সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

সম্পর্ক : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
১৩ মার্চ ২০২০ ১৬:৪১

আপডেট:
১৩ এপ্রিল ২০২০ ০১:২৩

 

জানালার কার্নিশ ধরে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছে দিপীকা। বাঁধভাঙ্গাঁ বন্যার মত দু’চোখ ভেসে যাচ্ছে। এত জল চোখে থাকে? নিজেকে একাকী প্রশ্ন করে দিপীকা। বার্ধক্যে এসে, আজ বড় বেশী অহসহায় লাগছে। এত বড় পৃথিবীতে তার সব শুন্য।  মরুভূমির মত হাহাকার। বিশাল অট্রালীকা জনমানব শুন্য। পুরনো কিছু কাজের লোক নিয়ে বেঁচে থাকা। এমনতো হবার কথা ছিল না! প্রাচুর্য্যে ভরা বাড়ীতে লোকে লোকারন্য থাকার কথা। একসময় ছিলও তাই। কোথা থেকে কি হয়ে গেল। গ্যাসে ভরা বেলুনটি ফুৎ করে ফেটে গেল যেন। সংসার এক ভয়ঙ্কর সং ছাড়া আজ আর কিছুই নয় দিপীকার কাছে।

এত বছর, দিনের পর দিন সব গোপন করে, সেদিন কেন সে সুমন্তকে সব বলতে গেল? সুমনতো নিস্পাপ, নিস্কলঙ্ক। এতদিনের ঘৃন্য ইতিহাস কেন তাকে বলতে গেল? মাতৃত্বের বন্ধন থেকে ছিন্ন করল তাকে? মনের পর্দায় একাকী জীবনে একের পর এক কতকিছুই না আজ ছবির মত ভেসে উঠছে। এইতো, মনে হয় সেদিনের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী দিপীকা। আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় সংগীত প্রতিযোগীতায় চ্যাম্পীয়ন হলো। আর রানার্সআপ হলো মাষ্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র জোবায়ের চৌধুরী।

পুরুষ্কার শেষে দোতালার সিড়িতে দেখা। কংগ্রাচুলেশন দিপীকা। থ্যাঙ্ক্ উ। উহু! শুধু ধন্যবাদে কাজ হবে না। কি করতে হবে? পাটি দিতে হবে। ওমা! তা কি করে হয়? আমি তো হলে থাকি! সে দায়িত্ব আমার। তুমি শুধু রাজী হও। ঠিক আছে। রাজী? রাজী। ব্রেভো! এই না হলে হয়? তারপর একদিন ক্যাম্পাসেই সবাই মিলে হৈ চৈ। দিপীকা পার্টি দিল। এভাবেই দিনে দিনে জুবের ও দিপীকার সম্পর্ক ঘনিষ্ট হতে থাকলো। জুবের মাষ্টার্স শেষ করে বাবার ব্যবসায় যোগ দিল। দিপীকার অনার্স শেষ হলো। মাষ্টার্স আর করা হলো না। জুবের বিয়ের জন্য চাপাচাপি করতে থাকে। একসময় উভয়ের বাবা মা’র মত নিয়েই খুব ঘটা করে দু’জনের বিয়ে হয়ে গেল।

হানীমুনে গেল নেপাল। দেখতে দেখতে বিয়ের ছ’মাস কেটে গেল। রঙ্গিন স্বপ্লেভরা দিন। হাসি আনন্দের দিনগুলি সাগরের ঢেউ এর মত সুখের ফেনা তুলে অসীম দিগন্তে মিলে যায় তিরতিরিয়ে। রেশটুকু থেকে যায় জীবনের পঙ্কিল বালু তীরে। এই ছ’মাস শশুর বাড়ীতে কেমন যেন ঘোরের মধ্যে ছিল দিপীকা। আস্তে আস্তে বাস্তব জীবনে চলে আসে। জুবের এর অগাধ সম্পত্তি। বনেদী পরিবার। বাবা মা’র একমাত্র সন্তান। বাড়ীতে চাকর বাকরের অভাব নেই। বিলাসীতারও শেষ নেই। আপন লোকর চেয়ে, কাজের লোকই বেশী।

