সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

নতুন আলো রশ্মিতে (২য় পর্ব) : ড. মীনা মুখার্জী


প্রকাশিত:
২০ ডিসেম্বর ২০১৯ ২০:২৮

আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২০ ১৩:০৭

 

বাচ্চাই তো,প্রলোভনে সে জেদটার উপশম হলো ঠিকই,কিন্তু অবচেতন মনে রিনরিন করে ঠাম্মির ঘুম পাড়ানিয়া গান ,রামায়ণের গান,রূপকথার ডাইনিবুড়ির স্বর৷

              আজকাল স্কুল ফেরার পথে লিফট থেকে নেমে পাশের বাড়ীর ঠাম্মির উপরে রীতির দৃষ্টি বেশ তীব্র আকর্ষণ৷খুব সখ্যতা দুজনের৷ব্যাগটা পরীদিদির হাতে দিয়ে গ্রিলের ফাঁক থেকে তার কয়েদী বন্ধুর সাথে নানান কথাবার্ত্তা৷বাইরে কেন আসতে পারেনা?কে তাকে বন্ধ করেছে?কেনই বা এ তালা বন্ধ?ইত্যাদি ইত্যাদি ......সে কত সাত কাহন!!

            মেয়েদের পায়ে অদৃশ্য শিকল বাঁধা তো থাকেই আর তা কেবল মেয়েরাই দেখতে পায়,তাই এই ছোট্ট রীতি ও লক্ষ্য করে তার ঠাম্মির শৃঙ্খলাবস্থার করুণ মানসিকতা !

            —আচ্ছা ঠাম্মি,তুমি তো বড় তাও তোমায় আন্টি কেন বন্ধ করে রাখে বলো তো?

           —জানিনা ,আমি তো ছোট্ট,বড় কই?

           — আরে তুমি তো বুড়ি৷আমার ঠাম্মির থেকেও তুমি বুড়ি৷

          রোজ টিফিন থেকে বাঁচিয়ে রীতি তার নতুন বন্ধুকে কেক দেয় কখনও বা টফিও ৷

আবার যখন পরীদিদি হাঁক দেয় তখন বন্ধুকে টা—টা করে বাড়ী যায় রীতি রাণী৷দুটো বিষম চিন্তা ছোট্ট রীতির মাথায় অনবরত ভিড় করে ৷এই ঠাম্মির কয়েদ জীবন ,আর নিজের ঠাম্মির হঠাৎ তাকে ছেড়ে শিলিগুড়ি ফেরা ৷তাই আবার তার প্রশ্ন ........

       —বন্ধু ঠাম্মি তুমি এবার আমার বাড়ী চলে আসবে?দু'জনে খেলবো ,গল্প করবো,তোমাকে সিনড্রেলার গল্প শোনাবো ইউ টিউবে৷তুমি কিন্তু পারমিশন নিও আন্টির কাছে৷ঠিক তো?

         এই ক্ষুদে মেয়েটির আন্তরিকতায় আপ্লুত হন প্রতিভা দেবী৷খানিকটা স্তম্ভিত ও বিমর্ষ৷অজান্তে কখন যে দু"চোখে জল গড়িয়ে পড়ে !

       এভাবেই বন্ধু ঠাম্মির সাথে বন্ধুত্ব যেই না জমেছে ওমনি হঠাৎ সোমবারে স্কুল ফেরার সময় দেখে তার বন্ধুর বাড়ীর গ্রিল ও ভেতরের দরজা দুটোতেই তালা বন্ধ৷রীতির মন খুব খারাপ হয়ে গেল৷ঠাম্মি তাহলে গেল কোথায়?পরী দিদিকে জিজ্ঞেস করলে বলে —তোমার আন্টিরা তো মথুরা বৃন্দাবন বেড়াতে গেছে৷

         গতানুগতিকতায় দিন কাটে রীতির৷বিমর্ষতা! আবার ও সেই একা! পরীদিদির সাথে বনছে না মোটেও ৷আবার সেই বিষণ্ণতা,চুপচাপ! মৃদুল চিন্তাক্লিষ্ট৷কাজের শত চাপেও আদরের মেয়ের উপর তার বিশেষ লক্ষ্য৷সময়ে অসময়ে পামেলার সাথে তার বিবাদ লেগেই থাকে৷পামেলার বাবা-মাকে এখানে এসে থাকার প্রস্তাবে তাঁরাও গররাজি৷এখনও মৃদুল ও তার মাকে উচ্চবিত্ত মেজর প্রণব সরকার সহ্য করতে পারেননা৷তাই মেয়ের এ প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যাত৷ 

