সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

রাজা মশাই : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ২২:৪১

আপডেট:
৩ মে ২০২০ ২০:৩৩

 

এক দেশে ছিল এক রাজা!তার ছিল দুই রাজকন্যা আর তিন রাজপুত্র!

নতুন বিয়ে হয়েছে দুই রাজপুত্রের!বাড়িতে রমরমা অবস্থা !আনন্দের ফোয়ারা বইছে যেন!

কিন্তু তাহলে কি হবে! রাজার মনে চিন্তা! রাজ্য চালায় আর দিনরাত রাজ্যের প্রজাদের সুখ শান্তির কথা ভাবে! রাণীও রাজার সব ধ্যানজ্ঞান এর মধ্যে থাকেন!

রাজার সকল কাজের প্রেরণা যেন রানীই!আপদ সারাক্ষন রাজাকে বিপদ আপদ থেকে আগলে রাখেন !

দুই রাজকন্যা কাছে নেই বলে,মাঝেমাঝেই রাজা রানীর মন খারাপ লাগে! বিশেষ করে ছোট রাজকুমার ঘুমনোর সময় বোনদের জন্য খুব কান্নাকাটি করে!বড় বোন বলতে পাগল!

বড় রাজকন্যা বিয়ে হয়ে স্বামীর ঘর করছে বিদেশ বিভূঁই এ!ছোট রাজকন্যার পড়ালেখা শেষ হয়নি তখনও!

দুই মেয়ের জন্য রাজামশাই ও মাঝে মাঝে আনমনা হয়ে যান!

রাজামশাই এর আবার চুরুট টানার অভ্যাস আছে!

ভোরবেলা নাস্তার পরই তার চুরুট চাই ! চুরুট টানতে টানতেই প্রজাদের বিচার আচার শুরু হয়ে যায়! রাজ্যের খোঁজ খবর নেয়া থেকে চলে নানা বিচার আচার!      

রাজ্যের নানারকম শলাপরামর্শ চলে! প্রজাদের সুখ শান্তিই যেন তার সুখ!

মাঝে মাঝে রাজার মন আচমকা উদাসিন হয়ে যায়!

পাশে এসে দাঁড়ায় রাজমাতা!

নিমিষেই ঠিক হয়ে যায় সব!

কিন্তু আজ মনটা কেমন কেমন করছে!চোখ বুজে চুরুট টানেন আর রাজ্যের নানান কথা ভাবতে থাকেন! রাজসভা চলে  দিনভর! খাওয়া দাওয়া ওর মধ্যেই  শেষ হয় কোনভাবে!

দুপুর গড়িয়ে কখন বিকেল হয়ে গেছে!

ছোট রাজকুমার বাবার গা ঘেঁসে ঘেঁসে আদর পেতে চায়!রাজা বুকের মধ্যে টেনে নেয়!

রাজামশাই ধির পায়ে মুল ফটকের বাইরে চলে আসেন আজ!

গোধূলি বেলা!

সামনেই বিশাল লেক!টলমল করছে লেকের পানি! শেষ শরতের নির্মল পেঁজা পেঁজা মেঘগুলো যেন উড়ে এসে কুর্নিশ করে রাজা মশাইকে !স্বচ্ছ  লেকের পানিতে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষন! প্রাসাদের বাইরে কত দর্শনার্থী!দূর দুরান্ত থেকে আসা মানুষগুলো এসে জমা হয় তার চারপাশে!যেন রাজার প্রতি কত নির্ভরতা এইসব দুখী মানুষদের!

একে একে তাদের অনেকের সাথে কুশল বিনিময় করেন রাজা!

সবার সঙ্গে কথা বলা হয়না তার !

অন্ধকার নেমে আসে!

ঘরে ফেরেন রাজা!

পরদিন দেশের সর্বচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ অনুষ্ঠান আছে! একটু তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পরেন আজ!

বাড়ি ভর্তি লোকজন!আত্মীয় স্বজন অনেকেই এসেছেন!সদ্য বিবাহিত দুই ছেলের বউ ঘরে!সবাই আনন্দ করছে!ঘর নয়,যেন চাঁদের হাট বসেছে!

ঘুমের ঘোরেই টের পান! ঘুম আসছেনা আজ কিছুতেই! এপাশ ওপাশ করেন!

রাজমাতা বুঝতে পারেন পাশ থেকে!প্রখর দূরদৃষ্টি তার!