সারাদিন টিভি, ভিসি আর চলে। কাজের লোকের, কাজের চেয়ে অকাজই বেশী। দিপীকার কেমন যেন দিন দিন সবকিছু অস্বাভাবিক লাগতে থাকে। দম বন্ধ হয়ে আসে। বৃদ্ধ শশুর মশাই, কাজের লোককে দিয়ে গা হাত পা টেপায়। পাকা চুলে মেহেন্দী লাগায়। শরীরে তেল মালিস করে কাজের লোক। শাশুড়ী একা একা ঘরে কোরআন তেলওয়াত করেন, কিংবা ধর্মীয় বই পড়েন। শাশুড়ীকে খুব অসহায় মনে হয় দিপীকার। কথা কম বলেন। দিপীকাকে আদর করেন। খাবার টেবিল ছাড়া শশুর শাশুড়ীকে একসঙ্গে কথা বলতে দেখেনি দিপীকা।

ঠিক যেন একটা মাটির পুতুল। কেমন অস্বাবাবিক জীবন। দিপীকা ছট্ফট্ করে। জুবের এর কিছু কিছু জিনিস দিপীকার কাছে অসহ্য লাগে। কি করবে ভেবে পায় না। শাশুড়ী এসব খেয়াল করে। একদিন অবসরে, দিপীকাকে কাছে ডাকে শাশুড়ী। শোন মা, তুমি শিক্ষিতা বুদ্ধিমতী মেয়ে। তোমাকে আমার তেমন কিছুই বোঝাতে হবে না। ইতিমধ্যে নিশ্চই এই পরিবারের রেওয়াজ রিতী সম্পর্কে কিছুটা অনুমান করতে পেরেছ। জ্বী মা। যে জন্য তোমাকে ডেকেছি। কিছু কথা তোমার জানা দরকার। এই পরিবারে স্বাভাবিক অস্বাভাবিক যা কিছুই দেখবে কোন বাদ প্রতিবাদ কোর না মা।

কেন মা? তোমার ভালোর জন্যই বলছি মা। বলতে পার, এটা আমার অনুরোধ। আমি সেকেলে অল্প শিক্ষিত মানুষ। আমার বাবা একজন সংগীত সাধক ছিলেন। আমি ও ভাল গাইতাম একসময়। সেই রক্তের কিছুটা জুবেরের মধ্যে প্রবহমান। আর সবই বংশীয় রক্তধারায় ধাবিত। একবার প্রতিবাদ করে, অনেক প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছিল আমাকে। আশা করি বুঝতে পেরেছে। জ্বী মা। শাশুড়ীর এমন বুদ্ধিদীপ্ত কথায় অবাক হয় দিপীকা। অল্পকথায় কতকিছুই না বুঝিয়ে দিলেন। কিছুদিন যেতেই দিপীকা জুবেরের বিকৃত রুচি টের পাচ্ছিল। কিন্তু ঐ যে, শাশুড়ী আগেই তাবে সর্তক করে দিয়েছেন। কোন প্রতিবাদ করা যাবে না।

