সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

গল্প - মতিজানের মেয়েরা (১ম পর্ব) : সেলিনা হোসেন


প্রকাশিত:
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০২:৩০

আপডেট:
১৪ এপ্রিল ২০২০ ০১:১৯

 

বিয়ে হলে নতুন সংসারে মেয়েদের একটি অবস্থান নির্ধারণ হয়, সে বাড়ির বউ হয়, বউ হওয়া মানে একটি নতুন জন্ম সুখ দুঃখ অনেক কিছু মিলিয়ে আপন ভুবন-সংসারের কর্তৃত্ব-এমন একটি ধারণা ছিল মতিজানের। কিন্তু এই সংসারে ওর অবস্থানটা যে কোথায় তা ও বুঝতে পারে না। এই সংসারের ওর কি প্রয়োজন সেটাও জানে না। মাথার ওপর আছে শাশুড়ি, সংসার তার, সে সংসারে মতিজান বাড়তি মানুষ। এই বাড়তি মানুষ হওয়ার কষ্ট ওর বুক জুড়ে। শাশুড়ির তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ বুক পুড়িয়ে খাক্ করে দেয়। তখন মতিজানের হৃদয় থেকে সংসারের সাধ উবে যায়। ও বিধবা হতে চায়।

মতিজানের শাশুড়ি গুলনূর, তার ছেলে আবুল। ছেলের জন্মের দেড় বছরের মধ্যে বিধবা হয়েছিল, এভাবে বাইশ বছর কেটেছে। স্বামীর ভিটে-জমি যা ছিল বেশ শক্ত হাতে তার দেখাশোনা করে সংসারটা টিকিয়েছে, ছেলেকে বড় করেছে। না, শ্বশুরকুল- না, বাপের কুল কারো কাছে কোনো সাহায্যের জন্যে গিয়ে দাঁড়ায়নি। গাঁয়ের লোকে বলে, বড়ো শুক্ত ম্যায়ামানুষ গো। এই অহংকার আছে গুলনূরের মনে। শক্ত হওয়াটাকে ও গৌরব মনে করে এবং এই হওয়ার ব্যাখ্যা ওর কাছে ব্যাপক। ফলে ও যা করে মনে করে সেটাই যথার্থ, এর বাইরে আর কিছু হতে পারে না। মতিজানের আশা ছিল স্বামীর কাছে, কিন্তু দেখল সে জায়গাও দখল করে রেখেছে শাশুড়ি। কখনো ওর মনে হয় মায়ের সংসারে আবুলও বাড়তি মানুষ। স্বামীকে নিয়ে সংসারের সাধ মিটল না বলে ওর প্রবল অভিমান যখন তীব্র হয়, তখন আবুল সংসার থেকে পালিয়ে যায়। মতিজানকে পরিষ্কার বলে দেয়, হামাক কিছু কব্যা না। হামি কিছু জ্যানি না। কিছু করব্যার প্যারমো না। মা-ই সব। হামার বুকের মদ্যি পা থুয়্যা চ্যাপা র‍্যাখছে।

আবুল হাত নেড়ে, ঠোঁট উল্টে কথা বলে খিস্তি আওড়ায়। খিস্তি কাকে উদ্দেশ্য করে ওর কথায় তা বোঝা যায় না। মতিজান দু’চোখ মেলে স্বামীকে দেখে। উদ্ভ্রান্ত চেহারা, রক্তাভ চোখ, সংসার সম্পর্কে উদাসীন। সংসারের ধার ধারে না। ওর গাঁজার আড্ডা আছে, মাস্তানি আছে, পকেটে টাকা নিয়ে গঞ্জে রসুইয়ের ঘরে ঢুকে পড়ে অনায়াসে। ওর কাছে মা কিছু নয়, বউও কিছু নয়। মতিজান এই সত্যটি বুঝে যাবার ফলে ওর ভেতরে রোখ চাপে। ও শাশুড়ির মতো শক্ত হতে চায়। শাশুড়ির গঞ্জনা ওকে ভেতরে ভেতরে জেদি করে তোলে।

