সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০


মেয়র নাই, মশাও নাই! (গদ্যকার্টুন) : মোহাম্মদ অংকন


প্রকাশিত:
৬ মার্চ ২০২১ ২১:৫৩

আপডেট:
৬ মার্চ ২০২১ ২২:৩৯

 

চা খেতে খেতে জনৈক ব্যক্তি এলাকার এক নেতাকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘বড়ো ভাই, এলাকায় মশার এত উৎপাত; কিন্তু মেয়র সাহেবকে দেখছি না কেন?’ (দেখছি না মানে শহরজুড়ে মশার উৎপাত বেড়ে গেলেও অনেকাংশে মেয়রদের কোনো ভ্রুক্ষেপ চোখে মেলে না। যখন মশার বিস্তার কম থাকে, তখন মশা নিধনের নানা পরিকল্পনার খসড়া দেখা মেলে এবং তা বাস্তবায়ন হতে হতে আরেকটা মশার সিজন কেটে যায়। তারপর আর মশা নিধনে কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় না। আচ্ছা, ওনারা যেখানে বসে থাকেন, শহর নিয়ে পরিকল্পনা করেন, সেখানে কি মশা নাই?) নেতা জনৈক ব্যক্তির উত্তরে বলছেন, ‘ধরেন, মেয়র বলে কিছু নাই।’ অবাক হয়ে জনৈক ব্যক্তি বলছেন, ‘আর মশা?’ নেতা সে প্রশ্নের উত্তরেও বলছেন, ‘ধরেন, মশা বলেও কিছু নাই।’

মেয়র নাই, মশাও নাই। কী অদ্ভুত ব্যাপার তাই না! আচ্ছা, আমরা তো নিজেরাই মশা নিধন করতে পারি? এই যেমন মশার কয়েল জ্বালিয়ে রাখলেই তো মশা মরে যায়। হাস্যকর হলেও সত্য, মশাও আজকাল কৌতুক করতে জানে। যখন কয়েল জ্বালানো হয়, তখন মশাও ধরে নেয় ‘কয়েল বলে কিছু নেই’। দেখা যায় যে জ্বলন্ত কয়েলের ওপরও মশা বসে ভনভন করছে। ভেজালের দৌরাত্মে বিষেও যে ভেজাল আছে, মশার কয়েল তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। যাইহোক, নগরে আমরা কর পরিশোধ করে বসবাস করব আর নগরের নালা-ডোবায়, ডাস্টবিনে উৎপাদিত মশার কামড় থেকে বাঁচতে কয়েল কিনে পরিবেশ ও টাকা নষ্ট করব, তার কি কোনো মানে আছে? জনৈক মহিলা সেদিন বলছেন, ‘বাচ্চাগুলো মশার কামড় খায় খাক, তবুও কয়েলের ধোঁয়া খাওয়ানো যাবে না।’ পাশ থেকে আরেকজন বলছেন, ‘মশারি টানাবেন, ভাবি।’ জনৈক মহিলা চটে গিয়ে বলছেন, ‘আপনি কি বাথরুমেও মশারি টানাবেন? দিনের বেলাও টানাবেন?’

মশা কোথায় নেই? কখন নেই? দিনেরাতে মশার কামড়ে অতিষ্ঠ জনগণ। কিন্তু এই দুঃখটা কে দেখবে? প্রতিটি সিটি কর্পোরেশনের জনগণের একটাই দুঃখজনক কথা তা হল- আমাদের যদি একজন মেয়র থাকত! মেয়রের পানে চেয়ে আছে জনগণ আর মেয়র কার পানে চেয়ে থাকেন তা বোঝা মুশকিল। নির্বাচনের সময় ঠিকই জনগণের পানে চান। আজকাল অবশ্য ভোটের জন্য জনগণের পানে চাইতে হয় না। শুধু ক্ষমতাসীন দলীয় নমিনেশনটা হলেই হয়। বিজয় সুনিশ্চিত। আর একবার বিজয়ী হলে মশার ইস্যু কেন আরও শত শত ইস্যুর কথা না শোনার ভান করে কান বন্ধ করে রাখা যায়। এই হচ্ছে আমাদের নির্বাচিত মেয়রদের ফিলোসফি। এসব বুঝতে কাউকে মনোবিজ্ঞানী হতে হয় না। আপাতত মনোবিজ্ঞানী না হলেও সিটি কর্পোরেশনে মশাবিজ্ঞানী খুবই দরকার। যারা কিনা আবিষ্কার করবেন- মশা নিধনের ‘একশো এক উপায়’! সেসব উপায়ের মধ্যে মেয়রের জন্য একটা পয়েন্টও না থাকলে বেশি ভালো হয়!

