সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

শশী কোথাও নেই (১ম পর্ব) : আফরোজা অদিতি


প্রকাশিত:
১০ জানুয়ারী ২০২০ ১১:৪৭

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২০ ২০:৫৮

 

একমাসের বিয়েকরা বউ,শশী যেদিন বাপের বাড়ি গেলো সেদিনই ঘটলো পনেরো বছর আগের পুরানো সেই ঘটনাটা। আকাশ ভেঙে অঝোর ঝরছিল বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ভালো লাগে ওর। বৃষ্টি হলেই যাতে ভিজতে পারে তাই সঙ্গে ছাতা রাখে না কখনও। দুপুর থেকেই মেঘ ছিল আকাশে। অফিস থেকে বেরুতেই গায়ে পড়লো জলের ফোটা। কয়েক গজ যাওয়ার পরেই সেই জলের ফোটা ঝমঝমিয়ে পড়তে শুরু করলো। বৃষ্টিতে ভেজার মজাই আলাদা। মনের খুশিতে নীরু নেমে পড়লো সেই জলে। মেঘ দেখলেই মাথাটা পাগলাটে হয়ে যায় নীরুর। ওর গান গাইতে ইচ্ছা করে, জল ছপছপ দৌড়াতে ইচ্ছা করে। টি.এস.সি. আর বকুলতলার ফুটপাতে বসে ভিজে ভিজে চিনেবাদাম আর গরম গরম চা খেতে ইচ্ছা করে। চায়ের কাপে টুপ-টুপ আকাশ থেকে ঝরে পড়া ঠান্ডা জল মিশানো চা ! আহা! ---

ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য হাঁটতে শুরু করেও, কী মনে করে রিকশা নিয়ে বাড়ির পথ ধরলো নীরু। হুড ফেলে আকাশ থেকে ঝরে পড়া জল হাতের তালুতে নিতে নিতে নিজ আবাসে পৌঁছে ভেজা কাপড়েই চায়ের জল চাপিয়ে একদৌড়ে বাথরুমে। শাওয়ার নিয়ে চা। শাওয়ার নিতে নিতে গান গাইলো। কন্ঠ ভালো। ওস্তাদের কাছে কিছুদিন শিখে ছেড়ে দিয়েছিলো। গান শেখার কথা চিন্তা করে গানের টিচারের সঙ্গে কথাও বলেছে। আগামি মাস থেকে শুরু, সা রে গা মা---

খুশি খুশি মন নিয়ে ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে ডাইনিং টেবিলে এসে গরম চা সঙ্গে সমুচা, রসমালাই দেখে অবাক নীরু। দুটোই ওর পছন্দের খাবার। কিন্তু শশী নেই, এগুলো কে-ই বা আনলো, কে-ই দিলো টেবিলে গরম চা ! কে এসেছে ওর ঘরে? দরোজা কি খোলা রেখে দিয়েছে ? চেয়ে দেখলো নাহ! দরোজা বন্ধ। কপালে ভাজ পড়লো ওর।

এমন সময় পেছনে নূপুরের ঝুনঝুন আর চুড়ির রিনঝিন আওয়াজ কানে এলো। মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো ঘরে। কে? পেছনে তাকালো। কেউ নেই ! এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুঁজলো, কেউ কোথাও নেই ! ঘরের মিষ্টি গন্ধ বাড়ছে, তীব্র থেকে তীব্রতর। ওর মন বিবশ হয়ে যাচ্ছে। কোন কিছুই ভাবতে পারছে না। শহরে আসার আগে গ্রামের বাড়িতে দুবছর ওর ঘরে প্রায়ই মিষ্টি গন্ধের সঙ্গে নূপুরের আওয়াজ পেতো। নূপুরের উৎস খুঁজেছে; পায়নি। ষড়ঋতুর সব ভোরেই দেখেছে বালিশের পাশে সতেজ শিউলি; কে রেখেছে তার হদিস পায়নি। তাছাড়া শরতের ভোর ছাড়া তো শিউলি পাওয়া যায় না। কখনও দেখেছে নূপুরের তালেতালে দুলছে কদম গাছে বাঁধা ওদের দোলনাটি। তখন ভয় ছিল না। কৌতূহল ছিল। এই মুহূর্তে ভয় করছে। শশী ছাড়া এই শূন্য বাড়িতে নূপুর আর চুড়ির শব্দ। শশী কি ভাববে? নতুন বউ। বিয়ের বয়স মাত্র ৩০দিন। বাবা-মায়ের পছন্দ। সে-ভাবে জানাজানি-ই হয়নি এখনও। একটু পরেই আবার নূপুরের সঙ্গে চুড়ির আওয়াজ শুনতে পেলো। একি আপদ! এতোদিন এ শব্দ কোথায় ছিল? এখন ত্রিশ চলছে। ব্যাংকে চাকুরি, সদ্য বিয়ে করেছে। বউ, সন্তান, সংসার নিয়ে সুখী একজন মানুষ হতে চায় ও। কোন ঝামেলায় এখন কিছুতেই পড়তে চায় না নীরু। বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দ মন থেকে চলে গিয়ে বিরক্তিতে ভরে উঠলো ওর মন। চুড়ির রিনঝিন, নূপুরের ঝুনঝুন আওয়াজ শুনতে শুনতে মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করে। আওয়াজ লক্ষ্য করে এদিক-ওদিক করতে থাকে নীরু।

