সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

দাঁড়কাক: সেলিনা হোসেন


প্রকাশিত:
২৬ জুন ২০১৯ ০৬:৫৭

আপডেট:
১ মে ২০২৩ ২০:৫৮

সেলিনা হোসেন

 

তেতাল্লিশ বছর বয়সে লোকটির শখ হয়েছে জীবনকে অন্যভাবে গড়তে। কিছু স্বপ্ন ওকে তাড়িত করছে। ও অন্যের জমি চাষ করে জীবনধারণের মতো পরগাছা বৃত্তি ত্যাগ করতে চায় এবং অনাকাক্সিক্ষত সন্তানের পিতা হওয়ার দায়ভার থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চায়।

লোকটির নাম মান্নান। গাঁয়ের লোকের মুখে মুখে কিভাবে যেন মউন্যা হয়ে গেছে। মাংসহীন, মেদহীন, কুচকুচে কালো শরীর, লম্বায় ছয় ফুটের কাছাকাছি। লোক বলে ওর উন্নত খাড়া নাক বেঁকে গিয়ে দাঁড়কাকের ঠোঁটের মতো দেখায়, সেজন্য ওকে সবাই কাউয়া মউন্যা বলে। নামের বিকৃতির জন্য ওর মনের গভীরে দুঃখ আছে। ও বুঝে যায় কাছে প্রতিবাদ করতে পারে না। ওই নামে ডাকলে সাড়া দেয়, গাঁয়ের ছেলেমেয়েরা পেছন পেছন ওই নাম ধরে ডেকে তামাসা করলে উপেক্ষা করে। হাঁটতে হাঁটতে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। মাথা নেমে আসে বুকের কাছাকাছি। লোকটির ক্রোধে উদ্দীপিত হয় না, দুঃখে পীড়িত হয়ে খালের ধারে বসে থাকে। কেউ বুঝতে পারে না যে, ও অসম্ভব আত্মকেন্দ্রিক। ওর বুকের ভেতরে ফসলের মাঠ আছে, ফসলহীন ধু-ধু প্রান্তর আছে, একটা কিছু যোগাড় করে এ বেড়ি ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় ও ছিন্নভিন্ন। যতো সহজে ও লোকের কথায় ওঠে-বসে, ছুটে কাজ করে ততো সহজ ও নয়। লাঙ্গলের ফলার মতো চিরে যাওয়া মাটি ও নিজে, নিজেকে প্রতিনিয়ত খুঁড়ে খুঁড়ে বাসনার বীজ বোনে। কিন্তু ওর ঘোলাটে দৃষ্টি এবং চোয়াল-ওঠা চেহারায় কেউ তা বুঝতে পারে না। গাঁয়ের চেয়ারম্যান সবার সামনে হাসতে হাসতে বলে, কাউয়া মউন্যা একটা বলদ।

গত রাতে সায়দার সঙ্গে ওর ঝগড়া হয়েছে। সায়দা শারীরিক দিক থেকে যতো রুগণ এবং কৃশ হচ্ছে, ততো ওর জিহ্বা শাণিত হয়ে উঠেছে। বলেছে, ওর পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলা উচিত। যে বাপ ছেলেমেয়েদের খেতে দিতে পারে না, তার আবার বাপ হওয়া কিসের জন্য? লোকটি বৌর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আচ্ছা করে পিটিয়েও নিজের রাগ ঠান্ডা করতে পারেনি। এখন ও দ্রুতপায়ে মাঠের মাখখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। বেলা দশটার মতো হবে, ওর অনুমান। কম কিংবা বেশি হতে পারে। দু’পাশে বিস্তীর্ণ কাটা ধু-ধু মাঠ মাঝে-মধ্যে ও হাতের তালু দিয়ে কপাল ঢেকে রোদ আড়াল করে। বৈশাখের তীব্র রোদে চোখমুখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। আলের ওপর দিয়ে হাঁটছে বলে কখনো ইঁদুরের গর্তে পা পড়ে যায়। লোকটির পায়ের গতিতে অস্বাভাবিক দ্রুততা। কখনও হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়া কোনো রকমে সামলে নেয়। ও রাস্তার ধারে বসে পড়ে পা ছড়িয়ে দেয়। সামান্য বিশ্রাম দরকার। ও যাচ্ছে সদর হাসপাতালে। নিজেকে নিবীর্য করার বাসনা এখন ওর মধ্যে প্রবল। গত রাতে বউর সামনে দম্ভ করে এ কথাই ঘোষণা করেছে।

