সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

গল্প - মতিজানের মেয়েরা (২য় পর্ব) : সেলিনা হোসেন


প্রকাশিত:
৩ মার্চ ২০২০ ১৬:৫৫

আপডেট:
১৩ এপ্রিল ২০২০ ০১:২৮

 

গুলনূর উত্তেজনায় গালাগাল, চেঁচামেচি করে। আবুলও মায়ের সঙ্গে যোগ দেয়। সেদিন মতিজানের কণ্ঠ ধরে আসে, চুপ থাকতে পারে না। কাঁপা গলায় বলে, বাপজান ঠগ লয়, গরীব। বাপজান মিথ্যুক লয়। পয়সা ন্যাই বুল্যাক, ঘড়ি সাইকেল কিনব্যার সময় লাগচ্ছে।

চোপ হারামজাদি। আবার বড় কথা।

গুলনূর ওর চুলের মুঠি ধরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। গলায় দড়ি দিয়ে ঘরের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখে। সারাদিন খেতে দেয়নি। মতিজান অনুভূতিশূন্য হয়ে যায়। চোখে জল নেই, বুকে জ্বালা নেই। বোধহীনতা ওর ভেতর শক্ত হয়ে জমতে থাকে। ও শক্ত মেয়ে মানুষ হতে চায়। সন্ধ্যায় গুলনূর দড়ি ধরে টেনে ডোবার ধারে নিয়ে গিয়ে বলে, হামি আর তুমহাক ভাত খ্যাওয়াবার প্যারমো না। খ্যাও, খ্যাও, ঘাস খ্যাও।

প্রচণ্ড কৌতুকে মায়ের সঙ্গে হাসাহাসি করে আবুল গঞ্জে রসুইয়ের কাছে চলে যায়। রাত হলে মতিজানকে বারান্দায় এনে এক থালা ভাত দেয় গুলনূর। ও শান্ত, সুবোধ হয়ে নিঃশব্দে ভাতগুলো খায়। তারপর ঘরের দরজা লাগিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার নামে দু’চোখের সামনে। সারারাত ও একফোঁটা ঘুমোতে পারে না। বিছানায় ছটফট করে, মেঝেতে গড়িয়ে নেয়। শান্ত থাকার চেষ্টা করেও পারে না। অন্ধকারের সঙ্গে কথা বলে, অন্ধকার তুই বলে দে কেমন করে প্রতিশোধ নিতে হয়। কেমন করে? কেমন নিঃশব্দতার এই চরম মুহূর্তে ওর মনে হয় ওর একজন সঙ্গী দরকার, খুব কাছের কেউ, যার সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে পারবে। এখন ওর আনন্দ চাই। এভাবে মার খাওয়া জীবন আর নয়। মাতাল, জুয়াড়ি, পরনারী আসক্ত স্বামীর জন্যে ও কোনো দায় অনুভব করে না। একজন প্রতিপক্ষই ও সামনে দেখে, যে শক্ত ম্যায়ামানুষ বলে এই গ্রামে খ্যাত। তার সঙ্গেই মতিজানের যুদ্ধ।

দিন তো গড়াবেই, দিনের নিয়ম-মতিজানেরও দিন গড়ায়। আবুল কখনো বাড়ি আসে, কখনো আসে না। শাশুড়ি যৌতুক নিয়ে গালাগালি করলে মতিজান চুপচাপ শোনে। ও কতোদিন বাবার বাড়ি যায় না। বাবার বাড়ি থেকেও কেউ আসতে পারে না। ওর বড়ো ভাই দু’বার এসেছিল। গুলনূর খারাপ ব্যবহার করেছে। সাইকেল, ঘড়ি না নিয়ে আসতে নিষেধ করেছে। মাস ছয়েক হয়ে গেল কেউ আসেনি। গতবার বড়ো ভাই যাবার সময় চুপিচুপি বলেছে, তুই একনাও মন খ্যারাপ করব্যু না কয়্যা দেল্যাম। হামি আর বাপজান ঘড়ি আর সাইকেল জোড়া করব্যার চেষ্টা করিচ্ছি।

