সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

লয়: কেতন শেখ


প্রকাশিত:
৩০ এপ্রিল ২০১৯ ১৫:২১

আপডেট:
৪ মে ২০২০ ১৩:২৩

 

ভাদ্র মাসের দুপুর। অস্হির গরম।

অর্ণব শার্টের হাতায় মুখ মুছলো। ওর শার্টের রঙ গাঢ় নীল। গাঢ় রঙের শার্টের কারণে হাতায় ঘামের দাগ পড়েনি। ঢাকার গরমে বাতাসে শুধু জলীয় বাষ্প না, কয়েক টন নাগরিক ময়লাও ভাসে। বাতাসে ভাসা ময়লা শরীরের ভেতরে ঢুকে কালো রঙের ঘাম হয়ে বের হচ্ছে। রোদে শরীরের চামড়া তো পুড়ছেই, সাথে খুব সম্ভবত গলে যাচ্ছে ভেতরের নাড়িভুড়ি, যকৃত ইত্যাদি। সেগুলো গলে যাওয়ায় হয় তো নিকোটিন আর রাজ্যের ভেজাল মিশছে ঘামের সাথে। মিনিটে মিনিটে সেই ঘাম মুছতে হচ্ছে। সকাল নয়টায় অর্ণব পকেটে ধোয়া রুমাল নিয়ে বের হয়েছিলো। তিন ঘন্টায় সাদা রঙের সেই রুমাল এখন আর খয়েরিও না, একেবারে কালো।

রুবার সামনে ময়লা রুমাল বের করা যাবে না। ময়লা রুমাল, কুঁচকানো শার্ট, নোংরা মোজা বা ছেঁড়া স্যান্ডেল রুবা সহ্য করতে পারে না। সে নিজে আসে ঝকঝকে তকতকে অবস্হায়। তার বাসা এখান থেকে অল্প দূরে, পলাশীর কাছে। সে আসবে রিকশাতে। অর্ণবের সাথে দেখা করার আগে পনেরো বিশ মিনিটের বেশী তাকে কখনোই পথে থাকতে হয় না। কিন্তু অর্ণবকে আসতে হয় বাড্ডা থেকে, দুইবার বাস বদল করে। বাসা থেকে যতোই ঠিকঠাক হয়ে বের হওয়া হয়, বাসের ধস্তাধস্তি আর বাতাসে ভাসা ময়লায় সব বরবাদ হয়ে যায়। অর্ণবের বরবাদ অবস্হা দেখলে রুবা বেশীক্ষণ থাকে না। একটু খুঁত ধরা পড়লেই সে বকাঝকা শুরু করে, আর যাই যাই করতে থাকে। বাস বা বাতাসের ময়লার কথা বলে তাকে তখন আর কিছু বুঝানো যায় না।

অর্ণব যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে শহরের বাকি অংশের তুলনায় গরম কম হওয়ার কথা। কার্জন হলের এই জায়গাটা ছায়াঘেরা, চারপাশে গাছগাছালি। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যানবাহনের গরমটা কম। গাছপালার কারণেও হয় তো কিছুটা ছায়ার আরাম পাওয়া যায়। কিন্তু অর্ণবের এখানেও অনেক গরম লাগছে। ওর মনে হচ্ছে গরমের কারণে কিছুক্ষণের মধ্যেই ও জ্ঞান হারাবে।

রুবা আসবে আরো মিনিট দশেক পরে। মুখ মুছতে দেখলেই রুমালের কথা জিজ্ঞেস করবে। এরপর তার চোখে পড়বে স্যান্ডেল। মহাখালীতে বাস বদল করতে গিয়ে অর্ণবের স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে গেছে। স্হূলকায়া এক লোক ধপ করে পা মাড়িয়ে বাসে উঠে গেলো, আর তখনই তার পায়ের নীচে পড়ে অর্ণবের স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়লো। লোকটার পায়ের ওজন আঠারো-বিশ কেজি হওয়ার কথা। কিন্তু পায়ের চাপে ব্যথা পাওয়ার চেয়ে স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে যাওয়ার দুঃখে অর্ণব রীতিমতো মুষড়ে পড়লো। মুচির দোকানে এই ফিতা সহজেই ঠিক করা যায়, কিন্তু হাতে সময় খুবই কম। ছেঁড়া ফিতার স্যান্ডেল নিয়েই এখানে আসতে হয়েছে। 

রুমাল আর স্যান্ডেলের কারণে রুবা আজকে ক্ষেপবেই। আজকেও রাগারাগি করে চলে যাবে। আজকেও ওদের মধ্যে প্রেমের কোনো কথা হবে না। রুবা একগাদা কথা শোনাবে, আর সেসব অর্ণবকে চুপচাপ শুনতে হবে।

