সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

ঘাটিয়াল (পর্ব দুই): মহি মুহাম্মদ


প্রকাশিত:
৩০ জুন ২০১৮ ১৩:৪০

আপডেট:
১৩ এপ্রিল ২০২০ ১৪:১০

 

বাজারের দক্ষিণে একটা ছাপড়া ঘর। সে ছাপড়া ঘরেই থাকত রাখাল মুচি। রাখাল মুচির বোনের নাম মালতি। বয়সটা বোঝা যায় না। অষ্টাদশী বললেও চলে আবার ষোড়শী বললেও মানায়। রাখালের ইনকাম তেমন নেই। তবে বাজারের অনেক টাকাই মালতি দেয়। বাজারে মালতির দাম আছে। দামটা আসলে কেমন যারা জানে তারা বোঝে। সবাই বলে তবে কেউ দেখেনি। আর যারা দেখেছে কিংবা পেয়েছে তারা মুখ খোলে না। তবে অভয় পিসির এই কর্মকান্ডের সাক্ষী। অভয়কে প্রায়ই টাকা দিতো। এটা ওটা। আরো কতো কী! সংসারে তাদের অভাব ছিল। মুচিগিরির টাকায় সংসার চলতো না। রাখাল বাজার বারে কিছু কাজ কাম পেত। সপ্তাহে দুদিন। রবিবার আর মঙ্গলবার। এ দুদিনের আয়ে কয়েকদিন চলতো আর দুদিন তিন দিন কষ্ট হতো। তখনই মালতি টাকা বের করতো। ওর টাকায় অভয় বাজার করে আনতো। মালতির এই রোজগার ভালোই চলছিল। বাজারের দিন যখন রাত নামতো তখন ছাপড়ার পেছনে গিয়ে মালতি দাঁড়াত। সঙ্গে সে অভয়কে নিতো। না হয় অভয়ের মা কিছুতেই মালতিকে চোখের আড়াল হতে দিত না। বাজারের দিন মালতি তার চুলে তেল দিত। তারপর চুলে লম্বা একটা বেণী করত। সেই বেণী পিঠের ওপর সাপের মতো দুলতো। তারপর বৌদির থেকে অনুমতি নিয়ে ছাপড়ার পেছনে অন্ধকারের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াত। অবশ্য অভয়কে সঙ্গে আনতেই হতো। মালতি অভয়কে তেমন সমস্যা মনে করতো না। সে মনে করতো অভয় এসব কিছুই বুঝবে না। কিন্তু অভয় অন্ধকারেও এসব বুঝতো। আলের উপর দাঁড়িয়ে থেকে দুজন মানুষ মালতির সঙ্গে কেন ফুসুর ফাসুর করতো তা অভয় বুঝতো। তারপর আরেকটু আড়ালে গিয়ে কি এমন হাঁসফাঁস কথা! সেও অভয় বুঝতো তাই সে কোনো কথা বলতো না। মালতি ট্যাকে টাকা গুঁজতে গুঁজতে ছাপড়ায় ঢুকত। অবশ্য অভয়কে চকলেট কিংবা মিষ্টি জাতীয় কিছু কিনে দিতো। অভয় হাতের দ্রব্যের দিকে গভীর মনোযোগ ফেলে রাখত। মালতি নিশ্চিন্ত থাকত। অন্তত অভয়কে নিয়ে কোনো ভয় নেই। সে জানে মালতি সম্পর্কে অভয়কে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেও  লাভ হবে না। অভয় অন্য টাইপের ছেলে। মালতির কাছেই ওর আবদার। মালতির ঠিকানা শুধু অভয়ই জানে।

মালতির দিন এভাবেই যেতে পারতো। হয়তো তার গল্প বাজার থেকে বাজারে ছড়িয়ে যেত। কিংবা মাঠ, ঘাট পেরিয়ে অন্য কোথাও ছড়াত। মালতির দিন  এভাবেই যেতে পারতো, কিন্তু গেল না। জমিরউদ্দিন মুয়াজ্জিন সব ভÐুল করে দিল। সে গল্প না বললে অভয়ের মানসিকতা ঠিক বোঝা যাবে না। কারণ মালতির পরিণতির একমাত্র সাক্ষিও অভয়। আর যে ঘটনায় অভয় নিজের মানসিকতাকে পরিবর্তন করে নিয়েছে তার উৎসটাও জানা দরকার। না হয় অভয়ের কাজ কারবার হুট করে বিশ্বাস যোগ্য মনে হবে না।

