জয় হোক সর্বমানবের।"
কিংবা
"মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা" ...

তথ্যসূত্র:
বাংলাপিডিয়া,
মুহাম্মদ লুৎফুর হক (এপ্রিল ১৪, ২০০৮)। "প্রথম মহাযুদ্ধে বাংলা বর্ষবরণ"। দৈনিক প্রথম আলো। ঢাকা।
প্রথম আলো। "বাংলা দিনপঞ্জি বদল"।
সাইয়েদা আক্তার। "রমনার বটমূলে জাতীয় উৎসবে"। দৈনিক প্রথম আলো। ঢাকা।
সমকাল, ৩০ জুন ২০১৬
দৈনিক কালের কণ্ঠ। ঢাকা। এপ্রিল ১৪, ২০১২।
দৈনিক আজাদী,পৃষ্ঠা ১৬২।
উইকিপিডিয়া ও ইন্টারনেট!

 

শাহান আরা জাকির পারুল 
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top