অর্ণবের ধারণা এসব অস্হিরতার কারণে কার্জন হলের এই ছায়াঘেরা পরিবেশেও ওর এতো বেশী গরম লাগছে। তার মানে জ্ঞান হারানোর সম্ভাবনাটা শুধু গরমের কারণেই না, রুবার রাগ করার ভয়ের কারণেও। রুবার রাগ ভাঙানো জটিল একটা প্রক্রিয়া। একবার তার রাগ উঠলে সহজে সেই রাগ ভাঙে না। কি করলে সেই রাগ ভাঙবে সেটাও অনিশ্চিত। রুবার আচরণে মাঝে মাঝে মনে হয় রাগ করা আর রাগ পোষার জন্য সে তৈরীই থাকে। যে কোনো সামান্য কারণে সে চট করে রেগে যায়। এরপর যতোদিন ইচ্ছে সেই রাগ পুষে রাখে। পোষা সেই রাগ ভাঙানোর জন্য তাকে দিনে কয়েকবার ফোন করতে হয়। তার মনের মতো করে কথাও বলতে হয়।

অর্ণবের বাসায় ফোন নেই। ফোন করার জন্য ওকে নীচতলার ফ্ল্যাটে বা দোকানে যেতে হয়। সেসব জায়গা থেকে শান্তিমতো কথা বলা যায় না। কিন্তু রুবার পোষা রাগ ভাঙানোর জন্য ঐসব জায়গাতেই অর্ণবকে কবিতা আবৃত্তি করতে হয়, প্রেমের ভাবাবেগ মাখা কথাবার্তা বলতে হয়। মাঝে মাঝে গানও গাইতে হয়। নীচতলার ফ্ল্যাটে এসব করা চরম অপমানের। ঐ বাসায় তিনটা অল্পবয়সী মেয়ে। অর্ণব ফোনে কথা বলতে এলেই তারা আশেপাশে ঘুরঘুর করে আর খিকখিক করে হাসে। আর দোকানে গেলে আছে বজলু মামার দার্শনিক লেকচার। বজলু মামা মন দিয়ে সব কাস্টমারের ফোনের কথাবার্তা শোনেন, এবং ফোন রাখার পরে সবাইকে একটা দার্শনিক লেকচার দেন। সেই লেকচারের বিষয়বস্তু হচ্ছে প্রেম, এবং মরাল হচ্ছে প্রেম মানেই পুরুষের চাকরামীর শুরু।

রুবা রিকশা থেকে নেমে হেঁটে আসছে। অন্যান্য দিনের মতো তাকে ঝকঝকে তকতকে লাগছে না। দেখে মনে হচ্ছে তাড়াহুড়ো করে তৈরী হয়ে এসেছে। কামিজ ঠিকমতো ইস্ত্রী করা হয়নি। মাথায় ওড়না। তার মানে চুলও ঠিকমতো বাঁধেনি। চেহারায় ঘুমহীনতার ক্লান্তির ছাপ। হাঁটার ভঙ্গিতেও অবসাদ। অর্ণবের কাছাকাছি আসতেই রুবা ওর দিকে তাকিয়ে অল্প হাসলো। হালকা স্বরে বললো, সরি, দেরী হয়ে গেলো।

নাহ দেরী হয়নি। তুমি কেমন আছো ?

রুবা কিছু বললো না। ক্লান্ত ভঙ্গিতে দালানের সাথে বাঁধানো সিমেন্টের বেদীতে বসলো। অর্ণবের দুশ্চিন্তা হচ্ছে। রুবার এই ক্লান্তি ওর পরিচিত না। বসার এই ভঙ্গি, এই চুপচাপ শান্ত অবয়ব, অযত্নে পরা পোশাক, সাজসজ্জার অবহেলা ওর চেনা রুবার না। অর্ণব রুবার পাশে বসলো। নরম স্বরে বললো, কি হয়েছে ? তোমাকে এতো ক্লান্ত লাগছে কেন ?

ক্লান্ত তোমাকেও লাগছে। নিশ্চই নাস্তা না করে বাসা থেকে বেরিয়েছো !

নাস্তা করেছি। তোমাকে এরকম লাগছে কেন ? কি হয়েছে ?

রুবা দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। নীচের ঠোঁট কামড়ে বড় করে নিশ্বাস নিলো। অর্ণবের অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। যতোই রাগ করুক বা ঝগড়া করুক, রুবাকে সেভাবেই ওর ভালো লাগে। সেভাবে রুবাকে দেখলেই ওর স্বস্তিবোধ হয়। আজকের রুবার মধ্যে সেসবের ছিটেফোঁটাও নেই। অর্ণব চিন্তিত স্বরে বললো, প্লিজ বলো তোমার কি হয়েছে। বাসায় সবাই ঠিক আছে তো ?

চারপাশের গরমের কিছুই এখন অর্ণবের ভাবনায় নেই। ওর দৃষ্টি রুবার দিকে। সেরকম না হলে হয় তো ও দেখতো হঠাত করেই রোদ হারিয়ে গেছে। ভাদ্র মাসের এই দুপুরে কোনোরকম ভূমিকা ছাড়াই আকাশে একদল কালো মেঘ এসে জায়গা করেছে। মেঘেদের আগমনে অবশ্য গরমের তেমন কোনো হেরফের হয়নি। বরং মেঘ এসে বাতাসকে ছুটি দিয়েছে। ওদের চারপাশে গাছের পাতারা নড়াচড়া বন্ধ করে নতুন কিছু একটা হওয়ার অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা অর্ণবের মনেও। ও অপেক্ষা করছে রুবার উত্তরের।

রুবা ওড়নাতে মুখ মুছলো। এরপর হালকা স্বরে বললো, আমি তোমার সাথে অনেক রাগ টাগ করি। তোমাকে কঠিন সব কথা বলি। তুমি নিশ্চই খুব কষ্ট পাও, তাই না ?