মুয়াজ্জিন জমিরউদ্দিন বাজরের মসজিদে আযান দিত। আর সুযোগ পেলেই সে মালতির খোঁজ নিত। তবে কেউ বলে না মালতি তাকে বিশেষ পাত্তা দিত। সবাই বলে এমন কি রাখালের বউও বলে জমিরউদ্দিনকে মালতি বিশেষ দেখতে পারতো না। সে প্রায়্ই মালতির সঙ্গে ভাব করতে এসে মালতির বকা খেয়ে ফিরে যেত। তবে মালতি কথা না বললেও অভয়কে জমির দুএকটা কথা জিজ্ঞেস করতো। অভয় জমিরের সঙ্গে কথা বলতো না। তবে কেউ কেউ বলে মালতি অভয়ের সঙ্গে কথা বলতো অন্য সময়। সে সময়টা কেউ তাদের দেখেনি। ফযরের আযান শেষ হলে মালতির সবচেয়ে কাছের মানুষ হতো জমির। আযান দেওয়ার পর মালতিকে সহজেই ঘুম থেকে তুলতে পারতো জমিরউদ্দিন।

 

মালতির বাজারের দিনে ক্ষেতের আলের আঁধারে দাঁড়িয়ে পুরুষসঙ্গ জমির মেনে নিতে পারেনি। মালতিও তার প্রয়োজনের কথা বলতে ছাড়েনি। সে ক্ষেত্রে তাদের আলোচনা হয় তারা চলে যাবে দূরে কোথাও। তবে জমিরের কথা আগেই ফাঁস হওয়াতে জমিরকে মুসল্লিরা আযান দেওয়া থেকে বিরত রাখে। জমিরের একটা কঠিন শাস্তির বিধান করার জন্যও তারা উঠে পড়ে লাগে। এই বিধান একইভাবে রাখাল মুচির জন্যও প্রযোজ্য হয়। রাখাল কিছুতেই তার বোন মালতিকে এখানে রাখতে পারবে না। কারণ যুবতী নারী মালতির দিকে সবার চোখ পড়েছে।  মালতিকে বিয়ে দিতে হবে। নচেৎ ওকে দূর করে তাড়িয়ে দিতে হবে। এই বিচার সাব্যস্ত হওয়ার পরেই ঘটনাটি ঘটল। জমির ও মালতি পালিয়ে গেল। কোথায় গেল কে জানে! দীর্ঘদিন জমির আর মালতির দেখা মিলল না। তবে সবাই মালতিকে ভুলে থাকলেও অভয় চুপচাপ বসে থাকল না। সে ঠিকই ভেতরে ভেতরে মালতির খোঁজ নিতে লাগল। সেও মাস দুমাসে একবার হারিয়ে যেত। কেউ  কিছুই বুঝতে পারল না। অভয় শহরে গিয়ে মালতির খোঁজ করতে লাগল।

 

সে যে প্রায়ই যেত কোথায় যেত, তা কেউ জানতো না। কেউ কেউ বলে অভয় আসলে শহরে যেত মালতিকে দেখতে। মালতি কোথায় থাকে তা একমাত্র অভয় জানতো। কিন্তু বছর না ঘুরতেই অভয় আর কোথাও যেতো না। মালতির কোনো খোঁজও সে করতো না। কিংবা মালতিকে কোনোদিন সে শহরে দেখছে  কিনা তাও  সে কাউকে জানাল না। তবে অভয়ের কথাটাও খুব বেশি গোপন রইল না। কেউ বলল অভয় শেষবার যখন গিয়েছিল তখন মালতির কোনো খোঁজ খবর পায়নি। কারণ মালতি আর সেখানে ছিল না। তবে জমিরউদ্দিন যখন শহর থেকে ফিরে এল তখন মালতির সম্পর্কে অনেক কথাই জানা গেল। জমির বলল, মালতি একটা খারাপ মেয়ে। সে খারাপ কাজ করার জন্যই তাকে ফেলে অন্য কোথাও চলে গেছে। এ কথা শোনার পর অনেকেই তখন বাজারে মালতির কাজ-কামের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাইল। ভেতরে ভেতরে মালতির নিষিদ্ধ যাতায়াতের কথা বলতে শুরু করল। যা হবে হোক, আরো কিছু দিন পর অভয় শহরে গিয়ে মালতির অবস্থান জেনে এল। আর এই জেনে আসায় অভয়ের কাল। কারণ তখন অভয়ও পাল্টাতে শুরু করল। অভয় কিভাবে পাল্টাতে থাকল তা কেউ টের পেত না। যদি শেষ বেলায় জামেলা অভয়ের সঙ্গে না যেত। জামেলা চলে যাবার পরেই অভয়রে ঘটনা এ অঞ্চলে ফাঁস হয়।

 

মহি মুহাম্মদ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top