সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

চাওয়া পাওয়া (শেষ পর্ব) : বেগম জাহান আরা


প্রকাশিত:
২৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ১১:২২

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২০ ২১:০৭

 

কফি খাওনি সকালে? খেয়েছি। আবার খাবো। ভালো লাগে। হাসে নাসিম মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। ভেতর থেকে গুটিয়ে যায় আবার শাহেরা। মনে হয়, ইচ্ছে করেই মাকে দেখিয়ে দেখিয়ে কফি খেতে চায় নাসিম।

চলো রান্না ঘরে। তোমাকে নিজের হাতে কফি বানিয়ে খাওয়াই। নাসিমের কথায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো রান্নাঘরে আসে শাহেরা। ফ্রিজে বিরিয়ানি আছে, ইচ্ছে হলে খেতে পারো। নাসিম ওয়াটার কুকার ওন করে।

সকালে কে বিরিয়ানি খায় বাবা? আমি খাই মাঝে মাঝে। তুমিতো জানো । আমি কি ভালোবাসি বিরিয়ানি খেতে। এখন আমি স্বাধীন মা। তোমার বউ রাবেয়া।  আমার শৈশবের সব কথাই জানে।

কি জানে? মুখ ফসকিয়ে বেরিয়ে যায় কথা দুটো। ভুলে গেছো মা। নাসিম হাসে আবার।  কথা বলতে পারে না শাহেরা। ছেলেটা এমন করে কথা বলছে কেনো।

মিষ্টি এনেছি। খেয়ো।  আমি আর খেতে পারি না। ডায়াবেটিস হয়েছে। আমিও তো ডায়াবেটিসের রোগি। প্রায় ফিস ফিস করে বলে শাহেরা।

বাচ্চারা খুব পছন্দ করে খেতে। কে জানে কখন আবার ওদেরও রোগ হয়। ছোটবেলা খেতে চাইতাম। তখন ডায়াবেটিস ছিলো না। এখন খেতে পারি কিন্তু রোগই বাধা।

কফি বানিয়ে নিজে এক কাপ নেয় নাসিম। মায়ের দিকে বাড়িয়ে দেয় এককাপ।

ও তুমিও তো নাশতা খাওনি।

থাক পরেই খাবো। কফিটা খাই এখন। গরম কপি দ্রুত শেষ করে চলে যায় নাসিম। দুদিন কেটে গেল কোথা দিয়ে। এলো শুক্রবার।  বন্ধের দিন। বাপরে সে কি ঘুম সবাইর। দশটা বেজে যায় তাও জাগে না কেউই।  অস্বস্তি লাগে শাহেরারা।  ইচ্ছা ছিলো আজ একবার কাবা ঘরের দিকে যাবে। কথাটা পাড়াই হয় নি।  নিজের ছেলের সঙ্গে মন খুলে কথা হচ্ছে না। কোথায় যেন দেয়াল ঠেকে যাচ্ছে্। আজ বলতেই হবে কাবা ঘরে যাওয়ার কথা।

খেতে বসেছে সবাই। পরাটা, আলু ভাজি, ডিম ভাজি, টিকিয়া কাবাব, নিরামিশ তরকারী, পায়েস, মিষ্টি দই, চা কফি, দুধ রাখা আছে। বাচ্চারা দুধ খাবে। বড়োরা চা কফি যার যা ইচ্ছা খাবে।

শাহেরা অবাক হয়, বিরক্তও হয়।  এতো খাবার কোনো সকালে? অতিথি এলে  শাহেরা এইরকম আয়োজন করতো। তবে সেটা শুধু অতিথিদের জন্য। নাসিম জসিম দুই ভাই এতো খাবার পেত না। লোভ পুষে রেখে উঠে পড়তে হতো টেবিল থেকে।

নাসিম খাচ্ছে সবই। বাচ্চারাও খাচ্ছে যার যা খুশি। হঠ্যাৎ মিষ্টি দইয়ের বাটি উল্টে গেল রনির হাত থেকে। দেখেও দেখলো না নাসিম। তটস্থ হয়ে উঠলো শাহেরা। বকাও দিতে পারছে না। বেশি আল্লাদিপনা ভাল লাগে না তার।  বললো আমি জানতাম, দইয়ের বাটি পড়ে যাবে হাত থেকে।  মেখে গেল তো সব।