দিপীকার সবচে বেশী অসহ্য লাগতো, কাজের মেয়ে নিয়োগের ব্যাপরটা। সুন্দরী, অল্পবয়সী। নয়তো খুব বৃদ্ধা। কমবয়সীদের দিয়ে ঘরের কাজ না করিয়ে গা হাত পা টেপানো হয়। পাকাচুল তোলা, দাড়ী, চুলে মেহেন্দী দেয়া এসব। আর রান্নাবান্না, বাকী কাজ বয়ষ্কদের। জুবের যখন কাজের মেয়ে মালতীকে দিয়ে গা, পা টেপায়, দিপীকা অসহ্য রোষানলে পুড়তে থাকে। প্রথম প্রথম জুবের লুকিয়ে লুকিয়ে মালতীকে দিয়ে এসব করাতো। এখন দিপীকা বুঝে ফেলার পর প্রকাশ্যেই করতে থাকে। জুবেরের সাথে প্রেমের বিয়ে দিপীকার। বাবা মা. আত্নীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব কাউকে কিছুই বলতে পারে না। বোঝাতে পারে না।
সারাক্ষণ বোবা কান্না। মানুষের শরীর আগুনে ঝলসে গেলে, ফোস্কা পড়ে।
তা সবার চোখে পড়ে।
দগদগে ঘা দেখে শিহরিত হয় মানুষ।
কিন্তু শরীরের অভ্যন্তরে, পুড়ে পুড়ে যে দগদগে ক্ষত এর সৃষ্টি হয়, তাতে চোখে দেখা যায় না।
কাউকে বলা বা বোঝানোও যায় না।
শুধু পুড়ে পুড়ে নিঃশ্বেস হওয়া।
দিপীকার শরীরেও ঠিক এরকম অসংখ্য ফোসকা গলে গলে অস্বাভাবিক ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে।
এ ক্ষত সে কাকে দেখাবে?
কি ভাবছ এত?
উ......!
জুবের এর কথায় চমকে ওঠে দিপীকা।
চমকে উঠলে মনে হয়? কাকে ভাবছিলে?
অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে এমন প্রশ্নে চিৎকার করে ওঠে দিপীকা।
এখন কত রাত জান?
সে জন্যেই তো এলাম। চল ঘুমুবে।
যাও....। কাজের মেয়ের কাছেই ঘুমাও। যাকে দিয়ে গা, হাত, পা টেপাও বাকী কাজও তার কাছেই সেরে ফেল। যাও.....। আমার সামনে থেকে চলে যাও....।
বড় বেশী বাড়াবাড়ি করছো না কি?
বাড়াবাড়ি তুমি করছো।
এসব আমাদের বংশের রিতী। কেন তুমি সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছো না?
এসব কথা তুমি আগে বলনি কেন আমাকে? তাহলে..... বিয়েতে রাজী হতে না, না?
কখ্খনো না।
থাক। কথা বাড়িয়ো না।
কোথায় যাচ্ছ?
জুবের কোন উত্তর না দিয়ে চলে গেল স্পেশাল রুমে।
দিপীকা, ক্ষীপ্ত বাঘিনীর মত হিংস্র হয়ে ওঠে।
তখন অনেক রাত্রি।
দিপীকা পা টিপে টিপে এগোয়।
জুবের অঘোরে ঘুমুচ্ছে।
নাক ডাকছে ঘড়ড়....ঘ...ড়..ড়।
কাজের মেয়ে মালতী গা টিপছে আর ঝিমুচ্ছে। দিপীকা চাপানো দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে থাকে।
হঠাৎ ঘুমের মধ্যে জুবের চেঁচিয়ে ওঠে- মা...লু....।
মালতী চমকে ওঠে।
হকচকিয়ে আবার জোড়ে সোড়ে গা, পা টিপতে থাকে।
মালু ডাক শুনে দিপীকা দাঁত কিডমিড় করে ঠোট কামড়াতে থাকে।
অসহ্য।
সজোড়ে দরজার ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢোকে দিপীকা।
জুবেব ধড়মড় করে উঠে বসে।
কি ব্যাপার, তুমি এত রাতে?
কেন, অবাক হলে নাকি?
এতরাতে আমি আসব না তো, ঐ মালু আসবে?
এ ঘর তো তোমার নয়।
আমার নয়তো কার? ঐ মালুর? আজকাল নামটাও দেখি, ছেটে কেটে ছোট করেছ।
কেন, তোমাকেও তো আমি দিপী বলে ডাকি!
আমার নামের সাথে দাসী বাঁদীর তুলনা?
আহ্, থামতো!
