সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০


বাঁচার নিত্যতা সূত্র : দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
৬ মে ২০২১ ২৩:১৫

আপডেট:
১৯ জুন ২০২১ ১৮:১৯

 

- চিনতে পারছেন স্যার?

মহিলার প্রশ্নে চোখ তুলে তাকাল অভীক। স্মৃতির দরজায় কড়া নাড়া। পরণে শাড়ি পরিপাটি। ঈষৎ পৃথুলা। প্রায় ত্রিশ ছুঁইছুঁই। চোখে মুখে শিশুর সারল্য। রামকিঙ্কর বেইজের আদিবাসী মহিলার ছবি যেন। অভীকের দিকে তাকিয়ে উত্তরের অপেক্ষায় মিটিমিটি হাসি মুখ।
- মা...মানে... ঠিক.....
- স্যার, আমি অনুপমা...... আপনার ক্যাপ্টেন। মনে পড়ে স্যার আপনি বলতেন, তোকে উপমা হতে হবে......

স্মৃতিরা শরতের শিউলির মতো একটা একটা করে ঝরে পড়ছে। বিদ্যালয়ের বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। সব আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু একটা রোগা পাতলা পাখি চেহারার মেয়ে। সবে পঞ্চমে ভর্তি হয়েছে। ১০০ মিটার,২০০মিটার সবেতেই উসেইন বোল্ট। প্রথম। করতালি মুখর জিজ্ঞাসু মুখগুলো উৎসাহ দিয়ে চলেছে ওকে। প্রতিযোগিতার শেষে পড়ন্ত সূর্যের আলো গায়ে মেখে ওর যখন ঘরে ফেরার পালা, তখন প্রশ্নের উত্তরে মজার কথা বলেছিল--ওর বাবা নাকি বলে যখন ছুটবি তখন ভাববি আকাশের বুকে পাখিদের উড়ে যাবার কথা। তাহলেই দেখবি তুই ছুটছিস না....উড়ছিস। বেশ মজার তো ব্যাপারটা। মগজে লালমোহন গাঙ্গুলি যেন বলে উঠেছিল, একটু কালচার করতে হচ্ছে মশাই।

এর কিছুদিন পরই ওর বাবার সাথে দেখা। শণিবার মেয়েকে ছুটির পর নিতে এসেছেন। সেদিনই বলেছিল অণুর করুণ ইতিহাস।

অণুর যখন সাড়ে তিন বছর বয়স,ওর মা ওদের ফেলে চলে যান। সেই সময় থেকেই ভদ্রলোক অর্ধনারী--একই শরীরে বাবা ও মা। ওনার চোখ ভর্তি জল সেদিন জানিয়ে দিয়েছিল অনেক না বলা কথা। এর পর থেকেই অণু অভীকের মনের কাছাকাছি। ভালো লাগার এক তাল কাদা। মানুষ গড়ার কারিগর হতে হলো অভীককে। লেখাপড়ায় খারাপ ছিল না। ওর সকলকে সাহায্য করার অদম্য ইচ্ছা ওকে অচিরেই বিদ্যালয়ে সকলের নেত্রী করে তুললো। অভীক মজা করে ডাকতো, ক্যাপ্টেন। সেই ক্যাপ্টেন আজ সামনে.....এতো বড়ো হয়ে গেছে !

শেষ দেখা মাধ্যমিকের রেজাল্ট বের হবার দিন। প্রণাম করে যাবার সময় বলে গেছিল ওর বাবার বদলির কথাটা। চলে যাবে পুরুলিয়া। সেই শেষ দেখা.....

- হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তা তোর সেই পাখির চেহারাটা যে মেলাতে পারছি নারে....
- স্যার,পাখিটাও যে বড়ো হয়েছে.....ওড়ার ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে....
- কতো বছর পর বলতো....তা কুড়ি বছর তো হবে।
- ঠিক তাই। দীর্ঘ কুড়িটা বছর স্যার। তবে আপনি কিন্তু আমার সাথেই ছিলেন । এখনও আছেন।
- মানে ?
- আপনার কথা মতো পড়াশোনা স্নাতক পর্যন্ত শেষ করেছি। তারপর আপনার কথা মতোই মানুষের মাঝেই আছি। স্যার আপনি বলতেন-----হায়াদ লেকে চলো,কায়নাদ লেকে চলো
মজা তো তব হ্যায়, জমানে কে সাথ লেকে চলো..... সকলের পাশেই আছি স্যার।
অভীক বুঝল, সময়ের ব্যবধান এর মধ্যে অনেক ইতিহাস লিখে ফেলেছে।
- তো তুই হাওড়া ষ্টেশনে? এখন?
- ইকো পার্কে হস্তশিল্প মেলা চলছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা স্টল দিয়েছে। ওরা ওখানেই রাত্রে থাকে। আমি বোলপুর ফিরি বাবার জন্য।
- বোলপুর?
- রিটায়ারমেন্টের পর বাবা ও আমি বোলপুরে দেশের বাড়িতে চলে আসি স্যার। প্রান্তিক ষ্টেশনের বামদিকে যে রাস্তাটা খোয়াইয়ের দিকে যাচ্ছে সেখানে ক্যামেলিয়া হোটেল থেকে একটু এগিয়ে আমাদের বাড়ি "আনন্দ ভৈরবী"। ওখানেই বাপ বেটিতে একটা এন জি ও চালাই।
- এন জি ও?
- বাবা যখন পুরুলিয়ায় প্রোজেক্ট অফিসার হিসাবে অসহায় নিরন্ন মানুষগুলোর মাঝে কাজ করতেন, তখন দেখতাম বাবার চোখে মুখে এক স্বর্গীয় আনন্দ। জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া মানুষটা মানুষের মাঝেই যেন আবার নতুন করে জীবনের মানে খুঁজে পেলেন। বাবা ঠিক আপনার মতোই বলতেন, মানুষ বড়ো কাঁদছে, মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াও।

এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে একটু থামল ক্যাপ্টেন। একবুক ভালোলাগা নিয়ে অভীক তাকিয়ে রইল ওর দিকে। কবেকার বলা কথাগুলো ও এখনও জীবন্ত করে রেখেছে ওর মনে....
- ছেলে মেয়ে গুলো ঐ "গুড আর্থ " রই। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্য সব।
- গুড আর্থ ! এ নামে তো পারল্ এস বাকের এক কালজয়ী উপন্যাস আছে। নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন।
- আপনার মুখেই প্রথম শোনা গুড আর্থের গল্পটা। হাতে হাত রেখে ওয়াঙলুর মতো চোখে সবুজ স্বপ্ন নিয়ে পৃথিবী গড়ার লড়াই ! ভুলিনি স্যার। ঐ নামটাই তাই রাখলাম।
- এন জি ও তে কি করিস তোরা?
- শিরদাঁড়াটা সোজা করে বাঁচতে শেখাই। সরীসৃপ হয়ে নয়----মাথা উঁচু করে বাঁচা। মানুষকে স্বনির্ভর করি আমরা। আর এটা হলেই অর্ধেক যুদ্ধ জয়। সাথে সাথেই ফিরে আসবে আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মান বোধ, সহানুভূতি, গোষ্ঠীবদ্ধতা। সর্বোপরি মহিলাদের ক্ষমতায়ন।
- কিভাবে স্বনির্ভর করিস তোরা?
- এটা আপনার জনকল্যাণ মূলক অর্থনীতির গল্প স্যার। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ মহম্মদ ইউনুসের রোড ম্যাপ। ছোট ছোট দল গড়ি। পনেরো থেকে কুড়ি জন সদস্য থাকে। সেলফ হেল্প গ্রুপ। দলগুলো ব্যাঙ্কের ঋণ নিয়ে বিভিন্ন আয় উপার্জনকারী কাজে যুক্ত হয়। আমাদের দলগুলো তাঁতের শাড়ি, গামছা, মাটির খেলনা, বাঁশের তৈরী হাতের কাজ,বেতের কাজ করে। পৌষমেলাতে এবং আশপাশের বিভিন্ন মেলাতে জিনিস বিক্রি করে ওরা ভালোই আয় করছে স্যার। তার ওপর প্রতি শনিবার খোয়াই এ সোনাঝুড়ির হাট বসে। বিভিন্ন সোসাল মিডিয়ার দৌলতে এখন প্রচুর লোক সমাগম হয়। কেনাকাটাও ভালো হয় এখন।
- বা: বেশ তো। এও তো এক ট্রান্সফরমেশন রে !
- হ্যাঁ স্যার, বলতে পারেন। তবে সবচেয়ে বড়ো বদল হয়েছে পরিবারগুলোতে। বাচ্চাগুলো স্কুল যাচ্ছে। পুরুষগুলো আর নেশা করে পড়ে থাকে না সারাদিন। মহিলাদের পাশে থেকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করছে। দিনের শেষে ভূমিকা বদলে এখন প্রেমিক সোয়ামী। রামকিঙ্কর বেইজের সুখী আদিবাসী পরিবারের ছবি। সত্যিই এ এক আনন্দ ভৈরবী !
- তুই "অ্যাকটিনোমাইসেটিজ" এর নাম শুনেছিস?
- সেটা কি স্যার?
- এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া। তপ্ত পৃথিবীর বুকে বৃষ্টির ফোঁটা গুলো যখন ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন যে মাটির সোঁদা গন্ধ বের হয় তার কারণ নাকি এই ব্যাকটেরিয়া। তুইও তো জীবনের তপ্ত বুকে বাঁচার সোঁদা গন্ধটা আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসছিস। স্যালুট তোকে----তোদের সকলকে।
- কি যে বলেন স্যার ! এতো আপনারই শেখানো পথ। আপনার মতো শিক্ষকরাই তো আমাদের জীবনের দিক নির্দেশ করে দেন। এই অস্থির সময়টায় আপনাদেরই বেশি করে দরকার সমাজের।

চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো অভীকের। গর্বিত মুখ তুলে তাকাল অণুর দিকে। ঘোষিকার আওয়াজ জানিয়ে দিল অগ্নিবীণা ছাড়তে চলেছে। এগিয়ে চলল আর এক যমুনাবতী। চললো মেয়ে রণে চললো। হঠাৎ বাবার কথাটা মনে পড়ল অভীকের----- বাঁচতে জানলে পৃথিবীটা সত্যিই "গুড আর্থ"!

 

দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top