সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১

নিষিদ্ধ ডায়েরি: কাজী জাকির হাসান


প্রকাশিত:
৪ এপ্রিল ২০১৯ ১১:১০

আপডেট:
২৮ জুন ২০২১ ২০:৪১

 

ঘটনাটা ঘটে গেল ১৩৯৭ বাংলা সনের ৩০ আষাঢ় সন্ধ্যারাতে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় সন্ধ্যাবেলাকেই গভীর রাত বলে মনে হচ্ছে। ঝড়ো বাতাসের সংগে কখনো জোরে, কখনো-বা টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। বাইরে মাঝে মাঝে মেঘের কড় কড় গর্জন শোনা যাচ্ছে। ভেসে আসছে তিতপাল্লার ঝোপঝাড় ও আশেপাশের ডোবানাল থেকে ব্যাঙের একটানা ঘ্যাত-ঘুত শব্দ।

আবহাওয়ার কারনেই বাইরে কোথাও বেরুই নি, ঘরে বসে বই পত্র নাড়াচাড়া করছিলাম। এমন সময় বাইরের দরজায় মৃদু কড়া নাড়ার শব্দ পেলাম। শব্দ তো এমন হরহামেশা কতই হচ্ছে, ফকির-মিসকিনের অত্যাচার, পাড়ার ছেলে ছোকরাদের বেয়াড়াপনা কিংবা বাতাসের কারনে কড়া নড়ছে ভেবে আমল দিলাম না কোনো। কিন্তু কিছুক্ষন বাদেই পূর্বের তুলনায় আরেকটু জোরে হাত দিয়ে দরোজায় আঘাত করার শব্দ হলো। অগত্যা উঠতে হলো। দরোজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কে?
আমি। মৃদু কন্ঠে উত্তর এলো।
 আমি কে?
আমি ।
এরপর বোধ করি দরোজা না খুলে কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক নয়। অতঃপর দরোজা খুললাম।
 কাকে চান আপনি?
জি !
কত নম্বর খুঁজছেন?
আপনি নিশ্চয়?
আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।
 বহুদূর থেকে এসেছি। একটু বসবো আমি।
দরোজার এক পাশে সরে দাঁড়ালাম। আগন্তুক দ্বিধাহীনভাবে ঘরে ঢুকে সোফায় গিয়ে বসে পড়লেন। দরোজা বন্ধ করে আমিও এসে বসলাম তাঁর মুখোমুখি।

লম্বায় ছয় ফুটের মতন। হালকা-পাতলা গড়ন। চোয়াল দুটো ফোলা সুপুরির মতো। ক্লিন শেভ। কিন্তু তবুও যেন মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ ফুটে উঠেছে। কটা চোখে ঝাঁকড়া চুলের ভেতর দিয়ে পলকহীন দৃষ্টিতে আগন্তুক চেয়ে রয়েছেন আমার দিকে। মনে হল, বাইরের পরিবেশটা মুহূর্তেই যেন ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে। অস্বস্তিবোধ হতে লাগলো। হাঁসফাঁস করতে লাগলাম এই ভেবে কে জানে আবার কোন ফ্যাসাদে জড়িয়ে ফেললাম নিজেকে। এমনিতেই নানান যন্ত্রনায় জ্বলে মরছি মাস কয়েক ধরে। নিজের থেকে কিছু জিগ্যেস করতেও মন উঠছে না, সুযোগ বুঝে যুত করে যদি জেঁকে বসেন।
যাই ভাবুন, কথা শেষ না করে উঠছি না আজ।
ধক করে উঠলো বুকের ভেতরটা। বলে কি! ভ্রু কুঁচকে তাকালাম আগন্তুকের দিকে। তেমনি নির্বিকার। শব্দ উচ্চারনের ভংগিতে দৃঢ়তা স্পষ্ট। আমি তাড়াবার জন্য যতটা উচ্চকিত উনি বসবার ভংগিতে ততটা শান্ত। তাঁর এই গায়েপড়া ভাব এবং অযাচিত অতিথি সাজবার বেহায়পনায় মনে মনে বিরক্ত হয়ে উঠলাম।
কি জানেন, উনিশ বছর খুঁজে আপনাকে আজ পেয়েছি। তাড়িয়ে দিলে কি যাবো ভাবছেন?
উনিশ বছর! বলেন কি?
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। ঠাওর করতে পারলাম না ভদ্রলোক বলছেন কি। উনিশ বছর ধরে তিনি আমাকে খুঁজবেন কেন? মাথা খারাপ নাকি? ভুল করে আবার পালিয়ে-টালিয়ে আসে নি তো কোথা থেকে। কিন্তু আমার নামটা তো ঠিক ঠিক বললো, কেমন যেন সব তাল গোল পাকিয়ে গেল। মাথা ঝিম ঝিম করে গা গুলিয়ে উঠতে লাগলো বারবার।
অনেক কষ্টে মেকু ভাইয়ের কাছ থেকে ঠিকানাটা যোগাড় করেছি আপনার।