ঐসব কথা রাখো। তোমার কি হয়েছে বলো তো !

তুমি কি জানো, তোমার সাথে রাগ করে আমিও ভালো থাকি না ?

জানি। জানি বলেই তোমার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করি। যা যা তোমার ভালো লাগে সব করি।

তুমি অনেক ভালো, তাই এরকম করো। আমার জন্য আর কেউ এরকম করতো না।

অর্ণবের অস্হির লাগছে। চারদিকে কেমন একটা ভ্যাপসা গরম এখন। কিন্তু অর্ণবের অস্হিরতাটা গরমের কারণে না। রুবার কথাবার্তায় নিরাশা আর ক্লান্তির স্পষ্ট ছাপ। সেই ছাপ অর্ণবের মনের কোনো গহীনে আঘাত করছে। খোলা আকাশের নীচে রুবার হাত ধরলে সচরাচর সে বিরক্ত হয়। অর্ণব সেই বিরক্তির ভয় করলো না। রুবার হাত ধরে বললো, তোমার জন্য আর কেউ করবে কেন ? যা করার আমিই করবো। কি হয়েছে বলো তো ... হঠাত এসব কথা বলছো কেন ?

কখনও বলা হয় না, তাই।

বলতে হবে কেন ! ... এসব কথা বলার বা ভাবার কোনো দরকার নাই।

দরকার আছে। আমি তোমার সাথে অযথাই অনেক রাগ করি। ঝগড়া করে আমি আমাদের অনেক সময় নষ্ট করি। এসব করার পরে তুমি আমার রাগ ভাঙাও ... আমি কখনও তোমাকে সরিটাও বলি না।

অর্ণবের ইচ্ছে করছে রুবাকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিতে। বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতে, চুপ করো তো রুবা ... তোমার যতো ইচ্ছা রাগ করো, কিন্তু আমার সাথেই করো। আমাকে তোমার কখনও সরি বলতে হবে না। আমি সারাজীবন তোমার রাগ ভাঙাবো।

খোলা আকাশের নীচে বসে সেটা করা সম্ভব না। কিন্তু কথা বলা সম্ভব। অর্ণব রুবার হাতে দুই হাতই রাখলো। দৃঢ়স্বরে বললো, তোমার রাগ ভাঙাতে আমার অনেক ভালো লাগে। কারণ রাগ ভাঙানোর সময় আমার মনে হয় তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো। ভালোবাসো বলেই আমার সাথে রাগ করো, আর আমাকে রাগ ভাঙানোর সুযোগ করে দাও। তোমাকে সরি টরি বলতে হবে না ....

রুবা অর্ণবের চোখে চোখ রাখলো। সেই দৃষ্টিতে কি ছিলো অর্ণব জানে না। ও সবকিছু ভুলে রুবার গালে হাত রেখে হালকা স্বরে বললো, তুমি সারাজীবন আমার সাথে রাগ কোরো ... আমি সারাজীবন তোমার রাগ ভাঙাবো। ঐসবই আমাদের সময় ... ঐসব কোনো সময় নষ্ট করা না।

মেঘ ডাকছে। ভ্যাপসা গরমের অনেকটা এখন হঠাত করেই কমে গেছে। হালকা লয়ে একটা ভেজা বাতাস বইছে। খুব সম্ভবত বৃষ্টি হবে। ভাদ্র মাসে সচরাচর বৃষ্টি হয় না। আশ্বিনে হয় আচমকা ঝড়। এখনকার হালকা বাতাসে ঝড়ের কোনো হুমকি নেই। এই মুহূর্তে রুবা আর অর্ণব অবশ্য এসব কিছুই খেয়াল করছে না। দ্বিতীয়বার মেঘ ডাকতেই অর্ণব রুবার ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো। রুবা সেই  আবেশে চোখ বন্ধ করে হারানো স্বরে বললো, তুমি সারাজীবন আমাকে এভাবে ভালোবাসবে অর্ণব ?

হ্যাঁ। তোমার কি হয়েছে বলো তো ?

আমাকে আজকে সন্ধ্যায় দেখতে আসবে। কেন যেন মনে হচ্ছে শুধু দেখতে আসবে না, আজকে আমাকে বিয়ে দেয়া হবে। যে দেখতে আসবে তার সাথেই।

অর্ণব ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। রুবার গাল থেকে হাত নামিয়ে নিলো। এই মুহূর্তে কি বলা উচিত সেটা ও বুঝতে পারছে না। অনেকদিন থেকেই বিয়ের জন্য রুবার বাসা থেকে চাপ দেয়া হচ্ছে। গত তিন বছরে বেশ কয়েকবার রুবাকে বিয়ের জন্য দেখতে এসেছে কিছু পরিবার। অর্ণবের ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ভাইরা পর্যন্ত বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। সেসব নিয়ে রুবাকে কখনোই এতো চিন্তিত মনে হয়নি। বরং এসব বলার সময় সে খুব স্বাভাবিক অথচ দৃঢ় আচরণ করে। খুব সহজভাবে অর্ণবকে বলে, তুমি এতো ভয় পাচ্ছো কেন ? দেখতে আসছে মানে কি বিয়ে করে নিয়ে যাবে ? এতো সহজ ! আমি না করলে আমাকে কেউ বিয়ে করতে পারবে না। আমি তোমাকেই বিয়ে করবো। তুমি মাস্টার্স শেষ করো। এরপর বিসিএস দাও, বা ব্যাংকে জব নাও। তোমার জব হলেই আমরা বিয়ে করবো। তার আগে এসব চলতেই থাকবে। তোমাকে এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না ... আমি সামলাতে পারবো। 

