সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

তুমি রবে গরবে : রোকেয়া ইসলাম


প্রকাশিত:
১৯ জুলাই ২০২২ ০২:৫৪

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ২৩:০৮

 

অনেকটা পথ হেঁটেছে আজ, কপালে ঘাম চকচক করছে, কিছুটা হাঁপ ধরেছে, মহানগর ব্রিজের কাছে এসে দাঁড়ায় পারভিন। বেরিকেটের উপর অনেকেই বসে আছে, পারভীনও দূরত্ব বজায় রেখে বসে পড়ে।
মাস্কটা দেওয়াই আছে, তবুও টেনে ঠিক করে নেয়। চশমাটা ঠিকঠাক করে। মাথায় ওড়নাটা তুলে দেয় ।
একটু জিরিয়েই আবার ওঠে পড়ে, মহানগর ব্রিজের রেলিঙ ধরে হাঁটতে থাকে , এপারে এসে আবার একটু জিরিয়ে নেয়।
চন্দ্রপ্রভা গাছটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, সবুজে হলুদে অনন্য সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে ।
উপরে নীল আকাশ।
সামনের রাস্তায় গাড়ি ছুটছে দিকবিদিকশুন্য হয়ে। হর্ণের শব্দে চমক ভেঙে যায় বারবার।
কোনদিকে যাবে পারভীন দিকভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেদিনের মত।
রামপুরার দিকে মোড় নিয়ে এগিয়ে যায়, এবার ওর পা ধরে যায়, হাঁটতে পারে না, সামনের খোলা জায়গায় বসে পড়ে। এক কাপ চা পেলে ভাল হতো।
আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখতে পায় সারিসারি চেয়ার সাজিয়ে বসে আছে ফুডকোর্ট।
শুধু চা হবে না। কফি এবং স্নেকস নিতে হবে।
পারভীন ফাস্টফুডে অভ্যস্ত নয়, ওর চাই ঝাল মুড়ি আর চা।
চটপটি পাওয়া গেল, কপাল মেনে সেটাই অর্ডার করে বসে থাকে সাদা কাঠগোলাপ গাছটার নিচে।
সামনে ঝিলের জলরাশিতে ভাটার টান লেগেছে। তবুও জলযান চলছে। জলছোঁয়া বাতাস গায়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। একটু শীতল অনুভূতি ওকে জাগিয়ে তোলে।
ফুলহাতা মোটা কামিজ তার ওপর পাতলা পশমিনা শাল যথেষ্ট উঁম দিচ্ছে, এতোক্ষণের হাঁটাহাঁটিতে একটু গরম আমেজ ভেদ করে শেষ শীতের প্রখর দাঁত কিছুটা কামড় তো বসায়ই শরীরে।
কত বয়স হলো পারভীনের।
বয়সটাও বের করতে ইচ্ছে হচ্ছে না আজ। আজ শুধু মতিনকে মনে পড়েছে।
সেই কবে ওর জন্য ঘর ছেড়েছিল, প্রিয় শহর ছেড়েছিল আজন্মের বাঁধন মা বাবাকে ছেড়ে চলে এসেছিল শুধু মতিনের জন্য।
মতিনের বাবার পোস্টিং ছিল পারভীনদের শহরে। মতিনের বাবার সরকারি কোয়াটার পারভীনদের বাসার কাছে।
প্রতিদিন স্কুলে যাবার পথে দেখা, দেখার পথ হেঁটে কথা কথার সূতো ধরে কাছে আসা তারপর প্রেম।
এক কান দুকান করে দু' বাড়িতেই কথাটা ঢুকে যায় চেনাজানাদের কাছে রটে যায় পারভীন আর মতিনের প্রেমকাহিনী। হাসাহাসি কানাকানি দুই ইঁচড়েপাকার প্রেম।
দুজনের উপর বেতের আঘাত চড়চাপড় লাথ্থিগুতা চলতে থাকে, ওরাও সমানতালে প্রেম করতে থাকে।
পারভীনের প্রভাবশালী পিতা মতিনের সরকারি কর্মকর্তা পিতার কাছে নরমসুরে বিচার প্রার্থনা করে।
সেদিন মতিনকে মতিনের সরকারি কর্মকর্তা পিতা কোমড়ের বেল্ট দিয়ে ইচ্ছেমত পেটায়। হিতেবিপরীত হয়ে যায়।
মতিন আর পারভীন বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
পারভীনের পিতা আর ছাড় দিতে রাজি নয়, এদিকে মতিনের পিতাও বদলি নিয়ে চলে আসে পারভীনের শহর ছেড়ে।
দুই পরিবার হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
একদিন পারভীনের মা দেখে মেয়ে ঘরে নেই আত্মীয় স্বজনের বাসায় নেই শহরে নেই গ্রামে নেই।
খোঁজ লাগিয়ে জানতে পারে মতিনও ওদের বাড়িতে নেই। অনেক খোঁজাখোঁজি করে এখানকার জল ওখানে ঘোলা করে তবে ওদের খোঁজ পায়। ফিরিয়ে আনে দুজনকে মতিনের বাবা, ফিরিয়ে দিতে চায় পারভীনের পরিবারের কাছে।
বেঁকে বসে দুজন। ওরা আত্মহত্যা করবে যদি ওদের ফিরিয়ে দেয়া হয়।
