সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতিকথা; উপন্যাস নয়, ইতিহাস : সেলিনা হোসেন


প্রকাশিত:
৩ জানুয়ারী ২০২০ ১১:৪৬

আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২০ ১৩:৪৮

 

১৯৭১-এর ডিসেম্বরের ৩ তারিখ। আমি ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে, রিকশায়। মাথার ওপর সাঁই সাঁই করে উড়ে গেল একটা ভারতীয় বিমান—খ্যাপা মোষের মতন। মুক্তিযুদ্ধের ওই সময়ে আমার একটুও ভয় লাগেনি। মনেই হয়নি, ওরা বম্বিং করতে পারে, ঢাকা শহর ছারখার করে দিতে পারে কিংবা আমি মারা যেতে পারি। সবকিছু ছাপিয়ে আমার মনে তখন উচ্চকিত ছিল স্বাধীনতার আশা। অনবরত মৃত্যুর গন্ধের মধ্যেও আমরা ঘাপটি মেরে পড়ে থেকেছি স্বাধীনতার লোভে। ঘটনাটি কি এখন অবিশ্বাস্য শোনাচ্ছে? আসলে এটাই সত্যি। মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়টাই ছিল এমন।

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের ইতিহাস হলো সাধারণ মানুষের তিতিক্ষার ইতিহাস। এই যুদ্ধ নিছক সেনাবাহিনীর একক যুদ্ধ ছিল না, সবাইকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছিল সর্বাত্মক জনযুদ্ধ। আর এই জনযুদ্ধকে বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে দেখার বাসনা থেকেই আমার একেকটি মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসের জন্ম। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আমার সাতটি উপন্যাসের জন্মই জনজীবন থেকে উঠে আসা ঘটনা ও চরিত্রগুলো নিয়ে। পেছন ফিরে আজ যখন উপন্যাসগুলোর দিকে তাকাই, মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধের বিস্তৃতি যতটা, সবটুকু কি এক বা একাধিক উপন্যাসে ধরা সম্ভব? উত্তর হলো, না।

আমার মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসগুলোর প্রসঙ্গে প্রথমেই আসবে হাঙর নদী গ্রেনেড (প্রকাশকাল: ১৯৭৪)-এর কথা। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে আমার লেখা প্রথম উপন্যাস। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক আবদুল হাফিজ, তিনি মুক্তিযোদ্ধাও। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে রেসকোর্সে যাওয়ার সময় আমি কেমন আছি জানতে স্যার এলেন আমার সায়েন্স ল্যাবরেটরি কলোনির বাসায়। তাঁর কাছ থেকে এক মায়ের গল্প শুনলাম, যিনি দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচানোর জন্য নিজের প্রতিবন্ধী সন্তানকে তুলে দিয়েছিলেন পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে। ঘটনাটি যশোরের কালীগঞ্জের। এই ঘটনা এবং ওই মাকে নিয়ে স্যার আমাকে একটি গল্প লিখতে বললেন। আমিও প্রথমে ভেবেছিলাম, ছোটগল্পই লিখব।

পরে মনে হলো, না, এই কাহিনির যে ব্যাপ্তি সেটি উপন্যাসের। হাঙর নদী গ্রেনেড শুরু করেছি বুড়ির শৈশব থেকে। বারো ভাইবোনের মধ্যে একটি মেয়ে সচেতনভাবে তার বাবাকে বলছে তার নামটি বদলে দিতে। বুড়ির প্রতিবাদের এই জায়গা থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে নিজের সন্তানকে তুলে দেওয়া পর্যন্ত উপন্যাসটির পরিসর। একজন মা ভাবছেন, তাঁর নিজের সন্তানের বিনিময়ে দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচিয়ে দিলে তিনি স্বাধীনতা পাবেন। এই যে উৎসর্গ তিনি করলেন, এমন অসংখ্য উৎসর্গের বিনিময়েই তো আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের বিজয়। হাঙর নদী গ্রেনেড-এর অনেক পরে লিখলাম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দ্বিতীয় উপন্যাস যুদ্ধ (১৯৯৮)।