রুবার বাসায় অর্ণবকে সবাই চেনে। অর্ণব যে রুবার পছন্দের, আর ওর সাথে যে রুবার নিয়মিত মেলামেশা আছে, সেসবের অনেকটাও বাসায় সবাই জানে। কিন্তু এসব জেনেও বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ভাবনা বা ছেলেপক্ষের দেখতে আসা কেউ বন্ধ করেনি। পরিবারের এই ব্যাপার নিয়েও রুবা এতোদিন খুব নিশ্চিন্ত ছিলো। আজকে রুবার সেই নিশ্চিন্ত নির্লিপ্ত ভাবের কিছুই নেই।

অর্ণব শার্টের হাতায় মুখ মুছে হালকা স্বরে বললো, আজকে যে দেখতে আসবে, সে-ই তোমাকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে কেন ? ... হঠাত এতো তাড়াহুড়া কেন করা হচ্ছে ?

রুবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, সম্বন্ধ ভালো। বাবা বলেছে এখানে আমাকে বিয়ে করতে হবে। এমন সম্বন্ধ নাকি জীবনে একটাই আসে। তিনি এই সম্বন্ধ হাতছাড়া করবেন না।

ওহ। আর তোমার মা ?

মা একই কথা বলেছে। সম্বন্ধ মায়ের দিক থেকেই এসেছে। ছেলে কানাডায় সেটেলড। এস্টাবলিশড। বাবা বলেছে এরকম বিয়ে নাকি লাইফ ইন্সুরেন্সের মতো। মা-বাবা কেউই এখানে আমার কোনো মতামত নিতে আগ্রহী না।

তার মানে তো বিয়ে আগেই ঠিক হয়ে আছে। আমার ধারণা ছেলে কালপরশু কানাডায় চলে যাবে, তাই আজকেই বিয়ে করতে আসছে। তোমাকে হয় তো আগেই দেখেছে।

রুবা বিরক্ত স্বরে বললো, আমি এসব জানি না। আমাকে এসব বলছো কেন ?

অর্ণব কিছু বললো না। আকাশের দিকে তাকালো। এখন বেশ ভালো বাতাস দিচ্ছে। বাতাসে শুধু গাছগাছালির পাতা না, ডালপালাও নড়া শুরু করেছে। বাতাসে ভেজা ভেজা স্পর্শ। হয় তো খুব কাছেই কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই বৃষ্টি এখানেও আসবে। আসুক। অর্ণবের অস্বস্তিবোধ কাটেনি। হয় তো বৃষ্টিতে ভিজলে মন শরীর দুটাই একসাথে শান্ত হবে। রুবা ক্লান্ত স্বরে বললো, কথা বলছো না কেন ? একটা কিছু বলো !

আমি কি বলবো বলো ? মনে হচ্ছে সবকিছু প্ল্যানমতো হচ্ছে। তোমার মা-বাবা চান তুমি এই ছেলেকে বিয়ে করো। হয় তো তারা চান আজকে রাতেই বিয়েটা হোক।

তারা কি চায় সেটা নিয়ে আমি ভাবছি না। তুমি কি চাও অর্ণব ?

অর্ণব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, তুমি কি চাও রুবা ?

রুবা কাঁপছে। কাঁপা কণ্ঠেই সে বললো, আমি কি চাই সেটা তুমি জানো অর্ণব। আমি তোমার সাথে সারাজীবন রাগ করতে চাই। আমি চাই তুমি সারাজীবন আমার রাগ ভাঙাও।

আমার অবস্হা তুমি জানো। তোমার মা-বাবাও জানেন। তাঁরা অপেক্ষা করেছেন। কিন্তু এখন মনে হয় না তাঁরা আর অপেক্ষা করবেন। তাই তুমি আমি কি চাই সেটা এখন আর গুরুত্বপূর্ণ না।

আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তুমি আমি কি চাই সেটাই আমার কাছে জীবন। আমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাই না অর্ণব।

অর্ণব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই রুবা। তোমার সাথে আমি বুড়ো হতে চাই। সারাজীবন তোমার রাগ ভাঙাতে চাই ... তোমার জন্য কবিতা আবৃত্তি করতে চাই, গান গাইতে চাই। কিন্তু আমার এখনকার অবস্হা তুমি জানো। এই মুহূর্তে আমি কি করতে পারি বলো ?