বড়ো ভাইকে তীব্র চোখে শাসিয়েছে মতিজান, না আপনেরা কষ্ট করবার প্যারবেন না। বাবা তো মিথ্যুক আর ঠগ হয়্যা গেছে। কিসের আবার ঘড়ি, সাইকেল ? আর হামি ? হামি তো গরু হয়্যা গেনু। ওরা হামাক ঘাস খ্যাবার কহে। খি খি হাসিতে মতিজান বাড়ি মাতিয়ে তোলে। এ বাড়িতে আসার পর এই প্রথম ওর বাঁধভাঙা হাসি। ওর ভাই বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। বারান্দা থেকে গুলনূর এমন বেয়াদবি হাসির জন্য তীব্র কণ্ঠে বকাবকি করে। মতিজান এই প্রথম শাশুড়িকে উপেক্ষা করে। উপেক্ষা করে হাসতেই থাকে। ওর ভাই মতিজানের অস্বাভাবিক চেহারা এবং হাসির শব্দে নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়। এই পলায়নে মতিজানের মনে দুঃখ হয়-কষ্ট ওর বুক ছিঁড়েখুঁড়ে দেয়। ও চুপচাপ গোয়ালে আসে। গোয়ার পরিষ্কার করে ঘুঁটে বানাতে বসলে ওর দুপুর গড়িয়ে যায়। খররোদ পড়ে আসে তখন থেকে মতিজানের বুকের ভেতর উপেক্ষা করার শক্তি শক্ত হয়ে যায়।

সেদিন অনেক বেলায় প্রচণ্ড খিদে নিয়ে ভাত খেতে গেলে গুলনূর রান্নাঘরের দরজায় ওকে বাধা দেয়। মতিজান বুঝতে পারে গুলনূর আজ দুপুরে না ঘুমিয়ে ভাত পাহারা দিচ্ছে। ওকে আজ বেয়াদবি হাসির শাস্তি দেবে। বাধা পেয়ে মতিজান ঠাণ্ডা গলায় বলে, হামি ভাত খ্যামো। হামার ভুক ল্যাগেছে। 

গুলনূর বলে, ভাত ন্যাই।

মতিজান চেঁচিয়ে ওঠে, ক্যানহে?

গুলনূর দাঁতমুখ খিঁচিয়ে হাত উল্টে বলে, ভাত দ্যামো না। ঘাস দ্যামো।

হামি তো এই বাড়ির কামের মানুষ। কাম কর্যা ভাত খ্যাই। বস্যা বস্যা ভাত খ্যাই না। হামাক ভাত দেয়্যা ল্যাগবি। মানষে কামের মানুষক ভাত দ্যায় না ?

মতিজান শাশুড়ির পাশ কাটিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে। হাঁড়িকুড়ি উল্টে ভাত পায় না। ছিকার ওপর এক সানকি ভাত ঢাকা দেয়া ছিল। ওটায় হাত দিতেই শাশুড়ি ছুটে আসে, হাত দ্যাবা না কয়্যা দেল্যাম। ইগুলান আবুলের ভাত।

সেই খি খি হাসি হেসে ওঠে মতিজান। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, তার লিগা রসুই ভাত রান্ধ্যা থুছে। আপনার ভাবনা কি ?

কি কল্যা? তুমহার এত বড়ো সাহস ?

মতিজান কোনো জবাব দেয় না। সানকিতে রাখা ভাত-তরকারি বুকের কাছে জাপটে ধরে খেতে থাকে। বুঝতে পারে সানকি হাতছাড়া করে খাওয়া যাবে না। বসে খেতে গেলেও শাশুড়ি আক্রমণের সুযোগ পাবে। সুতরাং ও এমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে খায় যে গুলনূর এগিয়ে আসার আগেই ও সানকিটা ছুড়ে মারতে পারবে, ঠিক মাথা বরাবর। আবুলের জন্য মাছের বড়ো টুকরো রাখা হয়েছিল, আজ তা ওর কপালে, কি ভাগ্য! নাকি অধিকার? বেলি আপা তো এভাবেই বলত, নিজের অধিকার বুঝে নেয়া, ভাবতেই মতিজানের ঠোঁটে চিকন হাসি খেলে যায়। প্রচণ্ড খিদে নিয়ে ও গপগপিয়ে ভাত খেতে থাকে। শাশুড়ির দিকে তাকায় না। আড়চোখে দেখে নেয় তার অবস্থানটা, না সে একপাও সামনে এগুচ্ছে না। ও বুঝতে পারে গুলনূর বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শক্ত মেয়েমানুষের এ পরাজয় বড় বেশি অভাবনীয়। ওর বুকের ভেতরে জয়ের মহানন্দা, ঘন কুয়াশার আবরণ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে।