কেন থামবো? এই মালতী.... বেরিয়ে যা ঘর থেকে। আর কখ্খোনো যেন এ ঘরে তোকে না দেখি। বুঝলি?
আঙ্গুঁল উঁচিয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে ফেঠে পড়ে দিপীকা।
বেরিয়ে যা বলছি।
ঘাড় ধাক্কা দিয়ে মালতীকে ঘর থেকে বের করে দেয় দিপীকা।
চিৎকার শুনে, পাশের রুমে শাশুড়ী কান খাড়া করে বিছানায় উঠে বসে।
বারবার মেয়েটাকে সর্তক করেছি। প্রতিবাদ করবে না।
আজ বুঝি রোজ কেয়ামত হয়ে যাবে।
শাশুড়ী ছটফট করতে থাকে।
আর এক রুমে দিপীকার শশুর এর পা টিপছিল শেফালী। চিৎকার শুনে সেও দৌড়ে পালায় ঘর থেকে।
শেফালী, মালতী দুজনেই যে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
খুশী হয় ওরা দিপীকার প্রতি।
গরীব ঘরে জন্ম হলেও সবাই মান সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়।
পেটের দায়ে মনিবের সবরকম চাহিদাই এরা মিটিয়ে চলে নিরবে।
এজন্য ওদের অনেক বড় পাওয়া। অনাহারী বাবা মাকে সাহায্য করে।
তারা প্রাণ ভরে দোয়া করে।
দিপীকার এমন ঘৃন্য প্রতিবাদে জুবের কিছুই বললো না। দিপীকা অবাক হয়। আদর করে কাছে টেনে নিল।
তুমি কাছে আস না বলেই তো আমি এমন করি। ভুল হয়ে গেছে। আর এমন করবো না, লক্ষীটি।
দিপীকাকে আদরে আদরে ভরিয়ে তুললো জুবের।
দিপীকা একেবারেই সাদা মাটা মনের মানুষ।
সহজ, সরল।
স্বামীর আদর সোহাগে, মুহুর্তে সব ভুলে যায়।
জুবেরের হাতখানি মাথায় রেখে বলে- চৎড়সরংবৃৃ.
ধূর্ত জুবের সংগে সংগে দিপীকার মাথায় হাত রেখে দৃড়ভাবে বলে চৎড়সরংব, চৎড়সরংব, চৎড়সরংব.
দিপীকা গভীর বিশ্বাসে জুবেরের আরও ঘনিষ্ট হয়।
পাশের রুম থেকে শশুর শাশুড়ী যে যার মত কান খাড়া করে থাকে।
কই, জুবেরের কোন হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে না তো?
কোন অঘটন ঘটলো নাকি?
এমন তো হবার কথা নয়।
এরকম জল্পনা কল্পনা করতে করতে রাত ভোর হয়।
জুবের ও দিপীকা অনেকদিন পর আজ প্রাতঃ ভ্রমন সেড়ে বাগান থেকে একগোছা টগর আর গন্ধরাজ তুলে নিয়ে ঘরে ঢোকে।
বাড়ীর সবাই অবাক।
এত পরিবর্তন জুবেরের।
দিপীকাকে দুর থেকে অজান্তেই শাশুড়ী আশীর্বাদ করেন।
এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিপীকার সুখের জীবন।
বিয়ের পর অনেক পুড়ে পুড়ে হঠাৎ জুবেরের এমন পরিবর্তনে মাঝে মাঝে অবাক হয়।
ভাবে, ইচ্ছে করলেই ভাল হওয়া যায়।
জুবের আর অশোভন কিছু করে না। একেবারে আদর্শ স্বামী।
দিপীকা জুবেরকে গভীরভাবে বিশ্বাস করে।
আর অবিশ্বাস নয়।
এভাবে বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোদুল দোলায় স্বপ্নে বিভোর ছিল দিপীকা।
এরপরও মানুষের মনতো!
মাঝে মাঝে জুবেরের এমন আমূল পরিবর্তনে সন্দেহ হয় দিপীকার।
ঠিক এ সময়েই ঘটে গেল ভয়াবহ বিপর্যয়।
মালতীর নাকি ডায়রিয়া হয়েছে।
বারেবারে বমি করছে।
কিছু খেতে পারছেনা।
বুয়ারা সবাই মাথায় পানি ঢালছে।
শরবত খাওয়াচ্ছে।
স্যালাইন, ডাবের পানি।
কিছুতে কিছু হচ্ছে না।
খবরটা শোনার পর জুবের হঠাৎ কেমন যেন ফুটা বেলুনের মত চুপসে গেল।
তাড়াতাড়ি পারিবারিক ডাক্তারকে ফোন করলো।