বাতাস বেড়েছে। মেঘ এখন আর ডাকছে না, গুরগুর শব্দ করছে। হয় তো কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি শুরু হবে। রুবার চোখে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। কান্না হয়ে কোনো অসহায় অভিমান গড়িয়ে পড়ছে। অভিমানের সেই অশ্রু অর্ণবের দৃষ্টি এড়ালো না। ও রুবার গালে হাত দিয়ে অশ্রু মুছে বললো, আমার বড় দুই বোনের বিয়ে হয়নি। নিজের পড়াশোনাও শেষ হয়নি এখনও। আমার বাবা ড্রাই ক্লিনিং-এর ব্যবসা করেন। পড়াশোনা আর তোমাকে সময় দেয়ার বাইরের সময়টা আমি তাঁর ব্যবসায় বসি। আমার জন্য তুমি অপেক্ষা করেছো ... কিন্তু তোমার মা-বাবা কেন করবেন বলো ? তাঁদের সামনে এখন কানাডায় সেটেলড এস্টাবলিশড ছেলের প্রস্তাব। তাঁরা তোমার সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য চেষ্টা করবেন। যে কোনো মা-বাবাই তা করবেন ...

আই ডোন্ট কেয়ার। সুনিশ্চিত ভবিষ্যত আমি চাই না। আমি তোমার সাথে ভবিষ্যত চাই। সেটা না চাইলে আমি এখানে আসতাম না। তোমার সাথে এতো কথা বলতাম না। তুমি প্লিজ একটা কিছু করো।

কি করবো বলো ? আমার কি করার আছে ?

রুবা উঠে দাঁড়ালো। খুব সহজ স্বরে বললো, আমার হাতে সময় নেই। বিপাশার বাসায় যাবো বলে বের হয়েছি। তোমার সাথে আজকে কেউ আমাকে দেখা করতে দেবে না, তাই। কিছুক্ষণের মধ্যে হয় তো বাসা থেকে বিপাশার বাসায় লোক পাঠাবে। আমাকে এখন যেতে হবে।

অর্ণব কি বলবে ভেবে পেলো না। মুখ তুলে রুবার দিকে তাকালো। বৃষ্টির প্রথম ফোটাটা তখনই ওর চোখে পড়লো। বাতাস এখন ঠান্ডা। ভাদ্র মাসের গরমের কোনো দুঃসহ ভাপ নেই। রুবা অর্ণবের দিকে তাকিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বললো, আজকে সন্ধ্যা সাতটার সময় আমি পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। আমি এক কাপড়ে আসবো। আমার হাতে বেশী সময় থাকবে না। কারণ আমাকে খুঁজতে লোক পাঠানো হবে। তুমি সাতটার সময় আমাকে পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে থেকে নিয়ে যাবে।

কোথায় নিয়ে যাবো ?

আমি জানি না কোথায়। আমি শুধু জানি আমি সন্ধ্যা সাতটার সময় সেখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। তখন থেকে আমার জীবন তোমার সাথে হবে। সেখানে আর কেউ থাকবে না। তুমি যেখানে নিয়ে যাও, আমি যাবো। যেভাবে রাখতে চাও, আমি থাকবো।

রুবা চলে যাওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টির ফোটা পড়া শুরু হয়েছে। অর্ণব উঠে দাঁড়ালো। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো রুবার দিকে। ওর বিস্ময় রুবার দৃষ্টি এড়ালো না। অর্ণবের হাতে হাত রেখে দৃঢ়স্বরে বললো, আমি তোমাকে ভালোবাসি অর্ণব। আজকে সন্ধ্যায় আমি তোমার জন্য সব ফেলে পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে চলে আসবো। তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।

অর্ণব তাকিয়ে আছে। রুবার হাঁটার ভঙ্গিতে এখন আর কোনো ক্লান্তি নেই। খুব সহজ সাবলীল ভঙ্গিতে হেঁটে রিকশায় উঠলো। দোয়েল চত্বরের পাশ দিয়ে ঘুরে সেই রিকশা শহীদ মিনারের দিকে যাচ্ছে। দৃষ্টি থেকে হারিয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত অর্ণব রিকশার দিকেই তাকিয়ে থাকলো। বৃষ্টি এখন পুরোদমেই হচ্ছে। অর্ণব বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলো। রুবা বলেছে সাতটার সময় সে অর্ণবের অপেক্ষা করবে। বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা অর্ণবকে দেখে যে কারও মনে হতে পারে, এই মানুষটাও কোনোকিছুর প্রতীক্ষায় আছে।

দিনটা হয় তো প্রতীক্ষারই ছিলো। এমনকি দুপুরের হঠাত আসা বৃষ্টিও হয় তো ছিলো কোনোকিছুর প্রতীক্ষায়। সন্ধ্যা পর্যন্ত অবিরাম বৃষ্টি হলো। সাড়ে ছয়টার সময় অর্ণব যখন পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে এসে দাঁড়ালো, তখনও ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে। অর্ণবের পকেটে তখন সতেরোশো টাকা, আর একটা বেনসন সিগারেট। ওর সাথে কেউ নেই। চারদিকে লোকজনের সান্ধ্যকালিন ব্যস্ততা। অনেকের হাতে ছাতা, বা মাথার উপরে ব্যাগ বা অন্যকিছু ধরা। এসবের মধ্যেও সেই ভিড়ের সব মুখ অর্ণবের দেখা হয়ে গেলো। চার ঘন্টা অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থেকেও অর্ণব সেখানে কোনো পরিচিত মুখ খুঁজে পেলো না।

