সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১


আঁধারকন্যা : পুলককুমার বন্দ্যোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
১৯ নভেম্বর ২০২০ ২২:২৫

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:০৫

 

কতক্ষণ যে সেখানে বেহুঁশ হয়ে পড়ে ছিলাম জানি না, যখন ঘোর কাটল তখন দেখি একটি মেয়ে ধীরেসুস্থে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। খুব আশ্চর্য লাগল। ওকে তো আমি চিনি না, কোনওদিন দেখিও নি। আকণ্ঠ পিপাসার কথা ভুলে গিয়ে আমি উঠে বসেছি। ক্ষীণ আলোয় শুধু মেয়েটিকেই দেখছিলাম। কে এই রমণী? তেমন আহামরি কিছু নয়, ওই কালো-কুচ্ছিৎ মেয়ের দিকে দ্বিতীয়বার তাকানোর মতো আকর্ষণও নেই, তবুও কোথায় যেন সামান্যতম চটক। গোটা মুখ জুড়ে এক অদ্ভুত প্রশান্তির ছাপ, যেন-বা ওইটাই তার মহার্ঘ্য সম্পদ। স্নেহ, বাৎসল্য, মমতা সব বুঝি একাকার হয়ে স্পষ্ট ছায়া ফেলেছে সেই মুখের ওপরে। আয়ত দু'খানি চোখ, সেখানে ভয়, ভাবনা কিংবা শঠতার চিহ্নমাত্র তো নেইই, বরং খুঁজলে পাওয়া যাবে এক পরম বিশ্বাসের ইঙ্গিত। আমাকে আস্তে আস্তে তুলে ধরে সেই মেয়ে একটা বাগানের কাছে নিয়ে গেল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো নিঃশব্দে ওকে অনুসরণ করতে আমার এতটুকু দ্বিধা নেই। বাগানে ঢুকে একসময় ক্লান্ত হয়ে বসে পড়তেই সে ফের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, "খুব কষ্ট হচ্ছে? একটু জল খাবে?"

পিপাসার কথা এতক্ষণ ভুলেই গিয়েছিলাম। ঘাড় নেড়ে সায় দিতেই সে তাড়াতাড়ি এক গেলাস জল আর একটা বাতাসা মুখের সামনে ধরে বলল, "হাঁ করো, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।"
এক নিঃশ্বাসে জলটুকু খেয়ে ওর মুখের দিকে ভাল করে তাকাই। জিজ্ঞেস করলাম, "তুমি কে?"
সে বলল, "আমি সুজাতা। আমিই তো ভগবান বুদ্ধকে পায়েস রেঁধে খাইয়েছিলাম।"
কিছু না বুঝে আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। সে আমার হাতটা ধরে বলল, "এসো আমার বাগানে। দেখো কত বিচিত্র ফুল ফুটে আছে। আমি খুব যত্ন করে বাগানটা সাজিয়েছি।"
ঠিক সেই মুহূর্তেই পিছনে খিলখিল হাসির শব্দ। আমি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, "কে ওখানে?"
সুজাতা বলল, "হয়তো কোনও দানবী। আমার এই সুন্দর বাগানটাকে নষ্ট করতে চায়। ও নিশ্চয়ই ফুল ভালবাসে না।"

আমি পিছন ফিরে তাকাতেই ফের সেই শব্দ। ঘন অন্ধকারে কাউকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু হাসিটা ক্রমশই যেন প্রকট হয়ে উঠছে। কী দুর্বোধ্য এক আকর্ষণ ! আমি জলতরঙ্গের সুর শুনছি। অদ্ভুত এক মাদকতায় বিভোর হয়ে যাই। পাহাড় ভেঙে বুঝি কোনও ঝরণা কুলুকুলু ধ্বনিতে বয়ে চলেছে তার আপন ছন্দে। আমাকে অন্যমনস্ক দেখে সুজাতা বলল, "ও কিছু নয়, ছলনামাত্র। ওই দানবী খুব চেষ্টা করছে বাগানে ঢুকতে। সব তছনছ করে দিতে চায়।.... তবে পারবে না। আমি যে এখানে ফুল ফোটাই ! ভালবাসার ফুল !"