ছলাত্‌ করে বুকের ভিতর হঠাত্‌ রক্তের ঢেউ খেলে গেল। মেকু ভাই? হ্যা, জীবনে একজন মেকু ভাইকেই চিনি আমি। মাত্তর একজন মেকু ভাই। একাত্তর সালের মেকু ভাই, স্বাধীনতা সংগ্রামের মেকু ভাই। পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী, মোগলহাট, লালমনিরহাট অপারেশনের পথ প্রদর্শক (গাইড) অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা মেকু ভাই। স্বাধীনতা-পরবর্তী জীবনযুদ্ধে পর্যুদস্ত মেকু ভাই। চাকরি জীবনে ষড়যন্ত্রের শিকার মেকু ভাই। সেই মেকু ভাই যিনি মলিন বেশে একবার একটা মোটা ফাইল হাতে এসেছিলেন আমার কাছে, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের টাকা চাইতে।

টানটান হয়ে গেল শিরদাঁড়া। সিনেমার পর্দার মতো চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়ংকর দিনগুলো। যতই মনকে বোঝাতে চাই এটা ১৯৯০, মন ততই বিদ্রোহী হয়ে ওঠে বলে, না এটাই ১৯৭১-একাত্তর-একাত্তর।

সচল হয় অনুভুতি। কন্ঠ হয় বাকরুদ্ধ। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে কান্নায়। সেই অন্ধকারে হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে মেলাতে চেষ্টা করি সময়টাকে, কিন্তু পারি না মেলাতে। অসহায় আক্রোশে তখন চিৎকার করে সামনে বসে থাকা ভদ্রলোককে জিগ্যেস করি, ‘কে আপনি?’
মেকু ভাইয়ের মুখ থেকেই শুনেছি সব, আমার ভাইয়ের ঘনিষ্ট বন্ধু নাকি আপনিই ছিলেন।
তখন আমরা সবাই সবার বন্ধু। সবাই সবার আত্মীয় ছিলাম।
তবুও ঘনিষ্ঠতম বন্ধু বলতে যা বোঝায় সে নাকি আপনিই ছিলেন।
 বেঁচে আছে না, মরেছে?
শহীদ হয়েছে।
কোচবিহারে ছিল কি?
 আপনার পাশের বেডে ছিল।

সচকিত হয়ে উঠলাম। তাকিয়ে থেকে চিনতে চেষ্টা করলাম ভদ্রলোককে। উনিশ বছর আগের স্মৃতিতো। আবছা আবছা মনে পড়তে লাগলো। একজন লোক হরলিক্সের বোতল হাতে কোচবিহার হাসপাতালে এসেছিলেন আমার আহত বন্ধুকে দেখতে, কিন্তু দেখা হয় নি। তাঁর আগেই মারা গেছে সে। তখন লোকটি হরলিক্সের বোতলটা আমার বিছানার পাশে রেখে অশ্রুসিক্ত চোখে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলেছিলেন, ‘এটা তুমি খেয়ে নিও ভাই’।
তা এতদিন পর হঠাত্‌ কি মনে করে? 
বলছি তো ভাই উনিশ বছর ধরে খুঁজছি আপনাকে।
আমাকে খুঁজছেন!
উনিশ বছরে মানুষ কত কিছু তো ভুলে গেছে, আর এই ভদ্রলোক হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরছেন আমাকেই, কেন? কি উদ্দেশ্যে?
আমি জানি, একমাত্র আপনিই আমার ভাইয়ের মৃত্যুর সময় পাশে ছিলেন। তাঁর শেষ কথা কি ছিল, সে শুধু আপনিই বলতে পারবেন।
আমি তখন ঘুমিয়ে ছিলাম।
 বাবার খুব আগ্রহ ছিল, তাঁর ছেলের শেষ কথাটা শোনার কিন্তু পারলেন না শুনে যেতে। গত বছর ইন্তেকাল করেছেন।
আমি দুঃখিত—
কিন্তু আমার মা এখনো বেঁচে আছেন।
বিশ্বাস করুন, আমি কিছু জানি না।
কিন্তু একটা বিষয় আমরা জেনেছি, মেকু ভাই বলেছেন, আমার ভাইয়ের একটা ডায়েরি নাকি আছে আপনার কাছে।