১১ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু তাহের আমার খালাতো ভাই। তাঁর অগ্রজ আবু ইউসুফ ভাই আমাকে বললেন কামালপুর যুদ্ধের ঘটনা। তখনই মনে হয়েছিল, ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযুদ্ধ এবং আশপাশের গ্রামে তার প্রভাবসহ নানা কিছু নিয়ে একটি উপন্যাস কি লেখা যায় না? শেষ পর্যন্ত সেই উপন্যাসটিই যুদ্ধ। উপন্যাসটির পরিকল্পনা অনেক পুরোনো, লিখতেও লেগেছে অনেক দিন। উপন্যাস রচনার জন্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে বেশ কয়েকবারই আমি গিয়েছি কামালপুর ও মেঘালয়-সংলগ্ন এলাকায়। এই আখ্যানের কেন্দ্রেও জনজীবন—আছে একটি হিন্দু পরিবার। সেখানে এক বয়সী নারী, বায়ান্ন সালে যার স্বামী ভাষা আন্দোলনের মিছিলে গিয়ে আর কোনো দিন ফিরে আসেনি, তবু সে তার সিঁদুর মোছে না। তার আশা, হয়তো স্বামী একদিন ফিরে আসবে। অথচ একাত্তরে যখন পাকিস্তানি সৈন্য আসছে, সে তার সিঁথি থেকে সিঁদুর মুছে ফেলল। হানাদারদের হাতে নির্যাতিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে সে তার বিশ্বাসকে বিসর্জন দিল। এমন অজস্র বিসর্জনের গল্প নিয়েই তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ।

উপন্যাসটি শুরু করেছি তারামন বিবিকে দিয়ে। তাঁর তালাক হয়ে গেছে। পুরো পরিবার মর্মাহত, অথচ তারামন আনন্দিত। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাচ্ছে—এটা যেন তারই প্রতীকী সূত্রপাত। পরে তারামন বিবি সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তারামনের এক বন্ধু রেণু। উপন্যাসে তার গল্পটিও এনেছি। যুদ্ধ শেষে একদিকে রেণুর প্রেমিক পা হারিয়ে ফিরে আসছে, আর রেণু ফিরছে বাঙ্কার থেকে। একপর্যায়ে রেণু ছেলেটিকে বলে, ‘দেশের জন্য তুমি দিয়েছ পা, আমি দিয়েছি জরায়ু।’

সত্যিকার অর্থে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার লেখাগুলো ঠিক উপন্যাস নয়, ইতিহাস। এগুলো নারীর সাহস, শক্তি, মর্যাদাবোধের ইতিহাস। তখন আমাদের অনেক মা-ই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হয়তো অতটা শিক্ষিত ছিলেন না, কিন্তু স্বাধীনতা সম্পর্কে দিনে দিনে তৈরি হয়েছিল তাঁদের সচেতনতা।

এরপর বলতে হবে কাঠকয়লার ছবি (২০০১)-এর কথা। যুদ্ধশিশু ও চা-বাগান, মুক্তিযুদ্ধের সময় চা-শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন—এই প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েছে উপন্যাসটি। স্বাধীনতাযুদ্ধে তো শুধু বাঙালিরাই অংশ নেয়নি, অন্যরাও দেশটিকে নিজের ভেবে আত্মত্যাগ করেছে। যেহেতু জনজীবন আমার একটি প্রিয় প্রসঙ্গ, প্রথমে ভেবেছিলাম মুক্তিযুদ্ধে চা-শ্রমিকদের অংশগ্রহণ নিয়ে আখ্যানটি লিখব। ১৯২১ সালে চা-শ্রমিকেরা শ্রীমঙ্গল থেকে রেললাইন ধরে চাঁদপুর হয়ে বাংলাদেশে আসে। ব্রিটিশ পুলিশ তখন গুলি চালায় ওদের ওপর—বিষয়টি অনেক দিন আমার মাথায় ছিল। পরে যুদ্ধশিশুর ব্যাপারটি এর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছি। মনে পড়ে, কাঠকয়লার ছবি লেখার সময় আমি চা-বাগানে গিয়েছি, কথা বলেছি চা-শ্রমিকদের সঙ্গে। এভাবে তাদের কাছ থেকে শোনা অভিজ্ঞতা এবং আমার কল্পনার মিশেলে লেখা হলো আখ্যানটি।

 

সেলিনা হোসেন
প্রখ্যাত সাহিত্যক, স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত ঔপন্যাসিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top