কালো-কুচ্ছিৎ সুজাতাকে এখন আমার একেবারেই পছন্দ হচ্ছে না। তার বদলে অন্ধকারের সেই হাসিটার জন্যেই ভীষণ আকুল হয়ে উঠেছি। কানের কাছে জলতরঙ্গের এমন মধুর আওয়াজ ! তাকে কি উপেক্ষা করা যায়? একটা পুরোপুরি ঘোরের মধ্যে আচ্ছন্ন হয়ে আমি সেই আঁধারকন্যাকে খোঁজার জন্যে বাগান থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সুজাতা বাধা দিল না, শুধু ভারাক্রান্ত গলায় বলল, "আমি অপেক্ষা করব। প্রয়োজন হলে ফিরে এসো কিন্তু।"

 আমি ওর কথা ভাল করে শোনার চেষ্টাই করলাম না। খিলখিল হাসির শব্দ তখন আমাকে কোনও এক অজানা গন্তব্যে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। পিছনে তাকানোর সময় নেই। খানিকটা এগিয়ে যেতেই অন্ধকার কেটে গেল। আলো ফুটতেই তার দেখা পেলাম। কিন্তু এ কে? ঈশ্বর যেন নিপুণ দক্ষতায় সৃষ্টি করেছেন সেই নারীমূর্তিকে। মুগ্ধ বিস্ময়ে বারবার দেখেও চোখ ফেরানো যায় না। শরীরের আনাচে-কানাচে শুধু আমন্ত্রণের অনুচ্চারিত ভাষা। আমার দিকে অদ্ভুত এক দৃষ্টি নিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, "কী দেখছ ?"
"তোমাকে।"
"তাহলে আমার হাত ধরো।"
আর তো অপেক্ষা করা যায় না। আমার  সব দ্বিধা-সংকোচ তখন পুরোপুরি উধাও। ওর দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, "তুমি কে?"
ঠোঁটের কোণায় একফালি হাসি টেনে সে বলল, "আমি বাসবদত্তা। চলে এসো আমার সঙ্গে।"
সারা শরীরে বিদ্যুতের তরঙ্গ খেলে যাচ্ছে। ওর পাশে দাঁড়িয়ে বললাম, "আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি বাসবদত্তা।"
মেয়েটা হঠাৎ হেসে উঠল, "তাই নাকি? এই কথাটা কিন্তু তোমার মতো আরও অনেকেই বলে।"
"অনেকে?"
"হ্যাঁ, তারা আমার জন্যে পাগল।"
"ওদের কথা ভুলে যাও। এখন শুধু আমি।"
সে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল, "কিন্তু তুমি আমাকে কী দিতে পারবে?"
"যা চাও।"
"সত্যি বলছ ? আমার সঙ্গে ছুটতে পারবে ?"
"পারব।"
"আকাশের ওই যে চাঁদটা দেখা যাচ্ছে, ওর একটা টুকরো আমাকে এনে দিতে পারবে? আমি চাঁদের জ্যোৎস্না গায়ে মাখব।"
"নিশ্চয়ই পারব।"
"নীল সমুদ্রের বুকে আমাকে নিয়ে ভেসে বেড়াতে পারবে?"
"তাও পারব।"
"পক্ষিরাজের পিঠে চাপিয়ে আমাকে নিয়ে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়াতে পারবে?"
আমি অধৈর্য হয়ে বললাম, "পারব, সব পারব। তোমার জন্যে এই মুহূর্তে আগুনে ঝাঁপ দিতে পারি, জলে ডুবতে পারি, খাড়া পাহাড়ের চূড়া থেকে লাফাতেও পারি।"
বাসবদত্তা এক মুহূর্ত কিছু ভেবে নিয়ে বলল, "তুমি সত্যিই সুন্দর। এসো, আমরা বরং একটা সংসার তৈরি করি।"
একটা প্রাসাদের দিকে আঙুল বাড়িয়ে সে বলল, "এটাকেই আমরা যত্ন করে সাজাব। এই সেই সংসার যেখানে আমাদের জীবনযাপন, সন্তানসন্ততি, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে ঘর-গেরস্থালি।"
ওর কথামতো শ্রম আর নিষ্ঠা দিয়ে সেই প্রাসাদটাকে মনের মতো সাজিয়ে তোলার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করলাম। দেখেশুনে খুব খুশি বাসবদত্তা। তার এই খুশি হওয়াটাই আমার কাছে বড় প্রাপ্তি। 
একদিন সে বলল, "তুমি আমাকে মুক্তো এনে দাও, সবথেকে ভাল মুক্তোটা আমার চাই।"
সমুদ্রের অতল গহ্বর থেকে ঝিনুক খুঁজে এনে মুক্তো বের করলাম। সেই মুক্তো বাসবদত্তার হাতে দিতেই উচ্ছ্বাসে ঝকমক করে উঠল ওর সারা মুখ চোখ। পরক্ষণেই বলল, "তুমিই পারবে। হীরে, চুনি,পান্নার মতো দামি দামি রত্ন জোগাড় করো, সব আমার চাই।"