খুঁজো না আমাকে, পাবে না। আমি দেখা না দিলে কখনও খুঁজে পাবে না আমাকে। ওর পেছনেই সুরেলা কন্ঠ। চমকে ফিরে তাকায়। ‘কে তুমি? কী করছো এখানে?’
‘এখানেই তো থাকি।’ সম্মোহিত হয়ে যাওয়ার মতো মিষ্টি কন্ঠস্বর।
‘এখানে কোথায়? দেখতে পাচ্ছি না কেন?’ নীরুর কন্ঠস্বরে চাপা রাগ।
‘সময় হয় নি এখনও।’
‘কিসের সময়, সময়-অসময়ের কী আছে ? সামনে এসো।’
‘আসবো। এতো অধৈর্য কেন ? তুমি তো অধৈর্য ছিলে না। সময় হ‘লে নিজেই দেখা দিবো আমি।’ নূপুরের আওয়াজ দূরে সরে যাচ্ছে।
‘দেখা না দিয়ে যেতে পারো না তুমি! এই বাড়িতে কোথায় থাকো তুমি!’ নীরুর কন্ঠে বিস্মিত উত্তেজনা।
‘উত্তেজিত কেন? আমি তো সেই কিশোর বয়স থেকে তোমার সঙ্গেই থাকি। তোমার দেখ-ভাল তো আমিই করে এসেছি এতোদিন। আজ অন্য কেউ করবে এ-রকম তো হতে দিতে পারি না আমি। ভালোবাসি,খুব ভালোবাসি তোমাকে। আমার ভালোবাসাকে পাওয়ার জন্য সব করতে পারি আমি, করবো-ও সব কিছু।
অদৃশ্য মানবীর কথায় রাগ চড়ে যায় নীরুর মাথায়। রাগে অন্ধ বলে, আমি তোমাকে ভালোবাসি না। যাকে কখনও দেখি নি তাকে ভালোবাসার প্রশ্নই ওঠে না! আমার স্ত্রী ছাড়া অন্য নারীকে ভালোবাসবো কেন? তুমি তো অন্য নারী !
রাগ করো না নীরু। আমি অন্য নারী নই! আমি তোমার, শুধুই তোমার। কষ্টে ভেজা কন্ঠ। কিছুক্ষণ চুপচাপ। কোন শব্দ নেই। ফুপিয়ে কান্না। নীরুর বে-দিশা অবস্থা।
তুমি কষ্ট দিতে পারো না আমাকে! কান্না জড়ানো কন্ঠ শুনতে পেলো নীরু। আমাকে দেখলেই তো বিয়ে করতে হবে আর বিয়ে না করলে অন্ধ হবে তুমি। অন্ধ স্বামী নিয়ে কী ঘর করবে শশী! ভেবে দেখো। একবার ভেবে দেখো।
তোমাকে দেখবো না আমি। আমি বিবাহিত। অন্য মেয়েকে দেখা আমার নীতিবিরুদ্ধ।
তা ঠিক। তবে তুমি বিবাহিত বলেই তো আমার সুবিধা। এতোদিন ছায়ার মতো থাকতে হয়েছে এখন তা হবে না। বিয়ে না করলে দেখা দেওয়ার নিয়ম নেই তাই...। এখন দেখা দিলেই কাছে আসবে, ভালোবাসবে, বিয়ে করবে। মিষ্টি হাসি কাঁচভাঙা শব্দে ছড়িয়ে পড়ে ঘরে।

ওই হাসিতে মোহিত হয় নীরু। মুগ্ধ নীরু, তার কিছুক্ষণ আগের মনের জোর হারিয়ে ফেলে। ভাঙাকন্ঠে বলে, আমি তোমাকে ভালোবাসবো না, বিয়েও করবো না। শশীকে ভালোবাসবো।
না,তুমি ওকে ভালোবাসবে না। কন্ঠে দৃঢ়তা। তুমি ভালোবাসবে শুধুই আমাকে। এই আমাকে।
না। আমি...
কথা শেষ হয় না। নূপুর আর চুড়ির শব্দ ক্রমশঃ চলে যায় দূরে। ঘরে মিষ্টি গন্ধ । গন্ধে সে উদাস বাউল। নীরুর শরীর, মন সবকিছু ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছে। ও নেচে নেচে গাইলো Ñও সুন্দরী প্রিয়তমা , তুমি এলে জ্বলে আলো/ না এলে থাকে অমা ...

রাতে স্বপ্ন দেখলো। দিগন্তরেখায় এক তরুণীর সাদাটে আবছায়া অবয়ব। লীলায়িত ছন্দে কাছে এসে, অপূর্ব মনভুলানো হাসিতে সেই তরুণী বললো, আমি ভালোবাসি তোমাকে, জীবনপথের সঙ্গী, বন্ধু আমার। তুমি তো শশী নও। তুমি জীবনপথের সঙ্গী হতে পারো না। কী ভাবে সম্ভব!
হাসে তরুণী। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, হাত ধরো সখা, আমি লিপাঞ্জিনা।

 

আফরোজা অদিতি
লেখক ও সংগঠক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা





আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top