সিডনী বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১

কুহেলিকা : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
২৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ১১:২৬

আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২০ ১৩:৫২

 

আজকাল কাজে কর্মে খুব ক্লান্তিবোধ করে সুদ্বীপ। কোন কাজেই মন বসাতে পারে না। পঞ্চাশোর্ধ বয়সে এসে এ কেমন ভিমরতি এল জীবনে। স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার। ঠিক যেন চাঁদের হাট।  হঠাৎ সেদিন বৃষ্টিমুখর দিনে কেন ঐ ফোনটা এল! ফোন ধরেই কন্ঠস্বরে চমকে উঠলো- চিনতে পারলে না তো!

কে? কে বলছো? একটু চেষ্টা কর চিনতে। মিষ্টি হেসে কি মায়াভরা কণ্ঠেই না বললো মেয়েটি।  অনল এর বুকের ভেতরটা মোচড়  দিয়ে ওঠে। এযে তার অতি পরিচিত কন্ঠ! স্বপ্ন! যাক্। চিনতে পারলে তা’হলে।  কত.....কত বছর পর তোমার কণ্ঠ শুনলাম বলতো!
এতদিন কোথায় ছিলে? এতটুকু বদলায়নি তোমার কন্ঠস্বর। সেই মিষ্টি হেসে হেসে কথা বলা ডাগর চোখে বাঁকা বাঁকা চাউনি।
তোমার দেখছি সবই মনে আছে দ্বীপ। বিশ্বেস কর, তোমার কথা আমার খু-উ-ব মনে পড়ে, আজো, যখন, তখন।  তাহলে, খোঁজ করনি কেন?

করেছি। তোমার ছোট ভাই সুরুযের কাছে সব সময়ই খোঁজ নিয়েছি। আজকাল ওকেও আর দেখি না। কিন্তু তোমার কথা আমার আজো খুব মনে পড়ে। কুঁড়ে কুঁেড় খায় আমাকে।  ছি, ওকথা বলতে নেই।  কেন বলতে নেই স্বপ্ন? সব কথা কি বলা যায়, বল। আমি কি বলতে পেরেছি তোমাকে? না, তুমি................ শুনতে চেয়েছো কখনো?  আমার দুর্ভাগ্য তো ওখানেই স্বপ্ন।
তা আমি জানিনে। তবে এটুকু জানি সৃষ্টিকর্তা যা করেন, তাই মঙ্গল। 

