সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

‘আঁধারে ডোবা চাঁদ’ (১ম পর্ব) : তিয়েন আন্দালিব


প্রকাশিত:
৩ জানুয়ারী ২০২০ ১১:৪৪

আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২০ ১৩:১৫

 

সুমি গোসল করে আয়নার দিকে তাকায়। চেহারাটা মিষ্টি আছে। কিন্তু রঙটা কাল। আর শরীর বেঢব সাইজের মোটা। সেই শরীরের দিকে তাকিয়ে সুমির প্রায় কান্না এসে যায়। ছোট থেকেই এই অবস্থা। সে কাল এবং মোটা। কাল রঙ পেয়েছে তাও মানা যায়। কিন্তু এত মোটা হবে কেন? সে তো বেশি খাওয়া দাওয়া করে না। ঘন্টার পর ঘন্টা শুয়ে বসেও থাকে না। তাহলে কি ব্যাপারটা জেনেটিক ? কিন্তু তা কি করে হয়? তার বাবা ধবধবে ফর্সা, মা উজ্জ্বল শ্যমলা। দুজনের শরীরই ছিপছিপে চিকন আকর্ষনীয়। তবে সে কেন মোটা আর কাল হবে? এটা কি বিধাতার নিষ্ঠুর কোন খেলা? প্রতিদিনের মত এক রাশ দুঃখ নিয়ে সে বাথরুমের আয়নাটার দিকে তাকিয়ে থাকে। দুঃখের মাঝে একটাই স্বান্তনা, তার বুকগুলো সুন্দর। অনেক সুগঠিত। কিন্তু সুন্দর বুক দিয়ে সে করবে কি? মানুষ তো দেখে তার বেঢব মোটা একটা শরীর। সবাই কেমন যেন সূক্ষ্ণ এক করুনার চোখে তার দেহের দিকে তাকাতে থাকে।

‘আপা, এই আপা! বের হো! গোসল করব!

আইরিন ডাকছে। তার ছোটবোন। সুমি জলদি বাথরুম থেকে বের হয়ে আসে।

আইরিন বলে,’ কি রে আপা! এত সময় ধরে গোসল করিস কেন? গোসল করিস না সাজগোজ করিস?’

সুমি বলে,’ তোর মত না আমি! পাঁচ মিনিটেই গোসল শেষ! শরীরের কিছু কি পরিষ্কার করিস নাকি সেটাই সন্দেহ হয়!’

-আপা মাইর খাবি কিন্তু।

-যা যা। বাথরুমে ঢুক।

সুমি আইরিনের ছিপছিপে দেহটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কি সুন্দর দেহ! একদম যেন সিনেমার নায়িকা। এতটুকু বাড়তি মেদ নেই। ওর শরীরটা কেন আইরিনের মত হল না? অনেক চেষ্টা করেছে, খাওয়া কমিয়েছে, ব্যায়াম করেছে। কিন্তু শরীরটাকে আর কমানো গেল না।

সুমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অনেক দেশি বিদেশি ক্রিম মেখেও চেহারটাকে একটু ফর্সা করা গেল

না । অথচ  ছোট বোন আইরিন টুকটুকে ফর্সা। বাবাও ফর্সা। মাকেও ফর্সাই বলা চলে। ওরা তিনজন একই রকম। ফর্সা, ছিপছিপে গড়নের। মাঝখান থেকে সে কোত্থেকে এল? প্রায়ই গ্রাঢ় সন্দেহ হয়, মা-বাবা কি তাকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনল? হ্যা সেটাই হবে। না হলে পরিবারের সবাই এক রকম আর সে এরকম অন্যরকম হবে কেন?

বাসার সবাই নিশ্চয় তার রঙ আর শরীর নিয়ে হতাশ। এটা তাদের চোখমুখ দেখলেই বোঝা যায়। আইরিন তাকে সারাদিন মোটা মোটা বলে খোঁচাতে থাকে। রাগে মাথায় রক্ত চড়ে যায়। কিন্তু সে কিছুই বলে না। বলে কি হবে? আর মা তো একদিন খাবারের সময় বলেই বসলেন, ‘সুমি একটু খাওয়া দাওয়া কমা, শরীরের কি অবস্থা হয়েছে দেখেছিস? পরে তোকে বিয়ে দিতে কিন্তু কষ্ট হয়ে যাবে!’