        অবশেষে মৃদুল বহুকষ্টে মাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আবার শিলিগুড়ি থেকে কোলকাতায় নিয়ে এলো৷দু'এক দিনের মধ্যেই রীতি তার ঠাম্মিকে পেয়ে আবার চনমনে৷সাধারণত মেয়েদের জীবন তো ত্যাগ ও সহ্যের জন্যই বরাদ্দ,এই বোধেই কল্যাণী দেবী আবার ছেলের সংসারে এডজাস্ট করতেই এলেন৷কিই বা বলবে পামেলাকে?মা-বাবা পরিত্যক্তা,প্রমোশনটাও আটকে আছে৷এই সব সাত কাহনে মনের অভিমান নিমেষেই ফানুস!পামেলাও নিশ্চিন্ত হয় শাশুড়ির জিম্মায় তার হিয়াকে ছেড়ে৷তবে মাস কয়েক যেতে না যেতেই আবার তার শাশুড়ি প্রীতি কমে৷মেয়েকে চেপে ধরে পড়াশোনার অজুহাতে নিজের রুমে টেনে বন্ধ রাখা৷সুইমিং,নাচ,গান,ড্রয়িং ইত্যাদিতে ব্যস্ত করে দেওয়া টাও কল্যাণীর জন্য যেন এক বিষম যন্ত্রণাবৎ৷এও যেন এক মহা বিপদ৷এত বড় ফ্ল্যাটে অপার নিঃসঙ্গতা৷বুকের মাঝে জমা কষ্ট গুলো যেন জগদ্দল পাহাড় ! না যায় গেলা আর না যায় ফেলা!স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানকে শিক্ষিত করার উদ্দ্যেশে আর গ্রামে ফেরা হয়নি তাঁর৷স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বন্চিত হয়ে অল্প বয়সী বিধবা কল্যাণী বিদ্যের জোরে স্কুলে শিক্ষিকা পদে নিযুক্ত হয়ে ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করেছেন৷স্বভাবতই ছেলে উচ্চ পদস্থ বড় অফিসার৷পরম শান্তি অথচ কেমন যেন অসোয়াস্তি ! লাভ ম্যারেজ তো ! দায়ী করাও যায়না ছেলেকে ৷ওরা তো সুখী৷ শিক্ষককতার সময় টুকু বাদে সব সময় টুকুই নয়নমণি পুত্রেই নিয়োজিত করেছেন৷পুত্র কেন্দ্রিক সে সংসারে ছিল অসীম নিমগ্নতা৷কত স্মৃতি!বৌয়ের বাঁকা চোখের চাউনি যেন আজকাল আর সহ্য হয়না৷বুকের জমা কষ্টগুলো যেন সশব্দে ডানা ঝাপটায়৷শ্লেষমিশ্রিত বাক্যবাণ ও বাঁকা চাউনি তাঁর উদ্ গত অশ্রুধারাকে সম্বরণ করতে পারেনা৷মনের চৌকাঠে শক্ত হোঁচট খেলেই আবার ছেেলেকেে অনুরোধ করে  বাড়ী ফিরেও যান৷ 

        এদিকে স্কুল থেকে ফিরে রীতি ঠাম্মিকে না দেখে এদিক ওদিক খোঁজে৷না পেয়ে গুমড়ে গুমড়ে কান্না ! আবার সেই এগারো বারোর কিশোরী মনের একাকীত্ব তাকে গ্রাস করে৷মাঝে মাঝেই কিশোর মনের প্রতিবাদী সত্ত্বা জেগে ওঠে তখন মায়ের আদর অসহ্য ঠেকে,বাবা বোঝায়—

         —দ্যাখো মাম,তুমি বড় হচ্ছ,ইনটেলিজেন্ট গার্ল,এভাবে অন্যমনস্ক না হয়ে পড়ায় মন দাও৷তোমাকে তো বড় হতে হবে৷দেখবে সময় তোমার চারপাশে কত আলো এনে ভরে দেবে৷সময়কে সুযোগ দাও,তোমার ভাল না লাগলে আমাকে বলবে৷

 

ড. মীনা মুখার্জী
লেখক ও সংগঠক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top