সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

গল্প - দ্বিতীয় মাতৃত্ব (১ম পর্ব) : ড. বেগম জাহান আরা


প্রকাশিত:
২৪ জানুয়ারী ২০২০ ১১:১৫

আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২০ ১০:৫২

 

সকলের ধারনা, নানু দাদু হলে জীবন ফুরিয়ে যায়। আশা আকাংখা সুখ দুঃখ চাওয়া পাওয়া প্রেম ভালোবাসা ইত্যাদি মানবিক ও সুকুমার বৃত্তি গুলো মরে যায়। থাকে শুধু রাগ হিংসে কুচুটেপনা আর  রাজ্যের রোগ। এই ধারনাটা যে কতো বড়ো ভুল, তা নিয়েই কথা হচ্ছিলো সেদিন। ওশিন এসব নিয়ে কোনো কথা বলছে না দেখে রাবেয়া বললো, তুমি একেবারেই চুপ কেনো ভাই?

-কি যে বলি, তাই তো ভেবে পাচ্ছি না।

-এখনই যদি কথা না বলো তাহলে আমরা সবাই যখন একসঙ্গে বসবো, তখন মুখই খুলবে না মনে হয়।

-আসলে কি জানো, আমার না আজকাল কথা বলতে ভালো লাগে না।

-জানি তো, নাতির কথা ভবছো। এই নাতি প্রীতির জন্যই তোমাকে ওশিন ডাকি, জানো তো?

মিষ্টি করে হাসে ওশিন। বলে, তোমার দেয়া এই নাম আমার ভালোই লাগে আপা।

আরে বাবা, ওরা কক্স বাজারে গেছে, ভালোই আছে। এতো ভাবনার কি হলো? সারাদিন শুধু নাতি আর নাতি। হাসে রাবেয়া।

-ভাবনা তো একটু হয় ভাই। অপুটা যে সাঁতার জানে না গো।

-তো কি হলো? বৌ আছে না, সামলে নেবে।

-তার তো শরীর ভালো না। আমি বলেছিলাম, এই সময় না যেতে। মাত্র চার মাস হলো, আর এক মাস বিশ্রামে থাকলে ভাল হতো। প্রথম বাচ্চা তো।

-তোমার না একটু বেশি বেশি ওশিন। দেখা শোনার জন্য তাহলে সঙ্গে গেলেই পারতে। আসল কথা হলো ওপুর জন্য চিন্তা। এবার ওকে সাঁতার শিখতে বলো। এশা বলে।

ওশিন মুখ টিপে হাসে। মনে মনে বলে, যেতে চাইলেই কি যাওয়া যায়? পারলে তো যেতোই।

রাবেয়া বলে, এই প্রসঙ্গ বাদ দাও। আজ দই বড়া করেছি, একটু খেয়ে দেখো তো কেমন হলো।

-আপনার দই বড়ার তুলনা নেই আপা। ওশিন বলে, রেসিপি নিলেই  কি রান্না হয়? হাতের গুন লাগে।

-ঠিক বলেছো। আমার কাজের মেয়েটা দইবড়া বানায়। নরমও হয়। কিন্তু স্বাদ পাইনা। এশা আপার বড়ার মতো হয় না।

-আজকাল ডাল বেটেই বড়া বানায়। একটু বেকিং পায়ডার দেয়। তাতে ফুলে ওঠে বটে, কিন্তু স্বাদ হয় না। বাটা ডাল দুঘন্টা রেখে দিয়ে খুব ভালোকরে ফেঁটে নিলে বড়া ফোলেও, একটু টক টক স্বাদও হয়। অতো ধৈর্য কোথায় মানুষের আজকাল?