ডাক্তার এলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই।
ঘর থেকে সবাইকে বের করে দেয়া হোল।
ডাক্তার দেখে স্পষ্ট বললেন- ঝযব রং চৎবমহধহঃ.
দিপীকার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো।
বলেন কি ডাক্তার সাহেব? ওরতো বিয়েই হয় নাই।
ডাক্তার মৃদু হেসে বললেন, বিয়ে হয়নি তাতে কি ভাবী? বনেদী পরিবারে এটাতো নতুন কিছু নয়।
ডাক্তার সাহেব বেরিয়ে গেলেন।
দিপীকা ক্ষ্যাপা সিংহীর মত দাঁতে দাঁত চেপে মালতীর চুলের মুঠো ধরে জিজ্ঞেস করলো- বল্, কে তোর এতবড় সর্বনাশ করেছে? ঠিক্ ঠিক বলবি। বল্, কে সেই পরপশু?
মালতী শাড়ীর আঁচলে মুখ চেপে আঙ্গুঁল দিয়ে দেখিয়ে দিল জুবেরকে।
এতবড় বিশ্বাস ঘাতকতা?
আজ থেকে আমার সম্পর্ক তোমার সাথে মায়ের মত।
স্ত্রী হিসেবে কোন অধিকার আর রইল না তোমার সাথে আমার।
ঘৃনায় অগ্নিস্ফুলিংগ এর মত বিচ্ছুরির হয় দিপীকার চোখ দুটি।
জুবের এর হৃৎপিন্ড কেঁপে ওঠে।
বংশের পৈশাচিক পরিবেশে জন্ম নিয়ে সকল বিকৃত রুচি তার মধ্যেও গড়ে উঠেছে।
ধিকৃত হয় বিবেকের কাছে।
পরদিন যথারিতী পুরনো সব কাজের লোককে দেনা পাওনা মিটিয়ে বিদায় করে দেয়া হোল।
কাউকে কিছু বুঝতে দেয়া যাবে না।
মালতীকে আলাদা ঘরে রাখা হোল।
কলঙ্কিত কিছু ঘটলে, এ বাড়ীতে এরকম রিতীই চলে আসছে।
পূর্ব পুরুষের রিতী।
এরপর জুবেরের সাথে দিপীকার আর কোন সম্পর্ক রইলো না।
দিপীকার ঘৃনাভরা মুখ সারাক্ষনই যেন জুবেরকে তিরষ্কার করতে লাগলো।
দিপীকার ব্যঙ্গঁ, বিদ্রুপ আর অবহেলা।
এক ঘৃন্য অপরাধবোধ, জুবেরকে দিনে দিনে বিষাক্ত তীরের মত সমস্ত শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করে তোলে।
বিবেকের কঠিন দংশন।
বিষাক্ত কেউটের ছোবল এর মত।
অতঃপর একদিন কাউকে কিছু না বলে রাতের গভীরে জুবের নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।
অনেক চেষ্টা করেও দিপীকা আর তার সন্ধান পায়নি।
এরপরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত।
জুবেরের বৃদ্ধ মা বাবা একসময় ইহলোক ত্যাগ করেন।
মারা যাবার আগে শশুর শাশুড়ী দিপীকার কাছেই বিষয় সম্পত্তি উইল করে দেন।
সবকিছুর দেখাশোনা দিপীকাই করেন।
মালতী পুত্র সন্ত্রানের জন্ম দিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরনে মারা যায়।
নিঃসন্তান দিপীকা স্বামীর পাপের বোঝা শিশুটিকে সন্তান হিসেবেই লালন পালন করেন।
সুমন্ত।
সুঠাম, সুপুরুষ।
জুবেরের মতই বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা।
অত্যন্ত মেধাবী।
বুকের লালিত স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিয়ে পুড়ে পুড়ে সুমন্তকে বড় করেছেন।
কোনদিন তাকে কোন কথা বুঝতে দেন নাই।
হঠাৎ এত বছর পর......
সুমন্ত সেদিন বাবার কথা জানতে চাইলে, দিপীকার কি থেকে কি হয়ে গেল।
সুমন্তও নাছোড়বান্দা।
আজ সে বাবার কথা জানবেই।
দিপীকার মাথাটা কেমন বিগড়ে গেল।
হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।
এতবছরের চাপা কান্না চৈত্রের দাবদাহে জ্বলন্ত স্ফুলিংগের মত দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো যেন।