ডায়েরি? হ্যাঁ তাইতো, সবুজ রেক্সিনের মোড়কে ঢাকা একটি খাতার কথা মনে পড়ে গেল আমার। মাঝে একবার ঝাড়পোঁছ করার সময় খাতাটা সযত্নে তুলে রেখেছিলাম, কিন্তু খুলে পড়ে দেখি নি একবারও কি লেখা আছে তাতে। কেন এত বছরেও খাতাটা খুলে দেখলাম না একবারও? এটা কি বন্ধুর প্রতি বিশ্বস্ততা? নাকি অশ্রদ্ধা? এমন কোনো কথা কি সে বলেছিল আমাকে, যার জন্য এতদিনেও কখনো খুলে পড়ি নি। বুকের ব্যথাটা হঠাত্‌ চনচন করে উঠলো। উঠে দাঁড়ালাম। ডায়েরিটা আনতে গেলাম ভেতরের ঘরে। খুঁজে পেতে সময় লাগলো অনেক। হাতে নিয়ে বসলাম ভদ্রলোকের সামনে।
যতদূর মনে পড়ে, এটা আপনাদেরকে দেয়ার কথা কিছু বলে নি সে আমাকে।
 বললেও তাই কি নিতাম কখনো। হা হা করে উঠলেন ভদ্রলোক।
শুধু জানতে এসেছি কি লেখা আছে তাতে।

ডায়েরির প্রথম পাতা উলটালাম। দ্বিতীয়-তৃতীয়-চতুর্থ-পঞ্চম একে একে সব পাতাই পড়ে শেষ করলাম দ্রুত নিশ্বাসে। হাত দুটো অবশ হয়ে এলো, শরীর ঘেমে শ্বাস পড়তে লাগল জোরে জোরে, ভেতরটা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠলো। ভদ্রলোক বুঝতে পারলেন আমার অবস্থা। কপালে হাত দিয়ে বললেন, ‘খারাপ লাগছে’? উত্তর দেয়ার ইচ্ছে হলো না কোনো। চেয়ারে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে রইলাম কিছুক্ষন? মনে হলো এ চোখ যেন আর কোনোদিন খুলতে না হয়, আর কাউকে যেন কিছু বলতে না হয় আমাকে।
 কি পড়লেন?

সংবিৎ ফিরে পেলাম। অপারেশনের রোগীর মত অত্যন্ত সন্তপর্ণে চোখ খুলে তাকালাম। ভদ্রলোক উদগ্র আগ্রহ নিয়ে ঝুঁকে পড়লেন আমার দিকে। টকটক হয়ে উঠলো মুখ, থুতু উঠে আসতে লাগলো। পৃথিবীর সব কিছু বিস্বাদ ঠেকতে লাগল আমার কাছে। চোখের সামনে কাফনের কাপড়ে ঢাকা বন্ধুর লাশ বেরিয়ে যেতে দেখলাম হাসপাতালের দরোজা দিয়ে। বাইরে হাজারো জনতার ভিড় মুক্তিযোদ্ধাকে এক নজর দেখার জন্য। বন্ধুর মুখে রাতের সেই হাসি যেন লেগে রয়েছে তখনো। তৃপ্তির হাসি। এ তৃপ্তি কিসের? কি বুঝিয়ে গেল সে?

উসখুস করে উঠলেন ভদ্রলোক। গলা খাঁকারি দিতে লাগলেন অযথা। আমি শান্ত চোখে তাকালাম তাঁর দিকে। বললাম,- ‘ডায়েরিতে লেখা ওর একটা কথাই শুধু আপনাকে জানাতে পারি’।
 আমিতো তাই জানতে চাইছি।
উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন ভদ্রলোক।
এটা তাঁর শেষ কথা কিনা বলতে পারব না। সে লিখেছে, ‘যেদিন তোমাদের থেকে ’৭১ বিস্মৃত হবে, শুধু সেই দিনই এই ডায়েরির পাতা উল্টাবে’।

ভীষন দমে গেলেন ভদ্রলোক। পাংশু মুখে আমার দিকে একবার তাকিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন ধীরে ধীরে। আমি উঠে দরোজা বন্ধ করার কোন তাগিদ অনুভব করলাম না। বাতাসে বৃষ্টির ঝাপটা আসতে লাগলো ঘরে। ডায়েরিটা তখনো আমার হাতে ধরা। আরেকবার চোখ বুলালাম ভাল করে, - না কিছুই লেখা ছিল না সে ডায়েরিতে, প্রতি পাতায় ছিল শুধু রক্তের দাগ।

 

কাজী জাকির হাসান
কথা সাহিত্যিক, নাট্য ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতা পুরুষ্কার প্রাপ্ত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top