বিশ্বেস কর স্বপ্ন, তোমাকে আমার খুব মনে পড়ে। যখন তখন। জীবনে কিছুই থাকেনা, থাকে শুধু স্মৃতি। আজ এরকমই মনে হয়।
তাই নাকি? আমাকে নিয়ে তোমারতো তেমন কোন স্মৃতি থাকার কথা নয় দ্বীপ। তোমাকে নিয়ে আমার অনেক স্মৃতি আছে। অগোনা, অগুনতি। ঠিক যৌবতী জোৎস্না রাতে, আকাশ ভরা তারার মতো।
সুদ্বীপের বুকটা ব্যাথায় চিনচিন করে।
কত স্বপ্ন দেখেছিলেম একসময়। তুমি তার কিছুই জান না। জানতে চাও ও নাই কখোনো। যা কিছু জেনেছ, আমার ঘনিষ্ঠ কারো কাছ থেকে। তবুতো জেনেছিলে অনল। কিন্তু একটি বারও তো ..... শুনাওনি আমাকে। দগ্ধ অনলের মতই পুড়িয়েছো শুধু। কেন বলতো? আমি কি এতই অসুন্দর ছিলাম তোমার কাছে? লোকে বলতো, কার্তিকের মত চেহারা তোমার।
লক্ষিটি, আর বোল না স্বপ্ন।
কেন, মিনতি কোরছ?
তোমার যা খুশী তাই বল স্বপ্ন। কি করে বোঝাব, প্রতিক্ষণে তোমাকে আমার মনে পড়েছে এতদিন।
আচ্ছা, তুমি তো সেরকমই আছ, তাই না? আমাকে এখন তুমি আর চিনতেই পারবে না।
আমারও একই অবস্থা। সেউ ইন্টারমিডিয়েটের টিন এজার, এখন আমরা বার্ধক্যের ঝরা বিকেলের মতই। এখন আর আমাদের দেখা না হওয়াই বোধ করি ভাল।
ঠিক বলেছ। সুচিত্রা সেনের মত। তরুন বয়সের মিষ্টি যৌবনই থাক আমাদের চোখে।
আচ্ছা দ্বীপ, তুমি কি এখনো পিন্টু ভর্টাচার্য্যরে সেই গানটি গাও?
কোন গানটি বলতো!
“তুমি নির্জন উপকূলে নায়িকার মত”
হ্যা, এখনও গাই। গাইলেই মনে পড়ে তোমাকে।
সত্যি বলছো?
সত্যি বলছি স্বপ্ন।
আচ্ছা। বৃষ্টি শেষ হয়ে গেছে। আরেকদিন কথা হবে। কেমন? আজ, তোমার
টেলিফোন নাম্বারটা সঠিক কিনা ঝালাই করে নিলাম।
ফোন কেটে গিয়েছিল।
স্বপ্ন আর ফোন করেনি।
এর পর থেকে সুদ্বীপ দিনে দিনে অস্থির হয়ে উঠেছে।
স্বপ্নের জন্য ফোনের অপেক্ষায় থাকে।
ফোন আর করে না স্বপ্ন।
অধৈার্য্য হয়ে, অবশেষে সুদ্বীপই তার মোবাইলে সেভ করা নাম্বারএ ফোন করে স্বপ্নকে।
হ্যালো আস্সালামুআলাইকুম।
স্বপ্ন বলছো!
না, না আমি তার মেয়ে।
ও, মামনি কেমন আছ? তোমার আম্মু আছেন।
মা’ মনিতো এখনো বাসায় ফেরেননি।
কখন ফিরবেন?
মা’ মনির আজ রমনায় অনুষ্ঠান আছে বিকেলে। ফিরতে দেরী হবে।
ফোনটি আবার কেটে গেল।
সুদ্বীপ আবার ফোন করে।
এনগেজ।
বারবার চেষ্টা করেও ফোনের লাইন পাওয়া গেল না।
কি মনে হোল, সুদ্বীপ মনস্থির করে ফেললো, বিকেলে সেও রমনায় যাবে। আড়াল থেকে স্বপ্ন কে দেখে আসবে।
যা ভাবা তাই করলো সুদ্বীপ।
বিকেলে রেডী হয়ে রমনায় চলে গেল।
রেষ্টুরেন্টের বাইরে কটেজে চাক হয়ে অনেক মহিলা পুরুষের কোন অনুষ্ঠান চলছে।
গল্প, কবিতা, গান, যে যেমন খুশী অংশ গ্রহণ করছে।
সুদ্বীপ ওখানেই অনেক লোকের মধ্যে মিশে গেল।
কেউ বুঝতে পারলো না সে বাইরের কেউ। একজন একজন করে সব মহিলাদের তীক্ষè দৃষ্টিতে দেখতে থাকলো।
এমন সময় কে একজন বলে উঠলো ভাই, আপনি কিছু শোনাবেন নাকি?
