সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৪) : সেলিনা হোসেন


প্রকাশিত:
৬ জুলাই ২০২২ ০২:৪৪

আপডেট:
৬ জুলাই ২০২২ ২২:১৬

 

আসমানী গাড়ির উপর উঠে বসে। যশোর রোডের গাছের দিকে তাকিয়ে বুক ভরে যায়। সন্তানের মৃত্যু গাছের ছায়ায় মায়া ছড়ায়। দুঃখ চেপে রেখে মনে জোর ফিরিয়ে আনে। নিজেকে বলে, বেঁচে থাকার কঠিন সময় এখন। এই সময়কে পার করতে হবে। হেরে গেলে চলবে না।
গাড়ি এসে থামে সীমান্তে। মারুফ এগিয়ে এসে শাশুড়িকে ধরে বলে, আমি আপনাকে নামাই আম্মা। আপনি আমার ঘাড়ে হাত রাখেন।
আকাশী ওকে ধরে গরুর গাড়ি থেকে নামে। মারুফ আবার সাফিয়াকে বলে, আপনি আমাকে ধরেন চাচী।
সাফিয়া নেমে বলে, আমরা দুজনে এবার আসমানীকে নামাই।
- আমরা দুজনে ওকে কোলে করে নামাব। তুমি যাও।
মারুফ সরে যায়। আকাশী আর সাফিয়া দুজনে ওকে কোলে নিয়ে নামায়। ওর ব্যবহৃত যেসব কাপড় লাগবে সেই পোটলাটা আকাশী নিজের কাছে রাখে। প্রয়োজনে সেগুলো দিয়ে ওর সেবা করতে হবে। মেয়েটাকে নিয়ে এতবড় একটা বিপদ হতে পারে এটা আকাশীর মাথায় ছিলনা। ওর কষ্টে নিজের বুক তোলপাড় করে। তারপরও দুজনে আসমানীকে নামিয়ে দাঁড় করায়। মেয়ের হাত ধরে পার হয় সীমান্ত। এর আগে মারুফের সঙ্গে সীমান্ত পার হয়ে বড় গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে বাবুল, নজরুল আর আমিনা। তিনজন লাফালাফি করে বলে, কি সুন্দর, কি সুন্দর!
মারুফ ধমক দিয়ে বলে, এই থাম তোরা। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক।
তিনজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে যায়। বাবুল বলে, আমার খিদে পেয়েছে।
- আমারও খিদে পেয়েছে।
- আমরাও। আমিনা চেঁচিয়ে বলে, গরুর গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে হয়েছে সেজন্য বেশি খিদে পেয়েছে।
- ওই যে সবাই আসছে। খাওয়ার ব্যবস্থা হবে।
রবিউল, মোবারক সবাইকে নিয়ে বর্ডার পার হয়। ছেলেমেয়েরা ছুটে আসে, মাগো খিদে পেয়েছে। মাগো ভাত দাও।
আকাশী বলে, আমার হাঁড়িতে ভাত আছে। সবাইকে ভাত দেব।
মারুফ বলে, বাবা-চাচা এই রাস্তার নাম যশোর রোড। এই রাস্তা অনেকদিন ধরে যশোর রোড নামে পরিচিত।
- কিন্তু আমরাতো এখন ভারতে ঢুকেছি?
- ভারতের অংশের নামও যশোর রোড। সামনে তাকিয়ে দেখেন কত শরণার্থী ক্যাম্প হয়েছে। আমরা নিশ্চয় একটা ক্যাম্প পাব। চলেন এগোই।
- গরুর গাড়ি চলে গেছে। দেখ কত লোক হেঁটে হেঁটে আসছে।
- বাব্বা দেখে মনে হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ আসছে। এত মানুষকে কোথায় জায়গা দেয়া হবে।
- ইন্দিরা গান্ধী বুঝবেন কি করতে হবে। চল আমরা আগাই। একটা জায়গা খুঁজে নেই। নইলে আবার ফিরে যেতে হবে কিনা কে জানে?
- না, বাবা এভাবে ভাববেন না। আমরা যখন ঢুকেছি আমাদেরকে টিকে থাকতে হবে। বুকের ভেতর কষ্ট একটাই যে ছেলেটা মরে গেল।
দুহাতে চোখ মোছে মারুফ। কাছেই দাঁড়িয়ে আছে আসমানী। কিন্তু মুখে কোনো কথা নেই। ও এখন দরকার ছাড়া একদম কথা বলেনা।
সবাই এগিয়ে গিয়ে একটি বড় গাছের ছায়ায় বসে। শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য যারা আশেপাশে ছিল তারা এগিয়ে আসে। নির্মল বলে, এই গাছের নিচে আপনাদের দুটো তাঁবু করে দিচ্ছি।
