সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

ঝুটা: শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
১০ জানুয়ারী ২০২০ ১১:৫৭

আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২০ ১৩:৩০

 

বস্তির খুপরি ঘরে তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে ভাড়া করে প্রায় তিনমাস হলো বসবাস শুরু করেছে জয়তুন। গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে এসে ভালই লাগছিল জয়তুনের। আসতে না আসেতই বস্তির পাশে কলোনীতে কাজও পেয়েছে ভাল বাসায়। খুব বড়লোকের বাসা।
বিবিসাব ও সাহেব বড় ভাল মানুষ। দু’মাস যেতে না যেতেই বেতন বাড়িয়ে দেড় হাজার এর জায়গায় দু’হাজার করেছে। খাওয়া-দাওয়ার কোন হিসাব নাই। রান্না-বান্না কর। নিজের হাতে বেড়ে নিয়ে পেট খরে খাও। এমন কপাল ক’জনের মেলে।
জয়তুন ভোরে উঠে দাঁত মাজতে মাজতে এসবই ভাবে।  নাহ্ দেরী করলে চলবো না নে। আইজ শ্যাষ রোজা। চাঁদ দেখন গেইলে কাইল ঈদ। বাসায় ম্যালা কাম। বিবিসাব কইছে, ঈদের পরদিন অনেক মেহমান খাইব। ঈদের দিন থেইক্যাই রান্না বান্নার গোছগাছ করতি হবি।

আপন মনে জয়তুন মনের সাথে কথা বলে চলে।  প্রচন্ড গরমে গা জ্বালাপোড়া করে।  জয়তুন এক চিলতে আঙ্গিনায় বসে গা চুলকাতে থাকে। শ্যাষ রাইতে সেহ্রী খাওনডা ঠিক অয় নাই। কেমন গা গুলায়া আসতিছে।  বমি হবি নাকি? জয়তুন উশখুস করতে থাকে।  সকাল আটটার আগে বাসায় যাওন নিষেধ।  শহরের বড়লোক মানুষ।  বেলা দশটার আগে কেউ ঘুম থেকেই ওঠে না। 
নাস্তা করতে করতে এগারোটার আগে না। কিন্তু কি করবে জয়তুন।  

গরিবের জীবন।  পেটের চিন্তায় ঘুম ভাঙ্গেঁ ভোর হওয়ার অনেক আগেই।  তিন ছেলে মেয়ে, হীরা, মীরা আর জামাল।  দুইডা মাইয়ার আগে ছাওয়ালডা হলি কি হইতো? আল্লাহ্ মানুষের সাথে এমুন খ্যালা ক্যান খ্যালে? দেখতে দেখতে হীরা-মীরা কেমুন ডাগর হইয়া উঠতিছে।  চোকির উপর দুই বোন জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে। জয়তুন দু চোখ ভরে দেখে।  ছেলেটা বাপের গলা ধরে শুয়ে আছে।
জয়তুন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে আর ভাবে ইস্ আটটা যেন বাজতেই চায় না।  পাশের ঘরে রিয়াজ মুনসী রেডিও খোলে। সাতটার খরব হচ্ছে কেবল।


আরও এক ঘন্টা।  জয়তুন এবার মেয়েদের পাশে একটু কাত হয়ে শুয়ে পড়ে।  চোখটা জড়িয়ে আসে।  ক্ষনিকের জন্য ফিরে যায় ফেলে আসা দিনগুলিতে। কি সুখেই না কাটছিল তাদের সোনাঝরা দিনগুলো।  খাস গৃহস্থঘরের মেয়ে জয়তুন।  জমিজমা ভালই ছিল রহিমুদ্দিনের। একমাত্র সন্তান জয়তুনের বিয়ে দিয়েছিল ধুমধাম করে। ছোটবেলার দোস্তের ছেলে নাসির ব্যাপারী। গায়েগতরে শক্ত সামর্থ খেটে খাওয়া মানুষ। লেখাপড়াও জানে নবম কেলাস পর্যন্ত। জয়তুনও গ্রামের প্রাইমারী স্কুল পাশ।  বিয়ের পাঁচবছরের মধ্যেই তিন ছেলে মেয়ের জন্ম। জয়তুনের সংসারে একটু একটু করে যেন অভাব দানা বাঁধতে থাকে।  প্রথম প্রথম অভাবের সময় রহিমুদ্দিন মেয়ের সংসারে যথেষ্ট সাহায্য করতেন।