আমি  তখন জীবন বিপন্ন করে খনিগর্ভে মূল্যবান রত্নরাজি খুঁজতে শুরু করলাম। সেগুলো বাসবদত্তার হাতে পৌঁছে দিয়ে তবে স্বস্তি। মূল্যবান রত্নালঙ্কারের সজ্জায় নিজেকে আরও বেশি মোহময়ী করে তুলল সে,তারপরেই গিয়ে দাঁড়াল রাজপথে। সেখানে তখন অসংখ্য পুরুষের ভিড়। তাদেরকে নানা ছলাকলায় ভুলিয়ে রেখেছে বাসবদত্তা। অথচ আমার দিকে ভ্রূকুটি করে বলছে, "তুমি খুব তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে পড়ছ। আমার কিন্তু এখনও অনেক চাহিদা বাকি।"

 বাসবদত্তার চাহিদা মেটানোর জন্যে আমি তখন বিপর্যয়ের একেবারে শেষ সীমানায় পৌঁছে গিয়েছি। বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়েও ওকে খুশি করার জন্যে অরণ্যের গভীরে ঢুকে সুগন্ধী কাঠ সংগ্রহ করেছি, দিনের পর দিন কত বিপদসংকুল পথে হেঁটেছি, কত খরস্রোতা নদী আর গিরিখাত পেরিয়েছি। তা সত্ত্বেও বাসবদত্তার গলায় ক্রুদ্ধ আস্ফালন, "তুমি একটি অপদার্থ। এখনও পর্যন্ত আমার জন্যে পক্ষিরাজ ঘোড়া আনতে পারলে না? অন্য কাউকে বললে এখনই সে এনে দেবে।"

ওর হাসির মধ্যে এখন আর জলপ্রপাতের শব্দ ঝরে না,পাহাড়ি ঝরণার কলধ্বনিও শোনা যায় না। চোখের ভাষাতেও এখন আর এতটুকু মাদকতা নেই। তার বদলে রয়েছে কী এক ভয়ংকর প্রতিবিম্ব ! আমি ভয়ে আঁতকে উঠি। বাসবদত্তার করালগ্রাস থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে আমি তখন মরিয়া। শেষমেষ সেই সুযোগটা পেয়ে যেতেই আর কালবিলম্ব না করে অন্ধকারের মধ্যে ছুটতে শুরু করলাম। 

বাসবদত্তা পিছু নিয়েছে। আমি আর কিছুতেই ওর কাছে ধরা দিতে চাই না। পাহাড়-পর্বত-বনজঙ্গল ডিঙিয়ে ক্লান্তিহীন ছুটে চলেছি। যেমন করেই হোক আমাকে মুক্তি পেতে হবে। 