রুবা সেদিন পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে আসেনি। দুপুরের বৃষ্টিটা শেষ পর্যন্ত থামলো রাত সাড়ে দশটায়। চার ঘন্টা সেই বৃষ্টিতে ভিজে অর্ণব রুবার জন্য অপেক্ষা করেছিলো। সেই চার ঘন্টায় ও মনে মনে রুবার সাথে অনেক কথা বলেছে। সেসব কথা কখনও রুবাকে বলার সুযোগ হয়নি। কয়েকবার ভেবেছিলো রুবার বাসায় যাবে কি না। কিন্তু বারবার মনে হয়েছে যদি ও সেখানে যায়, আর ঠিক তখনই রুবা এখানে এসে ওকে না পায়, তাহলে কি হবে। শাহবাগের কোনো দোকান থেকে ফোনও করা যেতো। কিন্তু অর্ণবের মনে সেই একটাই ভয় ছিলো। বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত ও পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে থেকে কোথাও যায়নি। এক বুক আশা নিয়ে রুবার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলো।

পরদিন থেকে রুবার বাসায় ফোন করে কারও সাথে কথা বলা যায়নি। রুবা ফোন ধরেনি। অন্য যে ফোন ধরেছে সে-ই অর্ণবকে ফোন করতে মানা করেছে। তৃতীয় দিন থেকে অর্ণবের কণ্ঠস্বর শুনে ফোন রেখে দেয়াও শুরু হলো। কিছুদিন পর বন্ধুদের থেকে অর্ণব জানতে পারলো যে সেই সন্ধ্যায় রুবার আকদ হয়ে গিয়েছিলো। বিয়ের সাতদিনের মাথায় রুবা স্বামীর সাথে কানাডা চলে যায়। যাওয়ার আগে বেশ ঘটা করে গায়ে হলুদ, বিয়ে আর বৌভাতের অনুষ্ঠান হয়েছে। সেসব অনুষ্ঠানে রুবার বন্ধুবান্ধব সবাই গিয়েছিলো।

এতোকিছুর পরেও অর্ণবের কেন যেন মনে হয় কোনো এক বুধবারে সন্ধ্যা সাতটার সময় পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে ওর সাথে দেখা করতে রুবা আসবে। সেই সন্ধ্যার পরে রুবার সাথে অর্ণবের কখনও কথা হয়নি। রুবা অর্ণবকে অপেক্ষা করতে বলেছিলো। ভালোবাসার কথা বলেছিলো। এসব কথা মিথ্যে হতে পারে না। রুবা অর্ণবকে মিথ্যে বলতে পারে না। কেন রুবা সেদিন আসেনি, সেটা অর্ণবের অজানা। ওর মনে হয় জীবনের কোনো একটা বুধবারে সন্ধ্যা সাতটায় পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে সেই কারণটা বলার জন্য রুবা আসবে। অর্ণবকে খুঁজবে।

এসব ঘটনার পর বহু বছর পার হয়ে গেছে। অর্ণবের জীবন আট-দশটা সাধারণ মানুষের জীবনের মতোই কেটেছে এই শহরে। কিন্তু প্রায়ই বুধবার সন্ধ্যা সাতটার সময় অর্ণব পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে চলে যায়। সেখানে চায়ের দোকানে বসে ঘন্টাখানেক রুবার জন্য অপেক্ষা করে। অর্ণবের এই অপেক্ষার কথা অবশ্য ওর পরিচিতরা কেউ জানে না। কিন্তু অনেকেই জানে যে মাঝে মাঝে বুধবার সন্ধ্যায় অর্ণব সেখানে গিয়ে খোলা রাস্তার টং দোকানের বেন্চে বসে দুই কাপ চা খায়।

আনিস চৌধুরী তাঁর হাতের কাগজগুলো টেবিলে রাখলেন। ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এর ক্লাসে তিনি তাঁর লেখা একটা গল্পের খসড়া পড়ে শোনাচ্ছিলেন। তার সামনে এই ক্লাসের চারজন ছাত্রছাত্রী। এরা ঝকঝকে দৃষ্টি মেলে আবিষ্ট হয়ে তার পড়া গল্পটা শুনছিলো। এদের চাহনিতে বাইশ বছর বয়সের অকপট মুগ্ধতা। আনিস চৌধুরী কিছুক্ষণ সেই মুগ্ধতা উপভোগ করলেন। এরপর অল্প হেসে বললেন, এটা ছিলো আমাদের আজকের গল্প। আমি চাই তোমরা এই গল্প সম্পর্কে তোমাদের মতামত কালকের ক্লাসে আলোচনা করবে ...

তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই রুবেল ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো, স্যার আমি কিছু বলতে চাই।

এখনই ! তোমরা আগে গল্পটা পড়ো, এরপর সেটা নিয়ে ভাবো। এরপর কালকে বোলো।

স্যার আমার একটা প্রশ্ন আছে। গল্পটার পটভূমি কখনকার ?

১৯৯২। আমার ধারণা মন দিয়ে গল্পটা শুনলে সেটা যে কেউ বুঝতে পারবে।

জি স্যার, সেটা আন্দাজ করেছি। কিন্তু সেই সময়েও কারও বাসায় ফোন ছিলো না, এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। মোবাইল কি ছিলোই না ?