ভালোই কাটলো সময়। বাসায় ফিরে  যে কে সেই। নিঝুম একেকীত্ব।ওশিনের বড্ড একা একা লাগে। সাতটা দিন কেমন করে এতো লম্বা হয়? অপুর মা বাবা দুজনেই মারা গেলো কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসার সময় বাস এক্সিডেন্টে। বাচ্চাটা আহত হয়েও বেঁচে ছিলো। কি মারাত্মক খারাপ সময় তার তখন। ঐ সময় আহত বাচ্চাটা নিতে এলো অপুর চাচা আর দাদি। ভালোবেসে  নয়, অধিকার ফলানোর জন্য। এতো নিষ্ঠুর কি করে হয় মানুষ? অপু তখন মাত্র দেড় বছরের। বড়ো বাচ্চাটার বয়স মাত্র সাত। ওকে দিতেই হলো বুকে পাথর বেঁধে। কিন্তু অপুকে দিলো না। মায়ের স্নেহে বুকে তুলে নিলো। নাতির স্পর্শে ভুলে থাকতে চাইলো মেয়ের শোক। বড়ো নাতিকে কাছে না পাওয়ার শূন্যতা। শক্ত অবস্থান নিলো ওশিন। প্রয়োজনে মামলা মোকদ্দমা করবে। কিন্তু অপুকে দেবে না, স্পষ্ট  জানিয়ে  দিলো।

কোনোদিন অপুকে যেতে দেয়নি  দাদার বাড়ি। ওরাও খুব কম খোঁজ খবর নিতো। টাকা পয়সা দেয় নি কখনো। তাতেই বেঁচেছে ওশিন। দাবি করতে এলে অন্তত সেই কথাটা বলতে পারবে। আর অপু তো চেনেই নি দাদা বাড়ির কাউকে। ওশিনের স্বামী ইসমাইল জাহাজে কাজ করতো।দুনিয়ার অনেক কিছু দেখেছে। বিবেচক মানুষ। তাঁর ধারনা ছিলো, বেশি ছেলে মেয়ে হলে ভালোভাবে মানুষ করা যাবে না। পরিবার পরিকল্পনার কথা সে অনেক আগেই জেনেছে দেশ বিদেহে জাহাজে ঘোরার সময়। ওশিনকেও বলেছিলো। সংসার বড়ো করবে না এই চিন্তা থেকেই ঐ একটি মাত্র মেয়েই নিয়েছিলো তারা। নাম রেখেছিলো  রঞ্জনা। চমতকার ভাবে মানুষও করেছিলো। ধুম ধাম করে বিয়ে দিলো। দশ বছরের সংসার জীবনে খুব ভালো  ছিলো তারা। কিন্তু কপালে সইলো না। এখনো ভাবতে পারে না ওশিন পেছনের কথা। বুক ফেটে যায়। কিন্তু আয়ু না ছাড়লে তো যেতেও পারবেনা ওপারে।

প্রথম প্রথম অপু 'মা' বলে ডাকতো ওশিনকে। কাজের বুয়ার ডাক শুনে শিখেছিলো। জান জুড়িয়ে যেতো ওশিনের। সে তাকে ডাকতো ‘দিদাম’ বলে। এক সময় সেও তাকে পালটা ‘দিদাম’ বলতে শিখলো। ভালোই হলো। শেখাতে হলো না। শব্দটা বলতে শিখে সারাদিন সে কি ডাকা ডাকি ! দিদাম এটা দাও, দিদাম ওটা দাও, দিদাম মাছ বেছে দাও, দিদাম তোমার মুখের পান দাও, দিদাম তোমার চায়ের শেষটা দাও। আর ইসমাইল ওকে ডাকতো 'দাদা' বলে। পালটা অপুও বলতো 'দাদা'। ফলে নানা নানু শব্দ দুটো ও জানতোই  না অনেক দিন।