বাবা বলে উঠেন,’ এই কি করছ! মেয়েটাকে একটু শান্তিতে খেতেও দিবে না নাকি?’

সুমি সেদিন খাওয়া ছেড়ে উঠে গিয়েছিল। নিজের রুমে গিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল। বাবা রুমে এলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘মা, তোর মায়ের কথায় কিছু মনে করিস না। মা তোকে নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা করে তো, তাই এসব বলে।‘

সুমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল,’ বাবা আমি এরকম হলাম কেন?’

বাবা নরম গলায় বললেন, ‘কাঁদিস না মা, সব ঠিক হয়ে যাবে।‘

‘সব ঠিক হয়ে যাবে’ – এটা হচ্ছে প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা বাবামায়ের অর্থহীন এক স্বান্তনাবুলি। মা বাবা যখন এটা বলেন, তখন মনে হয় আসলেই বুঝি একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আসলে কিছুই ঠিক হয় না। জীবন জীবনের মত চলতেই থাকে। নদী নদীর মত বয়েই যেতে থাকে। শুধু কষ্ট গুলো আরো গভীর হয়। সেই কষ্টগুলো মেনে নেওয়ার হয়ত একটা ক্ষমতা জন্মায় একসময়। এর বেশি কিছু না।

কষ্টকে মেনে নেয়ার ক্ষমতা সুমির এখনো জন্মায় নি। তাই আয়নায় নিজেকে দেখে প্রায়ই তার কান্না চলে আসে। যে কান্না কাউকে সে দেখতে দেয় না। সবার সামনে এমন ভাব দেখায় যেন সে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখি মানুষগুলোর একজন। মুখে হাসি লেগেই আছে। সুমি একটা বড় নিশ্বাস ফেলে খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। দুপুরের খাবারের সময় হয়েছে। সে আজ একমুঠো ভাত খাবে। সাথে কোন একটা তরকারি। এর বেশি কিছু না। সে জানে, এতে বাবা মা আর আইরিন কিছু বলবে না। কেউ বলবে না, এত কম খাচ্ছিস কেন? আর একটু খা। যেন সুমির এতটুকুই খাওয়া উচিত। আসলেই কি তার এতটুকুই খাওয়া উচিত? সুমি কিছুতেই বুঝে না। সুমি শুধু জানে, খাওয়া দাওয়া তার মোটা হওয়ার কারণ নয়। কারণ অন্য। কোন অজানা কারণ। হয়ত জন্মগত। কিন্তু এটা আর কে বুঝবে?

সুমির দিন এভাবেই কেটে যেতে থাকে। মোটা শরীরের জ্বালা নিয়ে। মানসিক কষ্টের পাশাপাশি শারীরিক কষ্টও তাকে বয়ে বেড়াতে হয়। একটু বেশি চলাফেরা করলেই সে ভয়ানক হাঁপিয়ে পড়ে। হার্টটা বুকে হাতুড়ি পেটাতে থাকে থাকে। মনে হয় শরীর চিঁড়ে বের হয়ে আসবে। এজন্য সে রিকশা ছাড়া চলাফেরা করতে পারে না। রিকশায় উঠলেও আরেক সমস্যা। রিকশায় উঠলে অন্য কোন বান্ধবী বা বন্ধুকে তার পাশে উঠানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। একে তো ভীষণ কষ্ট করে দুইজন আঁটে, তার উপর রিকশাওয়ালা সমানে হাঁপাতে থাকে। শেষে রিকশাওয়ালা ভাড়াও বেশি চেয়ে বসে। হাইরে দুনিয়া! একটু পর পরই সুমির বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসতে থাকে। তারপরও সুমি হাসতে থাকে। প্রাণখুলে আড্ডা মারতে থাকে। বন্ধু বান্ধব বলতে থাকে, সুমির মত হাসিখুশি মেয়ে নাকি পাওয়াই মুশকিল! তখন সুমির প্রাণটা একটু হলেও ঠান্ডা হয়। বন্ধু বান্ধবরা সুমিকে পছন্দ করে। ভালই পছন্দ করে। তার শরীরের দিকে সূক্ষ্ণ করুনার চোখে কেউ তাকায় না। এটা কি একটা বড় ব্যাপার নয়? হ্যা , তার কাছে এটাই অনেক বড় ব্যাপার।

 

তিয়েন আন্দালিব
লেখক ও সংগঠক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top