সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

কিছু জানি নে : ময়ূরী মিত্র


প্রকাশিত:
১৩ জুলাই ২০২২ ০২:১১

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ২১:২১

 

জীবনে স্রোত কাম্য ৷ কিন্তু কখনো কখনো নদীর স্থিরভাবের মতো জীবনেরও একটি নিশ্চুপ দশা আসে ৷ আর আসলে সেটিকে সমান আনন্দে নিতে হয় ৷ ছলবলে বা ছলে বলে এগিয়ে চলা পাহাড়ি ঝর্ণা দেখতে দেখতে দেশ বিদেশের ভ্রমনার্থী ভিড় জমায় ৷ তা বলে গাঁয়ের প্রান্তে শান্ত দীঘির পাড়ে দুদণ্ড জিরোতে যে মন্দ লাগবে এমন নয় ৷ হতে পারে -- দীঘির কোলেই স্থানীয় গৃহস্থের বেশি স্বস্তি ৷ সন্ধ্যায় সে দীঘির জলে যখন চাঁদ ঝরে মনে হয় জলাভূমি আকাশ হয়ে গেছে ৷ সে মুহূর্তে যদি জল থেকে চোখ তুলে আকাশে তাকান মনে হবে আকাশের তারাগুলো ছোট্ট মোট্ট এক একটি নৌকা ৷ এখন হয়ত আকাশঘাটে বাঁধা -- গন্তব্য স্থির হলে তারা রওনা দেবে ৷ সে পথে অনেক জনপদ ৷ আকাশে নীড় বেঁধেছে জনপদের পর জনপদ ৷ তারার নৌকোগুলো পিদিম জ্বালিয়ে ঘুরে ঘুরে জনপদের মানুষগুলোকে হাল লাঙল দেবে --গবাদি দেবে --- ৷ বধূদের চোদ্দহাতি কাপড় দেবে ৷ আকাশের বধূরাও তো সন্ধে দেয় ৷ কপাল অব্দি ঘোমটা দিলে তাদের বেশ লাগে ৷
আসলে ঘটনার বাহুল্যে মেতে যাওয়া না আত্মকে স্থিত করা কোনটি যে কত পরিমাণে জীবনকে পূর্ণ করে তা বলতে পারিনে ৷ এখনো অব্দি আমার জীবন আমাকে এই মিশেল শেখায়নি ৷ তাই আকাশে প্রাণপ্রবাহ খুঁজি ৷ লোভীর মতো চাই --- আকাশ ভর্তি মানুষ আর তাদের ঘরবাড়ি, সংসারযাত্রা, উৎপাদনশীলতা -- যা ভূমিজীবনে না পাওয়ার গভীর শোককে সংহত করবে ৷
রাতের মাঝে এসব লিখতে লিখতে কমলবাবুর কথা মনে এল ৷ মানুষটি রোগীর বাড়ি রক্ত সংগ্রহে এসে রোগীর গায়ে মাথায় হাত বুলোন --রক্ত নেন ---যত্ন করে বাহুতে লেগে থাকা শেষ রক্তবিন্দু মোছেন এবং তারপর ব্যান্ডেডলাগান ৷ কতদিন বলেছি --দূর ওটুকু রক্ত মোছা নিয়ে কেন এত মাতামাতি করেন ৷ সোজা পট্টিটা দিয়ে দিন না বাবা !
শান্ত হেসে বলেন --মানুষের রক্ত -তাকে আদর দিতে হয় ৷ এসব করতে গিয়ে কমলবাবুর সারাদিনের রক্ত সংগ্রহ কমে যায় -উপার্জন কমে যায় ৷ রাতে রিপোর্ট দিতে এসে নিজেই পড়তে শুরু করেন ফলাফল ৷ কোনো কিছু খারাপ দেখলে পলক না ফেলে রোগীর মুখের দিকে তাকিয়েই থাকেন ৷
----মা তোমার রক্তে ফ্যাট জমেছে ৷ ফ্যাট জমাট হলে রক্তের বইতে কষ্ট হবে মা ৷ মাছটা সেদ্ধ করে ঝোল কোরো ৷ একটু বেশি হলুদ আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে চোখ বুঁজে খেয়ে নিও মা --কেমন ৷
মায়া লাগে ৷ যাবার সময় দুটো মিষ্টি দি প্লেটে ৷ একটি সরিয়ে দিয়ে বলেন -- অন্য কাউকে দিও ৷ আজ অব্দি পরম লোভের মিষ্টি দিয়েও দুটো খাওয়াতে পারিনি ৷ অথচ জানি মিষ্টি বড় ভালোবাসেন ৷ তবু ওই একটিই খুঁটে খুঁটে খান শেষ গুঁড়ো অব্দি ৷ সব খাদ্য নিজে খাওয়ার ব্যাপারে কী যে লজ্জা তাঁর ৷ অনেকটাক্ষণ ধরে একটি ছোট্ট মিষ্টি খেতে খেতে ঘাড় নিচু করে দুপাশে মাথা নাড়াতে থাকেন অদ্ভুতভাবে ৷ এমন ভঙ্গি আমি কারো দেখিনি ---খাবারটি খেয়ে যেন একটু একটু করে তৃপ্তি পাচ্ছেন আর ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন ৷
কমলবাবু বোধহয় আকাশের মানুষ --না ? --একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে বাকিদের আরো আপন করেছেন ৷ হাতে তাঁর সদ্য ভোরের একগাদা শিশিরকণা ৷ তারা সব কুমারী ৷

 

ড. ময়ূরী মিত্র
গদ্যকার, বিশেষ শিশুদের প্রশিক্ষক ও নাট্যশিল্পী 
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top