- আমরা কি কিছু ভাত পাব?
- পাবেন। ডাল-ভাত-আলু ভর্তা এনে দিচ্ছি। এখানে এর বেশিকিছু খাওয়া হবে না।
- হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। আামদের বেঁচে থাকাটাই দরকার।
- আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে মালামাল আসে। আমাদের সব সীমান্তে শরণার্থী ভরে গেছে।
- কি করব? পাক সেনারা গুলি ছাড়া আর কিছু বোঝে না। বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া ছাড়া ওদের আর আনন্দ নেই। ওরা মানুষ চেনেনা। চেনে শুধু নিজেদের ছবি।
নির্মল সঙ্গে সঙ্গে বলে, আচ্ছা, ঠিক আছে চলুন। আপনাদের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
- আমরা দুটো পরিবার একসঙ্গে এসেছি।
- ঠিক আছে, দুটো ক্যাম্প বানিয়ে দেব।
ওরা তিনজন সামনে হেঁটে যায়। বাকিরা সবাই পেছনে হাঁটে। ওরা সামনে গিয়ে এক জায়গায় থামলে ছেলেমেয়েরা ভাত খাবার জন্য কাঁদতে শুরু করে।
আকাশী বলে, এই তোরা গাছের নিচে বস। আমি তোদের ভাত খাওয়াব। পোটলায় বেঁধে আনা ভাতের হাঁড়ি বের করে ছেলেমেয়েদেরকে থালা দিয়ে বলে, সবাই হাত ধুয়ে নে। আমি ভাত-তরকারি দিচ্ছি।
তারপর আসমানীর দিকে তাকিয়ে বলে, মাগো তুই খেতে আয়। তোর খাওয়া দরকার।
- হ্যাঁ, আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে মা।
- আয় বস।
- বসতে কষ্ট হয়। মনে হয় শুয়ে থাকি।
- আমাদেরকে তাঁবু দিলে তোকে শোওয়ার ব্যবস্থা করে দেব। ভাত খেয়ে নে।
আসমানী ঘাসের ওপর বসে এদিক-ওদিকে মোড়ামুড়ি করে। একসময় ভাতের থালা টেনে নেয়।
একটুপরে নির্মল আর যাদব এসে বলে আপনাদের জন্য একটা তাবু ঠিক করেছি। কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মারুফ বলে, আমি যাব আপনাদের সঙ্গে। বাবা ও চাচাকে নিয়ে যাব।
- হ্যাঁ, আসুন।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রবিউল ও মোবারককে নিয়ে মারুফ তাঁবুর কাছে যায়। একই ধরণের তাঁবুর পরিসর। কাছাকাছি করার কোনো সুযোগ নেই।
- বাবা, চাচা আপনারা এখানে থাকেন। আমি সবাইকে নিয়ে আসছি।
যাদব বলে, আপনাদেরকে শরণার্থী কার্ড দেয়া হবে। কাল সকালে নিয়ে আসব আমরা। এখন যাই।
- আচ্ছা বাবারা যাও। কাল দেখা হবে। তোমাদেরকে আশীর্বাদ করি।
নির্মল, যাদব, অসীম হাসতে হাসতে চলে যায়। ছোটদের খাওয়া হলে অবশিষ্ট ভাত সবাই একমুঠো করে খেয়ে ফেলে। তারপর জড়ো হয়ে যে যার তাঁবুর নিচে শুয়ে পড়ে। বেঁচে থাকার স্বস্তিতে আপ্লুত হয় সবাই। শুনতে পায় হেঁটে যাওয়া শরণার্থীর পায়ের শব্দ।
মার্চ মার্সেই পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আর এই মাসেই সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ভারতে। ইন্দিরা গান্ধী বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে ভারতে ক্ষমতায় আসেন। পরদিন নির্মল, যাদব, অসীম ওদের শরণার্থী কার্ড দিতে এসে এসব কথা মারুফকে বলে।
