সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০


মনোজাগতিক কঠিন ব্যাধি : শাহানারা পারভীন শিখা 


প্রকাশিত:
১৫ এপ্রিল ২০২১ ২১:৫৬

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ০২:৩৭

 

রাত ১২ টা বেজে ৪৫ মিনিট। রোহান ঘুমোতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। শেষবার ফোনের নিউজ ফিডে একটু উঁকি দেয়। চোখ থেকে যায় একটা পোস্টে। 
"আমি প্রিয়ন্ত। জীবনের সাথে লড়তে লড়তে বড্ড ক্লান্ত। তাই নিজেই জীবন থেকে মুক্তি নিচ্ছি। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।"
হাত ফস্কে ফোনটা বিছানায় পড়ে যায়। 
রোহানের মাথা কাজ করছে না। 
এলোমেলো হাতে প্রিয়ন্তের নাম্বারে ফোন দেয়। কিন্তু ফোন বন্ধ। 
অসহায় হয়ে বসে থাকে সে। কিচ্ছু করার নেই।
ওর ফোনটা বেজেই চলেছে। বুঝতে পারছে ওর অন্য বন্ধুরা পোস্ট টা দেখে ওকে ফোন দিচ্ছে। 
ফোনটা বন্ধ করে দেয় রোহান। 
ভোর না হতেই প্রিয়ন্তদের বাসায় চলে আসে। গেটের বাইরে ভীড় দেখেই বুঝে যায় প্রিয়ন্ত আর নেই। 
দৌড়ে সিড়ি দিয়ে উঠে রুমে ঢুকে দেখে প্রিয়ন্তর নিথর দেহটা মেঝেতে শোয়ানো। পাশের রুম থেকে ওর মায়ের আর্তনাদ ভেসে আসে।
 নিঃশব্দে নীচে নেমে আসে। 
আসতে আসতে কানে যায় আঙ্কেলের কান্না জড়ানো কন্ঠ "তোমরা তো ওর বন্ধু। রাতে ওর পোস্টটা দেখে আমাদেরকে জানালে না কেন তোমরা। পাশের রুমে থেকেও আমরা কিছুই জানতে পারলাম না বাবা।"


রোহান আর প্রিয়ন্ত দু'জন খুব কাছের বন্ধু ছিল। 
রোহান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। কিন্তু ভীষণ মেধাবী প্রিয়ন্ত চান্স হয়নি পাবলিকে। ভর্তি হয় নামকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। 
স্বপ্ন হারিয়ে মুষড়ে পড়ে ভীষণ ভাবে সে। ঘুরে দাড়াতে সাহায্য করে রোহানসহ কাছের বন্ধুরা। 
ঘুরে দাড়ায় প্রিয়ন্ত। ডাক্তারের কাছে নিজেই যায় চিকিৎসা নিতে। ডাক্তারের নির্দেশ মতো চলে। 
 কিছুটা স্বাভাবিক জীবনের মাঝে ফিরে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা আয়োজনে মেতে থাকে। কিছুদিন ভালো থাকে। আবারও ডিপ্রেশনে চলে যায় হঠাৎ হঠাৎ। বছর দুই নিজের সাথে লড়তে লড়তে হেরে যায় প্রিয়ন্ত। 

হারিয়ে যাওয়া প্রিয় বন্ধুর কথা মনে হলে আজও ডুকরে কেঁদে উঠে রোহান। 
__________________________

 

রাফি রণি আর আবির তিন বন্ধু। হরিহর আত্মা যাকে বলে। তিনজনের মধ্যে আবির খুব চটপটে। লম্বা চওড়া সুঠাম দেহের আবিরের জীবন খেলাধূলার মধ্যে বাঁধা।
 বড় খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন ওর চোখে। একারণে পড়াশোনায় মনোযোগ খুব কম। 
সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও আবির সেবার ভর্তি হয় না। শুধু খেলাধুলায় মেতে থাকে সারাদিন।  
এরমধ্যে নিয়ম করে ওদের দেখা হয় সবসময়। 