ছুটতে ছুটতে পা দু'টো যখন একেবারেই অসাড় তখন একটা কুটিরের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলাম। আর ঠিক তখনই কে যেন এগিয়ে এসে আমাকে তুলে ধরল। সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। অনেকক্ষণ পরে খুব কষ্ট করে চোখ খুলে দেখি এক শ্যামলাবরণ মেয়ে মুখের সামনে গেলাস এগিয়ে দিয়ে বলছে, "এই গরম দুধটুকু খেয়ে নাও। তৃপ্তি পাবে। তুমি বড় ক্লান্ত।"
চিনতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, "তুমি কে ?"
মেয়েটি বলল, "আমি সুজাতা। আমিই তো একদিন তোমাকে জল দিয়েছিলাম, ভগবান বুদ্ধকে পায়েস রেঁধে খাইয়েছিলাম।"
আমার মধ্যে এক তুমুল আন্দোলন। যেন জাগতিক সমস্ত প্রাপ্তির দ্বারদেশে দাঁড়িয়ে আমার গলায় করুণ আর্তি ফুটে উঠল, "তুমি আমাকে নিয়ে চলো সুজাতা।"
"কিন্তু তোমার বাসবদত্তা?"
"ওর কথা আর ভাবতে চাই না। অতখানি আলো আর উজ্জ্বলতা আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে। অন্ধকারের নারীকে চেনা খুব কঠিন। তার চেয়ে শ্যামলাবরণ কন্যা ঢের ভাল।"
"আমি তো কালো-কুচ্ছিৎ। শ্রী নেই, লাবণ্য নেই, ছলাকলা জানি না, দু'চোখে মাদকতা ঝরিয়ে কাছে টানার ক্ষমতাও নেই।"
"ওটাই তোমার আসল সম্পদ সুজাতা। আমি আর ভুল করব না। আমাকে নিয়ে চলো।"
"কোথায় যেতে চাও?"
"তোমার বাগানে।"
"সত্যিই তুমি যাবে?" আনন্দে উচ্ছ্বসিত সুজাতার সারা মুখে খুশির ছায়া পড়ল। ওর আশ্চর্য সরলতা আর মাধুর্যে মোহাচ্ছন্ন হয়ে আমি নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকি সেই অলংকারহীন শ্যামলা মূর্তির দিকে। জিজ্ঞেস করি, "আমার কাছ থেকে তুমি কী চাও সুজাতা?"   

সরাসরি আমার চোখে চোখ রেখে সুজাতা সংক্ষেপে শুধু বলে, "ভালবাসা !"
"আমাকে কী দেবে?"
আবেগে গলা বুজে এল সুজাতার। যেন ফের আগের কথাটারই প্রতিধ্বনি করল, "ভালবাসা ! এছাড়া তো আমার কাছে দেওয়ার মতো কিছু নেই।"

গভীর আকুতি নিয়ে সুজাতা তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। বোধহয় কোনও প্রত্যুত্তর সে চায় না। সারা মুখে মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে বলল, "এসো, আমরা এবার এই বাগানে আরও অনেক ফুল ফোটাব। ভালবাসার ফুল।"

কত বিশ্বাস আর যত্ন নিয়ে বাগান তৈরি করেছে সুজাতা। আমি ওর পাশে চলতে চলতে মুগ্ধ বিস্ময়ে সব কিছু দেখছি। বিচিত্র গাছ আর লতাবিতান, ডালে ডালে অগুন্তি কুঁড়ি, একটু একটু করে তারা ফুটবে। চতুর্দিকে অন্ধকার, অথচ সুজাতার বাগানে রাশি রাশি আলো। বাইরের আঁধার কখনও গ্রাস করতে পারবে না সেই আলোটাকে। কোনও দানবী কখনও ঢুকতে পারবে না সেই ভালবাসার বাগানে। 

কী আশ্চর্য ! একজন নারী যখন বাগানে ফুল ফোটায়, অন্য এক নারী তখন ধ্বংসের হাতছানি দেয় !

 

পুলককুমার বন্দ্যোপাধ্যায় 
পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top