অসীম বলে, পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনার ওপর আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভালোই নজর রাখছেন। তিনি জেনেছেন পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরায় অসংখ্য শরণার্থী ঢুকেছে। সেজন্য তিনি ২৫ মার্চ আদেশ জারী করেন যে, যেসব সীমান্ত দিয়ে শরণার্থী আসবে তা খোলা রাখার জন্য। সবাই যেন নিরাপদে ভারতে ঢুকতে পারে। ৩০ মার্চ তিনি সংসদের উভয় কক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা নিয়ে ভারত সরকারের মনোভাব প্রকাশ করেন। ভারত পূর্ব বাংলার পাশে থাকবে। সব ধরণের সহযোগিতা দেবে।
মারুফ দুহাত উপরে তুলে বলে, আল্লাহর রহমত। আমাদের সৌভাগ্য। ভারতের সহযোগিতা পেলে যুদ্ধে জিততে আমাদের সময় লাগবে না। আমিও যুদ্ধ করব। ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা আছে?
- আছে, আমরা তোমাকে সেখানে পৌঁছে দেব।
মারুফ ওদের তিনজনেরই হাত জাড়িয়ে বলে, তোমরা আমার আজীবনের বন্ধু হলে। এই জোয়ান বয়সে যুদ্ধ না করে দেশের জন্য কিছু করবনা, তা আমি ভাবতে পারিনা।
- আমরা আশীর্বাদ করি তুমি একজন বীরযোদ্ধা হও।
- তোমাদের প্রধানমন্ত্রী অন্য দেশের জন্য একজন সাহসী মানুষ। মানবিক বিবেচনায় একজন জ্ঞানী মানুষ। আর আমরা নিজেদের দেশের জন্য সাহসী হতে পারবনা!
- কেন পারবেনা, একশোবার পারবে। তোমার মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখাতে হবে। আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়ে বললে নেতারা তোমাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তালিকাভুক্ত করবে। এটাই নিয়ম বলে আমরা শুনেছি।
- ঠিক আছে নিয়মমাফিক যা করতে হয় আমি তা করব। তোমরা একটু সহযোগিতা কর।
- আমরা দু’একদিনের মধ্যে খবর নিয়ে তোমার এখানে আসব। তুমি অন্য কোথাও যেওনা।
ওদের কথা শেষ হতেই একজন দ্রæতপায়ে ওদের ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যায়।
অসীম বলে, আরে রঘু রাই কোথায় যাচ্ছে?
মারুফ জিজ্ঞেস করে, উনি কে?
- উনি একজন বিখ্যাত ফটোগ্রাফার। শরণার্থীদের অনেক ছবি তুলেছেন।
মারুফ বলে, ঐ যে লোকজন আসছে সেজন্যই তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন।
- ভালোই হলো আমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তাঁর কাজ শেষ হলে আমরা কথা বলব।
দারুণ ছবি তোলে রঘু রাই। যশোর রোডে শরণার্থীদের আসার একটা ছবি তুলেছে। মানুষজন পোটলা মাথায় করে হাঁটছে, ছোট বাচ্চাদের ঘাড়ে নিয়ে হাঁটছে। এক হাতে পোটলা ধরে রেখেছে অন্য হাতে হেঁটে যাওয়া শিশুদের হাত ধরে রেখেছে। নারীদের ঘাড়-মাথায় ছোট-বড় পোটলার বোঝা। চমৎকার ছবিটা। সময়ের নিখুঁত চিত্র। স্বাধীন দেশের মানুষেরা এই ছবি থেকে পাবে শরণার্থীদের বেঁচে থাকার খোঁজ। মৃত্যুকে পেছনে রেখে চলছে তারা, সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। কোথায় গিয়ে ঠাঁই মিলবে সেই নিশ্চয়তা তাদের বুকের ভেতর নেই। তারপরও যেতে হচ্ছে ভারতে।
(চলবে)...........

 

সেলিনা হোসেন
প্রখ্যাত সাহিত্যক, স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত ঔপন্যাসিক

 

শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ১)

শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ২)
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা (পর্ব- ৩)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top