জিজ্ঞেস করেন –কি এত চিন্তা কর রাতদিন?

রাজা বিমর্ষ!

রাজমাতা বলেন---সবাই কত আনন্দ করছে! তুমি কেন মন খারাপ করে আছ আজ বলত!

রাজা ধির গলায় বলেন---কি জানি কেমন যেন কুয়াশা জমেছে আজ মনের মধ্যে!হটাত ছোট কুমার এসে রাজার গলা জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে --- ও বাবা,কাল কিন্তু আমি তোমার অনুষ্ঠান এ  যাবই যাব!

রাজা কুমারকে বুকে টেনে নিয়ে বলেন---লক্ষ্মী সোনা আমার! তাতো যাবিই তুই ! এখন ঘুমোও বাপ!

বাড়ির সবাই একসময় ঘুমিয়ে পরে!

রাজা ও রাজমাতা কিছুক্ষন বেলকনিতে এসে দাঁড়ান দুজনে!আনমনে তাকিয়ে থাকেন লেকের দিকে!মিষ্টি শীতল হাওয়া কোন প্রান্তর থেকে ভেসে ভেসে এসে তাদের দুজন এর সর্বাঙ্গ বুলিয়ে দিচ্ছে! কিন্তু এত স্নিগ্ধতায় ও কেন যেন রাজাকে কি এক অচেনা রুক্ষশক্তি প্রবলভাবে কাবু করতে থাকে!

বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে কি এক অজানা ,অশুভ আতঙ্কে!

কন্যা দুটি ভাল আছেতো?

রাজ্যের সব প্রজারাই কি ভাল আছে?

সব প্রজারাই দুবেলা পেট ভরে খেতে পারছেতো ?

ভেতরে ভেতরে রাজ্যে কোন ষড়যন্ত্র চলছেনাতো!

একসময় ঘরে এসে ঘুমিয়ে পরে!সারাদিন এর ক্লান্তিতে সবাই অঘোরে ঘুমায়!

এ সময় রাজা মশাই  সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখেন !

প্রাসাদের আঙ্গিনায় নিজ হাতে লাগান নারিকেল গাছটিতে অদ্ভুত সুন্দর একটা পাখি বসে আছে !

সোনালি ডানার মিষ্টি পাখিটি মিষ্টি সুরে ডেকে যায় !যেন রাজাকে কিছু বলতে চায় ! রাজা বিভোর হয়ে পাখিটিকে জিজ্ঞেস করে --- ও পাখি তুই কেমন আছিস ? ভালতো ?

এই কথা শুনে পাখিটি গান বন্ধ করে উড়ে গিয়ে বসে গাছের মগ ডালে !রাজা দৌড়ে গিয়ে গাছের নিচ থেকে পাখিটিকে আদর করে ডাকতে থাকেন! পত পত করে উড়ে যায় পাখিটি !

রাজার মন উতলা হয়ে পরে !

পাখিটি গান বন্ধ করে উড়ে গেল কেন ? সে কি আমায় কোন দুঃসংবাদ দিতে এসেছিল ?

তাহলে কি আমার রাজ্যে প্রজারা অসুখী ? তারা না খেয়ে থাকে ?

রাজা মশাই ঘুমের ঘোরে অস্থির হয়ে পরেন !

তবে কি এতদিন আমি আমার কর্তব্য কাজে অবহেলা করেছি ? প্রাসাদের বাইরে কেউ কোনদিন আমাকে নিয়ে যায়নি ! প্রজাদের সুখ দুখের কথা শূনতে দেয়নি কেউ !মন্ত্রি পরিষদ চারপাশে আমাকে বন্দী করে রেখেছে !

কেন ?

তারা কি অনেক সত্যকে গোপন করেছে আমার কাছে ? সব্বাইতো স্যালুট দিয়ে ভালবাসার কথাই জানিয়েছে ! কই, প্রজাদের কোন দুঃখ দুর্দশা,রাজ্যের দুর্দিন, খরা, অনাবৃষ্টিতে দুর্যোগ, কোনকিছুই তো আমাকে জানায়নি কেউ !তবে কি আমার প্রজারা রাজ্যে না খেয়ে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে ?

তারা অসুখী আমার রাজ্যে ?

নানা কথা ভাবতে ভাবতে রাজা দেখেন ,পাখিটি উড়ে উড়ে দিগন্ত ছাড়িয়ে কোন দূরে দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছে !

কতদুর যাবি তুই দুষ্টু পাখি ? আমিও যাব তোর পিছু পিছু ! আমি নিজ চক্ষে আমার রাজ্য দেখব !

ওরে---- তোরা কে আছিস ?

ঘুমের মধ্যেই খুব জোরে হাঁক ছাড়েন রাজা মশাই!

সঙ্গে সঙ্গে ভোর রাতে হটাত দারুম দুরুম গোলাগুলির আওয়াজ শুনে হতচকিয়ে ওঠে সব্বাই!

ঘুম ভেঙ্গে যায় রাজার!কিসের আওয়াজ!? বুকের মধ্যে তোলপাড় করে ওঠে! হটাত কি হোল তার রাজ্যে!

দৌড়ে বেরিয়ে আসে ঘরের বাইরে! দারোয়ান বাধা দেয়!গুলি করে মেরে ফেলে দারোয়ানকে অজ্ঞাত ঘাতক !

ছুটে আসে কাজের মেয়েটি সহ রাজমাতা ! সদ্য বিবাহিত দুই রাজকুমার ও রাজ বধু !যাদের হাতের মেহেদি ও শুকায়নি ! একে একে সব্বাইকে গুলি করেন !মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেন সবাই!

রাজা হতবিহব্বল হয়ে দৌড়ে নেমে আসে দোতলার সিঁড়িতে!

চীৎকার করে জানতে চান ----কে তোমরা?কি চাও?

আমাকে বল নিঃসঙ্কোচে!  আমি তোমাদের সব কথা শুনব ! আমার সামনে আসো!

ঘাতক খুনি রাজার মুখোমূখী দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়!

সঙ্গে সঙ্গে অর্ডার আসে গুলি করার!দারুম দুড়ুম মেশিনগানের গুলিতে সিঁড়ীর মধ্যেই লুটিয়ে পড়েন রাজা মশাই !

দূর থেকে দেখছিল ছোট্ট রাজকুমার সবার মৃতদেহ !

আতঙ্কে ঘাতকের হাত ধরে কাকুতি মিনতি করছিলো তাকে গুলি না করার জন্য !

মিনতি করে অনুনয় বিনয় করে বলেছিল ---- আমাকে মেরনা তোমরা ! আমাকে বড়দিদিমনির কাছে নিয়ে চলো!

নিষ্ঠুর সিমার ঘাতকের হাত একটুও কাঁপেনি!শিশু রাজ কুমারের বুক বরাবর ট্রিগার টিপে মেরে ফেলে রাজ বংশের শেষ পুরধা সকলের আদরের নয়নের মনিকে !    

চিরচেনা আকাশ বাতাস ঘাচতকদের সস্পর্ধায় ডানা ঝাপটায়!

ক্ষণিকের জন্য হয়তো থেমে যায় প্রকৃতি !

থামেনা ঘাতকের পাষাণ হৃদয় ! 

একে একে সন্ত্রাসী ,ঘাতক ষড়যন্ত্রকারীরা বাড়ীর অতিথিসহ সকল মানুষকেই মেরে ফেলে নিরবিবাদে! 

দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যায় দুই রাজকন্যা!

পড়ে থাকে সিঁড়ীতে স্বপ্নভরা দুচোখ মুদে রাজার অশরীরী দেহটা!

ভোরের আলো ছড়িয়ে পরে চারদিকে !

পাখিরা গান গায় সেই গাছটিতে!

লেকের পানিতে ঢেউ খেলে ! ঝির ঝির বাতাস বয়ে যায়!

থেমে থাকেনা কোনকিছুই!

রাজা যায়! রাজা আসে!

দেশের অগণিত প্রজাদের মুখে মুখে গল্প হয়ে,কবিতা হয়ে,গান হয়ে,নাটক হয়ে,

মহা কাব্যের কাব্য হয়ে, যুগ যুগান্তরের চিরন্তন ছবি হয়ে, বেঁচে আছেন রাজামশাই সারাটি রাজ্যের আকাশে বাতাসে,ধূলিকণায়!

মৃত্যু তাঁকে পরাজিত করতে পারে নাই !

তিনি মহাকাব্যের অমরগাঁথা কালজয়ি, মৃত্যুহীন, অবিনশ্বর, সর্বকালের, সর্বশ্রেষ্ঠ রাজামশাই!

 

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকারলেখক  গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top