আবিরকে ইদানীং কেমন একটু অন্য মনস্ক লাগে রাফির কাছে। রণিকে বলতেই সেও একই কথা বলে। 
আস্তে আস্তে আবিরের সাথে দেখা সাক্ষাৎ কমে যায় ওদের। 
এইতো সেদিনের কথা। দুবন্ধু বসে আছে। দূর থেকে আবিরকে দেখে। খুব দ্রুত হেঁটে আসছে ওদের দিকে। চেহারার মধ্যে কেমন ভয়ের ছাপ। 
কি হয়েছে?  জিজ্ঞেস করতেই এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে,  দোস্ত কেউ একজন আমাকে ফলো করছে বেশ কিছুদিন থেকে। আমাকে মেরে ফেলবে। 
ওরা লাফিয়ে উঠে এদিক ওদিক তাকায়। কিন্তু রাস্তায় কাউকে তেমন চোখে পড়ে না। 
ওরা হেসে ওঠে। 
বলে তুই কি জঙ্গি দলে নাম লিখেছিস নাকি? যে তোর পিছে গোয়েন্দা ঘুরে বেড়াবে। 
ওরা মজা করে আবিরের সাথে। 
কিন্তু আবির সেই হাসিতে যোগ দেয় না। কিছুক্ষণ ওদের সাথে থাকে। তবে কথা তেমন একটা বলে না। 
এরপর কিছু না বলেই খুব সতর্ক পায়ে হেঁটে চলে যায়। ওরা বেশ অবাক হয় আবিরের অদ্ভুত আচরণে।

বেশ কিছুদিন পর। একদিন রাতে আবিরের আম্মুর ফোন আসে রাফির কাছে । 
কান্না জড়ানো কন্ঠে বলেন রাফিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোনও বন্ধ। 
"আন্টি চিন্তা করবেন না। ও ঠিক চলে আসবে। "
পরিচিত সব বন্ধুদের কাছে ফোন দেয় রাফি। কিন্তু কেউ ওর খবর বলতে পারে না।
একটু চিন্তা হয় রাফির। বেশ কিছু দিন থেকেই মাঝে মাঝে লাপাত্তা হয়ে যায় আবির। কিন্তু ফোন খোলা থাকতো তখন। 
এবার তো ফোন বন্ধ। 
পরদিন আবিরের পরিবারের সাথে রাফি থানায় যায়। 
থানার কর্মকর্তা সব শুনে বলেন, ইয়াং ছেলে। ঘুরতে চলে গেছে। দুদিন দেখেন। ঠিক ফিরে আসবে। আজকালকার ছেলেরা মন চাইলো তো ব্যাগ কাঁধে নিয়ে হাঁটা ধরলো।
আবিরের ছবি আর ফোন নাম্বার দিয়ে চলে আসে ওরা। 
তিনদিন পর আবির ফিরে আসে বাসায়। 
সম্পূর্ণ অন্য বেশে। 
চুপচাপ ঠান্ডা। 
খবর পেয়ে বন্ধুরা ছুটে যায় ওদের বাসায়। 
আন্টি কান্না জড়ানো কন্ঠে বলেন, “বাবা। আমার চঞ্চল হাসিখুশি ছেলেটার কি হয়ে গেল।"
রাফি আবিরের রুমে ঢুকে।
 অনেক কিছু জিজ্ঞেস করে। কিন্তু কোন জবাব দেয় না সে। কঠিন ভয়াবহ এক দৃষ্টি দেখতে পায় রাফি। বুঝতে পারে ভয়ংকর কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে যে কোন সময়।কারো জন্যই আবির এখন নিরাপদ নয়। 
পরিচিত ডাক্তারের কাছে ফোন করে রাফি। ডাক্তারের পরামর্শে সেই রাতেই আবিরকে রিহ্যাবে পাঠিয়ে দেয়া হয়। 
না। আবির নেশায় আসক্ত নয়।
ভয়ংকর এক রোগ ওর মনোজগতে বাসা বেঁধেছে। ছয়মাস ওখানে ছিল। 
আবির এখন ওর বাসায় আছে। নিজের মধ্যেই বন্দী হয়ে আছে। 
রাফির খুব কষ্ট হয় আবিরের কথা মনে হলে। এতো কাছের বন্ধু। অথচ বন্ধুর সাথে দেখা করতে পারছে না। ডাক্তারের নিষেধ। ওর কাছে এখনো কেউ নিরাপদ নয়।________________________

 