মতিনের পিতার সরকারি চাকরি রক্ষার ভয় কাজ করে তাই বিয়েতে সম্মতি দিতে হয়।
পারভীনের পিতা সেদিনই কসম কাঁটে জীবনে আর কন্যার মুখ দর্শন করবে না, পারভীন যেন কোনদিনও আর ফিরে না যায় পিতার বাড়িতে, সম্পত্তিতেও যেন কোনদিন অধিকার না রাখে।
সব মেনে নেয়, মতিনের ভালবাসার কাছে সব তুচ্ছ।
অনেক পরে পিতার মৃত্যুশয্যায় দেখা করতে চেয়েছে কিন্ত ভাইয়েরা আর দেখা করতে দেয় না, সম্পত্তিরও কোন অংশ দেয়নি ওকে।
পারভীনও কোনদিন কোনকিছুতে লোভ করেনি দাবি করেনি।
মতিনের পিতা যা দিয়ে গেছে সেটুকুই নেড়েচেড়ে বড় করেছে।
পারভীনের লেখাপড়া আর হয়নি তাতেও আফসোস নেই।
শুধু মতিনের ভালবাসা ওকে সবসময় ভরে রেখেছে।
জগতের সকল কিছু তুচ্ছ করে মতিনের ভালবাসার কাছে আত্মসমর্পন করে আনন্দে।
দিন কেটে গেছে দিনের মত।
পারভীন মতিনের ভালবাসার সংসারে এসেছে দুই ছেলেমেয়ে।
চলে গেছে মাতৃময়ী শাশুড়ী পিতার স্নেহদানকারী শশুর ।
যোগ হয় পুত্রবধূ কন্যা জামাতা,
পারভীনের ভরভরান্ত সংসার।
এতোদিনেও একটুকু মালিন্য হয় নাই মতিনের ভালবাসা, পারভীনের ভালবাসার পাত্র উপচে পড়ে।
একদিন বলা নেই কওয়া নেই মতিন ধুম করে চলে গেল,
বেদিশা পারভীন বুঝতেও পারলো না কার কাছে রেখে গেল মতিনের ভালবাসার পারভীনকে।
শুধু বুঝতে পারে ওর যা হারিয়ে যাওয়ার তা আর কোনদিন পূর্ণ হবে না।
সম্পত্তি ভাগাভাগি করতে বসে পারভীনের ছেলে ।
ও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, কি ভাগাভাগি করতে চায় ছেলে। ওর মাত্র অংশ দু' আনি।
কি ফেলে এসেছে এই সংসারে ও। কত পরিশ্রম করে গড়ে তুলেছে এই সংসার ও। আর আজকে ছেলের কাছ থেকে ভগ্নাংশ নিতে হচ্ছে ওকে।
দেবর ননদরাও আসে শালিসে। তাদের এককথা, যতদিন ভাবী বেঁচে আছে ততোদিন কোন ভাগাভাগি নয়,
মনটা খিঁচে যায় পারভীনের , ছেলের সাথে সম্পদের ভাগ!
সব ছেড়ে দেয় ও। নিচতলার একপাশে নিজের সংসার গুটিয়ে বসে।
প্রতিদিন সকালে সামনের বকুল গাছটার নিচে চেয়ার পেতে বসে থাকে। ঝুরঝুর করে ফুল পড়ে। কখনও মাথায় কখনো কাপড় কখনো শরীরে।
পুরো জায়গা জুড়ে সুবাস ছড়িয়ে থাকে।
একদিন সকালে দেখে গাছ কাটার লোক এসেছে।
পারভীন এসে দাঁড়ায়, ওদের কাছে শুনতে পায় বাড়িটা ডেবলাপারের কাছে দিয়েছে। বিশতলা ভবন হবে।
আজকাল শহরে এতোবড় জায়গা নেইই। অনেকগুলো ফ্ল্যাট হবে।
বকুল গাছটা কেটে ফেলবে! এই গাছটা কিসের প্রতিক হয়ে আছে সেটা তো অজানা নয় ছেলের কাছে তাহলে!
সব তো ছেড়েই দিয়েছে পারভীন।
গাছটা গায়ে হাত বুলাতেই চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। বুকটা ফেটে যেতে চাইছে।
আস্তে আস্তে বের হয়ে সেই হাঁটছে এলোপাতাড়ি। এখন একটু সুস্থির হয়ে বসে।
বকুল গাছটা লাগিয়েছিল শাশুড়ী, ওপর যেদিন বিয়ে হয় সেদিন।
বলেছিল এটা তোদের ভালবাসার বৃক্ষ।
কাঁদছে পারভীন,
কোন সকালে বের হয়েছিল বাসা থেকে এখন সন্ধ্যাও মিশে গেছে রাতের গায়ে।
বাসার কাছে আসতেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। বৃক্ষহীন ফাঁকা জায়গাটার মতই শুন্য মনে হয় নিজেকে।
কাটা গাছের গুড়ির কাছে বসে পড়ে পারভীন।
ওর ভালবাসার বৃক্ষটি চিহ্ন আর নেই পৃথিবীতে মাটির গভীরের মোটা শেকড় জানান দিচ্ছে একদিন ছিল সে পৃথিবীতে আজ হেরে গেলে পুঁজিবাদের দাঁতাল সময়ের কাছে।
পারভীন মতিনকে প্রথম স্পর্শের মত করে পড়ে থাকা গুঁড়িটার ওপর হাত বুলায়।
ভালবাসা হারতে পারেনা কখনও হার মানবে না।
আস্তে আস্তে শুয়ে পড়ে।
পথচারীদের আওয়াজে বুঝতে পারে বাড়ির ভেতরের মানুষজন, কাটা গাছের কাছে অনেকক্ষণ ধরে পড়ে আছে পারভীনের প্রাণহীন শরীর....

 

রোকেয়া ইসলাম
কবি ও লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top