পরবর্তীতে আর সম্ভব হয় নাই। নদীর ভাঙ্গনে জমিজমা সব শেষ হয়ে যায়। শেষের দিকের জীবন খুব কষ্টে কেটেছিল রহিমুদ্দিনের। 
জয়তুনের মা পক্ষাঘাতে ভুগে ভুগে মারা যান। যেটুকু জমিজমা ভাঙ্গনের হাত থেকে বেচেছিল, তা বিক্রি করে কোনরকম  নাতিপাত করতে করতেই রহিমুদ্দিনও মারা যান।  বিয়ের সময় জয়তুনকে কিছু জমিজমা দিয়েছিল রহিমুদ্দিন। কর্মঠ নাসির ব্যপারী চাষাবাদ করে আরও কিছু জমি বাড়িয়েছিল।  তিন ছেলে-মেয়ে স্কুলে পড়াশোনা করতো।  টিনের চালা ঘর আরও বড় করে বানিয়েছিল।
বাপের দেয়া একটি গাভী লালন পালন করে জয়তুনের তখন ভরা সংসার।  হঠাৎ করে নাসির ব্যাপারীর কেমন পরিবর্তন লক্ষ্য করে জয়তুন।  সরকার গ্রাম উন্নয়নের কাজ করছে।

তাদের গ্রামেও বিদ্যুৎ এসেছে। কাঁচা রাস্তা পাকা করা হচ্ছে।  রিক্সার টুং টাং শব্দ যেন গানের ঝৎকারে মেতে ওঠে জয়তুনের  সারে। একদিন নাসির ব্যাপারী বলে, নাহ্ আর চাষবাসের কাম বালা লাগতিছি না।  তয় কি কাম কইরবা? পেট চালাইবা কেমনে?  ক্যা, রিকসা চালামু। তগরেও মাঝে মাঝে রিকসায় ঘুরামু।  হিরা, মিরা আর জামাল খুশীতে লাফ দিয়ে ওঠে।  হ’ বাজান, খুব বালা অইবো। তুমি রিকসা কিন্যা ফেল।
নাসির ব্যাপারী ঠিকই রিকসা কিনলো।
রুজী রোজগারও আগের চেয়ে বেশ ভালো। ’
ঘরে একটা সাদা কালো টিভি কিনলো।
আর এই টিভিই হলো জয়তুনের কাল।
টিভিতে রাতদিন বিদেশী সিনেমাগুলো খুব মজা করে দেখে দেখে সময় কাটাতে লাগলো নাসির ব্যাপারী।
কাজে কর্মে আগের মত মন নাই।
জয়তুনের সাথে খিটিমিটি লেগেই থাকে।
যেদিন রিকসা নিয়ে কাজে যায়, ঘরে ফেরে অনেক রাত করে। জয়তুন বুঝতে পারে নাসির নেশা করে, জুয়া খেলে।
অনেক চেষ্টা করেও ফেরাতে পারে না।
জুয়ার নেশায় একে একে ঘরের সব কিছু বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে যায় জয়তুনের সংসার।
সহায় সম্বলহীন জয়তুন অবশেষে ঢাকা শহরে চলে আসে জীবিকার সন্ধানে।
মা, কামে যাবি না?
উঁ! হ’ বাজান এইতো যামু। সন্বিত ফিরে পায় জয়তুন পাতিলে পান্তা ভাত আর পুটিমাছের সালুন আছে। সবাই মিল্যা খায়া লইয়ো।
না, মা। আইজনা শ্যাষ রোজা। সবাই আইজ রোজা থাকুম। বাজান না থাকলে, না থাকবো। জামাল বাপের দিকে তাকিয়ে হাসে।
নেশাখোর নাসির ব্যাপারী বিরক্তে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে বউ-ছেলে মেয়ের দিকে।
জয়তুন বাসার দিকে পা বাড়ায়।
বেশী সময় নাই আর।
আজ বাদে কাল ঈদ।
পরশু মেহমান খাইবো। বিবিসাব থরে থরে কেমনু সুন্দর কইরা গুছাইয়া রাখছে।
সেদ্ধ কিমা পিষতে হইবো। বুটের ডাল সেদ্ধ পেয়াজ-রসুন-আদা-জিরাতো আছেই।
কোমরে আঁচল পেচিয়ে জয়তুন শিলপাটা নিয়ে বেলকুনিতে এক পাশে বসে বাটনার কাজে লেগে যায়।