বিয়ের এই নয় মাসে ওর চোখ এখন একদম খোলা-সেটা কোনোভাবেই বুঝতে পারে না। ডানে ফিরে না, বামে ফিরে না-নিচে তাকিয়ে না, উপরে তাকিয়ে না। চারদিক সাফ, কোথাও কুটোটি পড়েও ওর দৃষ্টি আড়াল করতে পারে না। এই সংসারের শুরুটাই কি খুব ভালো ছিল? নতুন সংসারে কয়দিন তো ঠিকমতো কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। এখন ভেবে দেখে বিয়ের সাতদিনও ওর ভালো কাটেনি। শাশুড়ি ভার, ঠিকমতো কথা বলে না। মতিজান ভয়ে ভয়ে সে মুখের দিকে তাকায়। স্বামীকেও বুঝতে পারে না। সেও ভালো করে কথা বলে না। রাতদিন বিড়ি টানে, ধোঁয়ায় ঘর ধোঁয়াটে করে রাখে। জোর করে শ্বাস টেনে হাঁফ ছাড়ারও উপায় নেই। মতিজান কিছু বলতে পারে না। এই গুমোট পরিবেশে ওর কেবলই ভয় করে। পা ফেলতে ভয়, হাঁচি দিতে ভয়। ইলিশ মাছের কাঁটা বাছার সময় হাত থমকে যায়। ভাতের গ্রাস মুখে তোলার সময় আড়চোখে দেখতে পায় শাশুড়ি ঝাঁঝালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মতিজানের বুকের ভেতর গুড়গুড় ধ্বনি গড়ায়, বর্ষায় মহানন্দার তুললে ও আতঙ্কে সিঁটিয়ে যায়। তখন কেবল খাওয়া শেষ হয়েছে। এলুমিনিয়ামের থালাটায় ঝোলের একটা চিত্র আঁকা হয়ে আছে। গুলনূর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, বিহার সুময় তুমহার বাপে কহাছিল আমার আবুলক ঘড়ি দিবে, সাইকেল দিবে। অক্যুনও প্যাঠালে না ক্যানহে?

মতিজান চুপ করে থাকে। তর্জনী দিয়ে থালার বুকে আঁকিবুকি কাটে। বাপের অবস্থা ও জানে, যা আয় তার চেয়ে দ্বিগুণ ব্যয় সংসারে। কেমন করে ঘড়ি আর সাইকেল কিনবে? কোথা থেকে এতকিছু জোগাড় হবে না জেনেই ওর বাবা এইসব দেয়ার কথা কবুল করেছিল। এখন? গুলনূর ঝাঁকিয়ে ওঠে, কথা কহাচ্ছো না যে ? মতিজান কাঁদোকাঁদো হয়ে বলে, হামি কিছু জ্যানি না।

গুলনূর চিৎকার করে ওঠে, জ্যানবে না ক্যানহে? জ্যানতি হবে।

মতিজান থরথর করে কাঁপে। থালার ওপর আঙুল স্থির হয়ে যায়। ভাতগুলো যেন গলার কাছে এসে থমকে আছে আর কিছু চেঁচামেচি হলে ওগুলো গলগলিয়ে বেরিয়ে আসবে।