শোক দুঃখ তাপ যাতনা বেদনার মধ্যেই অপু বড়ো হতে  লাগলো। দিদাম আর দাদার চোখের মনি অপু। ওর এইচ এস সি পরীক্ষার পর জীবনে দুর্যোগ আসতে লাগলো একের পর এক। ওর দাদার কিছু শেয়ার ছিলো এক ব্যাংকে। সে ব্যাংক দেউলিয়া ঘোষনা করলো। এক বন্ধু ট্রান্সপোর্ট-এর ব্যাবসা করার জন্য টাকা নিয়েছিলো, সেটাও গেলো। ফেরি ঘাটে পন্টুন ছাড়িয়ে যমুনায় পড়ে গেলো বাসটা। দেশের জমি চাচাতো ভাইরা দখল করে আখ চাশ করতে লাগলো। যে আত্মীয় জমি দেখা শোনা করতো, সে দুদিনের জ্বরে মারা গেলো। যেনো মড়ক লাগলো সংসারে।

ইসমাইল কিছু বলতো না মুখ ফুটে। বুক চাপা মানুষ। কিন্তু এতো কি আর সহ্য হয়? চলে গেলো এক আঘাতেই। বললো, বুকে ব্যাথা করছে।হাসপাতালে নিয়ে গেলে ওরা বললো,সে আর নেই। ব্যাস সব শেষ।জীবনের পর্যটন চুকে গেলো বিনা নোটিসেই। তবুও জীবন। অপুকে যে মানুষ করতেই হবে। জীবনের ঘোর অমানিশার মধ্যে অপুই তার চন্দ্র সুর্য। ওঠে ডোবে। প্রকৃতিতে শীত বসন্ত আসে। নির্বিকার সময়ের রথ ঘোরে আপন মনে। গোপনে চোখের কোন মুছে ওশিন রাঁধে বাড়ে। খায়, খাওয়ায়। অপু বড়ো হচ্ছে এই তার সান্ত্বনা। রঞ্জনার একমাত্র বংশ প্রদীপ। তার সোনার পুতুল। প্রানের প্রান। হৃদয়ের স্পন্দন।

দিন কেটে যায়। অপু বড়ো হলো। চাকরি পেলো। এক সময় মেয়ে পছন্দ করে তার বিয়েও দিলো। রঞ্জনা বলতো, সে মা বাবার মতো একটা মাত্র বাচ্চা নেবে না, নাতি নাতনিও হবে পাঁচ ছয়টা। মায়ের গল্প শুনে অপু হাসতো। কি যে সরল হাসি! এখনও দিদামের গলা ধরে শুতে ভালোবাসে।বিয়ের পর বৌ দেখে তো থ।

অপুর প্রথম চাকরি হলো পঞ্চগড়। 'যেতে নাহি দেবো' বললে কি আর হয়? নতুন বৌ নিয়ে  অপু চলে গেলো একদিন চাকরিতে। ওশিনের মনে হলো হৃদয়টা খুলে নিয়ে গেলো অপু। তখন রোজ একবার করে ফোনে কথা বলতো। নাতিবৌ নাকি হাসতো দেখে। বলতো, এমন কখনো দেখিনি। রোজ কথা বলার কি আছে? সেই তো একই  কথা, কি করছো, কি খেয়েছো, কোথাও বেড়াতে গেলে কি না, এই তো। অপুই বলেছে বৌ-এর এসব কথা। তাই তো,এলে বেলে কথার যে কি মানে, যে না বোঝে তাকে বোঝানো যাবে না। আসলে গলার স্বরটা শোনাই উদ্দেশ্য।

আস্তে আস্তে অপুর ফোন করা কমে গেলো। বুকের ভেতর সে কি উথাল পাথাল  আউলা ঢেউ  ওশিনের। কাকে বলবে কষ্টের কথা? সে নিজেই তো এখন এতিমস্য এতিম। কোথাও কেউ নেই যে তার কথা শুনবে এবং বুঝবে। একদিন অপুকে ফোনে বললো, দিদাম বাবা, খুব কি কাজ?

-তা কাজ তো থাকেই দিদাম।

 

ড. বেগম জাহান আরা
সাবেক প্রফেসর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
সক্রিয় ভাষাবিজ্ঞানী এবং কথা সাহিত্যিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top