গুনগুনিয়ে গান করে- “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ”। সমস্ত কাজ শেষ করে জয়তুন সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ী ফেরে।
পরদিন ঈদ।
বিবিসাব ঈদের দিন ছুটি দিয়েছে। নতুন কাপড়-চোপড়, দুধ-সেমাই এর টাকা ছাড়াও উপরি বকশিসও দিয়েছে।
জয়তুন এতে মহাখুশী।
ঈদের পরদিন কাজে যাইতে হইবো।
ঐ দিন ম্যালা কাম।
কত কি রাধন-বাড়ন অইবো।
মা, ঈদের পরদিন বিবিসাব আমাগো ব্যাবাকের জন্যি বালা বালা খাওন দিবো, না মা।
জামাল মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে একথা, ওকথা জানতে চায়।
জয়তুন ও ছেলেকে আশ্বাস দেয়।
হ’ বাজান। বিবিসাব দিল দরিয়া মানুষ।
আল্লা দিলে কাইল আমরাও মজা কইরা বালা খাওন খামু। কত মেহমান আইবো বিবিসাবের বাসায়।
সত্যি সত্যিই সারা দিনরাত খেটে পরদিন জয়তুন সাত-আট প্যাকেট খাবার নিয়ে রাত দশ-এগারোটার দিকে বাসায় ফিরলো।
অপেক্ষা করতে করতে ছেলে মেয়েরা ঘুমিয়ে পড়ছে।
জেগে আছে নেশাখোর স্বামী।
এত রাইতে কি খাওন আনছোস দেহি,
তুমার আগেই দেহন লাগতো না।
ও জামাল...হিরা...মিরা.... ওঠ মা ... ওঠ বাজান।
জামাল এক লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠে জয়তুনের হাত থেকে প্যাকেট গুলো নিয়ে উপরের এক প্যাকেট খুলে গোগ্রাসে খেতে থাকে। কাচ্চি বিরিয়ানী, সাথে মুরগীর বড় একটা রোস্ট-ডিম-সালাদ।
চারটি চারটি করে মোট আট প্যাকেট বিবিসাব নিজ হাতে জয়তুনের হাতে তুলে নিয়েছে।
আর চারটি প্যাকেটের উপরের প্যাকেটটি খোলে হিরা।
ওমা... কত্ত বড় বড় মিষ্টি মা। ক্ষীর জর্দ্দা-হালুয়াওমা দেহ্ কত্ত খাওন দিছে বিবিসাব।
আর একটি প্যাকেট ঝটকা টান মেরে কেড়ে নেয় নাসির ব্যাপারী।
খুলেই চিৎকার করে ওঠে।
অই.... খানকির বেটি..... কি আনছস??
এতো সব ঝুটা খাওন দিছে তরে। ঝুটা..... জয়তুনের চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে ধাক্কা মেরে ভাঙ্গা চৌকির উপর ফেলে দেয়।
টলতে টলতে সারাদিনের ক্লান্ত শরীরে জয়তুন একে একে প্যাকেটগুলো খুলতে থাকে।
অ্যা!
আঁৎকে ওঠে জয়তুন।
সব প্যাকেটেই যে ঝুটা খাবার।
একটি বোলে ঝুটা খাবারগুলি রেখে দিতে বলেছিল বিবিসাব।
জয়তুন বেছে বেছে ঝুটা খাবারগুলি আলাদা করে রেখেছিল।
সেই খাবারগুলিই যে বিবিসাহেব তাকে ভরে ভরে প্যাকেটে সাজিয়ে দিয়েছে।
উপরের দুটি প্যাকেট এ ভাল খাবার। বাকি সবই ঝুটা।
সারাদিনের অভুক্ত নেশাখোর নাসির ব্যাপারী আবারো রক্তচক্ষে জয়তুনের চুলের মুঠা পেচিয়ে ধরে।
বাইরে দমকা বাতাস।
প্রচন্ড ধুলিঝড়।
মেঘের গর্জন।
সবকিছুর সাথে যেন জয়তুনের বোবা কান্না সমুদ্রের ঢেউ এর মত আছড়ে পড়তে থাকে।
ঝুটা.... ঝুটা.... ঝুটা।

 

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top