কোনো কোনো মেয়র মনে হয় মশা নিধনের উপায় নিয়ে ভাবেন। একবার পত্রিকায় পড়েছিলাম, কোনো এক মেয়র শহরের যেখানে যেখানে পানি জমে, মশা উৎপাদিত হয়, সেখানে সেখানে তিনি গাপ্পি মাছ চাষের বিষয়ে ভাবছিলেন। প্রথমত, গাপ্পি মাছ মশার উৎপাদিত লার্ভা খেয়ে মশার উৎপাদন রোহিত করত। দ্বিতীয়ত, গাপ্পি মাছে নগরের মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণ হত! আমার জানা নেই গাপ্পি মাছে আমিষের পরিমাণ কেমন! তবে গাপ্পি মাছ খাওয়ার সুযোগ তৈরি হলে জীববিজ্ঞানীরা বলবে যে মানুষ মশা খায়, মশার কামড়ও খায়! বুঝলেন না তো। বলছি। খাদ্য শৃঙ্খল অনুসারে ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায় যে মশাকে মাছ খায়, মাছকে মানুষ খায়। তার মানে মশাকে মানুষ খায়। কামড় তো খাচ্ছেই। এই লেখা লিখতে গিয়ে কয়টা মশার কামড় খেয়েছি, তার হিসেব নেই। আচ্ছা, এটা আবিষ্কার করা যায় না, কে কয়টা মশার কামড় খেলো, তা হিসাব করল একটা যন্ত্র! মশা-কামড় হিসাবযন্ত্র!

মশার কামড়ের কোনো সাইড ইফেক্ট আছে না কি? আসলে আমি কী সব বলছি, ঠিক বুঝছি না। মশা নিধন নিয়ে কথা বলতে বলতে ক্লান্ত! যেখানে মানুষ ভিন্ন ভিন্ন কিছু উৎপাদন করছে, সেখানে আমি মশা নিধনের কথা বলছি। এ কারণেই বোধহয় মশা আমাকে বেশি কামড়ায়! মশা হচ্ছে মেয়র কর্তৃক পরিচালিত বিশেষবাহিনী। মেয়র ও মশার বিরুদ্ধে কথা বললেই কামড়াবে। দেখেন না তাদের কত মিল। দুজনের নামই ‘ম’ দিয়ে শুরু! আচ্ছা, মেয়র যদি নগরের মশাকে বশ মানিয়ে লালিত-পালিত করতে পারেন, তাহলে জনগণ কেন মশার সাথে সখ্যতা গড়তে পারে না? আসলে মানুষ তো দ্বিমুখি। এই এখন মশার ওপর ক্ষিপ্ত। কখন যেন মেয়রের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, তা বলা যায় না। তখন আবার মেয়রের পদ থাকবে না। এও হয়েছে মশা নিধনে ব্যর্থ হয়ে মেয়র পরের বার আর মনোনয়ন পাননি। কিন্তু অন্যান্য মেয়রের এই চৈতন্যবোধ হচ্ছে না যে মশাও একদিন আমাকে ক্ষমতাচ্যূত করতে পারে।

মশারও ক্ষমতা আছে, মেয়রেরও ক্ষমতা আছে। উভয়ের ক্ষমতাবলে জনগণ আজ নিশ্চুপ। খাই না মশার কামড়, তাতে কী! মশার কামড়েও না কি ভিটামিন আছে! সেই ভিটামিনের অভাবেই না কি ডেঙ্গুজ্বর, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া হয়ে থাকে। সে চিকিৎসার জন্যই মেয়র, এমপি, মন্ত্রীদের টাকায় বানানো সুবিশাল হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে যেতে হয়। দেখছেন, রাজনীতি কোথায়, কোথায় বিজনেস! তাইতো মেয়রদের সম্মান এত বেশি! জনৈক এক পাতি নেতা বলতেছেন, ‘আমাগো নেতার হাসপাতালে মশার কামড়ের চিকিৎসা ভালো হয়।’ তার কথা শুনে আরেকজন বলতেছেন, ‘তাইলে মশার কামড় খাইলেও সমস্যা নেই। নেতার হাসপাতাল তো আছে।’ দারুণ ব্যাপার-স্যাপার। দুদিক থেকেই কতিপয় জনগণ নেতার পক্ষে ও পাশে থাকছে। আচ্ছা, নেতার হাসপাতালে চিকিৎসা হয় না কি গলাও কাটা হয়?

মশা নিয়ে মশকরা করতে ভালো লাগছে না। আমার কথা, মশার জন্ম হবে, মৃত্যুও হবে। মশা তো আর আমাদের মত সত্তর বছরের গড় আয়ু নিয়ে আসে না। তাই বলে মশার জন্মবিস্ফোরণ হবে? এটা কি রোধে আমরা কিছুই করব না? এ দায়িত্ব কার? মেয়রের নিশ্চয়। তিনি যদি ব্যর্থ হন মশা দমনে, তবে জানিয়ে দিক সরকার ও জনগণকে। প্রয়োজনে মশা মন্ত্রণালয় করা হোক। যে মন্ত্রণালয় শুধু মশার বংশবিস্তার রোধে কাজ করবে। হাস্যকর হলেও এর চেয়ে ভালো বুদ্ধি ও পরামর্শ দেওয়ার কোনো উপায় দেখছি না আপাতত। নতুন প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব পাক, মশা ও মেয়র নিপাত যাক।

 

মোহাম্মদ অংকন
সম্পাদক, বাংলাদেশ চিত্র, ঢাকা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top