নিবীর্য হয়ে যাওয়ার পর লোকটির দুদিন মন খারাপ থাকে। নিজেকে কেমন অচেনা লাগে, কিছুতেই স্বস্তি পায় না। তখন ওর মনে হয় ও কি আসলেই কাক হয়ে গেল? ভাত খেতে পারে না, অর্ধেক ভাত খেয়ে ঘরের বাইরে চলে আসে। বিড়ি ধরানোর জন্য দিয়াশলাই জ্বালাতে গিয়ে ওর হাত কাঁপে ঠকঠক করে। অসম্ভব আতঙ্কে বিস্ফোরিত হয়ে যায় ওর দৃষ্টি, কেবলই মনে হয় কী যেন নেই ওর ভেতরে। কিন্তু না শরীর হালকা মনে হয় না, হাঁটতে কষ্ট নেই, ওর খিদে পায়, পিপাসাও। তবে কি সায়দার কাছে ছোটো হয়ে গেল বলে ওর এমন হচ্ছে? সায়দা কি ওকে করুণা করবে? ও বিড়ি টানতে পারে না, ছুড়ে ফেলে দিয়ে ক্রুদ্ধ পায়ে বউর সামনে এসে দাঁড়ায়। সায়দা বারান্দায় বসে ক্ষুদ-কুঁড়া ভরা চাল বাছছিল, জাউ রাঁধবে। একটু আগে করিমুদ্দিনের বাড়ি থেকে ধান ভেঙে ফিরেছে। করিমুদ্দিনের বৌর সঙ্গে চালের হিসাব নিয়ে মন কষাকষি হয়েছে। ঝগড়া করার সাহস নেই ওর, তাই নিজের ওপরই মেজাজ খারাপ। শুধু নিজের ওপরই নয়, কোনো কারণ ছাড়াই কাউয়া মউন্যার ওপর ও রেগে থাকে। ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত শরীর, প্রচ- খিদে চারদিক আঁধার করে রেখেছে। সায়দা স্বামীর দিকে ভ্রƒক্ষেপ করে না। টের পায় না লোকটির ক্রোধ, দেখে না ওর আগুনে-দৃষ্টি। ও রগ ওঠা দুহাতে কুলো তুলে ধরে, বাতাসে উড়ে যায় চালের তুষ। এই লোকটিকে নিয়ে ওর কোনো সুখ-দুঃখ নেই। সবকিছুই নিয়মমাফিক চলে। সুখ বা দুঃখের আবেগ সায়দাকে তাড়িত করে না। যাকে নিয়ে ভালোলাগা নেই তাকে নিয়ে মাথাব্যথা কি?

ও সানুর মা?

লোকটি পা দাপায়। সায়দা প্রথমে অবাক হয়, তারপর নিষ্পৃৃহ ভঙ্গিতে তাকায়, কী কন?

ওর হাতের কুলো থেমে গেছে। ওর মুখের ঘামে চালের কুঁড়ো লেগে আছে। ও হাতের কাজ দ্রুত সারতে চায়। ওর ঠোঁট বেঁকে ওঠে। লোকটির মনে হয় সায়দার ঠোঁ?

 

সেলিনা হোসেন
প্রখ্যাত সাহিত্যক, স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত ঔপন্যাসিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top