বিকেলে ও ডোবার ধারের বাঁশবাগানে আসে। জায়গাটা নিরিবিলি, ছায়াচ্ছন্ন। গাছের মাথায় ঘন পাতার জমাট আঠা যেন রোদ আটকে ধরে, সে রোদ নিচে পৌঁছয় না। স্যাঁতসেঁতে ভেজা মাটি নরম স্নিগ্ধ। মতিজানের কাছে পরাজিত শাশুড়ি ঘরে হয়তো ঘুমিয়েছে, সাড়াশব্দ নেই। দুপুরের ঘুম না ঘুমুলে তার স্বস্তি নেই, এ এক প্রিয় অভ্যেস? বাঁশঝাড়ের নিচে বসে মতিজান গুনগুনিয়ে গান গায়। বিয়ের পর এই প্রথম ওর খুব ভালো লাগছে। ডোবার ওপাশে বাছুর দুটো বাঁধা। গাই দুটো চরাতে লয়ে গেছে বুধে, ভারি ছটফটে ছেলে। একদণ্ড বসতে পারে না। মাঝে মাঝেই মতিজানকে বলবে, একটা গপ্প কহান না ক্যানহে ভাবী!

কিসের গপ্প? রাজার?

ও মাথা নাড়ে। মতিজান ওকে রাজার গল্প বলে। সাত-সমুদ্র তেরো নদীর কথা বলে। শুনতে শুনতে বারো বছরের বুধের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এই মুহূর্তে বাড়িতে বুধে নেই। মতিজানের মনে হয় আজ ওর বুকভরা রাজার গল্প-ও নিজেই সাত-সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে চলে যাচ্ছে। বুধেকে ওর এই কথা জানানোর খুব ইচ্ছে হয়।

বাঁশঝাড় পেরিয়ে বাড়ির সদরে আসতেও ও লোকমানের মুখোমুখি হয়। লোকমান ওকে দেখে হাসে। লম্বা, পাতলা শরীর, চোখে চোখ পড়লে শরীর কেঁপে যায়। অনেকবার এ বাড়িতে এসেছে। আবুলের বন্ধু। আবুল বেশ কয়েকদিন বাড়ি না ফিরলে লোকশানের হাতে সদাইপাত্তি পাঠায়। লোকমান এই পথে প্রতিদিন গঞ্জেও যাতায়াত করে। লোকমানের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ ছিল না, সাহসও ছিল না। আজ লোকমান ওকে সদরে দেখে অবাক হয়।

—ভাবী ক্যাংকা আছেন ?

— ভালো।

মতিজান সহজে হাসে। হাসিতে মুক্তো ঝরে, লোকমান চমকিত হয়।

—ন্যান। আপন্যাকেরে সদাই।

মতিজান হাত বাড়িয়ে সদাই নেয়। সহজভাবে বলে, চলেন ছ্যাওয়ায় বসবেন হানে। পান খ্যাবেন ?

কথায় সুর ঝরে। লোকমান চমকিত হয়। ইচ্ছে হয় দু’দণ্ড বসে যেতে। তবু দ্বিধা নিয়ে বলে, আজ য্যাই।

—আবার অ্যাসবেন। অ্যাসবেন তো ?

—অ্যাসবো, আবার অ্যাসবো।

লোকমান দু’চোখ উজ্জ্বল করে বলে। মতিজান ঘাড় ঝাঁকিয়ে সহজ ভঙ্গিতে হেঁটে বাড়িতে ঢোকে। চলায় ছন্দ উথলে ওঠে। লোকমান চমকিত হয়। এতদিনের দেখা মানুষটা কি এইরকম ছিল ? ওর দ্বিধা কাটতে সময় লাগে।

 

সেলিনা হোসেন
প্রখ্যাত সাহিত্যক, স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত ঔপন্যাসিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top