আর ফ্যাকফ্যাচ কর্যা ল্যাগবেন্যা। যাও থালাবাসনগুলা মাজ্যা আনো।

কাজ পেয়ে বর্তে যায় মতিজান। পালিয়ে বাঁচার এ এক দারুণ পথ। ও বাসন কোসন, হাঁড়িকুড়ি নিয়ে ডোবার ধারে আসে। তখন ভরা দুপুর, খরখরে রোদ চারদিকে। মতিজান নির্মিমেষে রোদের দিকে তাকিয়ে থাকে। বুঝতে পারে ওর কোথাও কিছু পুড়ছে, দহন নেই- জ্বালাও নেই। কেবল বাবার ওপর প্রবল অভিমানে ওর কান্না পায়। হাঁটুতে মুখ গুঁজে চাপা কান্নায় নিজেকে উজাড় করতে চায়। বাবা কেন মিথ্যে আশ্বাস দিল? ওর বিয়ে না হলে কি ক্ষতি হত? ও তো চেয়েছিল গ্রামে সমবায়ের কর্মী বেলি বুয়ার সঙ্গে নকশী কাঁথার কাজ করতে। নিজের রোজগার নিজে করবে বলে ওর জেদ হয়েছিল। বাদ সাধল বাবা। মেয়ের বিয়ে না হলে তার মানসম্মান থাকবে না। যে কোনো উপায়ে বিয়ে দিতে হবে। কেন? কেন? মতিজান লাথি দিয়ে বাসন-কোসন ডোবার জলে ফেলে দিতে চায়। হায় বিয়ে, কোথায় সংসার, কোথায় স্বামী ? এই কি বাবার মান-সম্মান? গরীবের মান-সম্মান তো ভাত-কাপড়। খর দুপুরের রোদ মতিজানের মাথায় ঢুকতে থাকে- বিড়ির ধোঁয়ায় ধোঁয়াটে হয়ে থাকা ঘরটা একটা রঙিন ফানুস হয়ে যায়-ক্রমাগত উড়ছে, উড়ছে। ছোঁয়ার সাধ্য ওর নেই। তখন দুপুরটা ওর ভেতরে শত্র“ হয়ে জমতে থাকে। ও ভাবে, আমিও একটা শক্ত মেয়েমানুষ হব।

দ্রুতহাতে বাসন মেজে ঝকঝকে করে তুলতে হয় ওকে। ঝকঝকে না হলে গুলনূর ওকে ঘরে উঠতে দেয় না। মাঝে মাঝে সামান্য খুঁত ধরে রাগারাগি করে আবুল। রাগ হলে সেও মতিজানকে ঘরে ঢুকতে দেয় না। তখন বারান্দায় বসে অন্ধকারে তাকিয়ে থাকে মতিজান। ওর চোখ ধরে আসে না। মাথা ঝিমঝিম করে না। ওর বুকের ভেতর অন্ধকার শক্ত হতে থাকে। তখনও ও ভাবে, ওকে শক্ত মেয়েমানুষ হতে হবে।

দিন তো গড়াবেই, দিনের নিয়ম। মতিজানেরও দিন গড়ায়। ও বুঝে গেছে আবুল ওর জীবনে থেকেও নেই। মাসের অর্ধেক দিন রসুইয়ের ঘরে কাটায়। প্রথম প্রথম মতিজান এ নিয়ে কথা বলে মার খেয়েছে। এখন এ প্রসঙ্গটি আর তোলে না। ছেলের ঘরে ফেরা না ফেরা নিয়ে গুলনূর মাথা ঘামায় না। ছেলে যা করে তাতেই তার সায় আছে। বরং ছেলে ঘরে না ফিরলে সে বেশ স্বস্তিতেই থাকে। মতিজানকে বেশ নিংড়ানো যায়, আবুল সামনে থাকলে সবসময় সেটা হয়ে ওঠে না। নেহাৎই চক্ষু লজ্জার খাতিরে ছেলেকে মানতে হয়। তাছাড়া যৌতুকের ব্যাপারটি নিয়ে গুলনূর এখন সরাসরি ক্রোধ প্রকাশ করে। চেঁচিয়ে বলে, তুমহার বাপ একটা মিথ্যুক, প্রতারক। সাইকেল, ঘড়ি দিতে না পারবে তো কহাছিল ক্যানহে?

চলবে....

 

সেলিনা হোসেন
প্রখ্যাত সাহিত্যক, স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত ঔপন্যাসিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top