সুদ্বীপ মনের অজান্তেই বলে ওঠে- আমি একটি গান শোনাবো।
দরাজ গলায় গাইলো- “তুমি নির্জন উপকূলে নায়িকার মত”।
গাইতে গাইতেই দূরে চোখ পড়লো।
মিটি মিটি হাসছে একজন শ্যামলা মহিলা।
কপালে লালটিপ।
সেই হাসি, সেই চোখ।
সুদ্বীপ গাইতেই থাকে গান।
চোখ তার ঐ দিকে।
এই তো পেয়ে গেছি তোমাকে স্বপ্ন।
গাইতে গাইতেই সুদ্বীপ ফিরে যায় তার কৈশারের কলেজ জীবনে।
যেখানে স্বপ্নের সাথে তার পরিচয়।
গান শেষ হতেই বিপূল করতালিতে মূখর হয়ে ওঠে।
কিন্তু..... কোথায় গেল স্বপ্ন। কাকে জিজ্ঞেস করবে সুদ্বীপ কিছু ভেবে পায় না।
পাগলের মত খুজতে থাকে স্বপ্নকে।
কেমন আছেন সুদ্বীপ ভাইয়া?
পিঠে হাত দিতেই চমকে ওঠে সুদ্বীপ।
সুরুয, তুমি এখানে?
এলাম। হয়তো আপনার সাথে দেখা হবে বলেই। অনেক খুজেছি আপনাকে।
আমিও তো তোমাকে খুজেছি সুরুয। কেন বলতো?
দেখা হলেই বুবুর কথা জিজ্ঞেস করতেন তো!
ঠিক বলেছ। অনেকদিন পর ওকে দেখলাম আজ এখানে। একটু মুটিয়ে গেছে। এখনো ‘ও’ আগের মতই আছে। সেই চোখ, সেই হাসি। কিন্তু ওকে তো দেখছি না আর।
বলেন কি সুদ্বীপ ভাইয়া?
হ্যা, আমি যখন গান করছিলাম, ও মিটি মিটি হাসছিল। আমিতো ওকে দেখতেই এখানে এসেছি। লুকিয়ে দেখে যাব বলে।
আজকের এ অনুষ্ঠানের কথা আপনি জানলেন কিভাবে?
কেন স্বপ্নকে ফোন করেছিলাম। ওর মেয়ে ধরেছিল। বলেছে, এখানে অনুষ্ঠানে স্বপ্ন থাকবে।
কি, যা-তা বলছেন সুদ্বীপ ভাইয়া? বুবুর ফোন নাম্বার আপনি কোথায় পেলেন?
কেন, স্বপ্নই আমাকে ফোন করেছিল। আমি সেভ করে রেখেছিলাম।
দেখি, নাম্বারটা দেখান তো।
সুদ্বীপ মোবাইল বের করে নাম্বার বের করার চেষ্টা করে।
কি আশ্চর্য! অনেকগুলো জিরো ছাড়া আর কোন নাম্বারইতো নেই। শুধু নামটি আছে “স্বপ্ন”।
সুদ্বীপ ভাই চলুন, রেষ্টুরেন্টের বাইরে গিয়ে আমরা বসি।
সুদ্বীপকে নিয়ে সুরুয দূরে একটা গাছের নিচে বসে।
সূর্য ডুবি ডুবি করছে।
আকাশ মেঘে ঢাকা।
হয়তো বৃষ্টি হবে।
সুরুয সুদ্বীপের হাত ধরে জিজ্ঞেস করে।
বুবু আপনাকে কবে ফোন করেছিল, সুদ্বীপ ভাইয়া?
এক বৃষ্টির রাতে।
এক বৃষ্টির রাতেই বুবু আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছন সুদ্বীপ ভাইয়া। বৃষ্টি ওর খুব প্রিয় ছিল।
আম্মুর কাছে শুনেছি প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে ওর জন্মও হয়েছিল।
বল কি সুরুয? তবে আমি একটু আগে কাকে দেখলাম? কে আমাকে ফোন করেছে? ওর মেয়ে যে বললো......
ভুল, সব ভুল সুদ্বীপ ভাইয়া!
সুরুয কেঁদে ফেলে।
বুবুর একমাত্র সন্তান, সে তো দেশের বাইরে স্থায়ী ভাবে বাস করছে।
তাহলে.............
ও আপনাকে খু-উ-ব পছন্দ করতো সুদ্বীপ ভাইয়া। আর কেউ না জানুক, আমি তা’ জানি।
হঠাৎ মেঘ গর্জন করে উঠলো।
সাথে সাথে ঝর ঝর বৃষ্টি।
সুরুয দৌড়ে গেল কটেজে।
সুদ্বীপ বৃষ্টিতে স্থির ভিজতে থাকলো।

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top