নাহ, মোবাইল ছিলো না। আর তখন অনেকের বাসায়ও ফোন ছিলো না। শুধু টিএন্ডটি লাইনের ফোন ছিলো। কিন্তু সবাই সেই ফোন ঘরে রাখতো না। ফোনের খরচ ছিলো, যেটা অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার নিতে পারতো না।

আনিস চৌধুরীর ঠিক সামনে বসা আনিকা উশখুস করছে। হয় তো সে-ও কিছু বলতে চায়। তিনি আনিকার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কিছু বলতে চাও আনিকা ?

স্যার গল্পটা খুব স্যাড। আমার গল্পটার শেষ ভালো লাগেনি। আমি জানি এটা আপনার লেখা, কিন্তু সরি স্যার ... আমার ফিনিশিং ভালো লাগেনি।

কেন ভালো লাগেনি ?

স্যার গল্পের রুবা চরিত্রটা খুব দুর্বল। এতো দুর্বল চরিত্রের একটা মেয়েকে অর্ণব কেন এতো ভালোবাসে সেটা আমি বুঝতে পারিনি। অর্ণব এখনও মেয়েটার অপেক্ষায় পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। এটা স্যার এ্যাবসার্ড। অর্ণবের মুভ অন করা উচিত ছিলো। গল্পের শেষে সেরকম কিছু থাকা উচিত যেন সবাই হতাশ না হয়। শেষটায় অর্ণবের পরিণতি খুবই হতাশার। রুবার মতো একটা দুর্বলচিত্তের মেয়ের ভালোবাসায় অর্ণবের আটকে থাকার কোনো কারণ আমি পাইনি। সরি স্যার।

আনিস চৌধুরী অল্প হাসলেন। আনিকার মন্তব্যের উত্তরে কিছু বললেন না। কথা বললো আনিকার পাশে বসা ফয়সল। গম্ভীর স্বরে বললো, স্যার আমি আনিকার সাথে একমত। গল্পটা ফ্যাব, কিন্তু শেষটা একটু সেকেলে। যেই মেয়ে প্রতিশ্রুতি করেও আসে না, আর বিয়ে করে কানাডা চলে যায়, তার জন্য জীবনভর পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে অপেক্ষা করার কোনো মানে নাই। অর্ণব মাস্ট মুভ অন। তার উচিত রুবাকে পুরোপুরি ভুলে যাওয়া, এবং আরেকটা মেয়েকে ভালোবেসে তাকে বিয়ে করে সেটেল হওয়া। সেরকম কিছু কথা দিয়ে ফিনিশিং হলে ভালো হতো। সবাই বুঝতো যে রুবা কতো বড় ভুল করেছে। এমনকি রুবাও জানতো। সেরকম হলে দারুণ হতো স্যার।

অর্ণব মুভ অন করলে সেটা রুবা কিভাবে জানতো ?

জানতো স্যার। এখন সোশাল মিডিয়ার যুগ, সবাই সবাইকে খুঁজে বের করতে পারে। অর্ণবের সুখি পরিবারের ছবি দেখলে রুবা তার ভুল বুঝতে পারতো, এবং সে রিগ্রেট করতো।

আনিকা সাথেসাথে বললো,  আর স্যার, আমি আরেকটু এ্যাড করি ... গল্পে অর্ণবকেও আমার বেশ দুর্বল মনে হয়েছে। রুবা কখনোই তার সাথে ভালো ব্যবহার করেনি। তারপরও সে রুবার রাগ ভাঙাতো। এই কনসেপ্ট এখন খুবই অবাস্তব স্যার।

আনিস চৌধুরী আনিকার দিকে তাকিয়ে হালকা স্বরে বললেন, অবাস্তব কেন ?

স্যার, এখন কারও রাগ ভাঙানোর এতো সময় কারও নাই। গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ড রাগ দেখালে এখন কেউ সেই রাগ ভাঙায় না, কুল অফ টাইম নেয়। এখন সবার অনেক বন্ধু। কুল অফ টাইমে তাদের সাথে কথাবার্তা বলা যায়। নতুন নতুন অভিজ্ঞতা এক্সপ্লোর করা যায়। এখন যে রাগ করে সে নিজেই পরে মিটমাট করে। স্যার আমার বয়ফ্রেন্ড এরকম রাগ করলে তো আমি কখনোই তার রাগ ভাঙাতাম না। প্রথম কথা হলো রাগ করবে কেন !

কারেক্ট স্যার ... আমার গার্লফ্রেন্ড এরকম খামাখা রাগ দেখালে আমিও তাকে এভয়েড করতাম। কিছুদিন তার সাথে যোগাযোগ না করলে সে নিজেই এসে সরি বলতো ...

আর স্যার, সম্পর্কে একজন সারাজীবন রাগ করবে, আর আরেকজন সারাজীবন সেই রাগ ভাঙাবে, এটা খুবই হাস্যকর। এরকম সম্পর্ক কখনোই খুব স্বস্তির না। আমার মনে হয় ফেয়ারও না। সম্পর্কে দুজনেরই সমান অধিকার এবং ডিগনিটি থাকতে হবে। হয় তো নব্বই দশকে এসব ধারণা ছিলো না, তাই এমন হতো। কিন্তু আপনিই বলেন ... সেটা কি কোনো ব্যালান্সড রিলেশনশিপ হতে পারে ?

