সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

শশী কোথাও নেই (শেষ পর্ব) : আফরোজা অদিতি


প্রকাশিত:
১৭ জানুয়ারী ২০২০ ১২:৩৮

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২০ ২০:৫৮

 

লিপাঞ্জিনার হাত ধরার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের ভেতর পরিবর্তন লক্ষ করে। ওর সমস্ত শরীর যেন কথা বলছে, গান গাইছে। মনের ভেতর কিচির-মিচির করছে আনন্দের পাখিরা। বারবার ওই তরুণীর নাম ধরে ডাকতে ই”ছা করছে। লিপাঞ্জিনা! লিপাঞ্জিনা, লিপাঞ্জিনা। বারবার ডাকে। ওর হাত ধরে ঘুরে বেড়ায় নীরু। ওরা হাত ধরাধরি পৌঁছে যায় ওই দিগন্তরেখার কাছে। দিগন্তরেখায় গিয়ে এক হয়ে যায় দুজনের শরীর।

রোজ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে। ব্যায়াম করে। কখনও রাস্তায় হাঁটে। আজ সকালে ঘুম ভাঙে না নীরুর। রেশমি চুড়ির আওয়াজে যখন ঘুম ভাঙে তখন সাড়ে নয়টা। স্বপ্নের আবেশ তখনও দেহে, মনে। স্বপ্নের রেশ কেটে যাওয়ার ভয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে নীরু। দেয়াল ঘড়িতে সাড়ে নয়টার সংকেত। তড়িঘড়ি ফ্রেস হয়ে অফিসে রওয়ানা হয়। পেছনে নূপুরের শব্দ। খেয়ে যাও। না খেয়ে গেলে, অকল্যাণ হবে আমার। নীরু তাকিয়ে দেখে, টেবিলে সাজানো পাউরুটি, কলা, মাখন, জেলি, ডিম, মিষ্টি। ওর পছন্দের নানান পদ। ওদিকে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে দরোজার দিকে পা বাড়ায়। এগিয়ে আসে নূপুরের শব্দ, হাতে নরম স্পর্শ পায় নীরু। শিহরিত হয়। তবুও জিদ্দি বালকের মতো বলে, না, খাবো না।

কান্নার কোন শব্দ পায় না নীরু। অথচ ওর হাতের ওপর একফোটা চোখের জলের সঙ্গে তীব্র গন্ধ এসে লাগে নাকে। ভেজা কন্ঠ শুনতে পেলো নীরু। আমার এতো বছরের প্রেম বৃথা হবে! কখনও না। তোমার জন্য সব ছেড়েছি। পরিবার,পরিজন, কমিউনিটি, দেশ সব ছেড়েছি আমি। শুধু তোমাকে পাবো বলে, শুধুই তোমাকে পাবো বলে সব ছেড়েছি। প্লিজ, খেয়ে যাও। নীরু এড়াতে পারলো না অদৃশ্য মানবীর কথা। বাধ্য ছেলের মতো খেয়ে নেয় ।

নীরু না জেনে ভুল করে ফেললো। এই মুহূর্তে নীরু যদি না খেতো তা’হলে ওর ইচ্ছা শক্তি থাকতো। ভোরের এই তিথিতে লিপাঞ্জিনার হাতে খাবার খেলেই ও সম্পূর্ণরূপে লিপাঞ্জিনার হয়ে যাবে। এটা জানা ছিলো না নীরুর। এখন নীরুর দেহ- মন সম্পূর্ণ লিপাঞ্জিনার। লিপাঞ্জিনার ইচ্ছার বাইরে কিছু করার ক্ষমতা রইলো না ওর। শশী ফিরেছে। ঘর-দোর পরিপাটি। মনে মনে স্বামীর প্রশংসা করে ঘরে গিয়ে বিস্মিত! খাটের পাশে দাঁড়িয়ে একটা সাজুগুজু করা কনেবউ!
এই কে তুমি? বিস্মিত শশীর প্রশ্ন ।
আমি! আমি, লিপাঞ্জিনা।
আমার বেডরুমে কী করছো? কী চাও!
কিছু চাই না। এখানেই থাকি,আমার ভালোবাসার কাছে। আমার ঘরে।
তোমার ঘর ? তোমার ভালোবাসা? এটা কিছুতেই হতে পারে না। এটা আমার, আমাদের ঘর।
না, তোমার ঘর নয় । এ ঘর আমাদের। কন্ঠে হসির ঝমক।
শশীর রাগে গা জ্বলে। চলে যাও, গেটলস্ট।
যাবে তুমি। আমি নই। ও আমার, শুধুই আমার। হাসে লিপাঞ্জিনা। লিপাঞ্জিনার হাসিতে লক্ষ কোটি বিষধর সাপ দংশন করলো শশীকে। শশী সেই বিষে ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকলো।

শশী ফোন করলো নীরুকে। বাসায় ফিরতে বললো ওকে।
লাভ নেই শশীকণা। ও বিকেলের আগে আসবে না। পনেরো বছর একসঙ্গে...। মনদগ্ধ করা হাসি হাসে লিপাঞ্জিনা। মিথ্যে বলো না। কপালের শিরা দপদপ করছে শশীর।
মিথ্যে নয়। চিন্তা করো বিয়ের পর কখনও একসঙ্গে থেকেছো? থাকো নি। থাকতে দেই নি আমি। দেবোও না কখনও।
সত্যিইতো! বিয়ের পর একরাতও একসঙ্গে থাকা হয় নি। বিয়ের আগের বাসা এটা। এক রুমের ছোটবাসা। বিয়ের দিন থেকে প্রতিদিনই মেহমান। সারাদিন অফিস, রাতে মেহমান। কাছাকাছি হতেই পারেনি ওরা।
তুমি জানলে কি করে? শশীর চোখে আগুন। বললাম না একসঙ্গে থাকি ।