হেসে ওঠে নাসিম। বলে, তোর কপাল ভালোরে রনি। রাবেয়া পিটুনি দিচ্ছে না।

সে কি মারবো কেনো। ও তো ইচ্ছে করে ফেলে নি, রাবেয়া বলে।

আমরাও ইচ্ছে করে ফেলতাম না। কিন্তু খাবার টেবিলে কিছু পড়লে আর রক্ষে হতো না।

বিশ্রি একটা অপমান বোধে বিব্রত হয় শাহেরা। একটু সামলে নিয়ে বলে, তোদের শুধু মেরেছি না? ভালোবাসে নি?

বেসেছো নিশ্চয়ই। কিন্তু সে ভালো বাসা দিয়ে কষ্টোগুলো ধুয়ে ফেলতে পারো নি মা।

আমাদের কালে সবাই এমনিভাবেই শাসন করতো।  আমরাও কম মার খাইনি।

এখনোও বলেছো তুমি ঠিক কাজ করেছো মা? একটুও লজ্জা পাচ্ছো না?

থরথর করে কেঁপে ওঠে শাহেরা। একি কথা বললো তার ছেলে? আদব কায়দা কিছুই কি শেখায়নি সে ছেলেকে।

এক কথা দু কথায় লেগে গেলো মা ছেলের মধ্যে। যেমন লেগো যেতো ফোনে কথা বলার সময়। একবার না, অনেকবার হয়েছে এমন। শাহেরা ভেবেছিলো, সাক্ষাতে ভদ্র আচরণ করবে ছেলে। কি ভেবেছে সে? বাড়িতে পেয়ে অপমান করবে? সেই জন্যই আসতে বলেছিলো?

নাসিম ভেবেছিলো, কিছুতেই সে মায়ের উপর  রাগ করবে না। হাজার হলেও সে মা। সমাদরে রাখবে তাকে। কিন্তু মানুষ যা চায় তা কি করতে পারে? কেন সে ভুলতে পারে না অতীতের কষ্ট?

বৌয়ের মধ্যস্থতায় শান্তি এলো। কিন্তু খাওয়া হলো না ভালো করে কারও। শাহেরা কেঁদে কেটে একাকার করলো। নাসিম চলে গেলো বাইরে। প্রতিদিন কোনো না কোনো কথার সূত্র ধরে মায়ের সাথে দুকথা হয়ে যায় নাসিমের। দুজনেই চায় সহজ হতে। নাসিম চায়, মা তাকে আদর করবে, ভালোবাসবে অনেক। মা চায়, ছেলে তার সাথে সহজভাবে কথা বলবে, কাছে আসবে। খুব সাধারন চাওয়া।

শাহেরা ভাবে, ছেলের ঘর হয়েছে, সংসার হয়েছে, বাচ্ছা হয়েছে। পেছনের কথা ভুলে সে এখন তার বর্তমান জীবনে ডুবে থাকবে। নাসিম ভাবে, মা কেনো তার ছোটবেলার পাওনা আদরগুলো দিতে পারে না? কেনো আফসোস করে না? কেনো ভুল স্বীকার করে না? অভিমান গাঢ়তরো হয় তার।

দুজনেই দুজনকে আপন করে পেতে চায়। কিন্তু কোথায় যেন কি হয়ে যায়। কাছাকাছি আসতে গেলেই বদ গন্ধে ভরে যায় বাতাস। বেশি কাছে চাইলেই আগুন জ্বলে উঠে বাতাসে। নমনীয় হতে পারে না কেউই। চাওয়াটা আরো তীব্র ব্যার্থতায় ভেঙে যায় খান খান হয়ে। পাওয়ার ঘরে জমা হয় জমাট থকথকে রক্তাক্ত হতাশা আর নীরাময়হীন বিপন্ন কান্না।

পরাজিত বিধ্বস্ত অপমানিত শাহেরা বুঝতে পারে না।কি করবে সে? নাসিমই কি জানে।

"দুজনেই কাঁদে রাতের নিকষ আঁধারের গা ধরে"!

 

বেগম জাহান আরা
লেখক ও সাবেক পরিচালক, মহিলা ও শিশু একাডেমি
বর্তমানে জার্মান প্রবাসী

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top