আনিস চৌধুরী এবারও কোনো মন্তব্য করলেন না। ঘড়ি দেখলেন। সন্ধ্যা ছয়টা তিন। ক্লাসের সময় শেষ হয়ে গেছে। তিনি চশমা খুলে সহজ স্বরে বললেন, তোমরা খুব তাড়াতাড়ি মন্তব্য করছো। গল্পটা পড়ে আরেকটু ভেবে এরপর সেটা নিয়ে আলোচনা করা উচিত।

কিন্তু স্যার, আমরা ঠিক কথাগুলোই বলছি। ভেবে বললেও এসব কথাই আমরা বলতাম।

হুম ... কিন্তু তোমাদের ভাবনাগুলো দ্রুতলয়ের। এতো দ্রুতলয়ের ভাবনার সাথে আমার পরিচয় নেই। যাই হোক, আজকের ক্লাস শেষ। আমরা গল্পটা নিয়ে কালকে আবার আলোচনা করবো। তোমরা রাতে গল্পটা পড়ে ২০০ শব্দে তোমাদের ভাবনা নিয়ে একটা কিছু লিখবে। কালকে সেটা আমাকে পড়ে শোনাবে।

আনিস চৌধুরীর বাসা লালমাটিয়ায়। ধানমন্ডি থেকে সেখানে যেতে খুব বেশী সময় লাগবে না। গাড়িতে উঠে ফোন বের করে তিনি ঘড়ি দেখলেন। ছয়টা তেরো। ফোন থেকে চোখ সরানোর আগেই স্ক্রীণজুড়ে মাধবীর ছবি ভেসে উঠলো। সেই ছবিতে মাধবীর মুখে শান্ত, স্নিগ্ধ, প্রেমময়, অপরূপ হাসি। মাধবী ফোন করেছে। আনিস চৌধুরী হাসিমুখে ফোন ধরলেন।

কি খবর কবি, ক্লাস শেষ তোমার ?

হুম। আবির আর অহনা কি করছে ?

যে যার ঘরে। যে যার মতো আছে। সাড়ে আটটায় রাতের খাবার দেবো ভাবছি। তুমি কি সাড়ে আটটার আগে আসতে পারবে ?

পারবো। সাড়ে আটটার আগেই আসবো আমি।

মাধবী হয় তো একটু হাসলো। ওর কণ্ঠে ভালোবাসার তারল্য। আনিস চৌধুরী মনে মনে বললেন, তোমাকে ভালোবাসি মাধবী। অনেক।

আমি জানি তুমি এখন কোথায় যাবে। আজকে বুধবার, তুমি পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে বসে চা খাবে। তাই না ?

আনিস চৌধুরী অল্প হেসে বললেন, হ্যাঁ। তোমার সবই মনে থাকে।

আচ্ছা শোনো, আমি জানি তুমি কোথায় যাবে, আর সেটা আমার মনেও থাকে। কিন্তু তুমি কেন যে বুধবারে সেখানে যাও, সেটা কিন্তু আমি জানি না। এমন না যে সেখানে তুমি কারও সাথে আড্ডা দাও। ড্রাইভার বলেছে তুমি একা একা টং দোকানে বসে দুই কাপ চা খাও। এরপর সেখান থেকে বাসায় আসো।

হুম, সে ঠিকই বলেছে।

কিন্তু তুমি কেন সেখানে যাও সেটা কবে বলবে আমাকে ?

আনিস চৌধুরী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, বলবো কোনোদিন। তোমাকে তো সবই বলি। এটাই বা বাদ থাকবে কেন !

গুড। বোলো। ধীরেসুস্হে ... কোনো তাড়া নেই।

হুম ... ধীরেসুস্হেই বলবো মাধবী। তোমার সাথে আমার জীবনের সব গান। জীবনের গান দ্রুতলয়ে হয় না, ধীরলয়ে হয়। মাঝে মাঝে বৈতালিকও হয়।

বুঝলাম কবি ... আপনি ধীরলয়ে আপনার একাকীত্মের চা খেয়ে বাসায় আসেন। সাড়ে আটটার যতো আগে আসবেন, এ্যাপেটাইজারে ততো বেশী চুমু পাবেন। রাখছি, বাই।

আনিস চৌধুরী ফোন রেখে নরম স্বরে ড্রাইভারকে বললেন, হাবিব, পাবলিক লাইব্রেরী চলো। ধীরেসুস্হে যাও ... কোনো তাড়া নেই।

বুধবার এই সময়ে কোথায় যেতে হবে সেটা হাবিব ভালো করেই জানে। সেখানে যাওয়ার সময় গাড়ি যে ধীরেসুস্হে চালাতে হবে, সেটাও তার জানা। দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাতে হাবিব নিজেই পছন্দ করে না। সে পুরানো লোক। সবকিছুর মধ্যে অস্হিরতা আর দ্রুতলয় ঢুকানো এখনকার ফ্যাশন। পুরানো লোকজন সেই ফ্যাশনে খাপ খায় না। সেটা নিয়ে পুরানো লোকজনের খুব একটা আক্ষেপও নেই। 

 

কেতন শেখ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা





আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top