বিকেলে নীরু ফিরলো। শশী কাঁদছে । কাঁদছো কেন? জবাব দেয় না শশী। অনেকক্ষণ পরে কান্না থামিয়ে বলে, ওই কনে-বউটা কে? কাকে নিয়ে থাকো তুমি?
কোন বউ! বিস্মিত নীরু। ওইতো খাটের পাশে। নীরু দেখতে পায় না লিপাঞ্জিনাকে। কই কোথায়?
ওইতো। না দেখার ভান করছো কেন?

কী আজে-বাজে বকছো বলো তো। এতোদিন পর দেখা। বিয়ের পর তো মেহমান আর মেহমান। তোমার সঙ্গে ভালো ক’রে কথা পযন্ত বলতে পারি নি। কন্ঠে ব্যথিত উষ্মা ।
কথা বলতে পারো নি, না বলতে ইচ্ছা হয় নি। বউ আছে তোমার বলো নি! ভালোবেসে বিয়ে করেছো, সংসার করছো, তা’হলে আমাকে কেন--- অধৈর্য শশী চিৎকার করে।
খামোখা আজেবাজে কথা নিয়ে চিৎকার বরছো শশী। ধৈর্য হারায় নীরু। তোমরা মেয়েরা এমনি, কথা নেই বার্তা নেই অযথা চিৎকার করো, আবার কাঁদো। চোখে পানি এসেই থাকে তোমাদের। কথাগুলো বলেই অবাক নীরু। এ কী ভাবে কথা বলছে ও। ও তো এমন মাথাগরম আর অসহিষ্ণু মানুষ নয়। তাহলে--- চিন্তিত হয় নীরু। নতুন বউ। ওর সঙ্গে এভাবে কথা বলা উচিত হয় নি। নাহ, শশীর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। ক্ষমা চাইতে গিয়েও ঘটে বিপত্তি। কথায় কথায় আরও রাগ হয়ে যায় নীরুর। শশীর কাছে ক্ষমা চাওয়া আর হয় না।

তুচ্ছ বিষয়েই রোজ চলে বাকযুদ্ধ। কখনও নীরু বারান্দায়, কখনও শশী। একদিন শশী মায়ের বাসায় তো অন্যদিন নীরু বন্ধুর বাসায়। একত্রে থাকা হয় না ওদের। নীরুর সঙ্গে লিপাঞ্জিনার কথা নেই। নূপুর, চুড়ির শব্দও নেই। শুধু ঘরে মিষ্টি গন্ধ। লিপাঞ্জিনাকে দেখতে পায় শশী। রান্নাঘরে গেলেই দেখতে পায়, রান্না করছে লিপাঞ্জিনা, টেবিল সাজাতে গেলে, দেখে পঞ্চব্যাঞ্জনে আগেই সাজানো হয়েছে টেবিল। রাতে ঘরে গেলে বিছানায় দেখতে পায় ওকে। ওর চলাফেরা শশীর মনকে পোড়ায়। যতোক্ষণ বাড়িতে থাকে নীরু দুজনের বাক-বিতন্ডা, রোজ খাবার নষ্ট। দিন যাওয়ার সঙ্গে সম্পর্কের এতোই অবনতি হলো, বাসা ছেড়ে চলে গেলো শশী। যেদিন শশী চলে গেলো, সেদিনই চুড়ির রিনঝিন শব্দ পেলো নীরু। রাতে চুড়ির শব্দ তুলে বললো মিষ্টি কন্ঠ, বিয়ে করো আমাকে।

কেন এমন করছো তুমি? তোমাকে দেখি নি পর্যন্ত। আমি দশটা মানুষের মতো সন্তানসহ সুন্দর জীবন চাই। শশীকে চাই। শশী নয়, সব দেবো আমি। সন্তান দেবো, দেবো সংসার। একজন স্ত্রীর কাছে তার স্বামীর যা যা পাওয়ার সব দেবো আমি তোমাকে। মিষ্টিগন্ধ জড়িয়ে ধরে ওকে। সম্মোহিত নীরু একটা অস্তিত্ব অনুভব করে।

স্বপ্ন দেখে। দিগন্তরেখা থেকে হেঁটে আসছে এক তরুণী। দুহাত বাড়িয়ে টেনে নিলো সেই নারীকে। সেই নারীও নিশ্চিন্তে সমর্পন করলো নিজেকে। নীরু ঘুম ভেঙে দেখে ওর পাশে শশী নয়, অন্য এক নারী । ভোরের আলো পড়েছে তার চোখে-মুখে। নীরু অনন্য এক ভালোলাগা নিয়ে তাকিয়ে থাকে ওই নারীর মুখে। বুকের ভেতর অপূর্ব এক ভালোবাসা জেগে ওঠে ওই নারীকে ঘিরে। সেই ভালোবাসার মাঝে শশী নামের কোন অস্তিত্ব নেই, যেন ছিল না কোনদিন।

 

আফরোজা অদিতি
লেখক ও সংগঠক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top