মোহিতের স্কুলের এক বড় ভাই বিদেশে থাকে।ভীষণ মেধাবী। বয়স ৩৫ বছর এখন। উচ্চশিক্ষা নিয়ে ওদেশেই থেকে গেছে। বড় চাকরি করছে। খুব ভালো সম্পর্ক সেই ভাইয়ের সাথে। মাঝে মাঝে কথা হয় সেই ভাইয়ের সাথে। 
 কঠিন এক রোগ বাসা বেঁধেছে সেই ভাইয়ের। নিজেই বলেছে সেই রোগের কথা। 
নিজের মধ্যে দৈতসত্বার অস্তিত্ব টের পাচ্ছিলেন একটু একটু করে। প্রথমদিকে তেমন একটা গুরুত্ব না দিলেও। এখন উনি বেশ সিরিয়াস। ডাক্তারের পরামর্শে চলছেন। কিন্তু মাঝে মাঝেই অন্য জগতে চলে যান।
বেশ কিছুদিন আগে সেই ভাই দেশে বেড়াতে আসে। মোহিত খবর পেয়ে দেখা করে। চারমাস থাকবে বলে। 
এরমধ্যে মোহিত সেই বড় ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারে না। 
ফোন বন্ধ পায়। দুশ্চিন্তা পেয়ে বসে মোহিতের। 
ভাই যে অসুখের কথা বলেছিল তাতে খারাপ কিছু হয়নিতো। অজানা আশংকায় বুক কেঁপে ওঠে ওর।
তিনমাস পর হঠাৎ একদিন সেই ভাইয়ের ফোন।
"ভাই আপনি কোথায়? 
"আমি বিদেশে ফিরে এসেছি।"
খুব বিরক্ত নিয়ে বলেন।
তারপর যা বললেন তা শুনে মোহিত অবাক হয়ে যায়। 
দেশে আসার পর তেমন সমস্যা না হলেও পরিবারের কাছে উনি নিজের অচেনা অসুখের কথা জানালেন। এদেশের একজন ভালো ডাক্তারকে দেখাতে চান ফিরে যাওয়ার আগে। 
কিন্তু পরিবারের কেউ সেটা বিশ্বাস করেনি। ভেবেছে বিদেশ বিভূঁইয়ে একা একা থাকে। বেলাইনে চলে গেছে হয়তো। 
এরপর তাদের উদ্যোগেই সোজা রিহ্যাবে। 
দুমাস পর সেখান থেকে ফিরে আর দুটো দিনও থাকবেননা জানান। ফিরতি প্লেনে সোজা ফিরে এলেন। 
এবং আর কখনই দেশে ফিরবেন না বলেন।

গত রোববার টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের অ্যালেন রাজ্যে একটি বাঙালি পরিবারের ছয়জন সদস্যের মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছে সকলকে। দীর্ঘদিন ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকা দুই ভাই নিজেদের সাথে পরামর্শ করে পরিবারের সবাইকে মেরে নিজে আত্মহত্যা করেছে। দীর্ঘ একটা 'সুইসাইড নোট' লিখে পোস্ট দিয়েছে ইনস্টাগ্রামে। 
সেই লেখাতেই উঠে এসেছে মানসিক এই কঠিন রোগটার ভয়াবহতা সম্পর্কে। 
একজন শিক্ষিত মানুষ নিজেকে বোঝার ক্ষমতা রাখে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। আপাতঃ দৃষ্টিতে সাধারণ মানুষের কাছে এই রোগ এখনো অচেনা অজানা। যে কারণে নানারকম সমস্যায় পড়ে যায় রোগী। সঠিক চিকিৎসাও করা হয়না। ফলে রোগটি আরও জটিল হয়ে পড়ে অনেক সময়। 
দীর্ঘদিন মনোব্যধির সাথে লড়তে লড়তে কখনো কখনো হেরে যায় নিজের কাছে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঘটিয়ে থাকে নানা দূর্ঘটনা। শেষ হয়ে যায় একটি পরিবার কিংবা পরিবারের সব স্বপ্ন। আসুন আমরা মনোজগতের এই ভয়াবহ রোগ সম্পর্কে অবগত হই।এবং এই ব্যধির সাথে লড়তে থাকা সকলকে বাঁচাতে সাহায্য করি।

 

শাহানারা পারভীন শিখা 
কবি এবং লেখক 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top