দিপীকা চিৎকার করে বললো- সুমন, আমি তোর মা নই। তোকে লালন পালন করেছি শুধু। আমি তোর ধাত্রী মা। তোর মা ছিল এ বাড়ীর কাজের বুয়া। তোকে জন্ম দিয়ে মারা গেছে। তুই তার অবৈধ সন্তান।
মা!
বিশ্বেস হচ্ছে না তো!
কি আবোল তাবোল বকছো? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল?
মাথা খারাপ হলে বেঁচে যেতাম। আমি যা বলছি, একটিও মিথ্যে নয়।
তোর বাবার অবৈধ সন্তান তুই।
চুপ কর মা, চুপ কর।
কেন চুপ করব? সত্যকে চেপে থাকার মত নির্মম যন্ত্রনা আর নেই।
অনেক চেপে রেখেছি।
দিপীকা অকপটে অতীতের সমস্ত গোপন কাহিনী বলে দেয় সুমন্তকে।
অসহায় সুমন্ত দিপীকাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
মা, এ তুমি কি শোনালে? যা এতদিন গোপন রেখেছিলে, তা আজ আমাকে না বললেও পারতে। এমন ঘৃন্য জীবন আমার? তুমি কেন আমাকে এসব বললে মা?
বল, বল মা?
দিপীকা নির্বিকার পাথরের মত দাড়িয়ে থাকে।
এরপর থেকে, সুমন্ত কেমন যেন অস্বাভাবিক হয়ে যায়।
কথাবার্তা কম বলতো।
ঠিকমত বাসায় ফিরতো না।
একদিন রাতের অন্ধকারে সেও নিরুদ্দেশ হয়।
দিপীকার একাকী জীবন শুরু হয় সেখান থেকেই। পুরনো কয়েকজন কাজের লোককে নিয়ে বসবাস করেন।
ব্যবসার দেখা শোনা করে পুরনো বিশ্বস্ত কিছু কর্মচারী।
কেউ আজ পর্যন্ত প্রকৃত ঘটনা জানে না।
যে যার মত কাজ করে যায়।
কেউ জানলেও প্রকাশ করবার সাহস নেই।
সুমন্ত নিরুদ্দেশ হবার পর, দিপীকা একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে।
দুর্বিসহ একাকী জীবন।
সময় যেন কিছুতেই ফুরায় না।
মনের মধ্যে সারাক্ষণ শুধু একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খায়।
কেন সেদিন সুমন্তকে সব বলতে গেল?
জন্মের পর থেকেই যাকে লালন পালন করেছে, তার প্রকৃত মা তো সেই।
সব বুঝেও কেন তার মধ্যে এমন হিংস্র অনুভূতি ঝড় তুলেছিল সেদিন?
তা কি মাতৃত্বের?
নিজের গর্ভে সন্তানকে ধারন না করার এক করুন আর্তি দিনে দিনে দিপীকাকে রাহুগ্রস্থ করে তুলেছিল।
বিকারগ্রস্ত স্বামীর পাশবিক লালসার শিকার মালতীর গর্ভে সুমন্তের জন্ম।
একথা সে মন থেকে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারছিলেন না।
যে পুরুষকে কৈশোরের রঙ্গিন স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে হৃদয় উজাড় করা ভালবাসা দিয়ে, ভালবাসা পাওয়ার জন্যে সংসার গড়েছিল।
সেই কি না...........
দিপীকা আর কিছু ভাবতে পারেন না।
অঝোরে কাঁদতে থাকেন।
কোথায় সুমন?
সুমন, তুই কোথায়রে বাবা?
মা... এই যে আমি।
দিপীকা বিদ্যুতের মত চমকে ওঠে।
সুমন ফিওে এসেছে।
সুমন দিপীকাকে জড়িয়ে ধরে চুমোয় চুমোয় ভরে দেয় আর বলে-
মা..... আমার লক্ষ্মী মা। আমার সমস্ত স্বত্বা জুড়ে তুমি রয়েছ মা। তোমাকে অনেক ভালবাসি মা...... মা...... মাগো......
মনের সমস্ত কালিমা মুছে যায় দিপীকার সুমন্তকে ফিরে পেয়ে। অঝরে কাঁদতে থাকে দুজনেই অনাবিল আনন্দের রেশ নিয়ে।

 

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top